ইতিহাসের সঙ্গে করমর্দন হচ্ছে ইতিহাসের অথবা হতে চলেছে। সেই করমর্দনের সাক্ষ্য গ্রহণ করার কথা আমাদের। সময়টা ১৯২০ সাল। ভারতবর্ষের মাটিতে একই সময় দাঁড়িয়ে আছেন মহাত্মা গান্ধী, আছের ছত্রপতি সাহু, আবার যুবা বয়সের আম্বেদকরও। আগের পর্বে, ঠিক সেই ১৯২০ সালে আমাদের দেখা হয়েছে তাঁদের সঙ্গে। দেখা হয়েছে ১৮৯৭ সালের বম্বেতে সাবিত্রী বাঈয়ের সঙ্গেও – প্লেগে আক্রান্ত অসুস্থ শিশুকে কোলে নিয়ে ছুটছেন সাবিত্রীবাঈ।
হ্যাঁ, তখনও ছিলেন, আমাদের খুব কাছের সাবিত্রীবাঈ। আর মাত্র কয়েকদিনই থাকবেন তিনি পৃথিবীর মাটিতে, সেই ইঙ্গিতও আমরা দিয়েছি।
১৮৯৭ সালের সেই ইতিহাসে ছিল অতিমারির ক্ষত। আরও এক ক্ষত বহন করছিল ভারতবর্ষ– ১৮৯৭ সালে, ১৯২০ সালেও। এমন এক ক্ষত যা আজও সমান ভাবে জীবন্ত, অনেকটা অতিমারির মতেই। সে ক্ষত অস্পৃশ্যতার, সে ক্ষত জাতবিভক্তি, ‘জাতের নামে বজ্জাতি’র চিহ্ন- স্বাধীনতার ৭৫ বছর পরেও আমাদের সর্বাঙ্গে, এপার বাংলা ওপার বাংলার কাঁটাতারে, দেশভাগের আর দাঙ্গার দগদগে স্মৃতি।
কিন্তু জাতপাত যা, অস্পৃশ্যতাও কি তাই? আমরা যেভাবে সমার্থে ব্যবহার করি দুই শব্দকে, তারা কি জন্মলগ্ন থেকেই পরস্পর সম্পৃক্ত, নাকি একে অপরের অনুসারী?
১৯২০ সালে কংগ্রেসের মানাগাঁও সম্মেলনে আম্বেদকরের সঙ্গে সাহুজি
এ প্রশ্নের উত্তর দিতে এগিয়ে আসবেন আম্বেদকর। তিনি বলবেন, বর্ণাশ্রম বৈদিক ভারতের সত্য। কিন্তু অস্পৃশ্যতা নয়। অস্পৃশ্যতা আসবে অনেক পরে, ব্রাহ্মণ্যবাদের হাত ধরে। বৈদিক কথনে ‘পুরুষাশুক্তা’ বলে ব্রহ্মার মস্তক থেকে জন্ম ব্রাহ্মণদের, বাহু থেকে ক্ষত্রিয়দের, ঊরু থেকে বৈশ্যদের এবং পা থেকে শূদ্রদের। এই কথনও কম অপমানের ইঙ্গিত বহন করে না। কিন্তু অস্পৃশ্যতার দিকে দিকনির্দেশ করে কি? আম্বেদকর, যুবা বয়সের আম্বেদকরের উত্তর ছিল নঞর্থক। বর্ণাশ্রম অনেক প্রাচীনতর ক্ষত, অস্পৃশ্যতা সেই ক্ষতকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা পরবর্তীকালের অভ্যাস।
এই অভ্যেসই চোখে পড়ে ছত্রপতির। সময়টা সেই ১৯২০ নাগাদ। রাজা ছত্রপতি, মহামতি আকবরের মতোই পরিদর্শন করতেন রাজ্য। নিজের তৈরি ছত্রপতি স্পিনিং উইলস্, রত্নগিরি জলাধার, জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র, অব্রাহ্মণ সংস্কৃত শিক্ষকদের টোল সবই দেখেন তিনি, আড়াল থেকে। বেশ ভালই চলছে স্পিনিং উইলস্ এখন। রত্নগিরি জলাধারের কাজও শুরু হয়েছে ১৫ বছর হল। অব্রাহ্মণ সংস্কৃত পণ্ডিতদেরও কিছুটা হলেও মেনে নিয়েছে মানুষ।
কিন্তু কোলাপুরের গ্রামের ভেতর যখনই পরিদর্শনে যান, তখনই অপ্রীতিকর এক দৃশ্যের সম্মুখীন হতে হয় তাঁকে। পানীয় জলের সমস্যা কোলাপুরের বহুদিনের, তার জন্যই তো রত্নগিরি জলাধার তৈরির কাজ করাচ্ছেন তিনি। তা সত্ত্বেও পানীয় জল অকুলান। আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন ছত্রপতি এই সমস্যা সমাধানের। এর মধ্যে কোলাপুরের গ্রামে গ্রামে দেখতে পান সেই একই দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি। পানীয় জলের জন্য গ্রামের বাইরে, অনেক দূরে কলসি কাঁখে হেঁটে যাচ্ছে দলিত মেয়েটি। কখনও সে একা, কখনও সঙ্গে পিপাসু সন্তান, কখনও আরও কিছু জলভরার বাসন মাথায় নিয়ে শিশু কন্যা।
গ্রামের একমাত্র ইঁদারার জলে একবিন্দুও অধিকার নেই তাদের। প্রথমে ব্রাহ্মণদের অগ্রাধিকার সেই জলে, তারপর একে একে ক্ষত্রিয়, বৈশ্য। সবাই জল নেওয়ার পর তলায় পড়ে থাকে কাদাজল। তবু সেটুকুও নিতে যেতে পারে না দলিত পরিবার, কারণ তাদের ছায়াও যে অস্পৃশ্য! সূর্য ঢলে পড়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয় তাদের, যাতে ছায়াটুকুও অদৃশ্য হয়ে যায়। ততক্ষণে শেষ জলটুকুও শুষে নিয়েছে রোদ্দুর।
অস্পৃশ্যতা-বিরোধী আইন প্রণয়ন করেন সাহুজি
ছত্রপতি যে এ ঘটনা প্রথমবার দেখছেন, তা তো নয়। দলিতদের পড়াশুনো, তাদের বিকল্প অন্নসংস্থান, সব শ্রেণীর ছাত্রছাত্রীদের জন্য আবাস, শিক্ষাশেষে তাদের বৃত্তিমূলক পেশার জন্য প্রয়োজনীয় শিক্ষা, সব ব্যবস্থাই করেছিলেন। ভেবেছিলেন শিক্ষা, কর্মসংস্থান দলিতদের ক্ষমতায়ন করবে, তাদের অত্যাচারিত হওয়া থেকে বাঁচবে। কিন্তু এই অস্পৃশ্যতা থেকে বাঁচবে কী করে? আইন প্রনয়ণ করলেন ছত্রপতি। যেমন তিনি করেছিলেন বিধবা বিবাহের সমর্থনে, এবং বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে। এবার ১৯২০ সালে প্রবর্তন করলেন অস্পৃশ্যতা ও রাজসম্পত্তি সংক্রান্ত আইন– রাজার দ্বারা নির্মিত পুকুর, ইঁদারা, রাস্তা, প্রাঙ্গণ, কোনও জায়গা থেকেই অস্পৃশ্যতার দোহাই দিয়ে কোনও মানুষকে বহিষ্কার করা যাবে না।
শুধু আইন প্রনয়ণ করেই ক্ষান্ত হন না ছত্রপতি, রাজত্বের শক্তি নিয়োগ করেন সেই আইনকে কার্যকর করতে। দেবদাসীদের কথা তো মনেই আছে আমাদের, কীভাবে ছত্রপতি নিজের সৈন্য নিয়োগ করে বজায় রাখতেন দেবদাসী নিয়োগ বিরোধী আইনের যাথার্থ্য। এবারও তার ব্যতিক্রম হল না। দলিতদের সম্মানরক্ষার্থে আরও একবার সম্মুখ সমরে নামলেন ছত্রপতি। এর আগে অব্রাহ্মণের সংস্কৃত পড়াবার সুযোগ করে দিয়েছেন, অব্রাহ্মণ পুরোহিত নিয়োগ করেছেন, জাতিভেদ নির্বিশেষে এক ছাত্রাবাস তৈরি করেছেন। এবার একই জলাধার থেকে জল, একই পথ দিয়ে চলার আইনত অধিকার দিলেন ছত্রপতি।
সময়টা ১৯২০, আগেই বলা হয়েছে। ব্রিটিশ ভারত তখন ভেদাভেদে দীর্ণ। ভারতীয়দের মধ্যে জাতপাতের প্রভেদ, ভারতীয় ও ইংরেজদের মধ্যে শাসক ও শাসিতের প্রভেদ, সাদা ও কালো চামড়ার প্রভেদ। রেলের কামরায়, বিভিন্ন প্রশাসনিক ভবনে ভারতীয় ও ইতরপ্রাণীদের একসঙ্গে প্রবেশ নিষিদ্ধ থাকার অপয়ানের ইতিহাসে, আজও না ভুলে যাওয়া ক্ষত হয়ে জীবন্ত।
এর ঠিক অর্ধশতক পরে, ১৯৭০ সালে আর এক নেতাকে দেখবে ইতিহাস, পৃথিবীর আর এক প্রান্তে। মার্টিন লুথার কিং জুনিয়ার। তিনিও বলবেন প্রায় একই কথা– রোজা পার্কসকে বাসের সিটে বসার অধিকার না দেওয়ার পর যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে চলছে সিভিল রাইটস্ মুভমেন্ট– মার্টিন লুথার কিং জুনিয়ার বলবেন, সকল পাবলিক ইউটিলিটি বা সাধারণ সম্পত্তির উপর কোনও বিশেষ জাত, বর্ণ বা লিঙ্গের অগ্রাধিকার থাকতে পারে না। তা ব্যবহারের অধিকার সকলের, বর্ণবিদ্বেষ নির্বিশেষে।
এর সমরেখার মাঝে ভারতবর্ষের মাটিতে রচিত হবে সংবিধান, ভীমরাও আম্বেদকর লিখবেন আর্টিকল ১৫, যাতে বলা থাকবে জাতি ধর্ম বর্ণ লিঙ্গ ও জন্মস্থানের ভিত্তিতে কোনও ভারতীয় নাগরিককে কোনও সরকারি সম্পত্তি বা সুযোগসুবিধা ব্যবহার করা থেকে বঞ্চিত করা যাবে না। তিনি লিখবেন, আর্টিকেল ১৭, যা বলবে অস্পৃশ্যতা এক দণ্ডনীয় অপরাধ। আর আবারও সাম্যের ইতিহাসের পথিকৃৎ হয়ে, বঞ্চনার অপমানের প্রতিবাদের প্রতীক হয়ে দূর থেকে হাসবেন ছত্রপতি।
ঈশা আদতে অর্থনীতির ছাত্রী, শিক্ষিকা ও সমাজকর্মী। বিধাননগর কলেজের স্নাতক ঈশার পড়াশোনা ও শিক্ষকতার ক্ষেত্র ছুঁয়ে ছুঁয়ে গেছে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, ইউনিভার্সিটি অফ ম্যাসাচুসেটস, আমহের্স্ট। ছোটবেলা কেটেছে পিতামহী শিক্ষাবিদ মৃণালিনী দাশগুপ্তের ছত্রছায়ায়, অনেক গল্প, গল্পের বইদের সঙ্গে। গল্প বলার ছায়ারা পিছু নিয়েছে তখন থেকেই। ছোটবেলার স্মৃতিদের নিয়ে লেখা 'আমার রাজার বাড়ি' প্রথম প্রকাশিত গদ্যগ্রন্থ। প্রকাশিত হয়েছে 'রাই আমাদের' নামে ছোটদের গল্পের বইও। কবিতার বই 'চাঁদের দেশে আগুন নেই' আর 'রোদের বারান্দা' আছে ঈশার ঝুলিতে। কবিতার জন্য কৃত্তিবাস পুরস্কারও পান। বড়দের গল্প লেখেন অল্পস্বল্প- 'দেশ' পত্রিকা সাক্ষী। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখেন গবেষণামূলক লেখা, যার বিষয় মহিলাদের বিভিন্ন সমস্যা ও তার সামাজিক ঐতিহাসিক স্থানাঙ্ক। মহিলাদের প্রতিবাদের ইতিহাস তুলে আনাই এখন মূল লক্ষ্য ঈশার।