অলিম্পিকে ভারত এইরকম ফল করতে পারে, কেউ কি ভেবেছিলেন? আমি নিশ্চিত, কেউ ভাবেননি। কেউ কল্পনা করেননি একটি সোনা, দু’টি রুপো আর চারটি ব্রোঞ্জ নিয়ে ভারত শেষ করবে, যা অলিম্পিকের ইতিহাসে সর্বকালীন সেরা হয়ে থাকবে। ছটি পদক এসেছে ব্যাক্তিগত ইভেন্ট থেকে, একটি পুরুষদের হকি অর্থাৎ দলগত ইভেন্টে।
যে ব্যাক্তিগত ইভেন্টগুলো থেকে পদক এসেছে সেগুলো একটু দেখুন। ছেলেদের ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ড আর কুস্তি, মেয়েদের ভারোত্তোলন, ব্যাডমিন্টন আর বক্সিং। আমি গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি, এই খেলাগুলো সম্পর্কে আপনার বিন্দুমাত্র আগ্রহ ছিল না। পুরুষদের জ্যাভলিন নিক্ষেপে ভারতীয় সেনাবাহিনীর রাজপুতানা রাইফেলসের সুবেদার নীরজ চোপড়া সোনা জেতার আগে পর্যন্ত মুষ্টিমেয় ভারতীয়ের ধারণা ছিল জ্যাভলিন সম্পর্কে, এখন যদিও অনেকেই জ্যাভলিন বিশেষজ্ঞ হয়ে গেছেন।

কিন্তু ক’জন জানেন যে শিবাজি স্টেডিয়ামে দৌড় প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে গিয়ে এক কিশোর জ্যাভলিন নিক্ষেপে আকৃষ্ট হয় এবং সেদিনের সেই কিশোরই আজকের অলিম্পিক চ্যাম্পিয়ন নীরজ চোপড়া। ভারতে পৌঁছেই নীরজ কী করতে চেয়েছিলেন জানেন? ফুচকা খেতে! কতদিন প্রিয় ফুচকা আর মায়ের হাতের ক্ষীর খাওয়া হয়নি নীরজের!
মেয়েদের ভারোত্তোলনে রুপো জিতেছেন মিরাবাই চানু। চানুর লড়াই, তাঁর ত্যাগ, তাঁর আত্মৎসর্গের কথা কজন জানেন? মেয়েরা ওজন তুলছে– এ বিষয় নিয়ে আপনার কোনও আগ্রহ ছিল না নিশ্চয়ই। তাই জানতেও পারেননি যে বিশ্বের দ্বিতীয় সেরা হওয়ার লক্ষ্যে মণিপুরের একটি মেয়ে কীভাবে তৈরি হচ্ছে। মণিপুরের বিদ্রোহিনী শর্মিলা চানুর নাম তবু শুনেছেন, কিন্তু মিরাবাই চানু তো আপনার কাছে অপরিচিত! অথচ দেখুন যখন মিরাবাই চানু পোডিয়ামে উঠলেন, ভারতের জাতীয় সংগীত বেজে উঠল, তখনই প্রতিফলিত গৌরবে আপনি উদ্ভাসিত হলেন। এটাই নিয়ম, সেরারা যখন সেরা হন তখনই সবার দৃষ্টি তাঁদের দিকে পড়ে। তার আগে উপেক্ষার পাহাড়।

শোনপতের নাহারি গ্রামের ছেলে রবিকুমার দহিয়াকে আপনি নিশ্চিতভাবেই চিনতেন না। কিন্তু, কুস্তিতে তিনি যখন অলিম্পিক রুপো জিতলেন তখন গুগল আর উইকিপিডিয়া তন্নতন্ন করে খুঁজে ফেললেন তেইশ বছর বয়সী এই তরুণটি সম্পর্কে জানতে। ছত্রশাল স্টেডিয়ামের আখড়ায় বেড়ে ওঠা সুঠাম স্বাস্থ্যের অধিকারী রবিকুমার সেনাবাহিনীতে সেপাইয়ের কাজ পেয়েছিলেন। কিন্তু গুরুভাই, চ্যাম্পিয়ন কুস্তিগির সুশীল কুমারের পরামর্শমতো চাকরি না নিয়ে রবিকুমার আখড়ার মাটি গায়ে মাখলেন। দঙ্গলে থাকার সুফল রবি পেলেন টোকিওয়।
পুসারেলা সিন্ধুর নামটি অবশ্যই আপনি জানতেন। ব্রাজিলের রিও অলিম্পিকে ব্যাডমিন্টনে রুপো জিতে সিন্ধু ভারতীয়দের কাছে বহুল প্রচলিত নাম। কিন্তু, খবর রাখেন কি মেয়েটি কোচ গোপীচাঁদের সেন্টারে পৌঁছনোর জন্য রোজ ছাপান্ন কিলোমিটার সফর করত এবং একদিনও প্র্যাকটিসে দেরি করেনি। নিয়ামানুবর্তিতা আর কঠোর অনুশীলন রিওর রুপোর পর টোকিওতে তাঁকে ব্রোঞ্জ এনে দিল। শীতে বিনোদনের জন্যে বাড়ির হাতায় লাইট লাগিয়ে একটু আধটু ব্যাডমিন্টন খেলেছেন কিংবা বনভোজনে গিয়ে। কিন্তু, এই ব্যাডমিন্টনে আমাদের মেয়েরা যে বিশ্বের প্রথম তিনটি দেশের মধ্যে, তা কি জানতেন?

লাভলীনা বড়গোহাই অসমের মেয়ে। দক্ষিণ কলকাতার চেতলা অগ্রণী সংঘের রিংয়ে যখন নেমেছিলেন তিনি, কেউ ফিরেও তাকায়নি। ভারতীয় মেয়েদের বক্সিং মানেই তো মেরি কম! কিন্তু লাভলীনা টোকিওতে ব্রোঞ্জ জিতলেন। কেউ জানলই না যে টোকিওর প্রস্তুতির জন্যে ভারতীয় মেয়ে বক্সারদের যেদিন ইউরোপ যাওয়ার কথা ছিল, তার আগের রাতে লাভলীনার করোনা হয়। ইউরোপ যেতে পারেননি তিনি। কিন্তু করোনাকে জয় করে অলিম্পিকে ব্রোঞ্জ জিতে লাভলীনাই আজ করোনার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের বড় বিজ্ঞাপন।
আর এক ব্রোঞ্জজয়ী কুস্তিগীর বজরং পুনিয়া। ষাট কিলোমিটার দূর থেকে মাখন আর দুধ ছেলের জন্যে প্রতিদিন আনতেন বাবা। কুস্তিতে ব্রোঞ্জ জিতে বাবার স্বপ্নপূরণ করেছে বজরং। আমরা জানতে পারিনা এই দধিচীদের কথা। বজরংবলীর কথা শুনেছি। বজরং পুনিয়াকে কে চিনত? মনপ্রীত সিংয়ের ভারতীয় হকি দল যেদিন অস্ট্রেলিয়ার কাছে সাত গোল খেয়েছিল, সেদিন আমরা আশাভঙ্গের বেদনায় অধীর হয়েছি। কিন্তু, মনপ্রীতদের মনে ছিল অন্য ভাবনা। প্রতিজ্ঞায় কঠোর হয়ে তারা ব্রোঞ্জ জিতল। একচল্লিশ বছরের ব্যবধানে এল হকির পদক। শাপমুক্তি। আশির মস্কো অলিম্পিকের পর আবার হকিতে অলিম্পিক পদক। নয়া ইতিহাস তো বটেই।
এবারের অলিম্পিকে পদকের খুব কাছাকাছি এসেও পদক জিততে পারেননি দীপক পুনিয়া, অদিতি অশোক এবং মেয়েদের হকি দল। পদক না পেলেও এঁদের শৌর্য মুগ্ধ করেছে আমাদের। রানি রামপালের নেতৃত্বে মেয়েদের হকি দলের লড়াই স্মরণীয় হয়ে থাকবে। ভারতীয় মহিলা হকিদলের নেতৃ রানি রামপালের বাবা রিকশা চালাতেন। মা পাঁচবাড়ি বাসন মাজতেন। রানির বাড়িতে ঘড়ি ছিল না। ভোরের আকাশের রঙ দেখে তার মা তাকে সকালের প্র্যাকটিসে পাঠাতেন।

রানির না ছিল শর্টস, না হকিস্টিক। সালোয়ার কামিজ পরে প্রাকটিস করতেন তিনি। মহিলা হকি খেলোয়াড়দের নিয়ম ছিল, সবাইকে রোজ পাঁচশো মিলিলিটার দুধ নিয়ে যেতে হবে প্র্যাকটিসে। রানির সামর্থ্য ছিল না রোজ অতটা দুধ নিয়ে যাওয়ার। দুশো মিলি দুধ নিয়ে রাস্তার কলের জল মিশিয়ে পাঁচশো মিলি করে তিনি মাঠে যেতেন। তারপর সেই দুধ চোঁচোঁ করে খেয়ে প্র্যাকটিস করতেন। পোয়েটিক জাস্টিস হত রানির দল ব্রোঞ্জ পেলে। কিন্তু, অলিম্পিকে সব তো কবিতা নয়। নিস্করুণ গদ্যও যে থাকে এখানে।

কিন্তু শুধু কি দারিদ্র্য? আরও কত সামাজিক ব্যধির সঙ্গে নিরন্ত যুঝতে যুঝতে খেলা চালিয়ে যেতে হয় মেয়েদের, তার জ্বলন্ত উদাহরণ মহিলা হকি খেলোয়াড় বন্দনা কাটারিয়া। বন্দনা দলিত। তাই ওর স্পর্শে অপবিত্র হওয়াতেই নাকি মেয়েদের হকিদল ব্রোঞ্জ পায়নি– এই কথা তুলে হরিদ্বারে তার বাড়ির সামনে সারারাত বিক্ষোভ চালায় একদল যুবক। জ্যাভলিনে সোনাজয়ী নীরজ চোপড়ার বাড়িতে যেদিন রোশনচৌকি বসে, সেদিন বন্দনার বাড়িতে বসে পুলিশ চৌকি। রানি রামপল যথার্থ বলেছেন, ‘মাঠে নেমে যখন খেলি তখন ব্রাহ্মণ , ক্ষত্রিয়, কায়স্থ, দলিত একসঙ্গে লড়ি।’ এই জাতপাতের লড়াই বন্ধ হোক ভারতীয় খেলাধুলোয়। রানি ঠিকই বলেছেন। ভারত যে বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্যের দেশ, টোকিও অলিম্পিক তা আরও একবার আমাদের বুঝিয়ে দিল।
*ছবি সৌজন্য: Wikipedia, Aljazeera, Aajtak, News18
জয়ন্ত চক্রবর্তীর পেশা সাংবাদিকতা। কখনও প্রথম সারির সংবাদপত্রের বার্তা সম্পাদক, কখনও টেলিভিশনে খবরের চ্যানেলের প্রধান সম্পাদক। জীবন শুরু ক্রীড়া সাংবাদিক হিসেবে। সংবাদপত্রের ক্রীড়া সম্পাদক হিসেবে তিনটি বিশ্বকাপ ফুটবল, একটি ইউরোপিয়ান কাপ ও এশিয়ান কাপ কভার করেছেন। এছাড়া অসংখ্য টেস্ট সিরিজ, বিশ্বকাপ ক্রিকেটও রিপোর্টের অভিজ্ঞতা রয়েছে তাঁর ঝুলিতে। এছাড়াও সঞ্চালনা করেছেন অসংখ্য টেলিভিশন অনুষ্ঠান। খেলার মাঠে ধারাভাষ্যকার হিসেবেও তাঁর পরিচিতি আছে।
ei rakom ekta lekhar khub dorkar chilo……..aapnar onuman thik …Olympic-e angsho grohoner jonyo amader athelists der ki poriman porishrom kora laagey ba kato abhaaboniyo katso swikaar kortey hoy ta beshir bhag loker-i janaa nei….aapnar lekhata khub bhalo legechey……asha kori bhobishyot-eo
aro lekha pora jabe……..binamro namoskar