*আগের পর্বের লিংক: [] [] []

এই রাস্তায় বাড়িঘর প্রায় নেই। দোকানঘর রয়েছে কিছু। কিন্তু তাদের মধ্যে ব্যবধান অনেক। মসৃণ রাস্তা এক দৌড়ে সোজা একশো মিটার দূরের দেবদারু গাছটাকে ছুঁয়ে ডানদিকে বাঁক নিয়ে উধাও। বাঁকের মুখ থেকেই বিকেলের আলো নেবাতে-নেবাতে এগিয়ে আসছে সন্ধে।

এতক্ষণে রঞ্জনের খেয়াল হল, এ তো সৈয়দ আমির আলি অ্যাভিনিউ নয়! তবে এ কোথায় এসে গেল? চট করে বোঝা গেল না, কোন অঞ্চল। উলটোদিকে পান-সিগারেটের দোকান। আলো জ্বলছে। সাধারণত, পানের দোকানে সাইনবোর্ড থাকে না। কিন্তু এ দোকানে আছে– দিলীপ’স পান শপ। বোর্ডের তলায় সিগারেট কোম্পানির নাম। এই ধরনের ভিনাইল বোর্ড ওরাই বানিয়ে দেয়। ভেতরে লাইট থাকে। রাত্তিরে বেশ ঝলমল করে। দোকানে কোল্ড ড্রিংকস আছে। বোতলে ভরা শুদ্ধ জলও! কিন্তু সাইনবোর্ডে রাস্তার নাম লেখা নেই। রাস্তার বাঁ-দিকে গাড়ি দাঁড় করিয়ে, দু’দিক ভালো করে দেখে তবে রাস্তা পেরতে হবে। সন্ধের মুখে আচমকা মোটরবাইক এসে পড়লে চাপ আছে।

দোকানের সামনে যেতেই লোকটি ভুরু তুলল,
– হ্যাঁ বলুন?
– কোলড ড্রিংকস…
একগাদা নাম বলে গেল দোকানদার।
– অরেঞ্জ কি লেমন, যে কোনও একটা… ঠান্ডা নয় কিন্তু…
চোঁ-চোঁ অর্ধেক বোতল শেষ করে ফেলল রঞ্জন। তারপর বোতলটা খালি বোতলের ট্রে-তে রেখে খুব কায়দা করে একটা সিগারেট ধরাল। প্রথম ধোঁয়াটা ছেড়েই–
— এই রাস্তাটা কতদূর…
– সোজা বাসন্তী… যাবেন নাকি? সোজা চলে যান…
অর্থা রঞ্জন আমির আলি অ্যাভিনিউয়ের বদলে এসে গেছে বাসন্তী হাইওয়ে! এই নিয়ে পঞ্চমবার হল।

কী যে হচ্ছে! মাস তিনেক হল এই ব্যারাম শুরু হয়েছে। প্রথমবার তো যাবার কথা ছিল বাগবাজার, চলে গেল চিড়িয়ামোড়। তখন ভেবেছিল, অন্যমনস্ক থাকায় বাগবাজার পেরিয়ে গেছে। কিন্তু দ্বিতীয়বার তো যাবার কথা ছিল ভবানীপুর, কী করে বারাসাত চলে গেল! তৃতীয়বার রাজাবাজার যেতে মৌলালি! তারপর, সেলস কনফারেন্সে বাংলাদেশে গিয়ে তো কেলেংকারি। তিনদিনের মিটিং, মাঝে একদিন ছুটি। শুক্রবার। ভেবেছিল দুপুরবেলায় যাবে নাজিরাবাজার– হাজি-র বিরিয়ানি খেতে। কিন্তু, আশ্চর্য! ভাড়া গাড়ির ড্রাইভারকে বলবার সময় মুখ দিয়ে বেরুল- মুন্সিগঞ্জ…। কেন হল? ওর মাথায় কি ঘুরছিল– ‘হাট বসেছে শুক্রবারে, মুন্সীগঞ্জে পদ্মাপারে।’ তবে আনমনে গিয়ে পড়লেও, সেবার আশ মিটিয়ে ইলিশ মাছ ভাজা খাওয়া গিয়েছিল। ইলিশের ডিমও। শুধু মাছভাত। অপূর্ব খাওয়া।

 

আরও পড়ুন: অমর মিত্রের উপন্যাস: কাকলি গানের বাড়ি

 

তিন বছর আগের ঘটনা হলেও এখনও পদ্মাপারের দোকানটির নাম মনে আছে। বটগাছের তলায় দাঁড়িয়ে এখনও স্পষ্ট– আল মদিনা হোটেল। সাইনবোর্ডের মাথায় ছোট অক্ষরে লেখা, বিসমিল্লাহির রাহমান-ই-রহিম। নীচে ঠিকানা– রানিগাঁও, শিমুলিয়া পরিবহন টার্মিনাল, ভিআইপি ফেরিঘাট, লৌহজং, মুন্সিগঞ্জ। — ভাত এক প্লেট ১৫ টাকা… মুরগ পোলাও এক প্লেট ১৫০ টাকা, ইলিশ ভর্তা এক পিছ্‌ ৩০ টাকা, ইলিশ মাছ ভাজা এক পিছ্‌ ৮০/১২০ টাকা, ইলিশ ডিম এক পিছ্‌ ১০০/১৫০/২০০ টাকা, সরিষা ইলিশ এক পিছ্‌ ১০০ টাকা… নদীর পাঙ্গাস এক পিছ্‌ ২২০ টাকা, চাষের পাঙ্গাস এক পিছ্‌ ৭০ টাকা… 

পাঙ্গাসের দাম মনে আসতে সেদিন যে উপমা ভেবেছিল, আজও তাই মনে এল। নদীর পাঙ্গাস হল জাত সেলসম্যান আর চাষের মাছ হল গুঁতিয়ে-ককিয়ে জাতে তোলা বেচুবাবু! এইজন্যেই জাত সেলসম্যানের দাম চাষের ফলনের থেকে তিনগুণ বেশি। 

আগের ঘটনা ঠিকঠিক মনে পড়লেও আবার কী করে রাস্তা ভুল হল! বাসন্তী হাইওয়েতে সন্ধে নেমে গেছে। দ্রুত সিগারেটের শেষটান দিয়ে গাড়ির মুখ ঘুরিয়ে সোজা নিউটাউন। ল্যাপটপে টাইপ করতে করতে নন্দিনী বলল,
– আজকাল নিশ্চয় অন্যমনস্ক থাকছিস। এত ভাববার কিছু নেই। ইচ্ছে হলে একটা মেডিসিনের কোনও ডাক্তার দেখিয়ে নে। অনেক সময় লিভারে প্রবলেম থেকে মেমারি গণ্ডগোল হয়…

নন্দিনী তেমন কিছু পাত্তা দিল না। রঞ্জনের খারাপ লাগল। ওর উচিত ছিল ব্যাপারটা গুরুত্ব দিয়ে ভাবা। এক আধবার তো নয়, পাঁচ-পাঁচবার এমন হল। হ্যাঁ, এ কথা ঠিক যে কাজের চাপে আজকাল রঞ্জন হঠা হঠা অন্যমনস্ক হয়ে যায়। কিন্তু তাই বলে পাঁচবার! তবু নন্দিনীর কথামতো মেডিসিনের ডাক্তার দেখানো হল। হাজার রকম পরীক্ষা! অস্বাভাবিক কিছু পাওয়া গেল না। লিভার তো একেবারে চাঙ্গা। ডাক্তার বললেন,
– একমাত্র ওষুধ সতর্ক থাকা…
আবার একদিন ভুল। যাবার কথা লেকটাউন, চলে গেল লেক গার্ডেনস!

 

আরও পড়ুন: মালিপাখির কলমে শিশুতোষ ছড়া: যেই এঁকেছি

 

রঞ্জন সতর্ক ছিল। বেরবার সময় কতবার যে মনে মনে লেকটাউন-লেকটাউন বলেছে তার ঠিক নেই। তা হলে কী করে হল এমন? ভাবতে গিয়ে মনে পড়ল, পার্ক স্ট্রিট থেকে পরমা আইল্যান্ড অবধি ঠিক গিয়েছিল, তারপর বাঁ দিকের জায়গায় ডানদিক ঘুরে সোজা চলে এসেছে লেক গার্ডেনস। ভাবতে গিয়ে এও মনে হল, যখন কোনও চেনা জায়গায় যাওয়া হয়, ভেতরের কেউ তো গুগল ম্যাপের মতো রাস্তা দেখায়– এইবার বাঁ দিক নাও, দু‘শো মিটার সোজা গিয়ে ডান দিক…
এমন তো নয় রঞ্জনের খুলির মধ্যের ওই চালকটি গন্ডগোল করছে? সে-ই সব দিক-দিশা ঘেঁটে দিচ্ছে?

ক’দিন সতর্ক থাকতেই ধরে ফেলল রঞ্জন। যাবার কথা ছিল পার্ক সার্কাস। কিন্তু কেউ যেন অনবরত ওর কানের কাছে ফিসফিস করছে। সোজা-সোজা। একশো মিটার গিয়ে বাঁয়ে। ওই দিকে গেলে তো ধর্মতলায় চলে যাবে! রাস্তায় বেরলেই ফিসফিসানি বাড়ে। কেউ যেন ওকে চালাচ্ছে! 

এইবার নন্দিনী বুঝল। সব শুনে রঞ্জনকে আপাদমস্তক দেখে নিল। মাথা নাড়ল দু’বার। কাকে যেন ফোন করল। তারপর আবার মাথা নেড়ে বলল,
– ঠিক হয়ে গেছে, পরশু তোকে নিয়ে যাব–’

নেমপ্লেট দেখেই বোঝা গেল ডাক্তার দেবব্রত সাহা মনোরোগের চিকিসক। তার কি মনের অসুখ হয়েছে নাকি! খুব রাগ হল নন্দিনীর ওপর– সাংবাদিকদের নিয়ে এই এক সমস্যা, নিজেদের সবজান্তা ভাবে, সব কিছুর হিসাব দিয়ে দেবে। আর কোনও কিছু হিসাবে না মিললেই সাইকিয়াট্রিক প্রবলেম।
– এখানে আনলি কেন? আমার কি… 
ঠোঁটের ওপর আঙুল তুলে চুপ করতে বলল নন্দিনী,
– একটু ধৈর্য ধর, সব ঠিক হয়ে যাবে… 

একটা ছেলে, বছর চব্বিশ-পঁচিশ, ডাক্তারবাবুর ঘর থেকে বেরতেই ওদের ডাক পড়ল। ডাক্তার ভদ্রলোক পেঁপেসেদ্ধর মতো ফর্সা, বেঁটেখাট, গোলগাল। নন্দিনীর দিকে তাকিয়ে বলতে শুরু করলেন,
– বুঝলেন, হেঁচকি ওঠা থামালাম।
এমনভাবে কথাটা বললেন, যেন এই কাজের জন্য ওঁর নোবেল প্রাইজ পাওয়া উচি। গল্পটা এইরকম– যে ছেলেটা নন্দিনীরা ঢোকবার আগেই ডাক্তারের ঘর থেকে বেরিয়ে গেল, মোহাম্মদ ইয়াসিন, বাংলাদেশের পশ্চিম নাখালপাড়ার বাসিন্দা। গত কয়েকমাস ধরে তার লাগাতার হেঁচকি উঠছিল। মিনিটে ষাট-সত্তরবার। সকলে স্নায়ুরোগ ভেবে চিকিসা করছিল বলে কাজ হচ্ছিল না। এটা একশোভাগ মানসিক সমস্যা। ডাক্তার সাহা ওকে সারিয়ে তুলেছেন।

নন্দিনী তেমন কিছু পাত্তা দিল না। রঞ্জনের খারাপ লাগল। ওর উচিত ছিল ব্যাপারটা গুরুত্ব দিয়ে ভাবা। এক আধবার তো নয়, পাঁচ-পাঁচবার এমন হল। হ্যাঁ, এ কথা ঠিক যে কাজের চাপে আজকাল রঞ্জন হঠা হঠা অন্যমনস্ক হয়ে যায়। কিন্তু তাই বলে পাঁচবার! তবু নন্দিনীর কথামতো মেডিসিনের ডাক্তার দেখানো হল। হাজার রকম পরীক্ষা! অস্বাভাবিক কিছু পাওয়া গেল না।

– তিনমাসের জন্য ভর্তি হওয়ার কথা বলি। আগের সব ওষুধ বন্ধ করে সাতদিন পর নতুন ওষুধ চালু করি। বোঝাতে থাকি হেঁচকির সঙ্গে শরীরের কোনও সম্পর্ক নেই। আড়াই মাসের মতো চিকিসা হয়েছে। এখন নব্বইভাগ সেরে গেছে। শুধু দুপুরে আর রাতে খাওয়ার সময় হেঁচকি ওঠে। ওইটাও আস্তে-আস্তে চলে যাবে…

ডাক্তার বললেও তার সমস্যা যে মানসিক, কিছুতেই মানতে পারছিল না রঞ্জন। নন্দিনীর উচিত ছিল আরও মন দিয়ে সমস্যাটা বোঝা। তা না করে ও একটা সহজ রাস্তা বেছে নিল– মনের ডাক্তার। ফুঃ! এইসব ওষুধ খেলে ঘুম পায় খুব। সজাগভাব নষ্ট হয়। এইভাবে সেলস-এর কাজ করা যায় নাকি! ওষুধ বন্ধ করে ভেতরে ভেতরে সজাগ হতে শুরু করল রঞ্জন। তাছাড়া মনের কোন অংশ থেকে যে ভুলভাল ফিসফিসানি আসছে, তাও তো সজাগ থেকে ধরা দরকার। সেইদিনই ঠিক করেছিল, নন্দিনী নয়, ডাক্তার সাহা নয়, সে নিজেই নিজেকে ঠিক করবে।

– রেহনে কা জা’গা মিল গয়া সাব…
সেই পালিশওলা। মুখের পেশিগুলি পর্যন্ত আনন্দে নাচানাচি করছে!
এতক্ষণে রঞ্জনের খেয়াল হল, লোকটার নামটাই তো জানা হয়নি।
– আরে তু নে তো কমাল কর দিয়া… তেরা নাম কেয়া হ্যায়?
– লছমন দোসাদ…
– তুমি আমার নামও জিজ্ঞেস করনি…
মুখ ঘোরাতেই ভদ্রমহিলা। বটগাছের ঝুরির তলায়। মুখে বিকেলের আলো।
– আমার নাম সুহাসিনী। সুহাসিনী হালদার।
প্রৌঢ়ার গলায় কৌতুক।
– দেখেছ, তুমিই চিন্তা করছিলে… কেমন ব্যবস্থা হয়ে গেল!

 

আরও পড়ুন: অনিতা অগ্নিহোত্রীর কলাম: লিখতে লিখতে অথৈ দূর

 

রঞ্জন গ্রাহ্য করল না। মনে মনে গুছিয়ে নিল সব। সুহাসিনী হালদার বলছেন, তাঁর ছেলে-বউ এই বাসস্টপের শেডের চেয়ারে তাঁকে বসিয়ে সিনেমা দেখতে গেছে, কাছেপিঠেই কোথাও। বলেছে তারপরে নিয়ে যাবে।
– আচ্ছা আপনার মনে হচ্ছে কেন, ছেলে আর আসবে না?
– কাগজে মাঝে-মাঝে খবর বেরোয় দেখ না, ছেলে হাওড়া স্টেশনে ছেড়ে দিয়ে পালিয়েছে কিংবা মেয়ে মায়ের সব সম্পত্তি হাতিয়ে নেবার পর দুর্গাপুর কিংবা আসানসোলের কোনও থানার সামনে ফেলে চম্পট…
এমনভাবে বললেন ভদ্রমহিলা, এ-সব যেন রোজকারের ঘটনা। উনি স্বাভাবিক গলায় বললেও রঞ্জনের অস্বস্তি হচ্ছিল। সে কোনওরকমে বলল,
– আপনার ছেলের ভুলে যাওয়ার অসুখ নেই তো?
– না না ছেলে মাকে ছেড়ে পালাতে পারে, ভুলবে কেমন করে?
সপ্রতিভ, শান্ত মুখ। যেন পিথাগোরাসের থিয়োরেম বলছেন!

প্রাবন্ধিক ঔপন্যাসিক অশোককুমার মুখোপাধ্যায়ের ঝোঁক বিভিন্ন বিষয়ের প্রতি। তাঁর তিনটি তথ্য-উপন্যাস-- অগ্নিপুরুষ, আটটা-ন’টার সূর্য এবং অবিরাম জ্বরের রূপকথা--তিনটি বিভিন্ন সময় নিয়ে। প্রবন্ধের জন্য দু’বার পেয়েছেন আনন্দ-স্নোসেম পুরস্কার। শেষোক্ত উপন্যাসটি ইংরেজিতে অনূদিত হয়ে নামী পুরস্কারের বিচার তালিকায় স্থান পেয়েছিল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *