মনে আছে নন্দিন, গতবছরের, এই দিনের কথা? জ্বর ছিল শরীরে। ঘাম হচ্ছিল, যেন গোবিন্দকুঞ্জ থেকে ডাকছিল মধু। তিরিতিরি কাঁপছিল রবির গান হৃদে-

“…জ্যোৎস্নাধারায় যায় ভেসে যায় দোলের পূর্ণিমাতে…
       এই আভাসগুলি পড়বে মালায় গাঁথা
কালকে দিনের তরে         তোমার অলস দ্বিপ্রহরে…”

কুসুমিত চতুর্দিক। প্লাবিত চতুর্দিক। উৎসারিত চতুর্দিক। নেশা লেগেছে ঐ… দূর-রঙের বাড়িটিতেও। দাঁড়িয়ে আছে মধ্যাহ্ন। একা। ত্রস্ত। ঠাকুমাটির হাত থেকে, উড়ে উড়ে যাচ্ছে মঠ মুড়কির সুবাস। তুমি দেখছ… মনে আছে তোমার- তুমি দেখেছিলে? পায়ের কড়ায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে, যে মা ক্রমে চিলের মতন চেরাবুক নিয়ে, ভেসে যেত রুগ্নতার দেশে; তুমি নন্দিন, শুয়েছিলে সেদিন, সেই মায়ের মাদুরের উপর। শুয়েছিলে… অপেক্ষা করা তোমার রক্তে লেগেছিল। তুমি জানতে, ঐ আভাসগুলি পড়বে না তার মালা-গাঁথায়! তুমি জানতে, জরায়ুর বেদনার মতো দ্বিপ্রহর, শুধু নিচু করবে তোমায়! হেয় করবে প্রত্যেক দুপুরবেলায়!

তবু তুমি অপেক্ষা করো…

সে এসেছিল নন্দিন। সে এসেছিল সেদিন। দাঁত যার তীক্ষ্ম। যার ঠোঁট ফুলে ফুলে ওঠে, নিদ্রাহীন মাকড়সার মতো! যে তোমায় কেটেছিল। কুচি কুচি করেছিল। আতরের গন্ধের হাহাকার হাহাকার নিয়ে, তুমি, উন্মাদ-স্তনী, আকাঙ্ক্ষার প্রভূত অগ্নিতে, লেলিহান জ্বলেছিলে ঈশ্বরের মৃত্যুর মতন!

— তোমার স্তন সে কামড়ে ধরেছিল! সে তোমায় উলঙ্গ করেছিল নন্দিন! তোমার ফালাফালা ঠোঁট জেনেছিল, সহজপাঠ মিথ্যে! কিশলয় মিথ্যে! সরস্বতী-বন্দনার মতো কবিতা লেখা- মিথ্যে! মিথ্যে! মিথ্যে! ‘অ’-এর অজগর, তোমার নাভি কুরে কুরে দেখেছিল! কস্তুরী-হীন করেছিল তোমার নীলাভ রাত্রিসম যোনি। তার আঙুলের প্রতিটা নখ তুলে এনেছিল- তোমার লালা, মাংস আর রক্তের, সহস্র অযুত বারিধার! কাঁটা-বসানো চোখের মতো লিঙ্গ তার! ঢুকিয়ে, পেঁচিয়ে তুলেছিল, তোমার সমস্ত নরম চামড়ার ধার!

— তুলতুল করতে থাকা, ধুকপুকে বিদ্যালয়-নারী
তোমার সকল সম্ভ্রম, হিঁচড়েছিল তোমার স্বামীটি—
সেদিন… সে-ই বসন্তের সুতীব্র-দ্বিপ্রহর!

লোলচর্মসার তুমি। মাংসের অবহেলা তুলে নিয়ে, কাঁচিয়ে নিয়ে তাচ্ছিল্য, চলে গেলে রক্ত ধুতে। বঁটিতে কাটা-পড়ার পর, ধুয়ে তো রাখতেই হয়! স্তনের মাংস ছিঁড়ে ঝুলছিল। যোনির দগদগে ক্ষত, ঠোঁটের কালশিটে- ধুলে… একটু একটু করে ধুচ্ছ রমণী…

তোমার রমণীয় জীবন…

সংসার…

তোমার সন্তানহীনতার পাপ- ধুচ্ছ রমণী…

ধুয়ে ফেলো; ধুয়ে ফেলো তুমি; পাপ বুঝি রাখতে হয় গোপনে, গরীয়সী… দেবী?

উড়ছে আরাধ্যা, উড়ছে আরাধ্য পলাশেরা
ফুটছে সুচঞ্চল, ব্যথার্ত স্মৃতির তিরগুলি

আকাশে আবির আজ, যোনিতেও আবির লেগেছে

ফেটে যাওয়া, চিরে যাওয়া, ভেঙে যাওয়া সতীচ্ছদ ওড়ে…

ও মোর শিমুলফুল
ও মোর অশোক, কনকেরা

দেখেছ দেখেছ তুমি
মেয়েদের গুঁড়ো ক’রে দেওয়া?

আজকে দিনের তরে
রক্তেও ভেসে যায় দোল

‘রঞ্জন’ নও তুমি, নন্দিন… তুমি শুধু শরীর!!!

 

*ছবি সৌজন্য: Artzolo.com

ঝিলমের জন্ম ১৯৮৪ -তে। দর্শনের ছাত্রী ছিলেন। লেখায় প্রবেশ সাতাশ বছর বয়সে। অনুভূতির গভীরে তাঁর লেখার শিকড়। ২০১৫ সালে প্রথম কাব্যগ্রন্থ "নিরুদ্দেশ সম্পর্কিত ঘোষণা"। ২০২০-তে দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ "বৃষ্টি পড়া বাড়ি", প্রতিভাস থেকে। ২০২১-এ প্রকাশিত হয় তৃতীয় কবিতার বই "আখরোট" এবং ওই একই বছর, কাশ্মীর থেকে তাঁর বাংলা কবিতার ইংরাজি অনূদিত কাব্যসংকলন- "Memoir Of a Girl" প্রকাশিত হয় মৌলীনাথ গোস্বামীর অনুবাদে। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় নিয়মিত লিখে চলেছেন। "দেশ" অনলাইন পত্রিকায় "নির্বাচিত কবি"-র সম্মান পেয়েছেন। লিখতেই হয় তাঁকে ঈশ্বরের অদৃশ্য নির্দেশের মতো।

One Response

  1. ঘোরের নিরুচ্চার মধ্যযামিনী
    প্রতিবাদী অবগাহন প্রতিটি ছত্রে
    বিরাশি সিক্কার চড় অপরিমেয় ঘৃণা অভ্যস্ত সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *