এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা বলছে, স্ট্যু হল মাংস, পোলট্রি অথবা মাছ এবং সবজির সমন্বয়ে একটি বদ্ধ পাত্রের মধ্যে তৈরি ব্রথ বা জলীয় খাদ্য। এই জলীয় অংশকে ঘন করার জন্য ময়দা বা ডিমের কথাও রয়েছে সেখানে। মাংসের স্যুপ আর স্ট্যু কাছাকাছি হলেও স্যুপ হল তরল এবং স্ট্যু অপেক্ষাকৃত ঘন। প্রাচীন ফরাসি শব্দ estuier বা estuve থেকে আজকের ইংরেজি শব্দ ‘স্ট্যু’-এর নাম এসেছে।

Raey Tannahill তাঁর ‘Food in History’ বইতে বলেছেন মৃৎপাত্র আবিষ্কারের আরও আগেও (৬০০০ খ্রিষ্টপূর্ব) মানুষ স্ট্যু বানাত কোনও পাত্র ছাড়াই। কেমন করে? প্রাগৈতিহাসিক আদিম মানুষের রন্ধনশৈলীতে সরীসৃপের খোলস, পাকস্থলী এসবের মধ্যে তরল পদার্থ ফোটানোর কথা জানা গেছে। সম্ভবত এভাবেই স্ট্যু বানিয়ে তারা খেত। গ্রিক ঐতিহাসিক হেরোডোটাসের লেখায় স্কাইথিয়াবাসীর (Scythia) যে কোনও পশুর মাংস তারই পাকস্থলিতে জল দিয়ে বনফায়ারের আগুনে ফুটিয়ে স্ট্যু রান্না করার কথা রয়েছে। এবার আসি আমাদের প্রিয় শহর কোলকাতার স্ট্যুয়ের ঐতিহ্যে।

ময়দান হল কলকাতার বাঙালির অন্যতম আবেগের জায়গা। ইংরেজ আমলে তৈরি ময়দান, মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গলের খেলার অন্যতম স্থান। ডার্বির দিনগুলোতে ময়দানের তাঁবুতে জমিয়ে স্ট্যু আর টোস্ট খাওয়া ছিল এক দেখার মতো জিনিস। বড় খেলার আগের রাত থেকে বাঁশের ওপর ছাউনি দেওয়া ক্যান্টিনে শুরু হয়ে যেত তুমুল ব্যস্ততা৷ ম্যাচ শেষে মোহনবাগান জিতলে কাজুর ক্যান্টিনে স্পেশ্যাল স্ট্যু খাওয়া ছিল মোহনবাগান সমর্থকদের গ্যাস্ট্রোনমিক তৃপ্তির সঙ্গে সঙ্গে প্রাণের আরাম, মনের শান্তি। আবার ইস্টবেঙ্গল ক্যান্টিনে ডার্বি-স্পেশাল মেনু ছিল মাংসের ঘুগনি আর ডিমের পোচ। 

Chicken Stew
মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল ম্যাচের পর স্ট্যু আর টোস্ট তো কিংবদন্তীসম

পশ্চিমবাংলায় এই স্ট্যু রাঁধা ও খাওয়ার চল কিন্তু ব্রিটিশ আমল থেকেই। কলকাতার অনেক পুরনো পুরনো ক্লাবগুলি-সহ কিছু রেস্তোরাঁতেও এই মাংসের স্ট্যু এখনও মেলে। দক্ষিণ কলকাতার রাধুবাবুর চায়ের দোকানে পাউরুটি দিয়ে এই স্ট্যু খেতে এখনও লাইন লেগে যায়।

উনবিংশ শতকে বাংলার খাওয়াদাওয়া নিয়ে যিনি হইচই ফেলে দিয়েছিলেন তাঁর নাম বিপ্রদাস মুখোপাধ্যায়। ১৮৮৩ সালে তিনি একটি সচিত্র মাসিক পত্রিকা বের করতেন যার নাম হল “পাকপ্রণালী”। বাংলা তথা সারা ভারতের সর্বপ্রথম কালিনারি ম্যাগাজিন সেটিই। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল বাঙালি মহিলাদের রান্নাবান্নায় উৎসাহিত করা। এর ঠিক পাঁচবছর পর পাকপ্রণালীর পাঁচ খণ্ডে সংস্করণ প্রকাশ করেন শ্রী হরিদাস চট্টোপাধ্যায়, গুরুদাস চট্টোপাধ্যায় অ্যান্ড সন্স “২০১ কর্নওয়ালিস স্ট্রিট, কলিকাতা” থেকে।

এই রান্নার বইটি পরবর্তীকালে আনন্দ পাবলিশার্স থেকে প্রকাশিত হয় ১৯৮৭ সালে যা আমার সংগ্রহে রয়েছে। এটি নিঃসন্দেহে আন্তর্জাতিক, কারণ এর সূচিপত্রে পাতে পাত মিলিয়ে, কালে কাল মিলিয়ে পঙক্তি ভোজে রয়েছে মোগলাই কাবাব থেকে মাদ্রাজি কাবাব, আইরিশ স্ট্যু থেকে জার্মান পুডিং, মাছের অম্বল থেকে পোস্ত চচ্চড়ি। বাংলার এই প্রথম রসনা-কলমচির লেখায় পেলাম সে যুগের এক গুচ্ছ স্টুয়ের খবর। তাঁর মতে স্ট্যুয়ের সংজ্ঞা হল

“ইহা রাঁধিবার নিয়ম অতি সহজ। ইউরোপে উহার অধিক প্রচলন। আজকাল এদেশীয়দিগের মধ্যেও এই রন্ধন প্রথাটির সামান্য মাত্র প্রচলন দেখা যায়। স্যুপের মাংস যেমন অত্যন্ত সিদ্ধ করিতে হয়, স্ট্যুয়ের মাংস সেরূপ হয় না।”

এক সের মাংসের স্ট্যু রাঁধতে আধসের আলু, এক ছটাক ঘি, পরিমিত নুন, দুই তোলা জিরাবাটা, এক তোলা আদাবাটা, দুই ছটাক পিঁয়াজ কুচি, হলুদবাটা আর দুই সের জল লাগে। এই রেসিপি বিপ্রদাসবাবুর। ইউরোপে এই রেসিপি এক এক জায়গায় এক এক রকম। জার্মান স্ট্যুয়ে নারকেলকোরা আর নারকোলের দুধ সেখানে থাকবেই আদা-পেঁয়াজ-রসুন-লংকার সঙ্গে। সঙ্গে দারচিনি আর ছোট এলাচ। আইরিশ স্ট্যু মেষ বা ভেড়ার শরীরের পাতলা মাংসের টুকরো দিয়ে রাঁধা আবশ্যক। সেখানে গোলমরিচের ব্যবহার উল্লেখ করেছেন বিপ্রদাসবাবু। কেরালায় এই স্টু কে “ইস্ট্যু” বলতে শোনা যায়। সেখানেও নারকোলের দুধ দিয়ে ঘন করে নামানো হয়। এমন নারকোলের দুধ দেওয়া স্ট্যুয়ের স্বাদ পেয়েছিলাম শ্রীলংকা আর ইন্দোনেশিয়ায়।

Gudeg stew
এঁচোড় দিয়ে তৈরি ইন্দোনেশিয়ান নিরিমিষ স্ট্যু গুডেগ

আবার আমার ঠাকুমা-দিদিমার আলু সহযোগে সদ্য-ওঠা কচি পটলের মিষ্টি স্ট্যু-তে দেখি, গরমমশলা, তেজপাতা ফোড়ন। সামান্য হলুদ ও অল্প আদাবাটার ছোঁয়ায় আর আলুপটল সেদ্ধ হলে নামানোর আগে ঘিয়ের গন্ধেই মাত সেই অনবদ্য নিরামিষ স্ট্যু। নিরামিষ স্ট্যুয়ের আর একটি অসামান্য রেসিপি চেখেছিলাম ইন্দোনেশিয়ায়। সেখানকার একটি অথেন্টিক রান্না হল এঁচোড়ের স্ট্যু বা গুডেগ (Gudeg)। ঠিক আমাদের মতো এঁচোড়ের ডালনা, তবে অন্যরকম ঝোলের রেসিপি।  

সাহিত্যিক শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের স্ত্রী ইতি গঙ্গোপাধ্যায়ের হাতের মাটন স্ট্যুয়ের খুব সুনাম শোনা যায়। এখনও অশীতিপর বৃদ্ধা ইতিদি বেশ আত্মপ্রত্যয়ী গলায় সুপুরি চিবোতে চিবোতে বলেছিলেন, খাসির মাংস সেদ্ধ করে, গোল গোল আলু কেটে সামান্য আদাবাটা আর চার টুকরো করা দুটো কাঁচা পিঁয়াজ দিয়ে ফোটাতে। তাঁর হাতের সেই উপাদেয় স্ট্যু শ্যামলবাবু রোজ রাতে খেতেন কড়া পাঁউরুটির টোস্টের সঙ্গে। আর বাঙালি মাত্রেই ভুলতে পারেন না ছোটবেলায় জ্বর হলে মায়ের হাতে পাঁউরুটি টোস্টের সঙ্গে মাংসের সহজপাচ্য স্ট্যু। এখনও সে স্বাদ মুখে লেগে আছে।

Mutton-Stew
কেরালার লারকোল দুধ দেওয়া মাটন স্ট্যু

ভারতীয় স্ট্যু অবশ্য মাছ, মাংস, সবজি সবকিছুরই হয়। শুধু মাখন অথবা ঘিয়ের মধ্যে সেখানে গোটা গোলমরিচ, গরমমশলা আর তেজপাতা ফোড়ন মাস্ট। হলুদ অতি সামান্য, তবে ঘন করতে সামান্য ময়দা গুলে দিয়ে নামাতে দেখেছি মা-কে। জাপানের স্ট্যু-ও খুব প্রাচীন। জাপান বলতেই মনে পড়ে যায় বিপ্লবী রাসবিহারী বসুর কথা, যাঁর রন্ধনপটুতার কথা আমরা অনেকেই জানি। ইংরেজের চোখকে ফাঁকি দিয়ে জাপানে আত্মগোপনের সময় তিনি একটি মাংসের ঝোল রাঁধতেন। জাপানিদের কাছে সেই নাতি গাঢ়, নাতি পাতলা মাংসের ঝোল খুব বিখ্যাত হয়েছিল।

Japanese-Cream-Stew
জাপানি ক্রিম চিকেন স্ট্যু

জাপানের বিখ্যাত “নাকামুরা” বেকারি বিখ্যাত হয়েছিল “নাকামুরার বোস”- নামে। সেখানে প্রথমে রুটি তৈরি হত। রাসবিহারী বসুর প্রস্তাবে তাঁর উদ্ভাবিত মুরগীর স্ট্যু আর ভাত চালু হয়েছিল সেই বেকারিতে। তার আগে সেই দোকানে মূলত ব্রিটিশ পদ্ধতিতে মুরগির কারি তৈরি হত। রাইসু কারি বা কারি রাইসু নামে এক জাপানি চিকেন কারি-রাইস সেসময় মিলত বড় রেস্তোরাঁয়। তাই রাসবিহারী বসু প্রস্তাবিত পাতি মুরগির ঝোলভাতের খুব কাটতি হয়েছিল। মুরগির এই ঝোল যে মূলতঃ চিকেন স্ট্যু, তা বলার অপেক্ষা রাখে না, কারণ সবজি সহযোগে এই ঝোল ময়দা মিশিয়ে গাঢ় করা হত না। সবজি সেদ্ধ হতে হতেই ঘন হয়ে যেত। আর এটি ছিল হালকা রঙের, অতীব সহজপাচ্য। আজ জাপানে সেই রেস্তোরাঁর মালিকানা বদল হয়েছে কিন্তু রাসবিহারী বসু এবং তাঁর স্ত্রীর ছবির নীচে লেখা আছে “আমরা ভারতীয় কারি পরিবেশন করি, যা জাপানে এনেছিলেন বিপ্লবী রাসবিহারী বসু।”

সেবার ব্লু দানিয়ুবের তীরে হাঙ্গেরির রাজধানী বুদাপেস্টে দানিয়ুব নদীর ক্রুজ়ে উঠেছিলাম বুদ্ধপূর্ণিমার রাতে। দানিয়ুবের ওপর একটি স্টিমার বুক করা ছিল আমাদের গ্রুপের জন্য। একে বুদ্ধপূর্ণিমা তায় নীল দানিয়ুবে রিভার ক্রুজ় উইথ ডিনার? ডিনারে আমার উত্সাহ কম, কারণ ইউরোপিয়ান ডিনারের আড়ম্বর অনেক বেশি। বহ্বারম্ভে লঘুক্রিয়া। আর মাংস আমার না-পসন্দ। ট্যুর ম্যানেজারকে বলে রাখাই আছে নিরামিষ কিম্বা চিকেনের কথা। সেই প্রদোষে হালকা ঠান্ডায়, পড়ন্ত সোনালি রোদে মাখামাখি দানিয়ুবের চরাচর। নোঙর করে রাখা প্রাইভেট স্টিমারে গিয়ে বসে পড়ি নির্ধারিত জায়গায়।

ছোট ছোট টেবিল সাজানো আর জানলা দিয়ে তারিয়ে তারিয়ে দেখ হিম জ্যোত্স্নায় মাখামাখি দানিউবের তীরে বুদাপেষ্ট শহরের আলোকময়তা, যার জন্য তার নাম  “দ্য প্যারিস অফ দ্যা ইস্ট”। সুন্দরী হাঙ্গেরীয় মেয়ে ওয়েলকাম জানাল স্পার্কলিং ওয়াইন দিয়ে। তারপর শ্যাম্পেন ও নিজের পছন্দমত ওয়াইনে চুমুক ও কিছুপরেই ডিনার ব্যুফেতে ঝাঁপিয়ে পড়া। হরেকরকম চিজ দিয়ে সুসজ্জিত চিজ প্ল্যাটার ও সবজিসম্ভারে হাত বাড়াই আমি। হরেকরকম ব্রেডে মাখন লাগিয়ে চিজ, স্যালাড দিয়ে কামড় দিই। ডিনার ব্যুফেতে দলের অন্যেরা খাবে স্পেশ্যাল হাঙ্গেরিয়ান বিফ গুলাশ আর আমি ঝাল ঝাল চিকেন ইন প্যাপরিকা সস উইথ রিসোটো। কিছুপরেই অবিশ্যি আমার জন্য সেদিন মুরগীর হাঙ্গেরিয়ান গুলাশ এসেছিল।

beef_goulash_soup
হাঙ্গেরিয়ান বিফ স্ট্যু যাকে বলে গুলাশ

ইউরোপের ঘন সবুজ দেশ এই হাঙ্গেরি। প্রাচীন স্থাপত্য থরেথরে সাজানো এখনও তার রাজধানী বুদাপেস্টে। ইতিহাস কথা বলে ওঠে আজও। হাঙ্গেরির খাওয়াদাওয়াতেও মাংস, সবজি আর দুগ্ধজাত দ্রব্য অর্থাত্‍ ক্রিমের আধিক্য। ওখানকার সবথেকে জনপ্রিয় খাবার এই স্ট্যু বা হাঙ্গেরিয়ান গুলাশ। রেসিপি ‌যেমন মজার, তেমনি সহজ, আর খেতেও অনবদ্য। যে কোন মাংস, পেঁয়াজ আর দুধের মূল উপাদান। আর মশলা হিসাবে আলু, গাজর, মাংসের সঙ্গে থাকে পেঁয়াজ, প্যাপরিকা বা মিষ্টি লাললঙ্কার গুঁড়ো, গোলমরিচ গুঁড়ো, রিফাইন্ড তেল, মাখন, ট্যোম্যাটো পেস্ট।  

কাজেই অতীব সাদামাটা মাংসের ঝোল বা স্ট্যু নিয়ে বিশ্বজুড়ে কেমন মাতামাতি বুঝতেই পারছেন! সাঝে কি আর শিরোনামে বলেছি যে স্ট্যুয়ের এমনই মাহাত্ম্য যে কেষ্টবিষ্টু যিনিই হোন, চাট্টি গরম ভাতের ওপর একবাটি পেলে, তিনি কুপোকাত হতে বাধ্য।

 

*ছবি সৌজন্য: Headbangers kitchen, Pinterest, Homemade culinary, BBC, Just one Coockbook
*ভিডিও সৌজন্য: Bongeats, Youtube

Indira Mukhopadhyay Author

রসায়নের ছাত্রী ইন্দিরা আদ্যোপান্ত হোমমেকার। তবে গত এক দশকেরও বেশি সময় যাবৎ সাহিত্যচর্চা করছেন নিয়মিত। প্রথম গল্প দেশ পত্রিকায় এহং প্রথম উপন্যাস সানন্দায় প্রকাশিত হয়। বেশ কিছু বইও প্রকাশিত হয়েছে ইতিমধ্যেই। সব নামীদামি পত্রিকা এবং ই-ম্যাগাজিনের নিয়মিত লেখেন ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনি, রম্যরচনা ও প্রবন্ধ।

2 Responses

  1. অনেক কিছুই আমরা খাই যার অতীত বর্তমান জানিনা। এইযে খিচুড়ি খাই তা কি আমাদের ? অবশ্য আজকাল তো সব কিছুই ভারতীয় রা ( মানে হিন্দু রা) সৃষ্টি বা আবিষ্কার করেছে। প্লাস্টিক সার্জারি থেকে মায় ইন্টারনেট পর্যন্ত!! শুনেছি, খিচুড়ি নাকি সম্রাট জাহাঙ্গীরের আবিষ্কার?? খুব জানতে ইচ্ছে করে!!!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *