উনিশ শতকের কলকাতা। তখনও ছবি বা ফটোগ্রাফ তোলাতে হলে বাঙালির ভরসা সেই ইংরেজের স্টুডিও। তার পেছনে লালমুখো সাহেব। তার সামনে সাধারণ ঘরের মধ্যবিত্ত মহিলারা লজ্জায় ঘোমটাই খুলতে পারতেন না, তো ছবি তুলবেন কী? ধনী বাড়ির মেয়েরা অবশ্য কখনও কখনও আসতেন ক্যামেরায় ছবি তোলাতে। তখন তাহলে সাহেব কোথায় থাকবেন? ঢাকা পালকি থেকে নামতেন মহিলারা। দাসীরা সঙ্গে করে স্টুডিওর ভিতরে নিয়ে যেত। চেয়ারে বসলেই আগে থেকে ঠিক করা লেন্সে ছবি উঠে যেত। পরক্ষণেই বেরিয়ে পালকিতে উঠে চলে যেতেন তাঁরা।
এ সময়ে জনৈকা মেমসাহেব স্থির করলেন, মেয়েরাই মেয়েদের ছবি তুলে দিক না কেন? তাঁর নাম মিসেস মেয়ার। ৭ নম্বর ওল্ড কোর্ট স্ট্রিটে খুললেন নিজের স্টুডিও। নাম দিলেন ‘জেনানা স্টুডিও’। পুরুষ সংসর্গের ব্যাপার নেই। মেয়েরা আসবেন দাসী পরিবৃত হয়ে, মেমসাহেব ছবি তুলে দেবেন, অতঃপর প্রস্থান। মিসেস মেয়ারের জেনানা স্টুডিওর নাম ছড়িয়ে পড়লেও মেয়েদের মধ্যে খুব বেশি জনপ্রিয়তা পেল না। ১৮৬৪ সালে জার্নাল অব বেঙ্গল ফটোগ্রাফিক সোসাইটির ডিসেম্বর সংখ্যায় মিসেস মায়ারের স্টুডিওর উল্লেখ পাওয়া যায়। সে বছর সোসাইটির বার্ষিক প্রদর্শনীতেও তাঁর একটি ছবি স্থান পেয়েছিল। স্টুডিও চালুর পরের বছর অর্থাৎ ১৮৬৪ সালে জেনানা স্টুডিও ওয়াটারলু স্ট্রিটে সরে যায়।
এই সময়ে কলকাতা তথা বাংলায় বেশকিছু নারীর খোঁজ মেলে যাঁরা পেশাদার এবং অপেশাদারভাবে ফোটোগ্রাফি চর্চা করতেন। তার মধ্যে অন্যতম ছিলেন অন্নপূর্ণা গোস্বামী। তিনি সাহিত্যচর্চাও করতেন। নিয়মিত গল্প উপন্যাস লিখতেন। তার সঙ্গেই চলত ফটোগ্রাফির চর্চা। পঞ্চাশের দশকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের লীলা পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছিলেন অন্নপূর্ণা। তাঁর জন্ম কলকাতায় ১৯১৬ সালের ৮ মার্চ। অর্থাৎ কিনা আজকের দিনে। তখন কোথায়ই বা আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী নারী দিবসের আন্দোলন কোথায়ই বা নারীর সমানাধিকারের গল্প। অন্নপূর্ণার বাবা নীতিশচন্দ্র লাহিড়ী ছিলেন ফিল্ম ব্যবসায়ী। বিখ্যাত মার্কিন চলচ্চিত্র স্টুডিও কলম্বিয়া পিকচার্সের সঙ্গে যুক্ত। ফলে ছোট থেকেই বাড়িতে ক্যামেরা আর ফিল্মের সঙ্গে কিছুটা পরিচিতি ছিলই অন্নপূর্ণার। কলেজের পড়া শেষ করেই বিয়ের পালা। রেলের ডাক্তার অবনীমোহন গোস্বামীকে বিয়ে করে অন্নপূর্ণা লাহিড়ী হলেন অন্নপূর্ণা গোস্বামী। আর ‘অনামিকা’ ছদ্মনামে শুরু হল লেখালিখি।
বরাবর সচ্ছলতার মধ্যে মানুষ হয়েও প্রান্তিক জীবনের কথা লিখতে চেয়েছিলেন অন্নপূর্ণা। প্রগতিশীল সমাজেও সাধারণ মানুষের পিছনে পড়ে থাকার দুর্দশা বারবার উঠে এসেছে তাঁর সাহিত্যে। ১৯৪৫ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম ছোটগল্প ‘ভ্রষ্টা’, পরের বছর ‘বাঁধনহারা’। পঞ্চাশের দশক থেকে পরপর প্রকাশিত হতে থাকে ‘মৃগতৃষ্ণিকা’, ‘রেললাইনের ধারে’, ‘এবার অবগুণ্ঠন খোল’, ‘তপস্বিনী’, ‘একফালি বারান্দা’ প্রভৃতি লেখাপত্র। আর সঙ্গে সঙ্গে চলতে থাকে শখের ফোটোগ্রাফি। না, পেশাদার ফোটোগ্রাফার ছিলেন না অন্নপূর্ণা। কিন্তু তাঁর ছবিতে উঠে আসত শহরের নিভৃত একান্ত সত্য প্রতিচ্ছবি। কেমন ছিল সেই ছবি?
সিদ্ধার্থ ঘোষ তাঁর ‘ছবি তোলা– বাঙালির ফোটোগ্রাফি চর্চা’ বইতে লিখেছেন অন্নপূর্ণা গোস্বামীর কাজের কথা। অধিকাংশ ফোটোগ্রাফারই যেখানে রাজকীয় প্রাচুর্য বা প্রকৃতিপ্রেম নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন, অন্নপূর্ণা তাঁর ক্যামেরায় ধরে রাখতেন সমাজের দারিদ্র্যপীড়িত নিচুতলার মানুষের জীবনালেখ্য। রেললাইনের পাশে ঘর বেঁধে থাকা বাস্তুহারা মানুষেরাও ছিলেন তাঁর ছবির বিষয়বস্তু, সেকালের নিরিখে যা অভাবনীয়। উদ্বাস্তু শিশু, পরিবার, দুর্ভিক্ষের সময় স্তূপ হয়ে থাকা চালের বস্তার পর্যন্ত ছবি তুলেছেন অন্নপূর্ণা। এক কথায় বাঙালি নারী ফটোগ্রাফারদের কাজে তিনি নতুন যুগের সূচনা করেন তিনি। একুশ শতকে নারীর অধিকার রক্ষার লড়াইয়ের দিনটিতে বাঙালিনীদের সার্থক অনুপ্রেরণা হয়ে ওঠার ক্ষমতা রাখেন অন্নপূর্ণা গোস্বামী। তাঁকে সংগ্রামী কুর্নিশ।
মৌলিক‚ ভিন্নধর্মী ও সময়োপযোগী - এমনই নানা স্বাদের নিবন্ধ পরিবেশনের চেষ্টায় আমরা। প্রতিবেদন বিষয়ে আপনাদের মতামত জানান 'কমেন্ট' বক্সে | নিয়মিত আপডেট পেতে ফলো করুন - https://www.facebook.com/banglaliveofficial
অপরিচিত অথবা অল্প পরিচিত তথ্য বেশ ভালো ভাবে পরিবেশিত হয়েছে।