*আগের পর্বের লিংক: [] [] [] [] [] [] [] [] []

বিকেলের আলো কমে এসেছে। তবু লছমন ছাড়বার পাত্র নয়, পালিশ করবেই। জুতো ছেড়ে, রবারের চটি পরে রঞ্জন দাঁড়িয়ে। একবার ব্রাশ বুলোবার পর এখন লছমন মন দিয়ে ক্রিম মাখাচ্ছে। আজকাল রাস্তার লাইটের তেজ কম নয়। ফুটপাতের প্রত্যেকটি দাগ স্পষ্ট দেখা যায়। এই যেমন কিছুক্ষণ আগে একটা আহত আরশোলা যে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে ড্রেনের দিকে গেল, মন দিয়ে লক্ষ করল রঞ্জন। বিদ্যাসাগরমশায় একালে থাকলে ফুটপাতে বসে লেখাপড়া করতে খুব কিছু অসুবিধা হত না মনে হয়। মাঝে মাঝে সুলভ শৌচাগারও ঘুরে আসতে পারতেন। অবশ্য কিছু খুচরো পয়সা সঙ্গে রাখতে হত।

এই জায়গার একটাই অসুবিধা– নো পার্কিং বোর্ড লাগানো। তাতে বিদ্যাসাগরের কোনও অসুবিধা হবার কথা নয়, কিন্তু রঞ্জনের হচ্ছে। আজকাল ট্রাফিক আইন খুব কড়া। ধরলেই হাজার টাকা ফাইন করে দেয়। এদিকে ট্রাফিক সিগন্যাল খারাপ হয়ে গেছে। সার্জেন্টমশাই রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে গাড়ি সামলাচ্ছেন। এতবার হাত তোলা নামানো করতে গেলে তো কাঁধের জয়েন্টে ব্যথা হয়ে যাবে! ভদ্রলোককে একটু রিলিফ দেওয়া দরকার। রঞ্জন সোজা চলে গেল সাদা কুর্তার সামনে। 

– স্যার একটু আসবেন আমার সঙ্গে, প্লিজ…
কথা শেষ করেই তার বহু পরীক্ষা-উত্তীর্ণ হাসি ভাসিয়ে দিল। পুলিশের লোক সব সময় প্রশ্ন দিয়ে কথা শুরু করে-
– কোথায়?
– এই তো সামনে… ওই যে লাল গাড়ি, নো পার্কিং বোর্ডের তলায় রাখা, ওইখানে।
– আপনার গাড়ি? ওই নো পার্কিং-এ… আবার আমায় ডেকে দেখাচ্ছেন…
ভদ্রলোক কিছুটা বিভ্রান্ত হয়ে গেলেন।
– দেখিয়ে রাখলাম। কারণ হঠা দেখলে আপনি খুব দোটানায় পড়ে যেতেন। ট্রাফিক সামলাবেন না বেআইনি পার্কিং ধরবেন, তাই না? আর তাছাড়া আপনার হাত ব্যথা করছে না? তখন থেকে দেখছি একা-একা লড়ে যাচ্ছেন–
সার্জেন্ট সাহেবের মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল
– হ্যাঁ তা অবশ্য…
– এইজন্যই তো ডাকলাম। আপনি এক কাজ করুন, আমার গাড়িতে বসুন। একটু বিশ্রাম করুন। আসলে আজ আমার বিবাহবার্ষিকী, আমরা ঠিক করেছি এইদিন আমরা দু’জন পরোপকারী লোককে আনন্দ দেব। আমার কাজ একজনকে খুঁজে বের করে তার মন ভালো করে দেওয়া। আমার বউ খুঁজবে অন্যজনকে। রাত্তিরে দু’জনে দু’জনকার গল্প শোনাব… 

 

আরও পড়ুন: বেদব্রত ভট্টাচার্যের কলমে: একে একে পাঁচে একেন

 

মুহূর্তের মধ্যে এমন একটা বিশ্বাস করবার মতো গল্প বানিয়ে ফেলতে পেরে মনটা ফুরফুরে হয়ে গেল। ট্রাফিক পুলিশের গলা নরম।
– ও আচ্ছা বুঝলাম। কিন্তু ট্রাফিক সামলাতে হবে–
– ভাববেন না, লছমন সামলে দেবে।
জুতোয় ক্রিম লাগাতে থাকা লছমনকে দেখাল রঞ্জন।
– অ্যাঁ?
– কেন পারবে না? জুতো পালিশ করবার মতো দুরূহ আর্টিস্টিক কাজ পারছে,  আর গাড়ি সামলাতে পারবে না? আমি তো কতবার দেখেছি, রাস্তায় পুলিশ নেই, ছেঁড়া জামা পাগল রাস্তা সামলাচ্ছে। মার্সিডিজ চালক অবধি ওই পাগলের হাত-পা নাড়া মেনে গাড়ি চালাচ্ছে। কলকাতার ড্রাইভাররা পাগলের কথা শোনে আর এই লছমনের হাত নাড়া মানবে না…?
এমন অকাট্য যুক্তির তোড়ে সার্জেন্ট সাহেব আগেরবারের মতোই বললেন,
– হ্যাঁ তা অবশ্য…তবু…
– ভরসা না হলে আপনি নিজে দাঁড়িয়ে থেকে একবার সবকটা দিকের ফ্লো প্র্যাকটিস করিয়ে দিন…
– হ্যাঁ তা অবশ্য করা যায়…

লছমন দাঁড়িয়ে গেল। এবং পেরে গেল। যাকে বলে লেটার মার্কস-সহ পাশ। কারণ শুধু ট্রাফিক সামলানো নয়। তার ফাঁকে-ফাঁকে পালিশের কাজটাও করে যাচ্ছে। উত্তর-দক্ষিণের গাড়ি চালু করেই একবার ছুটে এসে পালিশ করে গেল। পূর্ব-পশ্চিম চালু করে আর একবার। ডান পাটি আগেই হয়েছিল, বাঁ পাটিটাও এমন করে শেষ হল। আবার কালি লাগানো। শুকোনো। তারপর আবার পালিশ। ইতিমধ্যে সার্জেন্ট সাহেব গাড়ির পেছনের সিটে এলিয়ে বসেছেন। রঞ্জন ওঁকে একটা বিয়ারের ডিব্বা ধরিয়ে দিয়েছে। ভদ্রলোক প্রথমটায় লজ্জা-লজ্জা মুখ করে ‘এখন ডিউটিতে আছি’, ‘এখন খাওয়া কি ঠিক’ ইত্যাদি বলবার চেষ্টা করেছিলেন। রঞ্জনের অনুরোধের চাপে সেসব মনের বাধা উড়ে গেছে। উনি যতক্ষণ গাড়িতে, নো-পার্কিং জোনে গাড়ি রাখার জন্য ফাইন হবার ভয় নেই।

লছমন গাড়ি সামলাচ্ছে। ও উত্তর থেকে দক্ষিণ যাবার জন্য হাত দেখাতেই তামাকের গন্ধ পেল রঞ্জন। ডাইনে বাঁয়ে মাথা ঘোরাতে কাউকে দেখা গেল না। অতএব এর উস পূর্ব দিকে, অর্থা তার পেছনে। হুট করে মাথা না ঘুরিয়ে পার্স বের করে সামনে ধরল। মানি ব্যাগের ভেতরে একটা ছোট আয়না লাগানো আছে। চুল আঁচড়ানোর কাজে লাগে। তা দিয়ে খুব সহজেই দেখা গেল। তিরিশের চৌকাঠে পা দেওয়া এক যুবক ফুটপাতের ভুট্টাওলার সঙ্গে কথা বলছে। নীল শার্ট, কালো ট্রাউজার্স। হাতে সিগারেট। রঞ্জন কান খাড়া করল।
– …ভদ্রমহিলাকে দেখেছ? বয়স হয়েছে… ষাটের ওপর। সামনের দিকে পাকা চুল…
ভুট্টাওলা মাথা নাড়ল।
– ম্যায় নে তো আভি-আভি দুকান খুলা। নেহি দেখা…
এইবার যুবক রঞ্জনের সামনে।
– আচ্ছা একটা কথা… আপনি কী আমার মাকে মানে… প্রায় পঁয়ষট্টি বছর… সামনের দিকে–
– পাকা চুল, সাদা শাড়ি, জমিতে কালো ফুলছাপ, কালো পাড়… সুহাসিনী হালদার…
– হ্যাঁ, হ্যাঁ। দেখেছেন?… আপনি আমার মাকে চেনেন?

এইজন্যই তো ডাকলাম। আপনি এক কাজ করুন, আমার গাড়িতে বসুন। একটু বিশ্রাম করুন। আসলে আজ আমার বিবাহবার্ষিকী, আমরা ঠিক করেছি এইদিন আমরা দু’জন পরোপকারী লোককে আনন্দ দেব। আমার কাজ একজনকে খুঁজে বের করে তার মন ভালো করে দেওয়া। আমার বউ খুঁজবে অন্যজনকে। রাত্তিরে দু’জনে দু’জনকার গল্প শোনাব… 

একবার ডান-বাঁদিক দেখল যুবক।
– উনি কোথায়?
– বর্ষা সংঘ ক্লাবে আছেন…
– বর্ষা সংঘ মানে লেক গার্ডেনস-এর দিকের ক্লাবটা?
– হুম। কিন্তু শুনলাম, আপনি নাকি ওকে বাসস্ট্যান্ডের প্যাসেঞ্জার শেডে বসিয়ে পালিয়ে গেছেন…
– উফফ… আবার সেই এক কথা। ছ’মাস হল এই ব্যারাম ধরেছে। এর আগে কাউকে কিছু না বলে দু’বার বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছেন। প্রত্যেকবার ওই এক কথা, ছেলে ওকে পথে বসিয়ে পালিয়েছে। কী যে করি…
– ডাক্তার দেখান। মনোরোগ চিকিসক, ডাক্তার দেবব্রত সাহা। গুগল সার্চ করলেই নম্বর পেয়ে যাবেন… ভালো ডাক্তার। একজনের লাগাতার হেঁচকি উঠছিল সারিয়ে দিয়েছেন…
– কিন্তু হেঁচকির সঙ্গে আমার মা’র!… মা’র তো হেঁচকি–
– জানি। কিন্তু উনিও তো লাগাতার একই কথা বলে যাচ্ছেন… আপনার বদনাম হচ্ছে…

যুবক ঠিক বুঝতে পারল না রঞ্জন ঠাট্টা করছে কিনা। রঞ্জন নিজেও বুঝল না কেন তার মুখ দিয়ে এমন কথা বের হল। অপ্রস্তুতভাব কাটাতে সে তাড়াতাড়ি বলল,
– …কিন্তু আর দেরি করবেন না, তাড়াতাড়ি যান। আপনার মা তো ওইখানেই মানে ওই বর্ষা সংঘ ক্লাবেই থাকবেন ঠিক করেছেন…
– সে কী?
– তাই তো। ওকে রাখার ব্যাপারে ক্লাবের ছেলেদের খুব উসাহ। ওরাই টিভির লোক ডেকে খবর করতে চলেছে আপনার মাকে নিয়ে। শিগগির যান। আপনি থাকেন কোথায়?
– প্রতাপাদিত্য রোড… সামনে… ওই তো ব্রিজ পেরিয়ে বাঁ-দিকের রাস্তা…
– ঠিক আছে। আপনি এখন পা চালান…
যুবক হন্তদন্ত হয়ে দৌড় লাগাল।

Nandini is coming 1
নন্দিনী কোনও মনের ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেত আবার। অলঙ্করণ: শুভ্র বিশ্বাস

সামনে দিয়ে একটা ট্রাম চলে যেতেই রঞ্জনের মোবাইল বেজে উঠল। অচেনা নম্বর।
– হ্যালো…হ্যালো কে?
খুব হালকা আওয়াজ আসছে। মোবাইলের ভল্যুম বাড়িয়ে রঞ্জন আবার বলল,
– হ্যালো কে?
– হ্যাঁ আমি রঞ্জন, রঞ্জন মজুমদার বলছি। আপনি কে?
বাইরের আওয়াজ ঢেকে দিচ্ছে ওপারের কণ্ঠ। রঞ্জন দু’পা এগিয়ে গাড়ির পেছনের সিটে বসল। জুতো জোড়া নিয়ে লছমনও হাজির।

অতএব গাড়ির পেছনের সিটের দৃশ্যটা এইরকম– রাস্তার দিকের বন্ধ দরজায় হেলান দিয়ে ট্রাফিক সার্জেন্ট চিলড বিয়ার পান করে চলেছেন। ওর গায়ে হেলান দিয়ে রঞ্জন। ডেক চেয়ারে শোবার ভঙ্গিতে চটি পরা পা দুটো ফুটপাতের দিকের খোলা দরজায় মেলে ধরেছে। লছমন খুব সন্তর্পণে চটি ছাড়িয়ে জুতো পরাচ্ছে। তার ইচ্ছে দু’পাটি পরাবার পর, নরম কাপড় দিয়ে আরেকবার বুলোবে। যাকে বলে ফাইনাল টাচ।

এমনই প্রেক্ষাপটে রঞ্জনের সংলাপ শোনা যাচ্ছে। শুধু রঞ্জন নয়, স্পিকার চালু হবার কারণেই হোক অথবা ভল্যুম পূর্ণমাত্রায় করবার জন্যই হোক, শোনা যাচ্ছে ওপারের কণ্ঠটিও।
– হ্যাঁ, বলুন বলুন আপনি কে? নারীকণ্ঠ।
– বললাম তো আমি রঞ্জন। রঞ্জন মজুমদার…
– কিরে রঞ্জু, কেমন আছিস?
ওর ডাকনামটাও জানেন ভদ্রমহিলা!
– রঞ্জু… চিনতে পারলি না তো? হা-হা…আমি নন্দু…নন্দিনী…নন্দিনী রায়চৌধুরী। 

লছমন গাড়ি সামলাচ্ছে। ও উত্তর থেকে দক্ষিণ যাবার জন্য হাত দেখাতেই তামাকের গন্ধ পেল রঞ্জন। ডাইনে বাঁয়ে মাথা ঘোরাতে কাউকে দেখা গেল না। অতএব এর উৎস পূর্ব দিকে, অর্থাৎ তার পেছনে। হুট করে মাথা না ঘুরিয়ে পার্স বের করে সামনে ধরল। মানি ব্যাগের ভেতরে একটা ছোট আয়না লাগানো আছে। চুল আঁচড়ানোর কাজে লাগে। তা দিয়ে খুব সহজেই দেখা গেল। তিরিশের চৌকাঠে পা দেওয়া এক যুবক ফুটপাতের ভুট্টাওলার সঙ্গে কথা বলছে। নীল শার্ট, কালো ট্রাউজার্স। হাতে সিগারেট। 

রঞ্জনের কথা আটকে গেল। এত বছর পর নন্দিনী ফোন করছে! কিন্তু কতক্ষণ আর আটকাবে। খালি জলের পাইপে প্রথম খেপের জল আসতে যা দেরি। এসে গেলে তা শব্দ করতে-করতে বেরোয়।
– আরে নন্দু ডার্লিং! কেমন আছিস রে তুই। কতদিন যে তোকে দেখিনি। সেই টুনা স্যান্ডুউইচ। কতদিন খাইনি। রবিবারের কচুরিও নয়। আয় না রে একদিন–
– তুই এখন কোথায়?
– এখন… এখন… ।
চারপাশটা একবার দেখে নিল রঞ্জন।
– এই তো প্রিন্স রহিমুদ্দিন লেনের উলটো দিকে যে বটগাছ, তিনটে ঝুরি নেমেছে… তার তলায়…
– আহা! কী সুন্দর ডিরেকশন! বটগাছ তিনটে ঝুরি–
– কেন প্রিন্স রহিমুদ্দিন লেন বলিনি? গুগল ম্যাপ খুলে দেখ, পেয়ে যাবি।
– আরে ইডিয়ট, আরও দু’ একটা ল্যান্ডমার্ক বল…
– এখানে লছমন দোসাদ বলে একজন আছে, ভালো পালিশ করে, সেও নামকরা–
– ও মশাই বলে দিন না টালিগঞ্জ ফাঁড়ির সামনে। ভদ্রমহিলা আসতে চাইছেন আর আপনি তখন থেকে হলুদ সিগন্যাল দিয়ে খেলিয়ে চলেছেন। এইবার গ্রিন দিন, না হলে ট্রাফিক জ্যাম হয়ে যাবে যে…
ওপার থেকে ভেসে এল,
– এ মক্কেল আবার কে? দাঁড়কাকের মতো গলা…

রঞ্জন হেসে ফেলল।
– নারে ভদ্রলোক ভালো। নো পার্কিং জোনে আমাকে প্রায় আধঘণ্টা দাঁড়াতে দিয়েছেন। এখন আমার গাড়িতে বসে একটু জিরোচ্ছেন। কাজের যা ধকল। ওনার নাম…
এইরে! নামটা তো জানা হয়নি। দ্রুত ঘাড় ঘোরাল।
– শুভঙ্কর সেন…
নামটা বলেই সার্জেন্ট সাহেব বড়সড় ঢেকুর তুললেন। বাতাসে বিয়ারের গন্ধ ভাসতে থাকল। 

– শুনলি তো?
– হুম। তোর সেই গাড়িটাই আছে। ফোর ফোর এইট ফোর?… না নতুন কোনও মডেল? ফোন নম্বর তো পালটে গেছে…
– না না সেইটাই।
– শোন তুই অপেক্ষা কর, আমি আসছি। কোথাও যাবি না।
– কেন?
– সুনীল তলাপাত্র ওসি সাইবার সেল, আমায় সব বলেছেন। তুই তো ঝামেলায় পড়েছিস। ক্রিমিনাল কেসে ফেঁসে যাবি। উনিই তো তোর এই নতুন নাম্বার দিলেন।
– হুম… হ্যাঁ, আজ সকালের কাজটা হয়ে গেছে। অপেক্ষা করছি বিকেলেরটার জন্য।
– তুই কোত্থাও যাবি না… আমি না পৌঁছনো পর্যন্ত ওয়েট কর ওইখানেই। আমি আসছি…

রঞ্জনের কথা আটকে গেল। এত বছর পর নন্দিনী ফোন করছে! কিন্তু কতক্ষণ আর আটকাবে। খালি জলের পাইপে প্রথম খেপের জল আসতে যা দেরি। এসে গেলে তা শব্দ করতে-করতে বেরোয়। – আরে নন্দু ডার্লিং! কেমন আছিস রে তুই। কতদিন যে তোকে দেখিনি। সেই টুনা স্যান্ডুউইচ। কতদিন খাইনি। রবিবারের কচুরিও নয়। আয় না রে একদিন

রঞ্জন নিশ্চিন্তে গাড়ি থেকে নামল। ডিকি থেকে আরও দুটো বিয়ারের ক্যান বের করে সার্জেন্টকে দিল।
– নিন। পকেটে ভরে ফেলুন। কাজ সেরে বাড়ি ফেরবার পথে বাদাম-বাদাম করে মেরে দেবেন… 
সার্জেন্ট গাড়ি থেকে নামলেন।
– স্যার আপনি খুব ভালো মানুষ। আপনার বান্ধবীকে নিয়ে একদিন আমাদের বাড়ি আসবেন। উনি না আসা পর্যন্ত এখানেই গাড়ি থাক। লছমনকে বলে দিচ্ছি ও আপনার জন্য চা-টা এনে দেবে।
এইজন্যই কলকাতাকে এত ভালো লাগে। এখানে পুলিশ পর্যন্ত প্রেমিকের পাশে দাঁড়ায়। ছোটখাট বেনিয়মে ছাড় দেয়।

আলো আরও কমেছে, তবু কী মোহময় এই আকাশ। হালকা সোনালির সঙ্গে কমলা রঙ মিশে যেন গুয়াশ পদ্ধতিতে আঁকা ছবি! অনচ্ছ এই জলরঙের ছবি কী মানুষ আঁকতে পারে? হয়তো পারতেন অবনীন্দ্রনাথ। এবং অবশ্যই গগনেন্দ্রনাথ। এই মায়াবি আলোয় সব কেমন গঙ্গা-যমুনা মিশে গেল! ছেলে মার সন্ধান পেল, লছমন তার পালিশের লক্ষ্যপূরণ করল। আবার একদিনের জন্য ট্রাফিক পুলিশ সেজে তার কী আনন্দ! চিকুদার সঙ্গে অনিমার ঘনিষ্ঠতা নিশ্চয় আরও বাড়বে, সার্জেন্ট সাহেব কাজের মধ্যে এক চিলতে ফুর্তির ফাঁক পেয়ে গেলেন। নন্দিনী খুঁজে পেল রঞ্জনকে। এখন একটাই কাজ বাকি।

গাড়ির মধ্যেই জামা খুলে ভেতরের জ্যাকেটটা শরীর থেকে ছাড়িয়ে নিল। এ হিরোইন আরডিএক্স যাই হোক রঞ্জনের কিছু এসে যায় না। ডিকিতে রাখা পুরনো খবরের কাগজে জড়িয়ে নিতেই বেশ নির্দোষ দেখাল প্যাকেটটা। কলকাতার মস্ত সুবিধা, ময়লা ফেলার একটা আদিগঙ্গা আছে। তা স্থানে-স্থানে নির্জন। এবং তা কাছেই। হাঁটতে হাঁটতে ওইখানে গিয়ে আড়াল করে এই পাপের মাল বিসর্জন দেওয়া খুবই সহজ। আদিগঙ্গার পারে দাঁড়িয়ে মনে হল, কাজটা এতটাই সহজ, রাম-শ্যাম-যদু-পাঁচু যে কেউই করতে পারে। তাহলে আর সে রঞ্জন কেন? অতএব, কিনারা থেকে ফিরে আসতে হল। ফেরার পথে লছমনের হাতে প্যাকেটটা ধরিয়ে দিল।
– সাবধানে রেখ, আমার বন্ধু সুনীলবাবু কিছুক্ষণের মধ্যে এসে নিয়ে যাবে…। তারপর টেক্সট পাঠানোই বাকি–

তলাপাত্র সাহেব, আজকে ওরা আমাকে বড় কাজে লাগাচ্ছিল। এখনও পারেনি। সাদা গুঁড়োভরা একটা প্যাকেট দিয়েছিল, যা লছমনের কাছে রেখে যাচ্ছি। যে দিয়েছিল তার ছবিও পাঠালাম। বাড়ির ঠিকানা বুঝতে পারিনি, তবে রহিমুদ্দিন লেন, নিশ্চিত। লছমনকে খুঁজে পাওয়া অসুবিধা হবে না। টালিগঞ্জ ফাঁড়ির পাশেই বসে। না পেলে ফাঁড়ির কাছে যে ট্রাফিক সার্জেন্ট আছেন আজ, শুভঙ্কর সেন, ওর থেকে জেনে নেবেন…। 

কিছুক্ষণ পর, আবার দ্বিতীয় মেসেজ– আর হ্যাঁ, সম্ভব হলে লছমনকে সাহসিকতার পুরস্কার দেবার ব্যবস্থা করবেন। সম্মান পেলে এইসব মানুষ অনেক কিছু করতে পারে। 

ব্যস, এইবার মন ঠাণ্ডা। আর কোনও চিন্তা নেই। নন্দিনী আসছে। সমস্ত লাল আলো সবুজ করতে-করতে নন্দিনী এগিয়ে আসছে রঞ্জনের দিকে। মস্তিষ্কের ওয়েভলেন্থও যেন বদলে গেছে। রঞ্জন নিশ্চিন্ত হয়ে গাড়ি স্টার্ট করল। সে যাবে উত্তরে– শ্যামবাজার। নন্দিনী যে আসছে? চলুক, নন্দিনীর সঙ্গে কিছুক্ষণ লুকোচুরি খেলা চলুক। গাড়ির আওয়াজ শুনে লছমন ছুটে এল।
– স্যার আপকা তো ঠ্যাহরনা থা…
অ্যাক্সিলারেটারে চাপ দিল রঞ্জন। লছমনের দিকে তাকিয়ে হাত নাড়ল, টা টা… ।         (সমাপ্ত)

প্রাবন্ধিক ঔপন্যাসিক অশোককুমার মুখোপাধ্যায়ের ঝোঁক বিভিন্ন বিষয়ের প্রতি। তাঁর তিনটি তথ্য-উপন্যাস-- অগ্নিপুরুষ, আটটা-ন’টার সূর্য এবং অবিরাম জ্বরের রূপকথা--তিনটি বিভিন্ন সময় নিয়ে। প্রবন্ধের জন্য দু’বার পেয়েছেন আনন্দ-স্নোসেম পুরস্কার। শেষোক্ত উপন্যাসটি ইংরেজিতে অনূদিত হয়ে নামী পুরস্কারের বিচার তালিকায় স্থান পেয়েছিল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *