নিউজার্সিতে তখন বসন্ত এসে গেছে। দীর্ঘ শীতের শেষে এই সেই সময়, যখন বাঙালির ঘরে ঘরে উইকেন্ডের পার্টি, নিজস্ব ক্লাব হাউসে আসন্ন নববর্ষ উৎসব, রবীন্দ্রজয়ন্তীর রিহার্সাল শুরু হয়। পরিযায়ী পাখিরা কলকাতা থেকে ফিরে রুটিন জীবনে অভ্যস্ত হয়। যদিও এই বছর আমাদের প্রবাসজীবনে নববর্ষ উৎসবের কোনও আয়োজন ছিল না। দুহাজার বিশের বিষক্ষয় এর প্রক্রিয়া এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের আতঙ্ক রেখে গেছে। কাচের স্বর্গে বাস করে যে দেশের মানুষ বরাবর বিশ্বাস করে এসেছে, দুর্ভিক্ষ মহামারী হয় তৃতীয় বিশ্বের গরিব দেশে, টিভি চ্যানেলে ইবোলা, সারস্ এর মতো মারণব্যাধি আক্রান্ত শিশুর ছবি দেখে “রেডক্রস”, “কেয়ার” নয়তো “সেভ দ্য চিলড্রেনে”এ কিছু সাহায্য পাঠিয়ে দিয়ে ক্ষান্ত থেকেছে, সেই আমেরিকায় করোনাভাইরাস এর সংক্রমণে পাঁচ লাখের বেশি মানুষ ততদিনে মারা গেছে। ভ্যাকসিন না পাওয়া পর্যন্ত মহামারীর আতঙ্ক, সামাজিক বিচ্ছিন্নতা, গৃহবন্দি জীবন, প্রায় নির্বাসনের মতোই কেটেছে সেইসব দিনরাত্রি দীর্ঘসময়।

 

কোডিড নাইনটিনে হারিয়েছি আমাদের দীর্ঘদিনের দুই বন্ধুকে। নিউজার্সির বাঙালি সমাজে প্রথম এমন ঘটল যে বিপদের দিনে এক বিপর্যস্ত পরিবারের পাশে কেউ দাঁড়াতে পারল না। তখন শহরে শহরে লকডাউন। হাসপাতাল, ফিউনারেল হোমে যাওয়া বারণ। সেদিন নিজের বাড়ির আপাত নিরাপত্তা বলয়ে বসে থেকে, বহুদিন আগে পড়া কবিতা সিংহের কবিতার দুটো লাইন মনে পড়ছিল – “মানুষ যখন লড়ে, তখন সবাই মিলে লড়ে, মানুষ যখন মরে, তখন একা”।

 

কবিতার কথায় মহামারীর মরশুমে সদ্যোজাত বাঙালি কবিদের রাশি রাশি কবিতা মনে পড়ছে। সদ্য বলতে তাদের বয়স নয়, প্রতিভা স্ফুরণের কথা বলছি । শিলিগুড়ি থেকে কেন্টাকি, হোয়াটসঅ্যাপে লাগাতার স্বভাব কবিদের কবিতার বন্যা। সঙ্গে কারও বউয়ের গান- “কিচ্ছু চাইনি আমি আজীবন ভালবাসা ছাড়া”- । আশাতীত এইসব উপহারে অভিভূত হতে হতে কত মাস যে কেটে গেল। তার ওপর রয়েছে ভার্চুয়াল জলসার। নিউইয়র্ক, নিউজার্সি, টেক্সাসের বাঙালিরাই ছিল প্রধান উদ্যোক্তা। যে ক্লাব যেমন চাইছে, সেই মতো কুড়ি ডলার, পঁচিশ ডলার ঠুকে দিয়ে দেশের শিল্পীদের গান, বাজনা, কবিতাপাঠ, দেখতে বসে যাও। প্রথম প্রথম দু’দেশের দশ ঘন্টা টাইম ডিফারেন্সে মুশকিল হচ্ছিল। আমরা চাইছি ডিনারের পর জলসা দেখব ওদিকে দেশে তখন সাতসকাল। নিমরাজি হয়ে হারমোনিয়ামে বসে আধঘুমে কী যে গাইছেন। তারপর তাদের দাবি মেনে আমরা কখনও কখনও অবেলায় বসে কলকাতার রাতের জলসা দেখেছি। 

ঘরবন্দি থেকে থেকে ক্রমশ বাঙালির ভার্চুয়াল প্রোগ্রামের উৎসাহ এমন বেড়ে গেল যে, স্থানীয় প্রতিভারা ঘন ঘন zoom এ আবির্ভূত হতে লাগল। একটা দল নাটক উপস্থাপনাও করল‌। দুটো ক্লাবের প্রেরণায় আমিও কোথায় যেন গ্রন্থনা আর দেশের কবি, বাচিক শিল্পীদের আসর পরিচালনার জন্য ‘ ‘zoom’ এ বসেছিলাম।‌ প্রথমদিকে যান্ত্রিক জটিলতা এবং গোলযোগে হঠাৎ হঠাৎ এইসব স্ক্রিন থেকে হারিয়ে যেতাম আবার ফিরে আসতাম।  “মিউট” “আনমিউট”-এর ভুল বোঝাবুঝিতে কখনও নির্বাক চিত্র কখনও সবাক। তারপর অবশ্য বেশ সড়গড় হয়ে গেল। এখন তো বাঙালিদের ভার্চুয়াল আড্ডা, কলেজের আন্তর্জাতিক রিইউনিয়ন, নাচ-গানের আসর টাসর খুব জমে গেছে ।

দেশের শিল্পী এবং যন্ত্র শিল্পীদের নিয়ে এইসব অনুষ্ঠানের পর তাদের পারিশ্রমিক ছাড়া বাঙালি ক্লাব, কালী মন্দির থেকে করোনা ত্রাণ কার্যের জন্য রামকৃষ্ণ মিশন আর ভারত সেবাশ্রম সংঘকে অর্থ সাহায্য পাঠানো সম্ভব হয়েছে।          

তারপর শুরু হল ভ্যাকসিন পর্ব। প্রথম ডোজ্ নেওয়ার আগে “সম্ভাব্য” সাইডএফেক্ট-এর দুশ্চিন্তায় কেউ কেউ সপ্তাহ খানেকের মতো বাজারহাট রান্না বান্না সেরে নিয়েছিল যাতে ভ্যাকসিন নিয়ে ঝামড়ে পড়লেও সংসার অচল না হয়। ভ্যাকসিন পেয়ে আবার নতুন প্রতিক্রিয়া। কেউ বলল “কী যে ভ্যাকসিন দিল তো বুঝলাম না, ছুঁচ ফোটাও বুঝলাম না, জলের ছিটে লাগার মতো একটা ফিলিং হল।  পরদিনই একজন ভরদুপুরে ফোনে হাহাকার শুরু করল, ” ও আলোদি, আমি প্রায় মরে যাচ্ছিলাম গো ভ্যাকসিন নিয়ে কি মাথা ঘোরা এখন আবার শীতে কাঁপছি, তুমি কিন্তু দু-তিনদিন শুয়ে থাকবে‌।” তার বর এক দাড়িওয়ালা, পাগড়ি পরা সরদারজি। সেই ডাক্তারও নাকি ভ্যাকসিন নিয়ে একদিন জ্বরে পড়েছিল। কিন্তু সরদারজির নব্বই বছরের বাবা বিলকুল চাঙ্গা আছেন। ভ্যাকসিন সম্পর্কে এমন সব কথা কাহিনি  শুনতে শুনতে আমাদেরও দুটো ডোজ্ নেওয়া হয়ে গেল। প্রথমবার একটু শীত শীত লেগেছিল, দ্বিতীয় ডোজ এরপর এক্কেবারে ফিট।

 গত এক বছর ধরে মুখোশ পরার অসোয়াস্তির মতোই একটু মিথ্যে কথাও বলতে হয়েছে। ঠিক মিথ্যে নয়, একটু চেপে যাওয়া। মেয়ের খবরদারির থেকে বাঁচার জন্য। ও থাকে এক ঘন্টা দূরে কানেকটিকাটে। হঠাৎ হঠাৎ বিনা নোটিশে একগাদা বাজার-টাজার নিয়ে হাজির হয়। সেসব অতি স্বাস্থ্যকর খাদ্য। আমাদের নাকি সুপারমার্কেট ওষুধের দোকান কোথাও যাওয়া চলবে না। ওর ছোটবেলার দু’জন আমেরিকান বন্ধু আমার শহরেই থাকে, তারাই নাকি আমাদের লিস্ট নিয়ে গ্রসারি শপিং করে দিয়ে যাবে। এদিকে আমরা তো দিব্য়ি লুকিয়ে লুকিয়ে অন্য শহরে প্যাটেল ব্রাদার্স, ইন্ডিয়া বাজারে যাচ্ছি। হাতে গ্লাভস, দস্যু মোহন ও দস্যু রানি সেজে দোকানে ঢুকে, পুঁইশাক, করলা, মসালা পরোটা, ফ্রোজেন জাম্বো সামোসা,  দহিবড়া, শিক কাবাব, মথুরা পেঁড়া, হলদিরামের সোনপাপড়ি কিনে আনছি। 

সামাজিক বিচ্ছিন্নতার দুঃখে, মাঝরাত অবধি জেগে বসে টলিউড, বলিউডের নতুন পুরনো মুভি দেখে যাচ্ছি। সন্ধ্যে সাতটায় ডিনার সেরে, মাঝরাতে পেঁড়া, সোনপাপড়ি, মতিচুর লাড্ডু বেশ লাগে৷ ওদিকে আমেরিকান ছেলে-মেয়ে দুটো আমাদের জন্য বাজার করতে না পেরে মেয়ের কাছে ফোন করে। মহা মুশকিলে পড়া গেছে। দুতিন বার তো “প্যাটেল ব্রার্দাসে” পটল বাছতে বাছতে মেয়ের ফোন পেয়েছিলাম – “তোমরা ফোন ধরছ না কেন বল তো? বাবা কোথায়?” সে মুহূর্তে পটল তোলার দুঃসবাদ না দিয়ে মিথ্যে বলা ছাড়া উপায় কী? এইসব মিথ্যাচার,  লুকোচুরি চলছে বেশ কয়েক মাস, এখন স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার উদ্দীপনায় আবার সামাজিক আমন্ত্রণ নিমন্ত্রণ এর ডাক আসছে। আসুন আর ভার্চুয়াল প্রেমের খাঁচায় বন্দী থেকে নয়, আমাদের দেখা হোক মুখোশের অবরোধ মুক্ত হয়ে। 

ছবি সৌজন্য: Wikimedia Commons

দীর্ঘকাল আমেরিকা-প্রবাসী আলোলিকা মুখোপাধ্যায়ের লেখালিখির সূচনা কলকাতার কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় প‍র্বে। আমেরিকার নিউ জার্সির প্রথম বাংলা পত্রিকা "কল্লোল" সম্পাদনা করেছেন দশ বছর। গত আঠাশ বছর (১৯৯১ - ২০১৮) ধরে সাপ্তাহিক বর্তমান-এ "প্রবাসের চিঠি" কলাম লিখেছেন। প্রকাশিত গল্পসংকলনগুলির নাম 'পরবাস' এই জীবনের সত্য' ও 'মেঘবালিকার জন্য'। অন্য়ান্য় প্রকাশিত বই 'আরোহন', 'পরবাস', 'দেশান্তরের স্বজন'। বাংলা সংস্কৃতির প্রচার ও প্রসারের জন্য নিউইয়র্কের বঙ্গ সংস্কৃতি সঙ্ঘ থেকে ডিস্টিংগুইশড‌ সার্ভিস অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *