আগের পর্বের লিংক: [] [ ২] [] [] [] [] [] [] [ ৯] [১০] [১১] [১২] [১৩][১৪][১৫] [১৬] [১৭] [১৮] [১৯]

মনে হচ্ছে গুণেনের গায়ে জুড়ানের বাতাস লেগেছে। জুড়ানের  কথা ইদানীং অদ্ভুত লাগে। নিজের মতো করে সত্য নির্মাণ করে। এই সত্য ধ্বংসাত্মক মনে হয়। গুণেন আমার কোনও কথা কানেই নিল না। বলল,
– একে নিয়ে লং ড্রাইভে যায় নীলমাধব। কলকাতা নিয়ে আসে, দিয়ে আসে। আবার দূরে যাবে। কচি মেয়েটাকে শেষ করে দেবে  নীলমাধব। সেই সব ময়লা ধুতে এই সব উৎসব। 
– কে বলল এসব? আপনি এসব ভেবে নিচ্ছেন? আমি জিজ্ঞেস করলাম।
– আরে আপনি তো জানেন বশির মল্লিকের কথা! কথা কি চাপা থাকে? জুড়ান বলেছে, উত্তর ২৪ পরগনায় জুড়ানের লোক ছড়ানো, জুড়ানকে সকলে খবর দেয়। জুড়ানের লোকের কাছে ওর বাবা বসন্ত কিংবা বশির মল্লিক বলেছে, নীলমাধববাবু তার মেয়ের প্রোমোটার। একজন প্রোমোটার দরকার হয় এসবে। সিনেমার নায়িকা হতে গেলে দরকার হয়, গায়িকা হতে দরকার হয়। বশির মল্লিক ধরা পড়ে গেলে মেয়েটার যে কী হবে?
– জুড়ানের সব কথা মিথ্যে?
– কী মিথ্যে? ওই যে লোকটা শরবত দিচ্ছে বেয়ারার ট্রে থেকে তুলে লোকের হাতে, ওই হল বশির মল্লিক। ওকে ব্ল্যাকমেল করে ওর মেয়েকে কব্জা করেছে নীলমাধব, বন্দি করেছে ফ্যামিলিটাকে। 

আমি দেখলাম ঢ্যাঙা, সিল্কের ধুতিপাঞ্জাবি পরা মানুষটিকে। আগেও দেখেছি ঠাকুরের সেই তিরোধান উৎসবে। মনে হয়  এককালে তিনি রূপবান ছিলেন, হয়তো গানের গলা ছিল সুন্দর। ডি এল রায় গাইতেন, রজনীকান্ত গাইতেন। কিন্তু কিছুই হয়নি, সবার হয় না। প্রোমোটার দরকার হয়…। 

গুণেন যেন জুড়ানের মতোই বলতে লাগল সব কথা, একই কথা বারবার। আমি ভাবছি, মানুষ কত খবর রাখে! আর পৃথিবীতে কত খবরই না হয়। এখন যা হচ্ছে, পরমুহূর্তে তা অতীত হয়ে যাচ্ছে। আবার ভবিষ্যতের গর্ভে কত খবর নিহিত আছে। কিন্তু এইসব খবর না রাখলেই বা হত কী? মেয়েটা নিশ্চিন্তে গাইতে পারত নিজের গান। 

মেয়েটির বাবা লোকটা বেশ লম্বা, গৌরবর্ণ।  মনে হয় অভিজাত পরিবারই ছিলেন এক সময়। এপারে এসে গরিব হয়ে গেছেন।  মেয়েটির নাম কি শ্যামাশ্রী? আমি জিজ্ঞেস করলাম গুণেনকে। গুণেন বলল,
– শ্যামলী। ভুল শুনেছেন।
আমি ভুল শুনব কী, আমি তো জানি। শ্যামাশ্রী কি শ্যামলী হয়ে গেছে আমার কলমে। মাঝের পঞ্চাশ বছর উধাও। আমি বললাম,
– শ্যামাশ্রীর আর একটা নাম ছিল, শ্যামলী।
– চেনেন নাকি? বলেননি তো! গুণেন অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল। 
আমি চুপ করে গান শুনতে থাকি। আমাকে উদ্দেশ্য করেই যেন ওই গান। আমার সকল গান তোমাকে লক্ষ্য করে। দাঁড়িয়ে আছ তুমি আমার গানের ওপারে। কতদিন ভেবেছি গান নিয়ে ফিরবে শ্যামাশ্রী। ফিরল যখন গান নিয়ে, সেই গান শুনতে হবে। কী গাইবে এরপর… নিশিরাত বাঁকা চাঁদ আকাশে…। না সেই গান নয়, আমার জীবন নদীর ওপারে..। ছুটি সিনেমা। মৃণাল মুখোপাধ্যায় এবং নন্দিনী মালিয়া। সেই গান গাইছে শ্যামাশ্রী। 

স্যানাটোরিয়াম থেকে ফিরে এল ভ্রমর। ভ্রমর নয়, শ্যামাশ্রী। বলেছিল, স্যানাটোরিয়ামে চলে যাচ্ছে। গান আর হবে না। গান না হলে কী নিয়ে বাঁচবে সে? আমার চোখে জল এসে গেল। মনে হতে লাগল, কাকলি গানের বাড়ি আবার জন্ম নিচ্ছে মণিমালিকা আবাসন ভেঙে। একটু একটু করে লুপ্ত হচ্ছে মণিমালিকা। জন্ম নিচ্ছে কাকলি গানের বাড়ি। সব মনে পড়ে যাচ্ছে। তখন কতই বা বয়স। আমার মনে হয়েছিল, সেই দূর পশ্চিমে পাহাড়ি অঞ্চলেই শ্যামাশ্রী চলে গেছে। অসুখ। আমিই মৃণাল কিংবা অমল। শ্যামাশ্রীর গান শেষ হল। সে হারমোনিয়ম বন্ধ করে মঞ্চ থেকে নেমে এল। আমি পরম বিস্ময়ে তার দিকে তাকিয়ে আছি। গুণেন আমাকে বলল,
– বশির মল্লিকই ওই লোকটার নাম। 
– ঠাকুরের জন্মোৎসবে মুসলমান মেয়ে গান গাইবে, এত উদার কি নীলমাধব? আমি যুক্তি সাজালাম।
– এসেছে তো বসন্ত মল্লিকের মেয়ে হয়ে। এখানে মেয়েটাকে দিয়ে গান গাইয়ে আড়াল করছে বশির মল্লিককে। বসন্ত মল্লিক করে দিচ্ছে। গুণেন তার যুক্তি সাজায়। 

আমি মাথা নাড়লাম।
– হতে পারে না। জুড়ান জানে না। মিথ্যে কথা এভাবে রটিয়ে দেওয়া ঠিক না।
 
– আপনি কি নীলমাধবকে ভয় করেন? ওর কথায় তাল দেবেন? 
– আপনার মনে মায়া নাই গুণেনবাবু? 
গুণেন আমার কথা বুঝতে পারল না। বলল,
– বাবা মেয়েকে প্রোমোট করাচ্ছে নীলমাধবের কাছে ঠেলে দিয়ে। নীলমাধব কচি মেয়েটাকে শেষ করছে। বাবার নাম বশির। বাংলাদেশে ঢুকলেই জেল জরিমানা ফাঁসি। নাম বদল করে বসন্ত। 
আমি উঠে পড়লাম গুণেনের পাশ থেকে। বসন্ত মল্লিকের পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। বললাম,
– আপনার মেয়ে, অপূর্ব গলা। অনেক দূর যাবে।
বসন্ত অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। আপ্লুত হয়ে  বললেন,
– আশীর্বাদ করুন স্যার। মাধব স্যার ওকে চান্স করিয়ে দিচ্ছেন। আপনি স্যারের বন্ধু?
– হ্যাঁ, এই পাড়াতেই থাকি। ভাব জমাতে চাইলাম।  
– মলি, এই  মলি। বসন্ত মল্লিক ডাকলেন। 
– মল্লিকা ওর নাম?
– না। শ্যামলী, শ্যামাঙ্গী, শ্যামাশ্রী, শ্যামপ্রিয়া…। ওর অনেক নাম স্যার। আমাদের স্যার বলেন চন্দ্রমল্লিকা। 
– ওর নাম শ্যামাশ্রীই ভাল। আমি হেসে বললাম।
– ইয়েস স্যার, শ্যামাশ্রীই ভালো।
বসন্ত কিংবা বশির মল্লিক আমাকে সমর্থন করল। তারপর আবার ডাকল।
– এই মলি, মলি, এদিকে শোন। 

বসন্ত কিংবা বসির মল্লিকের ডাকে তার মেয়ে এল না। আসতে পারল না। নীলমাধব তাকে যেন আগলে রেখেছে। তার বাগানের চন্দ্রমল্লিকা, তারই অধিকার যেন। কী সব নির্দেশ দিচ্ছে? হোম যজ্ঞ হবে, তার ব্যবস্থা করছে ও। তাহলে কী করে মুসলমান হবে?  হবেই না। আমি বসন্ত মল্লিকের সঙ্গে কথা বলতে লাগলাম। তিনি আমাকে তাঁর বাড়ি যেতে বললেন। হাবড়া নয়, মসলন্দপুর। মসলন্দপুর হাবড়ার পরের স্টেশন। একেবারে রিফিউজি এলাকা। তাহলে আমরা যা জানি সবটা ঠিক নয়। জুড়ানও ঠিক জানে না। মসলন্দপুরে মল্লিক মশায় একটি রেশন দোকানে কাজ করেন। খাতা লেখেন। হোমিওপ্যাথি শিখেছেন বই পড়ে। তাঁরা জমি এক্সচেঞ্জ করে এসেছেন ফরিদপুর থেকে।

আমি কী অদ্ভুত এক মানুষ। মনে হল কাকলি গানের বাড়ির  বদলে কি? গানের বাড়ি যাদের ছিল, তারা কি ফরিদপুরে চলে গেছে? বদলে মসলন্দপুর আর এখানে জমি পেয়েছে নীলমাধব পালোধী? পালোধীরাই ওদের বসিয়েছে মসলন্দপুরে।  পালোধীদের প্রজা বলতে পারি ওদের। আজ্ঞাবহ। তাই মেয়েটি পালোধীবাবুর দাসী হয়েছে। বসন্ত মল্লিকের মেয়ে এল সেই  খাওয়ার সময়। ক্যাটারার সব করছিল। সেই মেয়ে তদারকিতে ছিল।

নীলমাধবের স্ত্রী বাতের ব্যথায় কাতর। চেয়ারে বসে তিনিও চন্দ্রমল্লিকাকে নির্দেশ দিচ্ছেন। বসন্ত আর তার মেয়ে টেবিলে টেবিলে ঘুরছে। আমাদের সামনে এল বাপ মেয়ে দু’জনেই।  শ্যামাশ্রী হাত জোড় করে নমস্কার করল। হাসল। হাসিটি আমার চেনা। তারপর বিষণ্ণ হল। এই বিষণ্ণতাও আমার চেনা। তারা চলে গেল অন্য টেবিলে। খোঁজ নিতে লাগল, সকলে ঠিকঠাক খাচ্ছে কিনা। একবার ডাকল নীলমাধব। বলল, মল্লিকা, এদিকে আয়। 

গুণেন  আমার কোনও কথা কানেই  নিল না, বলল, একে নিয়ে লং ড্রাইভে যায় নীলমাধব, কলকাতা নিয়ে আসে, দিয়ে আসে, আবার  দূরে  যাবে, কচি  মেয়েটাকে শেষ করে দেবে  নীলমাধব, সেই সব ময়লা ধুতে এই সব উৎসব। 

আমরা ফিরে এলাম। গুণেনের সঙ্গে আমার মতে মেলেনি, কিন্তু মেয়েটি যে অপূর্ব গান গায় সে বিষয়ে গুণেন একমত। ও নিজেই উঠবে। তবে প্রোমোটার দরকার হয় সব কিছুতে। লেখক নিয়ে যা বলেছিল সুমিতাভ মৈত্র, তেমনি গান নিয়েও একই কথা। কেউ সাহায্য না করলে হয় না।      

আমার মনে হচ্ছিল চঞ্চলচন্দ্রর সঙ্গে দেখা করি। শ্যামাশ্রীর কথা বলি। বসন্ত কিংবা বশির মল্লিকের সঙ্গে কথা বলার পর মনে হয়েছে তা। শ্যামাশ্রীকে নিয়ে আমি আবার লিখব ভাবছিলাম। সেই কবে কোনকালে লিখেছিলাম একটি গল্প বাঁকুড়ার এক অখ্যাত ম্যাগাজিনে। বিশ কপির দাম আগে পাঠাতে হয়েছিল, সেই শর্ত পূরণের পর গল্প ছাপা হয়েছিল। সেই গল্প আমি সুমিতাভকে পড়তে দিলাম এত বছর বাদে। সুমিতাভ সেই বিবর্ণ হয়ে যাওয়া, মলাট ছিঁড়ে আসা, লেটার প্রেসে ধ্যাবড়া ছবি-সহ ছাপা পত্রিকা পরদিন ফেরত দিলেন। বললেন,
– লেখা বহুদূর পিছিয়ে রয়েছে।
– তার মানে? পঁয়তাল্লিশ বছর আগে লেখা বলে?
– তারও ষাট বছর পিছিয়ে যান। ধরুন একশো বছর আগে এমন লেখা হত। কিন্তু আপনি যদি চর্চায় থাকতেন হত। শ্যামলী মেয়েটিকে আপনি চিনতেন? 
– হ্যাঁ। আমি মাথা নামিয়ে নিলাম। শুনছি সুমিতাভ বলছেন,
– কিন্তু গল্পটি আপনি নষ্ট করেছিলেন। কিছু সম্ভাবনা ছিল।
সম্ভাবনা তো ছিলই। শ্যামাশ্রীরা কলকাতা ছেড়ে কোথায় যাচ্ছে তা আমি জেনে নিতে পারতাম যদি তখন। অজয় নদীর বাঁকে কোন গ্রাম সে? যদি আমার ঠিকানা দিয়ে বলতাম, চিঠি লিখ। আমি তোমাকে ভালোবাসি। কিছুই করিনি। এতটা জীবন ধরে  জানতেও চাইনি সে কোথায়। সে গাইছে কিনা। মফসসলের গায়িকাও হয়ে উঠতে পেরেছে কিনা। সম্ভাবনা নষ্ট করেছি আমি। লেখার চর্চা করতেই পারতাম।

তবুও ভাবলাম বলি, আমি ঠিকই লিখেছি। শ্যামাশ্রীকে শ্যামলী করে দিয়ে একটুও ভুল করিনি। সে শ্যামলী হয়ে পঞ্চাশ  বছর  ভাসিয়ে দিয়ে প্রায় যেমন ছিল তেমনভাবে ফেরত এসেছে।  কিন্তু বলতে পারলাম না। বললাম না। লেখকরা অন্যের কথা দামি কলমে লিখে নিজের করে তোলে। আমি নীলমাধবের বাড়ির অভিজ্ঞতা একমাত্র চঞ্চলচন্দ্র চন্দ্রকে বলতে পারি, যিনি লেখেন না। চঞ্চলচন্দ্র কী বলেন শুনি।

এর ভিতরে এক রাতে জুড়ান রায় হাজির। আমি একবার ভাবলাম ওকে ভিতরে ঢুকতে দেব না। কিন্তু সে সাহস হল না। জুড়ান যতটুকু ভুল জানে, আমি সংশোধন করে দেব। জুড়ান নীলমাধবের বিরোধী।  নীলমাধব ফুর্তি করতে গেছে দেরাদুন। সঙ্গে নিশ্চয় শ্যামাশ্রী কিংবা শ্যামলী গেছে। বসন্ত কিংবা বশির মল্লিক তার মেয়ের ভবিষ্যৎ ভেবে পাঠিয়েছে। আর বসন্তকে টাকা দিয়েছে নিশ্চয় নীলমাধব। সুন্দর সিল্কের পাঞ্জাবি, ধুতি দিয়েছে, যা পরে সে বিরাম ঠাকুরের জন্মোৎসবে এসেছিল। আহারে, অমন মেয়েটাকে নিজের সেবাদাসী করে নিল নীলমাধব। নাহ, তা হয় না। এইভাবে কি সুরে বাজবে তোমার কণ্ঠ, ও শ্যামাশ্রী?

Amar Mitra

অমর মিত্রের জন্ম ১৯৫১ সালে বসিরহাটে। তবে বহুদিনযাবৎ কলকাতাবাসী। ১৯৭৪ সালে 'মেলার দিকে ঘর' গল্প দিয়ে সাহিত্যিক হিসেবে আত্মপ্রকাশ। প্রথম উপন্যাস 'নদীর মানুষ' ১৯৭৮ সালে প্রকাশিত হয় অমৃত পত্রিকায়। প্রথম গল্পের বই 'মাঠ ভাঙে কালপুরুষ'-ও ১৯৭৮ সালেই। রাজ্য সরকারি চাকরি করেও আজীবন সাহিত্যসাধনায় ব্রতী। ২০০৬ সালে 'ধ্রুবপুত্র' উপন্যাসের জন্য পেয়েছেন সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার। ২০০১ সালে বঙ্কিম পুরস্কার পেয়েছেন 'অশ্বচরিত' উপন্যাসের জন্য। এছাড়াও ২০০৪ সালে শরৎ পুরস্কার ও ২০১০ সালে গজেন্দ্রকুমার মিত্র সম্মান পেয়েছেন তিনি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *