তাঁকে কী বিশেষণ দিয়ে সম্মানিত করা যায় আমার সঠিক জানা নেই। তবে এক কথায় বলা যায় ‘শাহেনশা-এ- গজ়ল’ তালাত মাহমুদ।  আবার অন্যদিকে তিনিই এক সময় ছিলেন বাংলার জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী ‘তপনকুমার’। ভারতীয় চলচ্চিত্র এবং সংগীত জগতের অন্যতম কিংবদন্তী তালাত মাহমুদের জন্ম হয় লখনউতে ১৯২৪ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি। রক্ষণশীল মুসলিম পরিবারের সন্তান শুধু গান-বাজনা আর সিনেমায় অভিনয় করে জীবন কাটাবে, এটা খুব সহজে মেনে নিতে পারেননি বাবা মানসুর মহম্মদ। তবুও পরিবারের সব বাধা পেরিয়ে তালাত মাহমুদ গানের জগতে কাজ করতে শুরু করেন। বছরখানেক পরে কিঞ্চিৎ নামও করেন। নাটকীয় তাঁর জীবন। 

কিন্তু নাটক-নভেলকেও হার মানিয়ে সঙ্গীতকে পেশা হিসেবে নির্বাচন করেন। চলচ্চিত্রে জীবনের প্রথম পর্বের কাজ শুরু করেন কিন্তু কলকাতায়। তারও আগে আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের থেকে পাশ করে তিনি লখনউয়ের বিখ্যাত মরিস কলেজে পণ্ডিত এস সি আর ভাটের কাছে শাস্ত্রীয়সংগীতের তালিম নিয়েছিলেন।

লখনউ ও লাহোর বেতারকেন্দ্র থেকেও তাঁর অনুষ্ঠান পরিবেশিত হত নিয়মিত। তৎকালীন গ্রামাফোন কোম্পানি হিজ মাস্টার্স ভয়েস তালাতের ভেলভেট ভয়েসকে আবিষ্কার করতে দেরি করেনি। তাঁর গানের প্রথম গ্রামাফোন রেকর্ড ‘সব দিন এক সমান নহি থা’ প্রকাশিত হয় ১৯৪১ সালে। সেই গান শুনে পঙ্কজ মল্লিক যুবক তালাতের পিঠ চাপড়ে দিয়ে ছবিতে গান গাইবার প্রস্তাব দেন। 

তালাত মাহমুদের সংগীতের দক্ষতা, বিশেষত গজ়লে তাঁর পারদর্শিতা শুধুমাত্র লখনউ শহরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। সেই খবর এসে পৌঁছয় কলকাতায়। তখন কলকাতাতে একাধিক গজ়ল সম্রাটদের গানে শ্রোতারা মুগ্ধ। তাঁদের মধ্যে ছিলেন ওস্তাদ বরকত আলি খান, কুন্দনলাল সায়গল, এম এ রাউফ-সহ বিশিষ্টজনেরা। তাঁদের মধ্যেও এসে খুব সহজেই নিজের জায়গা করে নিলেন তালাত। পঙ্কজ মল্লিকের হাত ধরে নিউ থিয়েটার্স স্টুডিওতে ঢুকলেন। প্রমথেশ বড়ুয়ারও তালাতকে খুব পছন্দ হল। একটি বাংলা ছবিতে কাননদেবীর বিপরীতে নায়কের ভূমিকায় অভিনয় করলেন আর ‘সমাপ্তি’ ছবিতে অভিনয় করলেন ভারতী দেবীর সঙ্গে। 

১৯৪৪ সালে ‘তসবির তেরি দিল মেরা বেহেলা না সকেগি’ তাঁকে এনে দিল বিপুল জনপ্রিয়তা। পাশাপাশি শুরু হল ছবিতে অভিনয়। মোট ১৬টি ছবিতে তিনি অভিনয় করেন। কলকাতায় থাকাকলীন তপনকুমার নামে তাঁর একাধিক বাংলা গানের বেসিক রেকর্ড প্রকাশ হতে থাকে। কী সব মন ছুঁয়ে থাকা গান! কমল দাশগুপ্ত, পবিত্র মিত্র, শ্যামল মিত্র, শ্যামল গুপ্ত, কানু ঘোষ, সুধীন দাশগুপ্ত, ভি. বালসারা, রবীন চট্টোপাধ্যায়, গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার, পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখের কথায় ও সুরে গাইলেন, ‘দুটি পাখি দুটি তীরে’, ‘আলোতে ছায়াতে’, ‘চাঁদের এত আলো’, ‘ঘুমেরও ছায়া’, ‘এই তো বেশ এই নদীর তীরে’, ‘যেথা রামধনু ওঠে’, ‘সে কোন শাওনি মেঘ’, ‘অনেক সন্ধ্যাতারা’, ‘তুমি সুন্দর যদি নাহি হও’, ‘শোনো গো সোনার মেয়ে’, ‘আধো রাতে যদি ঘুম ভেঙে যায়’, ‘এই রিমঝিম ঝিম বরষায়’। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সুরে তাঁর গাওয়া ‘এ যদি আকাশ হয়, তোমায় কী বলে আমি ডাকব বল’ গানটি অল্পশ্রুত কিন্তু বড় মিষ্টি একটা গান। গানের সঙ্গে ছিল সংলাপ, সেটা ছিল অভিনেত্রী রাখির কণ্ঠে। 

আমার নিজের একটা আক্ষেপ রয়ে গেছে এ বিষয়ে। সেটা হল, আমার মাতামহ কবি-গীতিকার অমিয় বাগচির লেখা গানও তিনি গেয়েছিলেন, কিন্তু সেই গানের কথা বাড়ির কারুর মনে না থাকায় সেটা আজও উদ্ধার করা যায়নি। মায়ের কাছে শোনা যে দাদুর কাছে গান সংক্রান্ত বিষয়ে কথা বলতে শিল্পী বেশ কয়েকবার এসেছিলেন উত্তর কলকাতায় কেশবচন্দ্র সেন স্ট্রিটে আমার মামারবাড়িতে।

বাংলাকে ভালোবেসে ফেলেছিলেন তালাত। জীবনসঙ্গিনীও নির্বাচন করেছিলেন লতিকা মল্লিককে, যিনি ছিলেন একজন বাঙালি খ্রিস্টান। ভালোবাসা দিয়ে মুছে ফেলেছিলেন রক্ষণশীল পরিবারের সব বাধা-বিপত্তিকে। বাবা মনসুর, তালাতের গোপনে নিকাহ-র কথা শুনে প্রথমে প্রচণ্ড আঘাত পেয়েছিলেন, তবে পরে মেনেও নিয়েছিলেন বাঙালি পুত্রবধূকে। তালাত তাঁর প্রেম সফল করেছিলেন। 

Talat mahmood Mukesh Lata Rafi
বাঁ দিক থেকে: তালাত মাহমুদ, মুকেশ, লতা মঙ্গেশকর এবং মহম্মদ রফি

ম্যান অফ গোল্ডেন অ্যান্ড ভেলভেট ভয়েস তালাত মাহমুদ দ্বিতীয়বার যখন কলকাতায় আসেন, তখন তাঁর গান সাংঘাতিকভাবে হিট করছিল কিন্তু ছবিগুলো ততটা জনপ্রিয় হচ্ছিল না। ঠিক করলেন, কলকাতায় আর নয়।  ১৯৪৯ সালে চলে গেলেন মুম্বই। তখন সেখানে চাঁদের হাট। অনিল বিশ্বাস, ক্ষেমচাঁদ প্রকাশ, নৌশাদ, শ্যামসুন্দর, মদনমোহন সবাই সাদরে তালাতকে ডেকে নিলেন নিজেদের কম্পোজিশনে গান গাইবার জন্য। বাংলার তপনকুমার হলেন মুম্বইয়ের তালাত মেহমুদ। বিভিন্ন জনপ্রিয় হিন্দি ছবিতে গান করে তখন তিনি মন জয় করে নিয়েছেন দেশের মানুষের। দেশজোড়া সেই খ্যাতির জন্য নম্র, ভদ্র, লাজুক স্বভাবের মানুষটির মধ্যে কিন্তু কোনও অহংকার আসেনি। ‘জ্বলতে হ্যায় জিসকে লিয়ে’, ‘যায়ে তো যায়ে কাঁহা’, ‘ফির ওহি শাম’, ‘অ্যায় মেরে দিল কাঁহি  অউর চল’, ‘ইতনা না মুঝসে তু পেয়ার বড়া’, ‘রাত নে কেয়া কেয়া খোয়াব দিখায়ে’, ‘আহা রিমঝিম কে ইয়ে পেয়ারে পেয়ারে’, ‘রাহি মতওয়ালে’, ‘অ্যায় দিল মুঝে অ্যায়সি জগা লে চল’, ‘রো রো বিতা জীবন সারা’ ইত্যাদি গানের কথা আজও শ্রোতাদের কানে বাজে। বিমল রায় পরিচালিত ‘দেবদাস’ ছবিতে তালাত গেয়েছিলেন ‘মিতওয়া লাগি রে ইয়ে ক্যায়সি’ বলে একটা অসাধারণ বেদনাময় রোম্যান্টিক গান। 

হিন্দি ছবির ট্র‌্যাজিক হিরো দিলীপকুমারের লিপে তালাত মাহমুদের গান একটা অন্য মাত্রা পেত।  দেবদাসের গান শুনে বিমল রায় মুগ্ধ হয়ে যান। এরপর তাঁর ‘সুজাতা’ ছবিতেও তিনি প্লেব্যাক করার জন্য তালাতকে ডাকেন। দীলিপকুমার ছাড়াও দেবানন্দ, রাজ কাপুর, সুনীল দত্ত, ভারতভূষণ, গুরুদত্ত-সহ অনেক জনপ্রিয় নায়কের লিপেই তাঁর গান শোনা যায় হিন্দি ছবিতে। পাকিস্তানের দুটি ছবিতেও তিনি গান গেয়েছিলেন। মুম্বইয়ের হিন্দি ছবিতে নূতন, সুরাইয়া, মালা সিনহা-সহ বহু বিখ্যাত নায়িকাদের সঙ্গে অভিনয় করেছেন। লতা মঙ্গেশকর, শামশাদ বেগম, সুরাইয়া প্রমুখের সঙ্গে অনেক গান করেছেন দ্বৈতকণ্ঠে। শোনা যায় যে লন্ডনের রয়্যাল অ্যালবার্ট হলে তাঁর অনুষ্ঠানের দু’সপ্তাহ আগেই টিকিট শেষ হয়ে গিয়েছিল, এমনই ছিল তাঁর জনপ্রিয়তা। 

অন্যদিকে সমাজসেবার কাজে তাঁর নীরব অবদানের কথা অনেকেই জানেন না। দেশরক্ষার কাজে উত্তর ভারতের বিভিন্ন সীমান্ত এলাকায় কর্মরত জওয়ানদের জন্য আয়োজিত অনুষ্ঠান করতে গিয়ে তালাত মাহমুদ কখনও টাকা নেননি। অনেক সংস্থাকে অর্থ সাহায্যও করেছেন নীরবে। তাঁর কাঁপা গলায় সঙ্গীত পরিবেশনের জন্য অনেক সঙ্গীতবোদ্ধা তাঁর সমালোচনা করেছেন, কিন্তু তালাতের ওটাই ছিল সম্পদ। এ কথা অনিল বিশ্বাসই তাঁকে বলেছিলেন। ভারত সরকার তাঁকে পদ্মভূষণ দিয়ে সম্মানিত করে। 

বর্তমান প্রজন্মের অনেকেই হয়ত তালাত মাহমুদের নাম বা গান খুব একটা শোনেননি। নির্দ্বিধায় তাঁদের উদ্দেশে বলব, যে তাঁরা যদি ভারতের গজল সম্রাটের গান না শুনে থাকেন, তবে সঙ্গীতের এক অনাবিল আনন্দ থেকে তাঁরা বঞ্চিত হয়ে আছেন এখনও। হেমন্তজায়া বেলা মুখোপাধ্যায় একবার বলেছিলেন তাঁর স্বামীর গলা অনেকেই নকল করে থাকেন কিন্তু তালাতের গলা নকল করে গান করা অসম্ভব। অদ্ভুত লাগে যখন দেখি ছোটপর্দার রিয়েলিটি শোগুলোতে তালাত মাহমুদের গান কেউ করেন না বা তাঁর নামও উচ্চারিত হয় না। অবশ্য গানে গানেই শিল্পী বলে গিয়েছিলেন, ‘ওহ গুজ়রা জমানা, মুঝে ভুল যানা’। ১৯৯৮ সালের ৯ মে তাঁর কণ্ঠ স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল চিরকালের জন্য। যে যাত্রা শুরু হয়েছিল লখনউতে, তা শেষ হয় মুম্বইয়ের বান্দ্রায়। কিন্তু কীভাবে দেশের গোল্ডেন এবং ভেলভেট ভয়েসকে আমরা ভুলে যাব? মেলোডি কিং তালাত মাহমুদকে ভোলা সহজ নয়। অঘ্রাণের নবীন ভোরের মতো শান্ত স্নিগ্ধ তাঁর কণ্ঠ, কোমল তাঁর উচ্চারণ সারাজীবন ভারতীয় সংগীতপ্রেমীদের মনে জেগে থাকবে।               

ছবি সৌজন্য: Wikimedia Commons, Facebook

অরিজিৎ মৈত্র পেশায় সাংবাদিক। দৈনিক যুগশঙ্খ পত্রিকায় সিনিয়র সাব-এডিটার পদে কর্মরত। তপন সিংহ ফাউন্ডেশনের সম্পাদক অরিজিৎ পুরনো কলকাতা নিয়ে চর্চা করতে ভালবাসেন। নিয়মিত লেখালিখি করেন বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়। প্রকাশিত বই: অনুভবে তপন সিনহা, ছায়ালোকের নীরব পথিক বিমল রায়, চিরপথের সঙ্গী - সত্য সাঁই বাবা, বন্দনা, কাছে রবে ইত্যাদি।

3 Responses

  1. এক অপূর্ব মাদকতায় ভরা এবং অননুকরনীয় গানের গলা ছিল তালাত মাহমুদ সাহেবের। আশ্চর্য হতে হয় যে রফি, মুকেশ, এবং ঐ সময়ের শ্রেষ্ঠ গায়ক দের অপূর্ব পুরুষালি এবং বলিষ্ঠ গলার পাশাপাশি তালাত মাহমুদ সাহেবের ঐ কাঁপা এবং কিছু টা timid throwing এর গলা শুধুমাত্র গায়ন ভঙ্গিতে মাত করেছিল শ্রোতাদের। রোমান্টিক আবেশ, শান্ত স্নিগ্ধ গলা ছিল ওনার। প্রনাম এই মহান শিল্পী কে ।।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *