বাবার কবিতা সম্পর্কে লিখতে বলা হয়েছে। প্রথমেই বলে রাখি পেশাদার আলোচক বা প্রাবন্ধিক আমি একেবারেই নই, বরং তাঁর কবিতার অনুরাগী একজন পাঠকমাত্র। ব্যক্তিগত সম্পর্কের নৈকট্যের কারণে তাঁর কবিতার রুচিসম্মত অথচ নিরপেক্ষ বিচার বিশ্লেষণ ত্রুটিপূর্ণ হওয়াটাও মোটেই অস্বাভাবিক নয়, কারণ ব্যক্তিগত পরিচয় বা আত্মীয়তার সূত্রে আমার আলোচনার বিষয়বস্তু ব্যক্তিগত পছন্দ বা অপছন্দের দোষে দুষ্ট হতে পারে। তবু চেষ্টা করছি।

বাবার প্রথম বই ‘জলপ্রপাতের ধারে দাঁড়াবো বলে’ থেকে কয়েকটি পংক্তি উদ্ধৃত করছি। 

“তুমি তো এক বিশাল মরুভূমি
কান্নাছাড়া কাতরতার মত
তবুও কেন মনের এই নদী
তোমারই দিকে ছোটে যে অবিরত?” 

চিত্রকল্প শব্দচয়ন এসবেরও আগে যেটা লক্ষ্য করার মতো– ওঁর অনুভবের স্থাপত্য (architecture of emotions)কবিতার কাঠামো সুঠাম, টানটান কিন্তু গতিশীল– কোনওরকম স্থবিরতা নেই। এটা ওঁর প্রথম দিককার কবিতা। তারপর ক্রমশঃ প্রকাশিত হয়েছে ‘ব্যক্তিগত নক্ষত্রমালা’, ‘শব্দরা আমার বাগানে’, ‘পড়ে আছে চন্দনের চিতা’ ইত্যাদি। এই কবিতার বইগুলিতে একইধরনের স্থাপত্য বা আর্কিটেকচার লক্ষণীয়– সঙ্গে এসে গেছে নতুন অনেক বিষয়বস্তু, অনেক নতুন রঙ। দ্রষ্টব্য: 

“ভালোবাসা মানে কেবলই যাওয়া
যেখানেই থাকি না কেন
উঠে পড়া
পেয়ে গেলে নিকটতম যান” 

অথবা 

“ভোরের ছবিটা আত্মসাৎ করতে পারলেই
আমি আসব
এসে খুব শীতে বলব
চা দাও বিস্কুট দুখানি।”

পরবর্তীকালে বাবা একজন স্বাধীন চিত্রশিল্পী হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু তার বহু আগে থেকেই বাবার কবিতায় water colour painting-এর মতো একটা ব্যাপার আমাকে আচ্ছন্ন করে রাখত। ওঁর নিজের আঁকা ছবি পর্যবেক্ষণ করলে তার সাথে ওঁর কবিতার চিত্রকল্প বা ক্যানভাসের একটা সাদৃশ্য নির্ণয় করা হয়ত সম্ভব হবে। ক্রমশ বাবার বয়স বেড়েছে, উনি আরো অনেক রূপান্তরিত, পরিণত হয়েছেন, সমসময়ের আরো অনেক ভিতরে প্রবেশ করেছেন। প্যাস্টেল রংয়ের গাঢ় গভীর ব্যাঞ্জনা ওঁর কবিতাকে ছেয়ে ফেলেছে। কখনও বিষণ্ণতা, কখনও শহর কলকাতার অবক্ষয়জনিত হতাশা ওঁকে স্পর্শ করেছেওঁর কবিতায় আরো তীক্ষ্ণ অনুভব বা বক্তব্য ফুটে উঠেছে। দৃষ্টান্ত স্বরূপ:

“আমি কি তোমার প্রিয়তম মনোরুগী
আমারই চামড়া ধার নিয়ে তুমি বাজাবে কি ডুগডুগি?
মাদারির খেলা খেলছ চিকিৎসক
আমাকে তারের ওপরে হাঁটানো বিশিষ্ট এক শখ
সে শখ মেটাবে?
শিশুকে লোপাট করে রক্তের ফিনকি ছোটাবে?” 

অথবা 

“কোথায় খুঁজবে তাকে, পথে আজ বড় বেশি লোক
মিছিলে কে খুঁজে পাবে হারানো পালক
পথে আজ বড় বেশি লোক।”

এবং তারপর আরও রূপান্তর, আরও পরিবর্তন। ওঁর কবিতায় ক্রমশঃ এক ধরনের philosophical resignation বা acceptance এসে গেল। প্রতিবাদ করতে উনি ভোলেননি। কিন্তু রূপ, রঙ, মানুষ এবং প্রকৃতির দিকে ওঁর কবিসত্তা ছুটে গেছে। সবচেয়ে বড় কথা, একজন লিরিক্যাল কবি হিসেবে উনি বিশ্বাস বা ভালোবাসাকে সবচাইতে উঁচু আসনে বসিয়েছেন। ওঁর চলচ্চিত্র জীবনের অভিজ্ঞতা, ওঁর সমাজজীবনের অভিজ্ঞতা, অন্তর্জীবন, এই সবকিছু ওঁর কাব্যভাষাকে এক সিনেম্যাটিক ফ্লুইডিটি প্রদান করেছে। যেন মন্তাজ পদ্ধতিতে উনি কাব্যরচনা করছেন। ধানখেত, শরতের কাশফুল, নিম্বাস মেঘমালা, পপলার গাছের সৌন্দর্যের আরো কাছাকাছি পৌঁছে গেছেন নিজস্ব কাব্য পরিক্রমায়। জীবনের সহজ অনুষঙ্গগুলো মোটেই উপেক্ষা না করে উনি বরং কাব্যভাষাকে উন্নত করেছেন দৈনন্দিন জীবনের এবং নিসর্গ জগতের উপযুক্ত করে তুলে। তার একটি উদাহরণ দিচ্ছি:

“শেষ পর্যন্ত এই হরফগুলিই আমার সম্বল
এগুলি থেকে আমি যে ছায়াআতপ তৈরি করেছিলাম
সেই শব্দের নাম বনভূমি।” 

অথবা 

“গ্রীষ্মের দাহ থেকে সে আমাকে ঢেকে রাখছিল
তারপর রাতের অরণ্য হয়ে
অক্ষরগুলো আমাকে প্রতীক্ষা করতে বলে
হ্রাস শেষ হলে কখন আসবে প্রাত্যকাল।”

অর্থাৎ খুব ঝলমলে রঙিন ছবি বা চিত্রকল্প অথবা ঝংকৃত শব্দচয়নের পর পুনরায় সাদাকালো কোলাজ, পুনরায় ধূসরবর্ণ আভা। অনেকটা ওঁরই চলচ্চিত্রাভিনয়ে যে আন্ডার-অ্যাকটিং বা আন্ডারটোনস্ তারই সমার্থক বা সমান্তরাল। অথবা পশ্চিমী উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের কোনও আসরে খুব জোরালো, ধ্বনিবহুল যন্ত্রসংগীত শোনার অভিজ্ঞতা হঠাৎ স্থিমিত, নিস্তেজ হয়ে এসে কয়েক মুহূর্ত সম্পূর্ণ নীরবতা (যাকে বলে pause বা rest)একেই তো বলে পরিণতি। তথাপি ওঁর কবিতা পরিণতি লাভ করার পরও ভাষা (তার প্রয়োগ ও ব্যবহার) থেকে গেছে বলিষ্ঠ অথচ প্রাঞ্জল, ওঁর অন্তর্দৃষ্টি বা পরিমিতিবোধ একটুও কমে যায়নি। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত ছিলেন আমাদের জীবনপ্রবাহের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে সম্পৃক্ত একজন পুরোদস্তুর কবি। তাই ওঁর জন্মদিন একজন সার্থক কবির জন্মদিন বলা ভালো– ওঁর স্মরণে কবিতার নিশান ওড়ানোই আমি সমীচীন বলে মনে করি।

সৌগত চট্টোপাধ্যায়ের জন্ম ১৯৬১ সালে কলকাতায়। কলকাতা বিশ্ববিধ্যলয়ের ইতিহাসের সাম্মানিক স্নাতক। কবিতা ও সাহিত্য ছাড়াও তাঁর প্রধান আকর্ষণ সঙ্গীত। রয়াল স্কুল অফ মিউজিক, লণ্ডন থেকে বেহালাবাদক হিসেবে গ্রেড ৫, ৬ ও ৭ পাস করেছেন। সাংবাদিকতার সূত্রে অমৃতবাজার পত্রিকার লেখক ছিলেন। তপন সিংহ-এর অন্তর্ধান ছবিতে সহকারি পরিচালক হিসাবে কাজ করেন। নৃপেন গঙ্গোপাধ্যায় পরিচালিত অনিল চট্টোপাধ্যায় বিষয়ক তথ্যচিত্রেও সহকারি হিসাবে কাজ করেন। পরবর্তীকালে একটি স্কুলে কিছুদিন শিক্ষকতা করেন। বর্তমানে চাকুরীজীবি। নিয়মিত লেখালেখি করেন বেশ কিছু প্রথম সারির বাংলা পত্রিকায়। সৌগত চট্টোপাধ্যায় প্রয়াত অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের পুত্র।

One Response

  1. সৌগত চট্টোপাধ্যায় আদ্যোপান্ত একজন কবি । বেহালাবাদনে তাঁর প্রশ্নাতীত দক্ষতার মতোই তাঁর কবিসত্তাও সমানভাবে উজ্জ্বল । কিন্তু এর আগে তাঁকে কখনও সমালোচক হিসেবে পাইনি । ব্যক্তিগত সম্পর্কের বেড়া ডিঙিয়ে তাঁর বিখ্যাত পিতা-রচিত কাব্য প্রসঙ্গে সৌগতর নির্মোহ সমালোচনা প্রশংসার দাবী রাখে বৈকি ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *