আগের পর্বের লিংক: [] [ ২] [] [] [] [] [] [] [ ৯] [১০] [১১] [১২] [১৩][১৪][১৫] [১৬] [১৭] [১৮] [১৯] [২০] [২১]

জুড়ান  লিখল, কী লিখল, “বসির মল্লিক যে বসন্ত মল্লিক নয়, তাহা আমি  অদ্য জানিয়াছি।  ইহার অর্থ  বসির মল্লিক আলাদা কোনও ব্যক্তি যিনি বাংলাদেশ হইতে পলায়ন করিয়া ভারতে আসিয়া লুকাইয়াছেন। আমি হাবড়া মসলন্দপুর  নিবাসী জনৈক ব্যক্তিকে বসির মল্লিক বলিয়া সন্দেহ করিতাম, শুনিতেছি  তা  অমূলক। বসির মল্লিক এবং  বসন্ত মল্লিক এক ব্যক্তি  নহেন মনে হয়, কিন্তু  ইহার অর্থ এই নয় যে বসির  মল্লিক  নাই, আছেন  কিন্তু নাম বদল করিয়া  আছেন। সেই নাম বিজয় হতে পারে, অমল  কমলও হতে পারে, আবার  বসন্তও, কিন্তু  বসন্ত  না হইবার সম্ভাবনা  বেশি…।”  লেখা শেষ  করে  রিভিশন  করে  জুড়ান আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল,  হলো ?

চোখ  বুলিয়ে  আমি  বিরক্ত  হয়ে  বললাম,  না হয়নি, মাথা নাড়লাম, বললাম, এই  কথায় তুমি সন্দেহ জাগিয়ে দিলে।

কেন আমি তো লিখলাম বসন্ত আর বসির এক ব্যক্তি নয়।

তুমি বসির  মল্লিক নিয়ে তোমার ধারনা এখনও ছাড়তে পারনি।

জুড়ান বলল, না পারিনি, নীলমাধবের সঙ্গে বসির মল্লিকের  যোগাযোগ  ছিল, এবং আছে। 

আমি তো তা লিখতে বলিনি, বসির মল্লিক এখানে আসবে কেন?

আসবে কারণ বসির মল্লিকের শাস্তি হোক তা আমি চাই, সে ধরা পড়ুক।

কিন্তু বসির মল্লিক বলে কেউ আছে সত্যি? আমি জিজ্ঞেস করলাম।

আছে, ইউটিউবে একটা ভিডিও আছে,’ বসির এখন  কোথায়, দেখলে বুঝতে পারবে?’ 

সে রাজাকার, না ব্যাঙ্ক লুটেরা ?  

রাজাকার ফ্যামিলি, ব্যাঙ্ক লুটেরা, কোটি কোটি টাকা ঘাপলা করে সুইস ব্যাঙ্কে পাঠিয়েছে। 

বসন্ত  মল্লিককে দেখে মনে হয় তার ফ্যামিলি রাজাকার, সে ব্যাঙ্ক লুট করতে পারে? আর কোটি কোটি  টাকা  যদি  সরিয়ে  থাকে তবে এত গরিব হয়ে ইন্ডিয়ায় থাকবে কেন? আমি বিরক্ত হয়ে  বললাম। 

বাইরে থেকে কিছু  ধরা যায় না  অনুতোষ, চেহারা দেখে তুমি বুঝতে পারবে না, পার্ক  স্ট্রিটে  লুকিয়ে  থাকা  মুজিব  হত্যাকারীকে দেখলেও  বুঝতে পারতে না, বসির  মল্লিক মুজিব হত্যাকারীও  হতে পারে, বসিরও হয়ত তার  আসল নাম  নয়, এরা যে কত রকমে মানুষকে বিভ্রন্ত  করতে পারে, বসির বলে ধরা পড়লে দেখা যাবে, আসলে বসির বলে কারো নামে অভিযোগ  নেই,  সে হতে  পারে  মেজর মইনুদ্দিন।

আমি এত ব্যাখা চাই না, বুঝিও না,  তুমি এখানে বসির, মুজিব হত্যাকারী এসব ভয়ানক কথা লিখবে না।   একটু  রাগ করেই বললাম, এসব কথা লিখতে বলিনি তোমাকে। 

জুড়ান বলল, বলনি, কিন্তু  বসির আর  বসন্ত যে এক নয়, তা লিখতেই  তো বলেছ। তাইই তো লিখলাম। 

 

জুড়ান  খুব বুদ্ধিমান। সে বুদ্ধি দিয়ে আমার সঙ্গে খেলতে চাইছে। তার এক গোঁ, তা থেকে সে সরতে চাইছে  না। আমিও জুড়ানের  কথা মেনে নেব না। বললাম, জুড়ান, আমি কী চাইছি, তা তুমি বুঝেছ  ভাল, কিন্তু নিজের জায়গা থেকে সরে আসছ না। সুতরাং কথা শেষ, এই লেখা আমি চাইনি।

 

কিন্তু টাকাটা আমার দরকার। জুড়ান  বলল। 

 

তাহলে আমার কথা শুনতে হবে।  আমি বললাম। 

 

আমি তো বলেছি তোমার কথাই।

 

চালাকি কোরও না  জুড়ান, যা বলেছি তাই করতে হবে। আমি ক্রুদ্ধ গলায় বললাম। 

 

জুড়ান বিস্ফারিত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে  থাকল। তারপর তার ঘাড়  ঝুলে পড়ল যেন। মাথা নামিয়ে নিল। সে চাইছে না লিখতে। তার বিশ্বাস তা অলীক হলেও তা বিশ্বাসই। সেই বিশ্বাস জন্মেছে নীলমাধবের উপর ক্রোধ  থেকে। ক্রোধের কারণ  আমি এতদিনে বুঝলাম। কিন্তু সেই ক্রোধে একটি সাধারণ পরিবারের উপর কলঙ্ক লেপন  করবে কেন জুড়ান? আমি যা বলছি তা না করলে জুড়ানকে  টাকা আমি দেব না।  জুড়ান মাথা তুলল, আমার দিকে তাকিয়ে চোখ পিটপিট করতে থাকে। আমার মনে হল সে  একবার ভাবল যেন উঠে যায়। উঠতে গিয়েও উঠল না। চুপ করে বসে থাকল। মাথা নামিয়েই আছে। মেনে নিতে পারছে না। একবার বলল, কিংবা বলতে চাইল, টাকাটা খুব দরকার। শর্ত কেন? টাকা সে ফেরত  দেবে। সে কারও কাছে ধার করে না।  করলেও শোধ  দেয়। অনুতোষ  তুমি কি সত্যিই দেবে না ?  দেবে না বলছ। আচ্ছা আমি লিখছি। কাগজ দাও অনুতোষ। আসলে লিপির খুব কষ্ট। সহ্য করতে পারছি না। চিকিৎসায়  খরচ তেমন করতে পারছি না আমি। প্রোটিন দিতে হবে। এক একটা কৌটোর কত  দাম! দাও অনুতোষ নতুন কাগজ দাও, লিখব আবার। 

 

লিখতে গিয়ে চুপ  করে বসে থাকল সে। তারপর এক সময় গালে হাত দিল, মাথার চুল টেনে ধরল।  আমি শ্যামাশ্রীকে নিয়ে লেখাটি আরম্ভ করেছি কয়েকদিন। লিখতে বসে ভাবতে থাকি এমন করে। শুনেছি,  পড়েছি, কবিরা, ভাবুকরা লিখতে বসে এমনিই চুপ করে বসে থাকেন। ভাব না এলে  লিখতে পারেন না। জুড়ান কি কবিতা লিখবে, না গল্প লিখবে যে এমনি ভাবে চুপ করে বসে থেকে ধীরে ধীরে ভাবের ভিতর ডুবে যাবে। জুড়ান লিখতে আরম্ভ করল। লিখে তাকিয়ে থাকল কাগজের দিকে। কী লিখেছে তা পড়তে  থাকল নিজের মনে। তারপর আমার দিকে বাড়িয়ে ধরল।     

 

“বসন্ত মল্লিক পিং শরত মল্লিক নিবাস মসলন্দপুর  অতি সুভদ্র, সচ্চরিত্র এবং  সজ্জন ব্যক্তি…।  আমি তাঁকে বহুদিন যাবত চিনি। বসন্ত ও  আমাদের বাড়ি ওপার বাংলার যশোহর জেলার সাতক্ষীরা সীমান্তে  লবঙ্গ গ্রামে ছিল। আমাদের গ্রামের পাশ দিয়া কপোতাক্ষ নদ বহিয়া গিয়াছে। বসন্ত ভালো কন্ঠশিল্পী ছিল। সতীনাথ  মুখোপাধ্যায়ের  গান গাইত বড় সুন্দর। তখন পূর্ব পাকিস্তানে ভারতীয় আকাশবাণী কলকাতা শোনা যেত। অনুরোধের আসরে বসন্তের লেখা চিঠিতে সতীনাথ মুখোপাধ্যায় এবং উৎপলা সেনের  মাঝে নদী বহেরে, ওপারে তুমি শ্যাম এপারে আমি, শোনান হয়েছিল। তাহার বাবা শরত মল্লিক মশায় হরবোলা ছিলেন। কত রকম পাখির ডাক, জন্তু জানোয়ারের ডাক সেই বৃদ্ধ  বয়সেও শুনাইতে পারিতেন। তাহার কাকা যাত্রায় বিবেকের অভিনয় করত, গান গাইত ছেড়ে দাও রেশমি চুড়ি, বঙ্গ নারী, কভু হাতে আর পোরো না।  চারণ  কবি  মুকুন্দ দাসের  গান। লবঙ্গ গ্রামের মল্লিকরা গানের ঘর ছিল। সকলেই গান নিয়ে  থাকত। উহাদের বাড়ির নাম ছিল কাকলি গানের বাড়ি, কাকলি কে ছিল তাহা জানা যায় না, বসন্তর পিতামহী হতে পারে, প্রপিতামহী হতে পারে,  তিনি নাকি পাখির সুরে সুর মেলাতে পারিতেন, পাখির গান নিজ মুখে তুলিতে পারিতেন। পাখির ডাকই তো কাকলি। তাই  ঐ বাড়ির ঐ রূপ নাম।” 

 

বাহ, দারুণ লিখেছ। আমি অস্ফূট  স্বরে বললাম।

বাইরে থেকে কিছু  ধরা যায় না  অনুতোষ, চেহারা দেখে তুমি বুঝতে পারবে না, পার্ক  স্ট্রিটে  লুকিয়ে  থাকা  মুজিব  হত্যাকারীকে দেখলেও  বুঝতে পারতে না, বসির  মল্লিক মুজিব হত্যাকারীও  হতে পারে, বসিরও হয়ত তার  আসল নাম  নয়, এরা যে কত রকমে মানুষকে বিভ্রন্ত  করতে পারে, বসির বলে ধরা পড়লে দেখা যাবে, আসলে বসির বলে কারো নামে অভিযোগ  নেই,  সে হতে  পারে  মেজর মইনুদ্দিন।

জুড়ান বলল, এবার তাহলে প্রার্থনা মঞ্জুর  হবে ? 

জুড়ানের  হাতের লেখা খুব ভাল। গোটা গোটা অক্ষরে  লিখেছে শংসাপত্রর সমস্তটা। আবার আমি অস্ফুট গলায় বলে উঠলাম, বাহ, কী সুন্দর হাতের লেখা, কী সুন্দর লিখলে। 

তোমার চাপে পড়ে লিখলাম।

চাপে পড়ে বড় সুন্দর লিখেছ, এত ভালো বাংলা লেখ তুমি!

আমি জানি না  অনুতোষ, কী করে হয়ে গেল জানি না। জুড়ান ছলছলে চোখে বলল।

ভাল কথা এমনি ভাবেই লেখা হয় জুড়ান। আমি নরম গলায় বললাম। 

জুড়ান বলল,  তুমি ভুলে গেছ অনুতোষ, মানুষ সব মনে রাখতে চায় না, চা-ওয়ালার ছেলে হস্ত লিখনে ক্লাস ওয়ান টু তে ফার্স্ট, ক্লাস থ্রি থেকে হস্ত লিখন উঠে গেল, শ্রুতলিপি উঠে গেল, সে ঘষটাতে লাগল, তখন আমি কবিতা লিখেছি। 

বুঝতে পারছিলাম বুদ্ধিমান  জুড়ান কাকলি গানের বাড়ি যোগ করে দিয়েছে বসন্ত মল্লিকের জীবনপঞ্জী  লিখতে গিয়ে। এখানেও সে নীলমাধবকে জড়িয়ে দিল। কিন্তু এমন ভাবে জড়াল যে খুঁজে বের করতে হবে।  ঠিক যেন  কবিতা, কবিরা ঈঙ্গিতে কত কথা বলেন। পড়া শেষ করে আমি জুড়ানকে জিজ্ঞেস করেছি, এসব সত্যি ?

কীসব?  জুড়ান জিজ্ঞেস করল।

যা লিখেছ,  সেই কথা ?

সত্যি ভাবলেই সত্যি, আমি দলিল লিখতে জানি, সেখেনে জমির হিস্ট্রি কত ভাষা দিয়ে লিখতে হয়, কে কিনল কার হাত থেকে, তারপরে  কে, একটা জমি  কতবার  বিক্রি হয়, হাতের লেখা ভাল বলে আমার লেখার দাম হত, সাইড ইনকাম ছিল, এখন সব  কম্পিউটারে লেখা হয়, তাই আর ডাক পড়ে না। বলল জুড়ান।  

বসন্তর ঠিকুজি কোষ্ঠী তুমি সব জানো, অথচ তাকে বসির মল্লিক বলতে, খুব অন্যায় এটা জুড়ান।

জুড়ান ভাবলেশহীন গলায় বলল, আমি কিছুই জানি না, যা মনে হল তাই লিখে দিলাম।

এইসব হরবোলা, সতীনাথের গান, পাখির সুরে গান…?  বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করলাম।  

জুড়ান বলল, আমি বানাই অনুতোষ, আমি পারি, যা বানাই তা সত্যি হলেও হতে পারে,  হয়েও যায়, যেমন নীলামবর মোল্লা পালোধী ফ্যামিলির কথা, সত্য হবেই। 

শেষ  কথাটি আমার খারাপ লাগল না। নীলমাধবেরটা সত্যি হলে আমি  নিশ্চিন্ত থাকব এই কারণে যে নীলমাধব বসন্ত মল্লিকের  মেয়ের দিকে কু-দৃষ্টি দিয়েছে। আর সেই লবঙ্গ গ্রামের কাকলি গানের বাড়ির  এই কাহিনি  যদি  সত্যি হয়, আমার চেয়ে আনন্দিত কেউ হবে না। সেই রাতে  আমি জুড়ানের সঙ্গে বেরিয়ে এ টি এম থেকে টাকা তুলে ওকে দিয়েছিলাম। জুড়ান চলে যেতে আমি নিশ্চিন্ত হয়েছিলাম। সুদ আর  পেনশন ভাল পাই। পাঁচ-দশ  হাজার গেলে কিছু হবে না। দুদিন বাদে মনে হবে অমন কোনও টাকা আমার ছিল না।  কিন্তু শ্যামাশ্রী যেন ভালো থাকে। লিপি ভালো হয়ে গেলে শ্যামাশ্রী ভাল থাকবে। এই যে টাকাটা  দিলাম, আমি দিইনি, শ্যামাশ্রী দিয়েছে।   

পরদিন  ভাবলাম একবার চঞ্চলচন্দ্রর ফ্ল্যাটে গেলে হয়। একা যাব, না সুমিতাভকে নিয়ে যাব? একা গেলে আমি কী কথা বলব? আমি হিব্রু, জেরুজালেম নিয়ে বিশেষ কিছু জানি না, সুতরাং সুমিতাভর শরণাপন্ন হলাম। দুজনে   এক বিকেলে গিয়েছি। এখন আর দূরবীনের ভয় নেই। নীলমাধব গেছে ফুর্তির ট্রিপে। শ্যামাশ্রী কি একা যাবে? বসন্ত যাবে নিশ্চয়। বসন্ত কি লোভী? জানি না। আমি উদ্বিগ্ন হয়ে আছি। নীলমাধব এলে ছবি দেখব, শ্যামাশ্রী গেছে কি না তখন জানা যাবে।  

Amar Mitra

অমর মিত্রের জন্ম ১৯৫১ সালে বসিরহাটে। তবে বহুদিনযাবৎ কলকাতাবাসী। ১৯৭৪ সালে 'মেলার দিকে ঘর' গল্প দিয়ে সাহিত্যিক হিসেবে আত্মপ্রকাশ। প্রথম উপন্যাস 'নদীর মানুষ' ১৯৭৮ সালে প্রকাশিত হয় অমৃত পত্রিকায়। প্রথম গল্পের বই 'মাঠ ভাঙে কালপুরুষ'-ও ১৯৭৮ সালেই। রাজ্য সরকারি চাকরি করেও আজীবন সাহিত্যসাধনায় ব্রতী। ২০০৬ সালে 'ধ্রুবপুত্র' উপন্যাসের জন্য পেয়েছেন সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার। ২০০১ সালে বঙ্কিম পুরস্কার পেয়েছেন 'অশ্বচরিত' উপন্যাসের জন্য। এছাড়াও ২০০৪ সালে শরৎ পুরস্কার ও ২০১০ সালে গজেন্দ্রকুমার মিত্র সম্মান পেয়েছেন তিনি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *