শীতকাল মানেই শুকনো আবহাওয়া আর ঝকঝকে রোদ্দুর। শিরশিরে হিমেল হাওয়া আর সেই হাওয়ায় ভেসে আসা হারিয়ে যাওয়ার হাতছানি। ঘোরা‚ বেড়ানো‚ রকমারি খাওয়াদাওয়া ছাড়া বাঙালির শীতে রং ধরে না। কিন্তু এক মারণ ভাইরাসে সেই সব অভ্যাসেই জং ধরতে বসেছে। বাঙালির শীতবিলাস একেবারে চুলোয় যাবার দাখিল। তবু দেখতে দেখতে এসে গেল পৌষ সংক্রান্তি। আসলে, শীতকালটা তো শুধু খাবার বৈচিত্রের কারণেই বাংলার ইতিহাসে অমর হয়ে থাকতে পারে। নলেন গুড় আর পিঠেপুলির যুগলবন্দি পৌষ সংক্রান্তির জমজমাট ঠান্ডায় বাঙালিকে রসনার উৎসবে মাতিয়ে তোলে।
তবে একথা ঠিক, এখনকার থেকে আগেকার দিনে এই পিঠে পার্বণের গুরুত্ব অনেক বেশি ছিল। আমার এক ঠাকুমার কাছে শোনা‚ উত্তর কলকাতার শোভাবাজার রাজবাড়ির অন্দরমহলের এক সত্যি ঘটনা থেকে কিছুটা আন্দাজ পাওয়া যেতে পারে, এই ‘পিঠে করা’ বলতে তখন কী বোঝাত।
আজ থেকে প্রায় পঁচাত্তর-আশি বছর আগেকার কথা। সেই বৃহৎ পরিবারের একটি অংশে তখন তিন চারজন শাশুড়ি‚ তাদের কন্যা ও বউমা মিলিয়ে কম করে জনা পনেরো মহিলা আর ছেলের ঘর‚ মেয়ের ঘর মিলিয়ে পঁচিশ তিরিশ জন নাতিনাতনি। বাড়ির পুরুষদের গুনতি করছি না কারণ এই পিঠেপুলির গল্পে পাত পেড়ে খেতে বসা ছাড়া তাঁদের সেভাবে কোনও কাজ ছিল না। তবে বাড়ির মহিলাদের ধরিয়ে দেওয়া ফর্দ অনুযায়ী জিনিস যোগান দেওয়ার দায়িত্ব তাঁরা সানন্দেই গ্রহণ করতেন।
পৌষ সংক্রান্তির দিন সব মহিলা রান্নামহলে এক হয়ে পিঠে তৈরি করতে লেগে পড়তেন। সে কত রকমের পিঠে- আসকে পিঠে‚ রাঙা আলুর পিঠে‚ পুলি পিঠে‚ সরু চাকলি‚ নতুন গুড়ের পায়েস তো ছিলই। এর সঙ্গে ওইদিন রাজবাড়িতে কড়াইশুঁটির পিঠে আর কড়াইশুঁটির কচুরি হতেই হত। সে কচুরি আবার এমনি কচুরি নয়‚ বিননো কচুরি। অর্থাৎ মাঝখানে পুর দিয়ে কচুরির ধারগুলো বিনুনির মত মুড়ে দিতে হবে। তবে রাজাবাবুদের তা মনে ধরবে।

পিঠের অন্য সরঞ্জামের মধ্যে কাজু কিশমিশ পেস্তা বাদাম আসত ঢালাও। কারণ শুধু নারকোলের পুর যথেষ্ট ছিল না‚ পিঠের প্রতিটি কামড়ে মুখে মেওয়া আসা চাই-ই চাই। পিঠের থেকেও এই কিশমিশ কাজুর টানেই বাড়ির ছোটদের রান্নামহলের কাছে ঘুরঘুর করতে দেখা যেত বেশি। রান্নাঘরে অত মহিলার ভিড়ের মধ্যে যারা সবচেয়ে অল্পবয়সী বৌদি থাকতেন‚ তাঁদের মনটাই হত সবচেয়ে নরম। বড়দের চোখ এড়িয়ে মুঠো মুঠো মেওয়া‚ পায়েসের বাটি বা সদ্য তৈরি পিঠে কচিকাঁচাদের হাতে চালান করার দায়িত্ব তাঁরাই নিতেন।
পিঠে ছাড়াও সে সময় শীতকালে আর একটা ঘটনা বাড়ি বাড়ি ঘটত‚ সেটা হল বড়ি হাত। সেও বাড়ির মহিলাদের জন্য একটা ছোটখাটো উৎসব। সারারাত ডাল ভিজিয়ে রেখে পরের দিন সকালে সেই ডাল বেটে নানারকম বড়ি দেওয়া হত। ছোট্ট ছোট্ট ভাজা খাওয়ার বড়ি‚ মসলা দেওয়া ঝোলের বড়ি আর ছিল গয়না বড়ি। রকমারি তার নকশা। হাতের চুড়ি‚ চূড় ‚সীতাহার‚ দুল; কী নেই তাতে। শুনেছি‚ যে মেয়ের নতুন বিয়ে হত তার শ্বশুরবাড়িতে পাঠানো গয়নাবড়ির ডালা শীতের তত্ত্বের মান বাড়াত।
সংক্রান্তির দিনের আর একটি কাজ‚ বাউনি বাঁধা। এই রেওয়াজ আগেও ছিল‚ এখনও আছে। ‘বাউনি’ হল নতুন ধানের ছড়া। নতুন ফসলের চিহ্নস্বরূপ সেই ছড়া রাশি রাশি আসত। প্রথমে বাঁধা হত কুলদেবতার ঘরে বা ঠাকুরবাড়িতে। তারপর ঘরে ঘরে চলে যেত ধানের ছড়া বা বাউনি। আজও‚ শোভাবাজারের এই বনেদী পরিবারে বাউনি আসে তাঁদের কুলদেবতা শ্রীশ্রী গোপীনাথ জীউর ঠাকুরবাড়ি হয়ে। এই গোপীনাথ জিউর ঘরেই পুরো পরিবারের সবচেয়ে প্রথম বাউনিটি বাঁধা হয়। তারপর অন্য ঘরে বাউনি পাঠানো হয় এবং সকলেই নিজেদের নিজেদের ঘরে বাউনি বেঁধে থাকেন।
এ পরিবারে কুলদেবতাকে অন্নভোগ দেওয়ার নিয়ম নেই। তাই রাজবাড়ির ঘরে ঘরে এত পিঠের চল থাকলেও ঠাকুরকে তা নিবেদন করার উপায় নেই। কারণ বেশিরভাগ পিঠের মূল উপকরণ চালের গুঁড়ো। তবে এখনও নতুন ধান ভানা চালের গুঁড়ো (পাক না করা‚ শুকনো)‚ কোরানো নারকোল, নতুন গুড় গোপীনাথ জীউকে উৎসর্গ করা হয় ঠিক আগেকার মতো।

তবে এখন তো সকলের হাতেই সময়ের অভাব। রাজপরিবারের সদস্যরাও ব্যতিক্রম নন। বাড়ির মেয়ে বৌরাও আগেকার মতো শুধু অন্দরমহলের বাসিন্দা নেই‚ তাদের হাতেও ঘরে বাইরের বিস্তর কাজ। অনেক আগের একটিমাত্র বৃহৎ পরিবার আজ বহু অণু পরিবারের সমষ্টিমাত্র। তাই সেই দিনকার পিঠের পর্ব আজ অনেকটাই সঙ্কুচিত। তবু পিঠেপুলি হারিয়ে যায়নি। নতুন গুড়ের সঙ্গে পিঠের প্রেম আজও ততটাই উষ্ণ‚ যতটা আগে ছিল। বরং বলা যায় বাণিজ্যিক মোড়কের জাদুতে এই উৎসব আজ অনেক বেশি আকর্ষণীয়।
যদি কিছু হারিয়ে থাকে, তা হল সেই উৎসবের ঘরোয়া মেজাজ। আত্মীয়তার বন্ধনে বাঁধা মহিলারা এক হয়ে হাসিমুখে পুরো পরিবারের আনন্দের জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করতেন। পরিবর্তে কোনও স্বীকৃতিও তাঁরা পেতেন না। কিন্তু বাংলার ঘরে ঘরে মা বোনেদের এই মিলিত প্রচেষ্টা পিঠেপুলিকে এক শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে যেত। আদি কৃষিভিত্তিক সমাজে নতুন ধান ওঠার খুশিকে কেন্দ্র করে শুরু হওয়া এই উৎসব আমাদের আজও মনে পড়িয়ে দেয় আমাদের শিকড়ের কথা‚ সেইসঙ্গে কোথা থেকে যেন ভেসে আসে মাটির গন্ধ।
*ছবি সৌজন্য: Cookpad, oneIndia
শোভাবাজার রাজবাড়ীতে জন্ম ও বেড়ে ওঠা | জার্নালিজম-এ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর | পেশা ও নেশা লেখা | বিশ্বাস করেন যুক্তির থেকে হৃদয়ের জোর বেশি | তাই লেখার মাধ্যমে হৃদয় ছুঁয়ে যাবার স্বপ্ন দেখেন নিরন্তর |
আচ্ছা, এই রীতি রেওয়াজ গুলো লুপ্ত হলো কেন? এতো আনন্দ আর ভালোবাসার সময় ছিল তখন।বুঝি, সময়ের অপচয় করতে এখন কার মা বোনেরা রাজী নন। এতো বুঝি জিনিস পত্রের দাম প্রায় সবার ই নাগালের বাইরে। কিন্তু, নিজেদের কলা, কৃষ্টি, পার্বণ গুলো লালন করাই তো একটা জাতির ধর্ম, ঐতিহ্য কে ধরে রাখতে দরকার এই পার্বণ পূজোর পালন!! অন্যান্য রাজ্যের মানুষ জন কি এগুলো ভুলে গেছে ? বিসর্জন দিয়েছে ? না ! একদম না!! আসামে বিহু, কেরালায় ওনার বা বিহার উত্তর প্রদেশের ছট্ পূজো দেখে তো মনে হয়না। আমরা , বাঙালীরা আসলে কষ্ট করবো না। পরিশ্রম করবোনা। এটাই কারন মনে হয়।সব রেডিমেড চাই। ধন্যবাদ।