পাওভাজি একটি দ্বন্দ্বসমাস হতে বাধ্য। কারণ পাও বা পাঁউরুটি এবং ভাজি বা সবজি সহকারে ভাজা ঘুগনির সমন্বয়ে সৃষ্ট এক অপূর্ব ভারতীয় খানা, যার জন্ম মহারাষ্ট্রে। আর শুধু মহারাষ্ট্র কেন? বারাণসী থেকে ব্যাঙ্গালুরু, কামাখ্যা থেকে কাথিয়াওয়াড়, সর্বত্র অতি জনপ্রিয় একটি ফাস্টফুড পাওভাজি। এর মূল কারণ অবশ্যই উপনিবেশবাদের গর্ভে প্রোথিত এবং যার উৎপত্তির মূলে মুম্বই। সেই ‘পাওভাজি’র উৎস সন্ধানে গিয়ে ধাঁধায় পড়লাম ! পর্তুগালের রাজকন্যার সঙ্গে ব্রিটিশ রাজপুত্রের বিয়ে, আমেরিকার গৃহযুদ্ধ, গুজরাটি উদ্যোগপতিদের উৎসাহ, এ সব মিলিয়ে জন্ম নিল সুস্বাদু পাওভাজি! বুঝলেন না তো? বলি শুনুন…
ভারতবর্ষে ইংরেজরা সবচেয়ে বেশিদিন দাপিয়ে রাজত্ব করলেও এ দেশের ইতিহাস, ভূগোল, অর্থনীতিতে পর্তুগিজদের প্রভাবও কম নেই। মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকা থেকে পর্তুগিজদের হাত ধরে ভারতবর্ষে এসেছিল কাঁচালংকা, আলু, টমেটো। এবার দেখি পাওভাজি কী করে হল? অনেককাল আগে আরব সাগরের তীরে বম্বে বা মুম্বই নগরী ছিল মৎস্যজীবীদের আস্তানা। সাতটি দ্বীপ নিয়ে গড়ে ওঠা সেসময়ের বোম্বাই তখন পর্তুগিজদের দখলে। ইংল্যান্ডের রাজা দ্বিতীয় চার্লসের বিয়ে পর্তুগালের রাজকন্যা ক্যাথরিন ব্রিগাঞ্জার সঙ্গে, যার ফলস্বরূপ বিয়েতে উপঢৌকন হিসেবে চার্লস পেলেন আরব সাগর তীরের এই সাতটি দ্বীপ। এভাবেই পর্তুগীজ উপনিবেশে পড়ল ব্রিটিশ শিলমোহর। আর তার প্রভাব পড়ল খাদ্যাভ্যাসেও।
এর অনেক পরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধর সময় মুম্বইয়ের গুজরাটি তুলো ব্যবসায়ীরা রাতারাতি এই পাওভাজি বেচে বড়লোক হয়ে গেছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউ অরলিয়ঁ, মিসিসিপি অববাহিকা তুলো উৎপাদনের সবচেয়ে বড় ক্ষেত্র তখন। এই খামারগুলোতেই ক্রীতদাসদের দিয়ে করানো হত সব কাজ। মার্কিন গৃহযুদ্ধের প্রধান কারণই ছিল এই দাসপ্রথা, এ কথা প্রায় সকলেরই জানা। গৃহযুদ্ধের কারণে তুলোর উৎপাদন ও সরবরাহ বন্ধ হল। জর্জ ওয়াশিংটন তাঁর ইউনিয়ন নৌবাহিনী দিয়ে পাহারা বসিয়েছিলেন মিসিসিপি অববাহিকায়।
এদিকে ম্যানচেস্টারের কাপড় কলগুলোর তাঁত বন্ধ হয়ে পড়ে আছে। তুখোড় বেনিয়া ব্রিটিশদের চতুর বুদ্ধি। তারা সেই সুযোগে তুলো আমদানি করতে লাগল উপনিবেশ ভারতবর্ষ থেকে। এদিকে ইউরোপের সঙ্গে ভারতবর্ষের সময়ের পার্থক্যের কারণে কারখানাগুলোতে কাজও হত দীর্ঘ সময় ধরে, প্রচণ্ড চাহিদার জন্য। প্রায়ই শ্রমিকেরা বাড়ি ফিরত অনেক রাতে। কাজের মাঝে খাবারের জন্য সময়ও মিলত কম। তাদের খাওয়ানোর জন্যই এই চটজলদি পাওভাজির উদ্ভাবন। আমার মতে কমপ্লিট কম্বো মিল।

মটরের প্রোটিন, ঘুগনির মধ্যে দেওয়া নানারকমের আনাজ… গাজর, বিনস, ফুলকপি, ক্যাপ্সিকাম, আলু, পাঁউরুটির কার্বোহাইড্রেট আর নাটের গুরু মাখনের আদি অকৃত্রিম স্নেহপদার্থ মিলে সুষম আহার বটে। বাজারচলতি পাও, মটরের ঘুগনি, টুকরো করে কাটা সব আনাজপাতি হল বেসিক জোগাড় পাওভাজি বানাতে। সামান্য রিফাইন্ড তেলে পেঁয়াজ, লংকা, ধনেপাতাকুচি আর টমেটো দিয়ে নেড়ে নেওয়া সব আনাজপাতি। বাজারচলতি পাওভাজি মশলা দিয়ে আরও খানিকক্ষণ নাড়াচাড়া। এবার ঘুগনি দিয়ে হাতায় করে দলাই মলাই বেশ কিছুসময়। এবার মাখন অল্প করে। সামান্য লেবুর রস।
ওদিকে ননস্টিক প্যানে মাখন ব্রাশ করে দু’টুকরো করে নেওয়া টাটকা পাও সেঁকে নেওয়া মুচমুচে করে এপিঠ ওপিঠ ঘুরিয়ে ফিরিয়ে। যেমন দেখেছিলাম বারাণসী থেকে নৌকো করে রামনগর গিয়ে রাস্তার ধারে কিম্বা মুম্বইয়ে ছত্রপতি শিবাজি টারমিনাসে আর কলকাতার স্ট্র্যান্ড রোড, ডালহৌসি কিম্বা ডেকারস লেনেও। ছুটির দিনে ব্রেকফাস্ট আর ডিনারের মাঝামাঝি এক ঢিলে দুইপাখি মেরে পাওভাজি দিয়ে দিব্যি ব্রাঞ্চ সেরে নেওয়া যায় কিন্তু।
‘শুভশ্রী’ লিটল ম্যাগাজিনে প্রকাশিত একটি লেখায় পাওভাজির এই ঘুগনিকে কলকাতার অন্যতম সস্তার পথখাদ্য বলেছেন অর্পিতা সরকার। তাঁর মতে, ধোঁয়া ওঠা এই ঘুগনি হল আমাদের নার্সারি রাইমসের “hot peas porridge”। মধ্যযুগীয় ইউরোপে গরিব চাষিদের একমাত্র সম্বল। এই পিজ পরিজে প্রোটিনের চাহিদা তো মিটতই, খিদেও মিটত। তাই আমাদের দেশের অন্যতম পথখাদ্য ঘুগনি-পাউরুটি নিয়েও আর কোনও সংশয় থাকে না। ঘুগনির প্রথম রেসিপি লেখা হয়েছিল রোমের প্রথম রান্নার বই “De re coquinaria”-তে (on the subject of cooking)। ন’রকমের ঘুগনির রেসিপি আছে এই বইতে। কিন্তু এই বই লেখার অনেক আগে থেকে এথেন্সের রাস্তায় ফেরিওয়ালা ঘুগনি ফেরি করে বেড়াত খ্রিষ্টপূর্ব ৫০০-৪০০ অব্দে। তাহলে এই ঘুগনির মটর, যা পাওভাজির প্রধান উপকরণ, তা ভারতে এল কবে?
ভারতবর্ষে ইংরেজরা সবচেয়ে বেশিদিন দাপিয়ে রাজত্ব করলেও এ দেশের ইতিহাস, ভূগোল, অর্থনীতিতে পর্তুগিজদের প্রভাবও কম নেই। মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকা থেকে পর্তুগিজদের হাত ধরে ভারতবর্ষে এসেছিল কাঁচালংকা, আলু, টমেটো। এবার দেখি পাওভাজি কী করে হল? অনেককাল আগে আরব সাগরের তীরে বম্বে বা মুম্বই নগরী ছিল মৎস্যজীবীদের আস্তানা। সাতটি দ্বীপ নিয়ে গড়ে ওঠা সেসময়ের বোম্বাই তখন পর্তুগিজদের দখলে।
লেখক জানিয়েছেন ঘুগনি মটর আলেকজান্ডারের হাত ধরেই ভারতে এসেছিল। মৌর্য সম্রাট চন্দ্রগুপ্তের সঙ্গে গ্রিকদের শত্রুতার পরিসমাপ্তি ঘটে আলেকজান্ডারের সেনাপতি সেলুকাসের কন্যার সঙ্গে চন্দ্রগুপ্তের বিয়ের মাধ্যমে। আর সেই বিয়ের মেন্যুতে গ্রিক ঘুগনি পরিবেশিত হয়। চরক সংহিতায় আলিসোদাগা (Alisaudaga) নামে কড়াইশুঁটির যে প্রজাতির কথা মেলে তা আলেক্সান্দ্রিয়ায় উৎপন্ন এক গুরুত্বপূর্ণ ফসল, যা আলেকজান্ডারের হাত ধরে ভারতে জনপ্রিয় হয়। ঐতিহাসিক সিলভ্যাঁ লেভিও এ মতকে মান্যতা দিয়েছেন । আবার পতঞ্জলি কালায়া সূপ (Kalaya Supa) নামে মটর দিয়ে তৈরি একটি ঝোলজাতীয় খাবারের কথা বলেছেন।

পাঁউরুটি আমাদের দেশে বিলিতি প্রাতরাশ হিসেবেই সুপরিচিত। তবে স্বদেশী আন্দোলনের যে সময়টায় বিলাতি দ্রব্য বর্জনের রমরমা ওঠে, ঠিক তখনি শুরু হয় বাংলার বেকারি কালচার। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের শিষ্য শরৎচন্দ্র ঘোষ “আর্য বেকারি অ্যান্ড কনফেকশনারি” খুলে বাঙালির হাতে তুলে দেন দেশীয় পাঁউরুটি। একখানি বইও লিখেছিলেন তিনি “পাশ্চাত্য পাকপ্রণালী ও বেকারী দর্পণ” নামে। এই দেশীয় বেকারির পাঁউরুটি অচিরেই জনপ্রিয় হয়েছিল এমনকী বিদেশিদের কাছেও।
আমার মফসসলের কাটানো ছোটবেলায় সন্ধের মুখে একটি ছেলে চেঁচিয়ে, হাতে ঘুঙুর বাজিয়ে বিক্রি করত গরম পাঁউরুটি। টিনের মধ্যে করে নিয়ে আসত। মা যেদিন ঘুগনি বানাতেন, সেদিন পাঁউরুটিওয়ালার ডাক শুনলেই বলতাম, মা আজ হাতরুটির ছুটি দাও, ঘুগনি দিয়ে পাঁউরুটি খাব। পাঁউরুটির সঙ্গে ঝোলাগুড়ের কেমিস্ট্রি আজও রসনায় ধরা পড়েনি, তবে আজকের ফাস্ট লাইফে বাঙালির প্রাতঃরাশে বাটার বা জ্যামটোস্ট কিন্তু আদি অকৃত্রিম এক ঝামেলা ঝঞ্ঝাট মুক্ত কেজো জলখাবার। পাঁউরুটির সঙ্গে ডিমের সঙ্গতে ফ্রেঞ্চটোস্ট, সবজি দিয়ে স্টারফ্রাই করা ব্রেড স্যালাড, কারিপাতা ফোড়ন দিয়ে পাঁউরুটি চটকে ব্রেড উপমা আর অগতির গতি ব্রেড-অমলেট কিম্বা স্যান্ডুইচ সব ঘরোয়া খাবার।

পৃথিবীর যে কোনও দেশেই হাতে বানানো রুটির পাশাপাশি পাও বা ছোট গোলাকৃতি পাঁউরুটির ভালই কদর। ইংরেজি ‘pav’ শব্দটি এসেছে পর্তুগীজ ‘pao’ থেকে যার অর্থ রুটি। আবার পাওভাজির এই ছোট ছোট বানগুলি বিদেশের বার্গার ব্রেডের ছোট সংস্করণ। উভয়ক্ষেত্রেই বান রুটিগুলিকে মধ্যিখান থেকে কেটে দু’ টুকরো করা হয়।
আর সেই মহারাষ্ট্র, মানে যেখানে কঠোর পরিশ্রমী মজুরদের পেটভরা জলখাবারের জন্য পাওভাজির জন্ম, সেখানে কিমা পাও বা কিমার পুর ভরা পাও আর বড়াপাও এখন সেলেব্রিটি স্ট্রিট ফুড। ১৯৭১ সালে মুম্বইয়ের দাদার স্টেশনে নিত্যযাত্রীদের কথা ভেবে অশোক বৈদ্য নামে এক খাবার বিক্রেতা জন্ম দেন এই বড়াপাওয়ের, যা পথে চলতে চলতেই খাওয়া যাবে। সেখানেও পাঁউরুটির মধ্যে চাটনি দেওয়া সেদ্ধ মটরশুঁটি, লংকা, রসুন, নারকোলের মন্ডের মিশ্রণ। তবে শুধু ঘুগনিই বা কেন, তার সঙ্গে সেউভাজা আর টমেটো মিশিয়ে লাল ঝোল তরকারির সঙ্গতে মিসল পাও, আর তারই আর এর রকমভেদে উসল পাও রোজকার আটপৌরে পাঁউরুটিকে এক অন্য মাত্রা দিয়েছে নিঃসন্দেহে।
*ছবি সৌজন্য: Indianhealthyrecipies, cookpad, youtube
রসায়নের ছাত্রী ইন্দিরা আদ্যোপান্ত হোমমেকার। তবে গত এক দশকেরও বেশি সময় যাবৎ সাহিত্যচর্চা করছেন নিয়মিত। প্রথম গল্প দেশ পত্রিকায় এহং প্রথম উপন্যাস সানন্দায় প্রকাশিত হয়। বেশ কিছু বইও প্রকাশিত হয়েছে ইতিমধ্যেই। সব নামীদামি পত্রিকা এবং ই-ম্যাগাজিনের নিয়মিত লেখেন ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনি, রম্যরচনা ও প্রবন্ধ।