সর্বাঙ্গে আমার জরার সাক্ষর, তাও আজ কত শত বছর ধরে এইভাবে আমি দাঁড়িয়ে আছি। ভাবলে আশ্চর্য লাগে। কম ঝড়ঝঞ্ঝা বয়ে যায়নি আমার ওপর দিয়ে, কম পরিবর্তনের সাক্ষী নই আমি, পুরনো যুগকে নিশ্চিহ্ন হতে দেখলাম, নবীন যুগের আগমন দেখলাম। যারা আমার সমসাময়িক ছিল তারা আজ কোথায়? দামোদরের বিপুল জলরাশির তলায় কেউ নিমজ্জিত হয়েছে, কেউ বা তার আগেই ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে স্তুপে পরিণত হয়েছে। গর্ভগৃহের বিগ্রহগুলোও রক্ষা পেল না। কোনও কোনওটি অবহেলায় পড়ে থেকে ধ্বংস হল, কোনওটি আবার কোনও বৃক্ষের নীচে ঠাঁই পেল। মানুষ তাদের সিঁদুর চর্চিত করল, পুষ্প নিবেদন করল, ধূপ, দীপ জ্বেলে দিল। কাদের বিগ্রহ সেগুলো? কারাই বা তাদের পুজো অর্চনা করে? সেও এক অদ্ভুত কাহিনি, মহাকালের বিচিত্র লীলাখেলা। সব কিছুরই নীরব সাক্ষী আমি। এখনও কত স্মৃতি ছবির মতো আমার সামনে ভেসে ওঠে। আমি ভুলে যাই যে সে যুগ কবেই হারিয়ে গেছে। এই যেমন মৃন্ময়ী আর অকলঙ্কের কথা। সে কবেকার ঘটনা? দিন, মাস, বছরের জটিল হিসেব বরং থাক। ও হিসেব করতে গেলে আমার কেমন ধাঁধা লাগে। 

এই তৈলকম্পি তখন এক বর্ধিষ্ণু জনপদ ছিল। বর্তমানের ক্ষুদ্র গ্রামটি দেখে তৈলকম্পির সে সুবর্ণযুগের কথা কল্পনা করা দুষ্কর। শুনেছি স্বয়ং ভগবান মহাবীরের পদধূলি ধন্য হয়েছিল তৈলকম্পি। স্থানীয় বহু মানুষ তাঁর শরণে এসে জৈন ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। বহু মন্দির নির্মিত হয়েছিল। তাদের অভ্যন্তরে মহাবীর, ঋষভনাথ প্রমুখ জৈন তীর্থঙ্করদের পাষাণ বিগ্রহ প্রতিষ্ঠিত হল। আমার জন্মও এই সময়ে। ভগবান মহাবীরের বিগ্রহ স্থাপিত হল আমার গর্ভগৃহে। সে এক সময় ছিল বটে! আর আজ জীর্ণ শরীরে একা এই ফাঁকা প্রান্তরে আমি দাঁড়িয়ে। আশাপাশে কিছু কৃষি জমি, স্থানীয় কৃষকদেরই আনাগোনা সেখানে। তৈলকম্পির গৌরবময় অতীতের কথা সকলেই বিস্মৃত হয়েছে। জানার ইচ্ছেও কারুর নেই। 

Telkupi
ভগবান মহাবীরের বিগ্রহ স্থাপিত হল আমার গর্ভগৃহে

সেই সময়ে আমার আশাপাশে আরও অন্তত দশটি দেবালয় ছিল। মন্ত্রোচ্চারণের শব্দে, ঘণ্টাধ্বনিতে চারপাশ মুখরিত হত। পুষ্প, ধূপের সুগন্ধে বাতাস সুরভিত হত। উৎসবের দিনগুলোয় আমার প্রাঙ্গণ জনাকীর্ণ হয়ে উঠতযেমন ভগবান মহাবীরের জন্মতিথিতে। সেদিন আমার অঙ্গও মার্জনা করে পত্রপুষ্পে শোভিত করা হত। সুদৃশ্য রথে যথাবিধি স্থাপন করা হত দেববিগ্রহ। শোভাযাত্রা সহকারে সেই রথ পরিক্রমা করত সারা নগর। তারপর পরিক্রমা শেষে  আবার আমার গর্ভগৃহে প্রত্যাবর্তন করতেন ঈশ্বর। আমার প্রাঙ্গণে সেদিন তিলধারণের স্থান থাকত না। কত মানুষ আসতেন, কত মনস্কামনা নিয়ে! কেউ বা শুধুই অন্তরের ভক্তি, শ্রদ্ধা নিবেদন করতেন। শুধু জৈন ধর্মাবলম্বী নয়, ভগবান মহাবীরের রথযাত্রা দর্শন করতে সারা তৈলকম্পির মানুষই ভিড় করতেন। সব ধর্মের মানুষের মধ্যে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ছিল এখানে। কেউ কারুর ধর্মাচরণে বাধা দিতেন না।

সময় অতিক্রান্ত হতে থাকে। বঙ্গে তখন মহারাজ রামপালের রাজত্ব। তৈলকম্পির শাসনভার অবশ্য ছিল রুদ্রশিখরের হাতে। তৈলকম্পি পাল রাজত্বের অন্তর্গত ছিল ঠিকই, কিন্তু রুদ্রশিখর স্বাধীনভাবেই শাসনকার্য পরিচালনা করতেনপ্রবল পরাক্রান্ত ছিলেন তিনি। তৈলকম্পিতে তখন কোনও অশান্তি ছিল না। এই পরিবেশেই বড়ো হয়ে উঠেছিল অকলঙ্ক আর মৃন্ময়ী। তাদের দু’জনের জন্মস্থানই এই তৈলকম্পি।  অকলঙ্কের পিতা অনন্ত, তিনি বণিক। দেশের নানান স্থানে তিনি পণ্য বিক্রয় করেন। অকলঙ্ক তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্র। পরপর তিনটি কন্যাসন্তান লাভের পর পুত্রের মুখদর্শন করেছেন তিনি। অকলঙ্ক তাই পিতামাতার অতি আদরের। অনন্ত বিত্তশালী ব্যক্তি, দূরদূরান্তে তাঁর বাণিজ্য প্রসারিত। তিনি বৃদ্ধ হলে অকলঙ্ককেই এ দায়িত্বভার গ্রহণ করতে হবে, অনন্ত তাই মাঝে মাঝে তাকে সঙ্গে করে নিয়ে যান। ধর্মপ্রাণ মানুষ অনন্ত, ভগবান মহাবীরের একনিষ্ঠ ভক্ত। তৈলকম্পিতে থাকলে প্রতিদিন প্রভাতে ভগবানের বিগ্রহ দর্শন করতে তাঁর ভুল হয় না। অকলঙ্কও আসে তাঁর সঙ্গে।

Ancient King
তৈলকম্পির শাসনভার অবশ্য ছিল রুদ্রশিখরের হাতে

সেদিন প্রথম অকলঙ্ককে একাকী দেখলাম। জৈষ্ঠের দ্বিপ্রহর, সূর্যের খর তাপে চতুর্দিক দগ্ধ হচ্ছে। প্রাঙ্গণ স্বভাবতই জনহীন। অকলঙ্ক কিন্তু অভ্যন্তরে প্রবেশ করল না। আমারই বহির্গাত্রে ঠেসান দিয়ে পাষাণ কুট্টিমে বসে রইল। যেন কারুর প্রতীক্ষারত। আমার অনুমান দেখলাম নির্ভুল। ক্ষণকাল পরেই এক কন্যার আগমন ঘটল। বস্ত্রে নিজের মস্তক, মুখমণ্ডল যথাসম্ভব আবৃত করে এসেছে সে। অকলঙ্কের নিকটে এসে আবরণ উন্মোচন করল। তাকে দেখে অকলঙ্ক উঠে দাঁড়াল।
– মৃন্ময়ী… অকলঙ্কের মুখে চোখে প্রফুল্লতার আভাস স্পষ্ট হল।
আমি আশ্চর্য হয়েছিলাম। মৃন্ময়ী তো অকলঙ্কের ধর্মের নয়। সে তো শিবদাস ভট্টের মেয়ে। ব্রাহ্মণ শিবদাস গোঁড়া শৈব। নিজের ভদ্রাসনের পাশে ছোট্ট একটি দেবালয়ে নাগেশ্বর শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠিত। প্রতিদিন তিনি স্বয়ং নিষ্ঠাভরে তার অর্চনা করেন। শিবদাস ভট্টের পত্নীবিয়োগ হয়েছে দীর্ঘকাল। নাগেশ্বর আর মাতৃহারা মৃন্ময়ী ছাড়া এ সংসারে তাঁর আর কেউ নেই। কিছু ভূসম্পত্তি আছে, নাগেশ্বরেরও দেবত্তর সম্পত্তি আছে, তাতেই সংসার প্রতিপালিত হয়।

চতুর্দশী মৃন্ময়ীর মুখখানা বড়ো সুন্দর। উজ্জ্বল শ্যামবর্ণে কী যেন মায়া মাখানো। দীর্ঘ কাজল কালো দুটি নয়ন। কিন্তু সে মুখে দেখলাম উদ্বেগের কৃষ্ণ ছায়া। সে বললে,
– এরকম করে গোপনে আর সাক্ষাৎ করা সম্ভব হবে না। পিতার অজ্ঞাতে আসি, বড়ো ভয় করে। গতকাল ওরা আবার এসেছিল গৃহে, পিতার সঙ্গে অনেকক্ষণ কথা বলল। পিতা এখনও আমাকে কিছু বলেননি, কিন্তু মনে হচ্ছে এবার কিছু স্থির করবেন। কী হবে জানি না…
এরা তার মানে পূর্বপরিচিত। আগেও এভাবে গোপনে সাক্ষাৎ করেছে। তৈলকম্পির নির্জন কোনও স্থানে হয়তো। তবে আমার প্রাঙ্গণে এই প্রথম। অকলঙ্ক মৃন্ময়ীর হাতদুটো ধরল, কাতর কন্ঠে বলল,
– না মৃন্ময়ী, এরকম করে বোলো না। ভরসা রাখো, আমি কিছু উপায় করবই।
আরও কিছু কথা, আরও কয়েকবার আশ্বাস জ্ঞাপন, ভবিষ্যতের রঙিন কল্পনা, কিন্তু সে আর কতক্ষণ? চলে গেল মৃন্ময়ী। সেইরকমই বস্ত্রে নিজেকে আবৃত করে। 

Lovers meet
মৃন্ময়ী আর অকলঙ্কের এই স্বল্পক্ষণের সাক্ষাৎ, অতি সুমিষ্ট লাগল আমার

কত মানুষ আসে আমার প্রাঙ্গণে, আসে ভগবৎ দর্শন করতে, কত রকমের মনোবাসনা নিয়ে, কত নবদম্পতি আসে, নতুন জীবনে প্রবেশের মুহূর্তে ভগবানের আশীর্বাদ ভিক্ষা করতে। তাদের চোখেও রঙিন স্বপ্ন দেখেছি আমি, পরস্পরের পরস্পরের প্রতি অনুরাগ দেখেছি। কিন্তু আজ মৃন্ময়ী আর অকলঙ্কের এই স্বল্পক্ষণের সাক্ষাৎ, স্বল্প কথোপকথন অতি সুমিষ্ট লাগল আমার। মৃন্ময়ী প্রস্থান করেছে, কিন্তু অকলঙ্ক নয়। সে আমার দ্বারের সম্মুখে এসে দাঁড়াল, মুদ্রিত নেত্রে করজোড়ে বলল,
– পথ দেখাও হে ভগবান। তোমারই রথযাত্রায় মৃন্ময়ীকে দেখেছিলাম আমি। রাজপথের এক পাশে দাঁড়িয়ে পরম বিস্ময়ে সে রথযাত্রা দর্শন করছিল। দয়া করো প্রভু। এ বিবাহে যেন কোনও বিঘ্ন না আসে।
আমার সমস্ত অন্তরাত্মাও অকলঙ্কের প্রার্থনায় অংশীদার হল। আমিও ওদের মিলন কামনা করলাম। কিন্তু ভাগ্যের কী পরিহাস! তখন কি আর আমি জানতাম যে ওদের মিলনের নয়, আমি সাক্ষী হব ওদের বিচ্ছেদের!

উদগ্রীব হয়ে আমি অপেক্ষা করতাম অকলঙ্ক আর মৃন্ময়ীকে দেখার জন্যে। দিন গুনতাম কবে ওরা আবার আসবে। অবশেষে এল সেই দিন, মৃন্ময়ী আর অকলঙ্ক প্রায় একই সঙ্গে আমার প্রাঙ্গণে প্রবেশ করল ভিন্ন ভিন্ন দিক থেকে। কিন্তু ওদের দেখে আমি আনন্দিত হলাম না, বরং ভীত হয়ে চেঁচিয়ে উঠে বলতে চাইলাম,
– চলে যাও তোমরা এখান থেকে, যত শীঘ্র সম্ভব।

Telkupi 2
ভগবানের কাছে প্রার্থনা করলাম, কিন্তু তিনিও প্রস্তর মূর্তি হয়েই রইলেন

কিন্তু আমার কী আর সে ক্ষমতা আছে? আমি ভগবানের কাছে প্রার্থনা করলাম, কিন্তু তিনিও প্রস্তর মূর্তি হয়েই রইলেন, আমার প্রার্থনা তাঁর কর্ণে প্রবেশ করল না। অকলঙ্ককে দেখে মৃন্ময়ী যেই তার মুখের আবরণ সরাল, অমনি আমার আশেপাশে আত্মগোপন করে থাকা ব্যক্তিরা নিজেদের প্রকাশ করল। কর্কশ কণ্ঠে চিৎকার করে বলতে লাগল,
– দেখুন দেখুন আপনার কন্যার কীর্তি দেখুন! নাগেশ্বরের পুজো ছাড়া তো অন্য কোনও দিকে আপনার দৃষ্টি নেই, আপনার কন্যাটিও সেই সুযোগ গ্রহণ করে যথেচ্ছ স্বেচ্ছাচারিতা করে যাচ্ছে। এই নির্জন দ্বিপ্রহরে বিধর্মীদের মন্দিরে প্রবেশ! কেন? কী উদ্দেশ্যে? বিধর্মী অনন্তর পুত্রটিও উপস্থিতদেখুন একবার। এখনও কি আপনি আপনার কন্যার উদ্দেশ্য বুঝতে অসমর্থ? এই বয়সে যদি জাতিচ্যূত হতে না চান তাহলে নিজের কন্যাকে শাসন করুন, তাকে সংযত করুন…
ভট্ট শিবদাসকে দেখলাম, আমার অনতিদূরেই দাঁড়িয়ে, ক্রোধে, অপমানে আরক্ত নয়নে। অস্ফূট আর্তনাদ করে মৃন্ময়ী পলায়ন করল, অকলঙ্ক তখনও বিমূঢ়ের মতো দাঁড়িয়ে। সেই শেষবার ওদের দু’জনকে পাশাপাশি আমি দেখেছিলাম।

এ ঘটনা তৈলকম্পির শান্ত পরিবেশকে যথেষ্ট আলোড়িত করেছিল। আমার প্রাঙ্গণে উপস্থিত ভক্তদের মধ্যেও এ নিয়ে আলোচনা হত। শুনলাম মৃন্ময়ীর বিবাহ সম্পন্ন হয়েছে। ওই ঘটনার পরের দিনই। তৈলকম্পিরই এক ব্রাহ্মণের সঙ্গে। পুত্রলাভের আশায় তিনি তৃতীয়বার দার পরিগ্রহ করেছেন। তাছাড়া অপুত্রক ব্রাহ্মণ শিবদাসের ভূসম্পত্তির ওপরেও তাঁর অনেক দিনের দৃষ্টি। দেব দেউল থেকেও উপার্জন মন্দ হয় না। মৃন্ময়ীর বিবাহের পর তো তিনি বলতে গেলে নাগেশ্বরের আরাধনাতেই দিনাতিপাত করছেন। তাঁর অবর্তমানে এসব কিছুই তো মৃন্ময়ীর পতির। অকলঙ্কর মুখখানা আমার মনে পড়ত, আমার অন্তরাত্মা হাহাকার করে উঠত। সেও নেই, অনন্তর সঙ্গে বাণিজ্যে গেছে। 

Ancient Indian wedding
মৃন্ময়ীর বিবাহ সম্পন্ন হয়েছে ঘটনার পরের দিনই

আমি অপেক্ষা করে থাকি। মৃন্ময়ী যে আর কোনওদিন আসবে না, সে আমার অজ্ঞাত নয়, কিন্তু অকলঙ্ক? সে নিশ্চয়ই আসবে কখনও। তাকে একবার দেখার জন্যে আমি বড়ো ব্যাকুল হয়ে উঠতাম। না, সেও এল না। বছর অতিক্রান্ত হলঅনন্ত প্রত্যাবর্তন করলেন তৈলকম্পিতে, একাই, অকলঙ্ক নেই তাঁর সঙ্গে। অভ্যাসমতো পরের দিনই এলেন দেবদর্শনে। তাঁর সেই বিধ্বস্ত চেহারা দেখে আমি অনুমান করলাম যে কিছু ঘটেছে। পূজারীর প্রশ্নের উত্তরে অনন্ত বললেন,
– অকলঙ্ক আর কখনও ফিরবে না এখানে।
শুনলাম দূরে কোনও এক স্থানেই সে তার জীবন অতিবাহিত করবে বলে স্থির করেছে।

কত মানুষ আসে আমার প্রাঙ্গণে, আসে ভগবৎ দর্শন করতে, কত রকমের মনোবাসনা নিয়ে, কত নবদম্পতি আসে, নতুন জীবনে প্রবেশের মুহূর্তে ভগবানের আশীর্বাদ ভিক্ষা করতে। তাদের চোখেও রঙিন স্বপ্ন দেখেছি আমি, পরস্পরের পরস্পরের প্রতি অনুরাগ দেখেছি। কিন্তু আজ মৃন্ময়ী আর অকলঙ্কের এই স্বল্পক্ষণের সাক্ষাৎ, স্বল্প কথোপকথন অতি সুমিষ্ট লাগল আমার।

দীর্ঘশ্বাস পড়ল আমার। আর দেখতে পাব না তাকে! সেই কোন বাল্যকাল থেকে সে পিতার সঙ্গে আসত। একটু একটু করে তাকে বড়ো হতে দেখলাম। মৃন্ময়ীর প্রতি তার অনুরাগের কথা যেদিন প্রথম জেনেছিলাম, অদ্ভুত এক শিহরণ অনুভব করেছিলাম। তাদের সেই ক্ষণস্থায়ী আলাপচারিতা আমার মনে গুণগুণ করত। ওদের বিবাহ হোক, ওরা সুখী হোক, এই কামনা করেছিলাম আমি। কিন্তু বিধাতার ইচ্ছে অন্যরকম ছিল। ওদের বিচ্ছেদ দেখলাম, দেখলাম মৃন্ময়ীর অন্তিম যাত্রাও। না, সে তার পতিকে নিরাশ করেনি। তিনি পুত্রমুখ দর্শন করেছেন, কিন্তু তাকে জন্ম দিতে গিয়েই মৃন্ময়ী প্রাণত্যাগ করেছে।

তারপর থেকে অকলঙ্ক আর মৃন্ময়ীর স্মৃতি বুকে নিয়ে আমি দাঁড়িয়ে আছি। তৈলকম্পির সবাই তাদের কথা বিস্মৃত হয়েছে, এ তাদের কাছে নেহাতই তুচ্ছ, কিন্তু আমি পারিনি, পারবও না। তারপর? তারপর আরো কত কত বছর যে অতিক্রান্ত হয়ে গেল! আমারই মতো কত দেবদেউল নিশ্চিহ্ন হল, গর্ভগৃহের শান্ত, ভাবগম্ভীর পরিবেশ থেকে কত বিগ্রহের ঠাঁই হল উন্মুক্ত আকাশের নীচে বা কোনও বৃক্ষের তলায়। কিন্তু আমি রয়ে গেলাম, সর্ব শরীরে জরার চিহ্ন ধারণ করেও রয়ে গেলাম। তারপর একদিন দেখলাম আমার অভ্যন্তরের ভগবান মহাবীরের বিগ্রহ পরিচিত হলেন ভৈরবনাথ রূপে। মানুষ তাঁকে ভগবান শিবের রূপজ্ঞানে অর্চনা করতে শুরু করল, মহাবীর বিস্মৃত হলেন। আজও কত মানুষ আসে এখানে, ভৈরবনাথের প্রতি তাদের ভক্তি, শ্রদ্ধা অটুট। সবাই জানে, বিশ্বাস করে এ ভৈরবনাথের দেউল, এখানে তাঁর অধিষ্ঠান, সেই কোন আদিকাল থেকেই নাকি!
আমি হাসি। বলেছিলাম না, মহাকালের কী বিচিত্র লীলাখেলা!

 

*ছবি সৌজন্য: Worldorgs, Youtube, Wikiwand, Indiaart

অদিতি ভট্টাচার্যের পড়াশোনা সংখ্যাতত্ত্ব নিয়ে। কর্মসূত্রে বিদেশেও থেকেছেন। বই পড়া, লেখালিখি, এমব্রয়ডারি, বেড়ানো, ছবি তোলা– পছন্দের তালিকায় রয়েছে এসবই। ছোটবড়ো সবার জন্যেই লিখে চলেছেন নিয়মিত। গল্প প্রকাশিত হয়েছে দেশ, আনন্দমেলা, সানন্দা, উনিশ কুড়ি, সাপ্তাহিক বর্তমান, কিশোর ভারতী, চির সবুজ লেখা ইত্যাদি নানা পত্রিকায় এবং ওয়েবজিনেও। এযাবৎ প্রকাশিত গল্পসংকলন তিনটি। ‘চাঁদ উঠেছিল আকাশে’ নামে উপন্যাস লিখেছেন। প্রকাশিত হয়েছে ‘সর্দার’ নামে একটি অনুবাদগ্রন্থও।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *