সময়টা সম্ভবত ২০০৯ সাল, তখন আমি ইউনিভার্সিটির ছাত্র, সংগীত নিয়ে মাস্টার্স করছি। সকালে তৈরি হচ্ছি, ক্লাসের জন্য বেরোব। হঠাৎ একটা ফোন, ল্যান্ডলাইনে— 

– কোথায় তুই? আজ বিকেলে ঠিক পাঁচটায় আমার বাড়ি আসবি। আসর আছে।ডোভারলেন।

ফোনের ওপারে রেশম সুতোর মতো মিহি অথচ মন্ত্রের মতো গভীর আওয়াজ— আমার গুরুজি— সঙ্গীতাচার্য অমিয়রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের। আমতা আমতা করে শুধোলাম: 

– আপনি তো অন্য ছাত্রকে নিয়ে আসরে বসবেন বলেছিলেন। আমি তো ইউনিভার্সিটিতে।
কণ্ঠস্বরের মন্দ্রত্ব বাড়ল ফোনের ওপারে—

– পাঁচটায় গাড়ি ছাড়বে।

ব্যস, রিসিভার রাখার জোরালো আওয়াজে সম্বিত ফিরল। এদিকে আজ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কলারশিপের পরীক্ষা। পুরিয়া গাইব ঠিক করেছি। কিছুক্ষণের জন্য কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়লাম। কী হবে! কী করে সবটা সামলাব? এদিকে তানপুরা নিয়ে বসে তো গলা লাগাতে হবে গুরুজির সঙ্গেকী গাইবেন? যাঃ… জিজ্ঞাসা করা হল না। এদিকে সময়ও সাপাট তানের মতো দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলেছে। তাড়াতাড়ি বেরলাম— বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে জানলাম, আমার দু’নম্বরে নাম আছে। যাক্ বাবা। হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। নিশ্চিন্ত মনে গান্ধার, নিখাদ-এ তানপুরা মেলালাম, জানলাম পনেরো মিনিট সময়। তার মধ্যেই নিজের তালিম, রাগদারী, তৈয়ারি দেখাতে হবে। ওই গোস্পদে আকাশ প্রতিবিম্বনের মতো। পুরিয়ার মতো সুগভীর ও ব্যপ্ত রাগের আওচারেই পনেরো মিনিট কেটে যায়। সেখানে সম্পূর্ণ রাগ! 

মনে পড়ল গুরুবাক্য—
– ওরে বড় বড় ওস্তাদ বা পুরনো স্পুল রেকর্ডে আড়াই মিনিটে খেয়াল গেয়েছেন। 

সত্যিই, পনেরো মিনিট তার কাছে অনেক বেশি সময়। মনে মনে পনেরো মিনিটে রাগবিন্যাসের একটা খসড়া তৈরি হল। ইতিমধ্যে ডাক এল, বিভাগের তাবড় তাবড় গুণীরা বসে সাদা ফরাসের আসনে, সামেন কার্পেট পাতা। তানপুরা নিয়ে বসলাম, ইজাজত্ নিয়ে সুর লাগালাম, কড়ি মধ্যম শুদ্ধ ধৈবতের রাস্তা দিয়ে ষড়জ ছুঁয়ে মন্দ্র মাধ্যমে। আস্তে আস্তে আলাপ শুরু করলাম। গান যত এগোতে থাকল, সময়ের জ্ঞান তত ভুলতে শুরু করলাম। শেখা তালিম, ওস্তাদদের রেকর্ড, আর নিজের অনুশীলনের সবটা দিয়ে গান শেষ করলাম, দেখলাম চল্লিশ মিনিট গেয়েছি। বিচারকমণ্ডলীর অপার ঔদার্য— আমার গান থামাননি। তারপর বেরিয়ে ভাবলাম স্কলারশিপ তো দূরস্থ, হয়ত ডিসকোয়ালিফাই হব। মনখারাপ নিয়ে বেরলাম ইউনিভার্সিটি থেকে। গন্তব্য সল্টলেক— গুরুগৃহ।

কলিংবেল টিপলাম না, কারণ দরজার ওপারে তানপুরা মেলানোর আওয়াজ। দেখলাম দরজা ভেজানো। ভিতরে প্রবেশ করে দেখি, সাদা ধুতি-পাঞ্জাবিতে আমার ইষ্টকে। বড় পবিত্র, দেখলে মনে হয় ভৈরবের কোমল ধৈবত। প্রণাম সেরে শুধোলাম, 

– আজ কী গাইবেন গুরুজি?

মুচকি হেসে বললেন, 

– স্টেজে উঠে যা মনে হবে।

ব্যস হয়ে গেল। চল্লিশ মিনিট মতো সময় ছিল, একটু রগড়ে নিতে পারতুম, তা আর হল না। যেতে যেতে গাড়িতে গুরু বলছেন, 

– জানিস, বাবা আমার গুরু (আচার্য্য সত্যকিঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়) যখন আসরে যেতেন, আমি সবসময় লক্ষ্য করতাম বাবা কীভাবে গাইছেন। ঘরের রেওয়াজ আর আসরের গানে কত ফারাক। আসরে না গাইলে শাস্ত্রীয় সংগীত শিল্পী হওয়া যায় না। কারণ, সেখানে তুমি একটা লিংক যার মাধ্যমে ঈশ্বর ও দর্শকশ্রোতার সমন্বয় সাধিত হবে। তাই নিজেকে এক্সপ্লোর করতে হবে।

গ্রিনরুমে এলাম। যন্ত্র মেলানো হল। তানপুরার পঞ্চম ষড়জের আলিম্পন, গুরু মুখ থেকে একটা সুরও বার করছেন না। বোঝার উপায় নেই কী রাগ গাইবেন আজ! সময় এল আমার। স্টেজে উঠলাম, ঝাপসা আলোয় দেখলাম সামনের সারিতে বসা ভারত ও বিশ্ববন্দিত বরেণ্য গুণী মানুষদের, যাঁরা গুরুজির গান শুনতে এসেছেন। প্রথমে গুরুকে সম্মান জানানো হল, ফুল, কাশ্মীরি শাল ও মানপত্রের নৈবেদ্য নিয়ে। এরপর গান। অভিবাদন সেরে গুরুজি প্রথমেই বললেন:

– দর্শকাসনের সব আলো জ্বালিয়ে দেওয়া হোক। আসরে আপনাদের না দেখলে আমি গাইব কী করে?

জ্বলে উঠল সব আলো। এরপর মুচকি হেসে বললেন:

– তানপুরা দে।

এক মোচড়ে পঞ্চম নেমে এল গান্ধারে, আর পরের তারটি নিখাদে। রাগ পুরিয়া— মনে হল এটাই হয়তো সংযোগ, এটাই আধাত্ম্যিকতা, এটাই সাধনার ফল, সম্পর্ক লালনের ছায়াবৃক্ষ। সেই চেনা বন্দিশ, বিস্তারের চেনা রাস্তাগুলো যেন সান্ধ্য লালিমার আসরে রং মেখে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র— এ আমার গুরুর নিবেদনের অর্ঘ্য। সারা হল বুঁদ হয়ে শুনছে এই অমৃতবর্ষণ, বিলম্পদ সেরে যখন দ্রুত খেয়ালের তার ষড়জে এসে দাঁড়ালেন পুনরায়, ইশারা করলেন আমাকে আবারও গাইতে। গাইলাম, মনে হচ্ছে সাক্ষাৎ ঈশ্বরদর্শন হচ্ছে, গুরুর গলা ওই তার ষড়জকে কেন্দ্র করে বিচিত্র তানকারিতে এসে প্রবেশ করছে। 

গান শেষ হল, অজস্র করতালি আর কদরদানের সুখ্যাতিতে ভরে উঠল প্রেক্ষাগৃহ। পর্দা পড়তেই আমার কানে কানে বললেন, 

– ভালই গাইলি

যাব্বাবা! আমি গাইলাম কোথায়? গুরু বললেন:

– তুই স্কলারশিপটা পেয়েছিস!

আমার চোখে জল, কণ্ঠরুদ্ধ। শুধু প্রণাম করে মুখের দিকে চাইতেই বললেন,

– সুরে থাক। 

আমাদের ভারতীয় সংগীতের তথা রাগসংগীতের ভাব ও তাত্ত্বিক দিকটি এমনই যে সেখানে অধ্যাত্মচেতনা আলাদা করে দেখানো বা বোঝানো সম্ভব নয়। এ এক বিমূর্ত অনুভূতি যা শিল্পী ও শ্রোতার মধ্যে অবিরাম সঞ্চারিত হয়। ভারতীয় সংগীতের এই বিমূর্ততা কখনও ভক্তিমার্গে, কখনও শ্রদ্ধামার্গে, কখনও ভাগবতমার্গে অনুভূত হয়। রাগ-রাগিনী ও তার স্বরগত, শ্রুতিগত কাঠামো, শ্রুতিজাতির ভারসাম্য ও রসের ব্যাকরণসম্মত বিকাশ ও সর্বোপরী নন্দনতত্ত্ব— এ সব কিছু নিয়ে রাগ, রাগ হয়ে ওঠে, যা স্বততই রঞ্জক গুণসমৃদ্ধ। উদাহরণস্বরূপ বলতে পারি, পণ্ডিত নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায়ের কৌশিকানাড়ায় যে পঞ্চমের প্রতিস্থাপন হয়েছে, তা দৈবিক বা কুদরতি, উস্তাদ আমির খানের মারবার ধৈবত থেকে কোমল রেখাবের সম্পর্ক, বা উস্তাদ আব্দুল করীম খাঁ-এর বিলাবলের ধৈবত গান্ধার সংগতি। যেভাবে দেহশুদ্ধি, চিত্তশুদ্ধি বা আসনশুদ্ধি করে পূজায় বসতে হয়, বা যেভাবে ওজু করে পবিত্র চিত্তে নমাজ আদা করতে হয়, সেইভাবে রাগ-রাগিনীর চর্চা ও শ্রবণ করা আমাদের শাস্ত্রীয় সংগীতের মূল আধার। এখানে রাধা-কৃষ্ণের মানবীয় প্রেম আধ্যাত্ম্য বা ভাগবত প্রেমে রূপান্তরিত হয় ঠুমরির আবেদনে, কাওয়ালি, সুফি বা ভজন ইত্যাদি উপশাস্ত্রীয় সংগীতধারাতে এই একই আধ্যাত্মচেতনা প্রতিফলিত হয়, ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিকে, কাজেই সংগীতের আধ্যাত্মচেতনাকে উপলব্ধি করতে হলে, নিজের মন, রুচি ও আত্মার শুদ্ধি একান্ত কাম্য। 

তবে সব নিয়মের ব্যতিক্রম থাকে। এ ক্ষেত্রেও আছে। সংগীত সম্পর্কিত তাত্ত্বিক, ক্রিয়াত্মক বা ঔপপাত্তিক দিকটির বাইরে আরও একটি দিক আছে। যা হল সংগীতের আবেদন। যা দেশ, কাল, ভাষা, জাতি নির্বিশেষে সার্বভৌম্য। এই আবেদন নির্ভর করে শিল্পীর কণ্ঠস্বর, প্রকাশভঙ্গি, যন্ত্র ও বাদ্য সংগীতের ক্ষেত্রে টোন্ বা আওয়াজ-এর ওপর। বিষয়টি অত্যন্ত সূক্ষ্ম, কিন্তু সহজেই হৃদয়ে প্রবেশ করে ও আধ্যাত্ম্যমার্গের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করে। শুনেছি উস্তাদ বড়ে গুলাম আলির কণ্ঠস্বর-এ রাস্তার সাধারণ মানুষও মুগ্ধ হতেন, আখতারী বাঈ-এর আওয়াজের দিওয়ানা তো সারা হিন্দুস্থান। 

begun akhtar akhtari bai
আখতারী বাঈ-এর আওয়াজের দিওয়ানা সারা হিন্দুস্থান

উত্তর ভারতের উচ্চাঙ্গ সংগীতের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল সংগীত ঘরানা। ঘরানার অর্থ Stylisation of singingএকই রাগ ভিন্ন ঘরানায় ভিন্ন ভাবে প্রতিস্থাপিত হয়, অবশ্যই ব্যাকরণগত দিকটি অব্যাহত রেখে। কণ্ঠসংগীতের বিভিন্ন ঘরানাগুলির মধ্যে কিরানা, গোয়ালিয়র, পাতিয়ালা, আত্রোলী, আগ্রা ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। টেকনিকালি স্বর লাগানো, আওয়াজ ফেলা, কণ্ঠ সংগীতের ক্ষেত্রে রাগে ব্যবহৃত স্বরালঙ্কার ও হৃদয়গ্রাহ্যতা তথা নন্দনতাত্ত্বিক আধারে ঘরানাগুলির গায়কির ভিন্নতা দেখা যায়। তবে এসবকে ছাপিয়ে সংগীতের divinity বা আধ্যাত্মবাদ তখনই প্রতিস্থাপিত হয় যখন শিল্পী তাঁর তালিম, রেওয়াজকে অতিক্রম করেন ও মৌলিক দর্শন সংগীতে প্রতিস্থাপিত করেন। অর্থাৎ সংগীত যখন কৌশলকে, ব্যাকরণকে অতিক্রম করে কেবলমাত্র সংগীত হয়ে ওঠে, তখন সেই দর্শন ঈশ্বরচেতনার প্রতিফলন ঘটায়, আমরা সাঙ্গীতিক পরিভাষায় যাকে বলি, রুহদারি বা রুহানিয়ত। এই উপলব্ধি কেবলমাত্র আনন্দের সঞ্চার করে, যা দৈবিক বা সচ্চিদানন্দ। এই আনন্দ মানবমনের অতি সূক্ষ্মস্তরের এক আনন্দ, এক চিরশান্তি, যার কোন শেষ নেই। নিরবচ্ছিন্ন প্রবাহমান ধারার মতো শাস্ত্রীয় সংগীতের এই আধ্যাত্ম্যবাদ এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে সঞ্চারিত হয়।

আমাদের ভারতীয় সংগীত এক ঐতিহ্যবাহী পরম্পরাপ্রবাহী গুরুমুখী শিক্ষাধারা। আমাদের সংগীত প্রকৃতির সঙ্গে নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত। বৈদিক যুগের সামগান আর বর্তমানের ক্লাসিক্যাল শৈলীর মাঝের ইতিহাসটি কিন্তু ভীষণভাবে প্রকৃতির সঙ্গে সম্পর্কিত। তাই রাগসংগীতের ঋতু বা সময়কাল (দিবা/রাত্রি) নির্ধারিত। এই রাগসংগীত কিন্তু মস্তিষ্কপ্রসূত কোনও বিষয় নয়। প্রকৃতি থেকে আরোহিত বাহ্যিক উপাদানগুলি যখন অন্তরের উপাদানগুলিকে (তালিম শিক্ষা, রুচি, মৌলিকতা, নন্দনবোধ) উদ্দীপ্ত করে তখনই জন্ম নেয় রাগসংগীত যাকে আধ্যাত্মবাদ থেকে আলাদা করা যায় না। এ যেন রংমেশানো জল-এর মতো। মৌলিক উপাদান ও ব্যক্তিগত আধ্যাত্ম্যদর্শন, তার উপলব্ধি ও প্রকাশ-এর সার্থক শিল্পীকে কালজয়ী করে। এটাই আমাদের সত্ত্বা, এটাই আমাদের ভারতবর্ষ।   

ছবি সৌজন্য: Facebook

বিষ্ণুপুর ঘরানার শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের কণ্ঠশিল্পী। রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সঙ্গীতে স্নাতোকত্তর। বর্তমানে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। সম্বুদ্ধ বেতার, দূরদর্শন ছাড়াও দেশে ও বিদেশে অসংখ্য সঙ্গীত সম্মেলন ও অনুষ্ঠানে নিয়মিত সঙ্গীত পরিবেশন করেন। পেয়েছেন একাধিক পুরস্কার ও সম্মান।

2 Responses

  1. ‘গুরু’ যে তমালনীপকুঞ্জ আবার নীল দিগন্ত তা এই অপূর্ব লেখনীতে প্রজ্জল। প্রজ্ঞায় ও ভাষাবিন্যাসের মাধুরীতে লেখনীটি আপন মহিমায় মহিমান্বিত। আপনাকে বিশ্লেষণ করার যোগ্যতা ধৃষ্টতা নেই আমার। হে গুণী আপনি ভালো থাকুন, চরণতলে আশ্রয়টুকু চাই। বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি🙏 🌼

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *