লাল কাপড়ে মোড়া একটা খাতা। যেমন মুদি দোকানের হিসেবের খাতা হয়। তার উপরে মেটে হলদে দিয়ে লেখা ছবির নাম— গুপী গাইন বাঘা বাইন। একেবারে ওপরে সেই বিখ্যাত সই – সত্যজিৎ রায়। পাশে তারিখ।
এই সেই খাতা, যেখানে বাংলা চলচ্চিত্রের প্রবাদপ্রতিম মানুষটি লিখে রেখেছিলেন গুগাবাবা ছবি নিয়ে তাঁর যাবতীয় ভাবনা। ছবির প্রতিটি শটের ফ্রেম বাই ফ্রেম ছবিতে আঁকা, ঝরনাকলমে লেখা অজস্র নোটস। এমন দু’খানি খেরোর খাতায় ন’শো পাতারও বেশি নোটস লিখে রেখেছিলেন সত্যজিৎ রায়, তাঁর অবিস্মরণীয় ছবিটির প্রস্তুতিপর্বে। কী নেই সে খাতায়! প্যান্ডোরার বাক্স যেন খুলে যায় সামনে। ছবির ভাবনাপর্ব থেকে একেবারে পোস্ট প্রোডাকশন পর্যন্ত সব ছবির মতো সাজিয়ে রেখেছেন তিনি, হলদে হয়ে যাওয়া পাতাগুলিতে।
এমনই দুটি খেরোর খাতা নিয়ে সত্যজিৎ রায়ের জন্মশতবর্ষে একেবারে অন্যরকমভাবে শ্রদ্ধা জানানোর পরিকল্পনা করে দ্য চ্যাটার্জি গ্রুপ (টিসিজি)। তাদের নয়া উদ্যোগ টিসিজি সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ইন সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি (টিসিজি ক্রেস্ট, CREST)-এর অন্তর্গত সেন্টার ফর নিউ মিডিয়া (CENEMA) এই দুই খেরোর খাতার ডিজিটাল সংস্করণ তৈরি করার বিপুল কর্মযজ্ঞে হাত দেয়।
মূল ভাবনাকে বাস্তবায়িত করার ক্ষেত্রে কাদের সাহায্য পেয়েছেন? টিসিজি ক্রেস্টের প্রজেক্ট অ্যান্ড ডিজিটাল ট্রান্সফরমেশন হেড, শ্রী অয়নাংশু বন্দ্যোপাধ্যায় জানান, এই প্রোজেক্টের প্রধান পরামর্শদাতা ও সহায়ক শ্রী সন্দীপ রায় এবং প্রযুক্তিগত পরামর্শদাতা শ্রী কুণাল সেন। দুই কিংবদন্তি চলচ্চিত্র নির্মাতা সত্যজিৎ রায় এবং মৃণাল সেন-এর পরবর্তী প্রজন্মের দু’জন যেভাবে এই প্রোজেক্টটির বাস্তবায়নের জন্য সম্মিলিত হয়েছেন— তার জন্য TCG CREST অত্যন্ত আনন্দিত এবং কৃতজ্ঞ। খেরোর খাতা এবং ‘গুগাবাবা’ ছবির সঙ্গে যুক্ত অন্যান্য বেশকিছু শিল্পসামগ্রীর জন্য CENEMA, TCG CREST সন্দীপ রায় এবং রে সোসাইটি-র কাছে এবং গুপী গাইন বাঘা বাইন চলচ্চিত্রের নানা দৃশ্য ব্যবহারের অনুমতি দেবার জন্য শ্রীমতী পূর্ণিমা দত্তের কাছে বিশেষভাবে কৃতজ্ঞ।
কীভাবে করা হল এই ডিজিটাল সংস্করণ তৈরির কাজ? টিসিজির তরফে জানানো হয়, প্রথম খাতাটিতে রয়েছে ৭৩৩টি পাতা। সেখানে ছবির জন্য তৈরি স্টোরিবোর্ড, খসড়া স্কেচ, গান এবং সঙ্গীত পরিচালনার ভাবনা, সেটের প্রাথমিক খসড়া, শুটিং স্ক্রিপ্ট, এই সমস্তকিছু রয়েছে। দু নম্বর খাতায় রয়েছে ভূতের নাচের দৃশ্যের বিশদ পরিকল্পনা এবং পোস্ট প্রোডাকশনের নোটস। সম্পাদনা, আবহ, স্পেশাল এফেক্ট সংক্রান্ত সমস্ত তথ্য নিঁখুতভাবে ছকে রেখেছেন পরিচালক। সেই দুই খাতার প্রতিটি পাতা স্ক্যান করে তার সঙ্গে প্রয়োজনীয় টিকা, ভাষ্য যোগ করে তৈরি করা হয়েছে এই বিশেষ ওয়েবসাইট exploreray.org। খেরোর খাতার বিষয় ধরে ধরে তৈরি করা হয়েছে সাবমেনু। সেখানে ক্লিক করলেই পৌঁছে যাবেন সেই বিষয়ের পাতায়। বিষয়গুলিকে আরও প্রাঞ্জল করে বোঝাতে ব্যবহার করা হয়েছে ‘গুগাবাবা’-র পাঁচশোরও বেশি ভিডিও ক্লিপ, একশোর বেশি স্থিরচিত্র, এমনকী আবহসঙ্গীতের টুকরো পর্যন্ত।
২৫ ডিসেম্বর ১৯৬৪ থেকে শুরু করে খেরোর খাতার নোটস চলেছে ১৯৬৬ সালের ২১ অগস্ট পর্যন্ত। একের পর এক দেখতে দেখতে আমাদের চোখের সামনে ফুটে ওঠে সত্যজিতের মাথায় কীভাবে ধীরে ধীরে দানা বেঁধে গড়ে উঠেছিল গোটা ছবিটি। এ ছবির অন্যতম প্রধান সম্পদ, সত্যজিতের সুরে অনুপ ঘোষালের গলায় গুপীর গান। সেগুলিও একটু একটু করে গড়ে তুলেছিলেন পরিচালক। তার স্বরলিপির খসড়া, প্রাথমিক লিরিক টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে রয়েছে খেরোর খাতার পাতায় পাতায়। ওয়েবসাইটে তার সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়েছে ওঁর পিয়ানো বাজানোর রেকর্ডিং।
মূল স্ক্রিপ্ট বাংলা ভাষায় থাকলেও সারা বিশ্বের কাছে সত্যজিৎ রায়ের মননজগৎ উন্মুক্ত করতে গোটা সাইটটি দ্বিভাষিক করা হয়েছে। ইংরিজিতে অনুবাদ করে দেওয়া হয়েছে প্রতিটি উপাদান। তবে খেরোর খাতায় স্কেচের সংখ্যাই বেশি। লেখার পরিমাণ কম। ফলে খুব বেশি অনুবাদের কাজ করতে হয়নি। আর এ ছবির ইংরিজি সাবটাইটেল নিজের হাতেই লিখেছিলেন পরিচালক। ফলে সংলাপের ক্ষেত্রে ইংরিজি সংস্করণ পেতে কোনও সমস্যা হয়নি বলে জানান অয়নাংশুবাবু।

উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর মূল উপন্যাস ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’ ১৯১৫ সালে ‘সন্দেশ’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল ছ’টি কিস্তিতে। ১৯৬১ সালে নতুন করে যখন সন্দেশ ফের প্রকাশিত হতে শুরু করে উপেন্দ্রকিশোরের নাতি সত্যজিতের সম্পাদনায়, তখন পুজোবার্ষিকী সংখ্যায় ফের উপন্যাসটি প্রকাশ করা হয়। এই ওয়েবসাইটে রয়েছে সেই সমস্ত হারিয়ে যাওয়া সংখ্যা। এক ক্লিকেই হাতে এসে যাবে পুরনো সন্দেশের পাতা। সম্প্রতি এ বিষয়ে এক সংবাদপত্রে দেওয়া সাক্ষাৎকারে শ্রী সন্দীপ রায় জানান, এই উদ্যোগের শুরু বহুদিন আগে। কিন্তু মাঝখানে পথরোধ করে এসে দাঁড়ায় কোভিড ও লকডাউন। ফলে কাজ খানিকটা বাধা পায়।
সন্দীপবাবু আরও জানান, ‘প্রতিটি ছবির জন্যেই খান দুয়েক করে খেরোর খাতা তৈরি করতেন বাবা। তবে ‘গুগাবাবা’-র মতো এত অনুপুঙ্খ, বিশদ, লেখা-ছবিতে সমৃদ্ধ খাতা কমই আছে, কারণ এ ছবি ছিল তাঁর মনের খুব কাছাকাছি। ছবির সুবর্ণ জয়ন্তী উপলক্ষে রে সোসাইটি আয়োজিত একটি প্রদর্শনীতে প্রথম খেরোর খাতার কয়েকটি পাতা প্রদর্শিত হয়। এবার এই ওয়েবসাইটের মাধ্যমে সারা বিশ্বের সত্যজিৎ-প্রেমী মানুষ খুব সহজে বিনামূল্যে এই অমূল্য অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে পারবেন, সেটা ভেবে খুব ভাল লাগছে।’
লিখতে শিখেই লুক থ্রু! লিখতে লিখতেই বড় হওয়া। লিখতে লিখতেই বুড়ো। গান ভালবেসে গান আর ত্বকের যত্ন মোটে নিতে পারেন না। আলুভাতে আর ডেভিলড ক্র্যাব বাঁচার রসদ। বাংলা বই, বাংলা গান আর মিঠাপাত্তি পান ছাড়া জীবন আলুনিসম বোধ হয়। ঝর্ণাকলম, ফ্রিজ ম্যাগনেট আর বেডস্যুইচ – এ তিনের লোভ ভয়ঙ্কর!!