সেই বছর আমি মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছিলাম। অনেকের মনে আছে, অঙ্ক প্রশ্ন ফাঁস হয়ে যাওয়ায় পরীক্ষা বাতিল হয়েছিল। অনেক পরে সেই পরীক্ষা নেওয়া হয়। সেই প্রথমবার। আর এখনও অবধি সেই শেষবার। সে বছর সব কিছুই কেমন যেন হিসেবের বাইরে। একেবারে অন্যরকম। ধর্তব্যের মধ্যে না থেকেও প্রথম সুইস খেলোয়াড় হিসেবে উইম্বলডন জিতলেন মার্টিনা হিঙ্গিস। ইয়ানা নোভোতনা তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলেন, ঘাসের কোর্টে আন্ডারডগ কেমন করে ট্রফি ছিনিয়ে নিয়ে যায়। ইংল্যান্ডে ডায়ানা ব্লাডকে বলা হল, তিনি আর মা হতে পারবেন না। ডায়ানা হাল ছাড়লেন না। মৃত স্বামীর শুক্রাণু থেকে তাঁর সন্তান জন্মাল।

এনবিসি টিভিতে ‘আনসেনসরড শিন্ডলারস লিস্ট’ একসঙ্গে দেখলেন ৬৫০ লক্ষ মানুষ। স্টিভ আরউইন অনেক রকম শো-তে হাত পাকিয়ে শেষ চেষ্টা হিসেবে শুরু করলেন ‘দি ক্রোকোডাইল হান্টার।’ মে মাসে স্পিলবার্গের ‘জুরাসিক-পার্ক লস্ট ওয়ার্ল্ড’ রিলিজ় করল। সেই একই মাসে রাশিয়া আর চেচনিয়ার সন্ধি হল। চারশো বছরের যুদ্ধের অবসান। গার্ডিয়ান ঘোষণা করেই দিল এই বছর এর চেয়ে বড় কোনও ঘটনা হতেই পারে না।

১৯৯৭ সালের ২৬ জুন একটা ছেলের খবর পাওয়া গেল, যার আদৌ বেঁচে থাকারই কথা ছিল না। 

প্রায় বারো বছর ধরে মোট সাতটা উপন্যাস লিখেছিলেন জোন কিথ রাওলিং, যার প্রথমটারই পৃথিবীর আলো দেখার কথা না। বারোবার প্রকাশকরা একে নস্যাৎ করেছেন। একটু বেশিই অলৌকিক। বড্ড অবাস্তব। বেশিই ডার্ক। বাচ্চাদের জন্য নয়। কতরকম বাহানা। আর প্রকাশমাত্রেই সেই বই ভেঙে দিয়েছিল প্রকাশনার ইতিহাসের সব রেকর্ডকে। রাওলিং আসলে চেয়েছিলেন এক নতুন বিশ্ব তৈরি করতে। ঠিক যেমনটা করেছিলেন বাউম তাঁর উইজ়ার্ড অফ ওজ়ের গল্পে, কিংবা টকিন তাঁর মিডল আর্থের ইতিহাসে। সেখানে পরতে পরতে লেগে আছে ফেলে আসা মাইথোলজির ছাপ, প্রাচীন সাহিত্যের অদ্ভুত কুয়াশাভরা দুনিয়া, ড্রাগন, এলফ, পরি, হবিট আর ট্রোলেরা। সেই অদ্ভুত পৃথিবীতে রাতের চাঁদের সাদা গুঁড়ো পড়ে থাকে পৃথিবীর বুকে। একেবারে অনাহুত হয়ে আসে জাদুকর গ্যানডালফ, আর চিরকালের ঘরকুনো হবিট বিলবো ব্যাগিনস ব্যাগপত্র গুটিয়ে নিয়ে চলে ভয়ঙ্কর এক অভিযানে। 

এই দুনিয়া রাওলিংকে টানত। বিশ্ববিদ্যালয়ে ল্যাটিন ক্লাসে লাইব্রেরিতে বসে আপন মনে শব্দ জুড়ে জুড়ে নতুন শব্দের খেলায় মেতে উঠতেন। ল্যাটিন ‘এক্সপেলার’ মানে যা বার করে দেয়। আর ‘আর্মা’ হল অস্ত্র। এই দুই জুড়ে রাওলিং বানিয়েছিলেন নতুন শব্দ ‘এক্সপেলিয়ার্মাস।’ কে জানত, কয়েক বছর পর শত্রুর হাত থেকে অস্ত্র কেড়ে নিয়ে খোদ হগওয়ার্টসে শেখানো হবে এই মহামন্ত্র! যেই না জানলেন, ড্রাগনকে ল্যাটিনে ‘ড্রাকোস’ বলে, অমনি ঘুমন্ত বাঘকে না জাগানোর চেনা ল্যাটিন প্রবাদ ‘Tigris dormiens nunquam titillandus’ কে বদলে দিলেন হগওয়ার্টসের মোটোতে। নিজের জীবন, নিজের আবেগ খুঁড়ে, খুঁজে পটার-বিশ্বের এক একটা চরিত্র তৈরি করেছিলেন রাওলিং। সঙ্গে থাকে টিন এজের সমস্যায় ভুগতে থাকা একেবারে ছাপোষা একটি ছেলের কথা। না চাইতেই যার উপরে এসে গেছে ভুবনের ভার।

অস্বীকার করার উপায় নেই, একটু খেয়াল করলেই হ্যারির চরিত্রে যে আইকনিক টিন এজারটি উঁকি মারে, সে আর কেউ নয়, পিটার পার্কার। স্পাইডারম্যান। ডাম্বলডোর কখনও মিশে যান আঙ্কেল বেনের সঙ্গে, হ্যারিকে বোঝান এই ডার্ক লর্ডের সঙ্গে লড়াইতে ঈশ্বরপ্রদত্ত এক অদ্ভুত ক্ষমতা পেয়েছে হ্যারি। শুধু ঈশ্বর নয়, মা বাবার দানও আছে তাতে। হ্যারিকে শুধু ন্যায়ের পথে চলতে হবে এই লড়াইতে। ‘With great power, comes great responsibility’… আংকল বেনের এই অমোঘ বাণী টিন এজার হ্যারিকে প্রতি মুহুর্তে এক দোলাচলে বিদ্ধ করে। মাগল বিশ্বের সরলতা তাকে টানে, কিন্তু জাদুর স্বাদ যে একবার পেয়েছে, সে শত বিপত্তিতেও “যে নাহং অমৃতস্যাম, কিমহং তেন কুর্যাম” বলে মুখে উঠিয়ে নেয় বিষের পাত্র। পান করে হলাহল।

J K Rowling
গ্রিক ট্র্যাজেডির বীরদের মতো হ্যারিকেও একের পর এক পড়ীক্ষার সামনে ফেলেন রাওলিং

পটারের বিশ্ব এক চেনা অচেনার জগত। এখানে প্যাঁচারা চিঠি নিয়ে আসে, তৈলচিত্র কথা বলে, লুসিফারের মতো শয়তান লর্ড ভোল্ডেমর্ট তার উত্থানের ভয় দেখায়। আবার তার পাশেই চরম মনখারাপেরা আসে ডিমেনটরের রূপে। শুষে নেয় মানুষের আত্মার অংশ। ঠিক যেমন ডিপ্রেশন করে থাকে। অবিশ্বাস্য মনে হয়, যখন জানতে পারি পটারের দুনিয়ার অদ্ভুত নামের একটা গাছও কাল্পনিক না। ফ্লাক্সউইড, টোডফ্লাক্স, ফ্লিওয়ার্ট, গাউট-ওয়ার্ট, মাগওয়ার্ট, গ্রোমেল, এসব উদ্ভট নামের প্রতিটা গাছের বাস্তব অস্তিত্ব ছিল। আছে। সপ্তদশ শতকের বিখ্যাত বটানি বই ‘কালপিপারস কমপ্লিট হারবাল’ থেকে প্রতিটা নাম নেওয়া। মজার ব্যাপার, এই বাস্তব গাছগুলো আমরা হাতে পেলেও তা দিয়ে একটাও ‘ম্যাজিক পোশান’ বানাতে পারব না। রাওলিং শুরুতেই সে রাস্তা বন্ধ করে রেখেছেন। সেই জাদুপানীয় বানাতে গেলে তাতে হাত ছোঁয়ানো যাবে না। আর একমাত্র উইজার্ডরাই না ছুঁয়ে জিনিস মেশাতে পারে!

যত পর্ব এগিয়েছে হ্যারির কাহিনি, তত অন্ধকার থেকে প্রগাঢ় অন্ধকারের দিকে এগিয়েছে। পাঠকও তৈরি হয়েছে অন্তিম লড়াইয়ের জন্য। এ লড়াই চিরকালীন। সাদা আর কালোর লড়াই। ইন ইয়াং-এর লড়াই। ডেভিড আর গলিয়াথের লড়াই। একেবারে শেষে যে লড়াইটা বাধে, আগের ছ’টা পর্ব জুড়ে চলে সেই লড়াইয়ের মহাকাব্যিক প্রেক্ষাপট রচনা। তাতে একের পর এক সাবপ্লট হিসেবে আসেন স্নেপ, ক্যুইডিচ, ম্যালফয়, ক্লাসের খুঁটিনাটি, আজ়কাবানের কারাগার। যত উপন্যাস গড়ায়, দেখা যায় এ লড়াই আসলে হ্যারির একার লড়াই। অসম লড়াই। রাজা পঞ্চম হেনরির মতো। কিং আর্থারের মতো। প্রাচীন গ্রিক ট্র্যাজেডির বীরদের মতো হ্যারিকেও একের পর এক পড়ীক্ষার সামনে ফেলেন রাওলিং। দেখতে চান, সে কেমন করে মোকাবিলা করে তাদের। এ পরীক্ষা বীরত্বের, বুদ্ধির, বন্ধুতার, মানবতার। সময় এগিয়ে পিছিয়ে যায়। হ্যারির অতীতের অন্ধকার পাঠককে চমকে দেয়। আর তখনই হ্যারির ভাগ্য মিশে যায় তার চিরশত্রু ভোল্ডেমর্টের সঙ্গে।

বারবার হ্যারির কাহিনি অনুষঙ্গে তাঁর বাবারা ফিরে ফিরে আসেন। সবুজ চোখের হ্যারির চোখদুটো মা লিলির মতো। বাকি সবটাই বাবা। যে বাবাকে সে কোনওদিন দেখেনি। যে বাবা আর মা তাকে বাঁচাতে গিয়ে মারা গেছিলেন বলে সবাই বলে। অনেকদূরে, অনেক আগে ক্রিপ্টন গ্রহেও একবার ঠিক এমনটা হয়েছিল না? ছোট্ট ছেলেটাকে বাঁচাতে পৃথিবীতে পাঠিয়ে দিয়েছিল তার মা-বাবা, নিজের প্রাণের বিনিময়ে। কিন্তু সব ক্লার্ক কেন্ট কি সুপারম্যান হতে পারে? হ্যারিও পারেনি। তার পালিত বাবা ডামবেল্ডোর আর সিরিয়াস ব্ল্যাক তাকে জানায়, এই ভয়, এই অপূর্ণতা তাঁর জন্মের সময় থেকে প্রাপ্ত। অদ্ভুত এক সংযোগের তার বেঁধেছে তাকে আর ভোল্ডেমর্টকে। এই লড়াই তাই শুধু অস্তিত্বর লড়াই না হয়ে ঔদ্ধত্ব আর হতাশার বিরুদ্ধে লড়াই হয়ে ওঠে হ্যারির অজান্তেই। 

হ্যারির কাহিনির তন্নিষ্ঠ পাঠকরা খেয়াল করবেন, প্রচলিত ফিকশন ও ফ্যান্টাসি থেকে কোথাও হ্যারি নিজের শিকড় সরায় না। প্রাচীন গড়িক আর নর্স উপাখ্যান, বেউলফ, টকিনের জগৎ, লুইসের নারনিয়া এমনকী অ্যালিসের অনুষঙ্গও এসেছে হ্যারিতে। একাধিকবার। কিন্তু কখনওই তা প্রক্ষিপ্ত লাগেনি। রাওলিংয়ের ম্যাজিক এখানেই। হোমারের ইলিয়ড, মিলটনের প্যারাডাইস লস্টের মতো ক্লাসিকের ঠিক পাশেই ধরতাই হিসেবে রাওলিং রাখেন ‘ওয়ান্স এন্ড ফিউচার কিং’ বা স্পাইডারম্যানকে। ক্লাসিকসের সঙ্গে পপুলার লিটারেচার মিলিয়ে মিশিয়ে এই অদ্ভুত আমোরটেনসিয়াটি একমাত্র রাওলিং-ই তৈরি করতে পারেন। এ বইগুলো একাধারে ফ্যান্টাসি, কামিং অফ এজ নভেল, ডিটেকটিভ উপন্যাস, পারিবারিক আখ্যান, ফোকলোর- এক কথায় সম্পুর্ণ পট বয়লায়। আর তাই প্রতিটা হ্যারি পটার বইতে সব বয়সী মানুষের জন্য কিছু না কিছু থেকেই যায়। শুধু ফ্যান্টাসি হলে এই স্বাদ পাওয়া যেত কিনা, সন্দেহ আছে। 

Harry Potter Booklist
পটারের দুনিয়া

ইংরাজিতে একটা বড় শব্দ আছে। ‘Bildungsroman’, যার সেই অর্থে কোনও বাংলা প্রতিশব্দ নেই। একজন মানুষ আর তার বেড়ে ওঠার কাহিনি নিয়ে বয়ে চলে এর আখ্যান। জেন আয়ার, টু কিল আ মকিং বার্ড, টম সইয়ার কিংবা অ্যান অফ গ্রিন গ্যাবেলস, এই ঘরানারই কাহিনি। তবে এরা কেউই এই ধারাটিকে এমন মহাকাব্যিক উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারেননি, যেমন রাওলিং পেরেছেন।

আবার একটু ব্যক্তিগত আলোচনায় ফিরে আসি। মাধ্যমিকের পরে সিমলা গেছি বাবামায়ের সঙ্গে। ম্যাল প্রচণ্ড বরফে ঢাকা। বেশিরভাগ দোকানই বন্ধ। দু’একটা খোলা। তার মধ্যেই একটা বইয়ের দোকানে ঢুকে গেলাম। মারিয়া ব্রাদার হতে পারে, নাও পারে। মনে নেই। নানা বই ঘাঁটতে গিয়ে আচমকা একটা বইতে হাত পড়ল। তখনও আমি ইংরিজি বই বেশি পড়ি না। বেশি কেন? পড়ি না বললেই চলে। এই বইটার নাম শুনেছিলাম। পেপারে খুব লেখালেখি হচ্ছিল। হাতে নিয়ে দেখি ১৯৯৭ সালের হার্ড বাউন্ড ব্লুমসবেরী প্রথম সংস্করণ, অবশ্য প্রথম পাঁচশোটা নয়। ঠিক তার পরেরটামলাট এঁকেছিলেন শিল্পী টমাস টেলর, এখন যে মলাট আইকনিক হয়ে গেছেকিনে ফেলে সো-ও-জা কালীবাড়িতে ফিরেই পড়া শুরু করেছিলাম।

সেই আমার ইংরিজি বই পড়া শুরু। এখন ভাবি, প্রথম বইটাই এত টানটান না হলে কোনওদিন কি আদৌ ইংরিজি গল্পের বই পড়ার অভ্যাস হত? কে জানে? আজকের দিনে সে জন্মেছিল। তার লেখিকাও। আর ঠিক পঁচিশ বছর আগে প্রকাশিত হয়েছিল তার অদ্ভুত যাত্রার প্রথম বইটা। হ্যারি পটার অ্যান্ড দি ফিলোজ়ফারস স্টোন। সেই যে হ্যারিতে মজেছিল গোটা দুনিয়া, আজও সেই নেশা কাটল না।

জন্মদিনে ভাল থাকবেন রাওলিং। বেঁচে থেকো হ্যারি পটার….

 

*ছবি সৌজন্য: Pinterest, Scholastic ও লেখক

জন্ম ১৯৮১-তে কলকাতায়। স্নাতক, স্নাতকোত্তর এবং পিএইচডি-তে স্বর্ণপদক। নতুন প্রজাতির ব্যাকটেরিয়ার আবিষ্কারক। ধান্য গবেষণা কেন্দ্র, চুঁচুড়ায় বৈজ্ঞানিক পদে কর্মরত। জার্মানি থেকে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর লেখা গবেষণাগ্রন্থ Discovering Friendly Bacteria: A Quest (২০১২)। তাঁর লেখা ‘কমিকস ইতিবৃত্ত’ (২০১৫), 'হোমসনামা' (২০১৮),'মগজাস্ত্র' (২০১৮), ' জেমস বন্ড জমজমাট'(২০১৯), ' তোপসের নোটবুক' (২০১৯), 'কুড়িয়ে বাড়িয়ে' (২০১৯) 'নোলা' (২০২০) এবং সূর্যতামসী (২০২০) সুধীজনের প্রশংসাধন্য। সম্পাদনা করেছেন ‘সিদ্ধার্থ ঘোষ প্রবন্ধ সংগ্রহ’ (২০১৭, ২০১৮)'ফুড কাহিনি '(২০১৯) ও 'কলকাতার রাত্রি রহস্য' (২০২০)।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *