পৃথিবী (নাটক): [পর্ব ১] [পর্ব ২] [পর্ব ৩]

শ্যামলী: আমি কেন বলব? ওর বলার কথা ছিল। 

সুজয়: আমিই বলতাম। সত্যি বলছি মাসিমা, আজ নয়ত কাল আমি সত্যি আপনাদের বলতাম। বেশ ফরমালি বলতাম, মানে মা বাবাকে সঙ্গে এনে ঘটা করে বলতাম। কিন্তু দুম করে এই ব্যাপারটা ঘটে গিয়ে সব প্ল্যান তো বানচাল হয়ে গেল। তাই ভাবলাম – 

মৃত্যুঞ্জয়: পাঁচদিন বাদে পৃথিবী যখন ধ্বংসই হয়ে যাবে, তখন কাজটা যত শীঘ্র করে ফেলা যায় ততই মঙ্গল। অন্তত কয়েকটা বিবাহিত দিন তো একসঙ্গে কাটাতে পারবে। 

সুজয়: ঠিক বলেছেন মেসমশাই। সেই প্রপোজালটা দিতেই এলাম। কিন্তু – 

মৃত্যুঞ্জয়: কিন্তু?

সুজয়: আপনি বলছেন বিয়ের কোনও খরচ আপনি করতে পারবেন না। কোন সঞ্চয় নেই। তাহলে? 

শ্যামলী: তার মানে? তুমি কি বিয়ের জন্য টাকা পয়সা নেবে নাকি?

সুজয়: না তা বলিনি। কিন্তু বিয়ের তো একটা খরচা আছে। ম্যারাপ, প্যান্ডেল, আলো, মাইক। তারপর কম করে হলেও শ-দুই লোক খাবে। কি বলুন মেসোমশাই? 

মৃত্যুঞ্জয়: হ্যাঁ সেটা অবশ্য ঠিক। কিন্তু তুমি যখন বলছ দশ দিন বাদেই সব শেষ, তখন এইসব বাজে খরচের কোনও প্রয়োজন আছে কি? 

শ্যামলী: এক পয়সা খরচ করবে না বাবা। (সুজয়কে) লোক খাওয়াতে হলে তুমি খাওয়াবে – তোমার পয়সায়। 

সুজয়: আমার পয়সায়? আমার পয়সা কোথায়? যে চাকরি করি, বাড়িতে সংসার খরচের টাকা দিয়ে এক পয়সাও বাঁচে ভেবেছ? 

শ্যামলী: বেশ তাহলে খাওয়াবে না। রেজিস্ট্রি আপিসে যাব, বিয়ে করব, চলে আসব। রেজিস্ট্রি ফিটা নাহয় আমিই দিয়ে দেব। 

সুজয়: যাহ্‌ তাই কখনও হয় নাকি? বাড়ির বড় ছেলে আমি, সবাই আশা করে আছে। তাছাড়া একটা ইয়ের ব্যাপারও তো আছে – 

মৃত্যুঞ্জয়: কিন্তু সুজয়, আমি সত্যিই এই মুহূর্তে কিছু খরচ করতে পারব না। ভেবেছিলাম, শ্যামলীর বিয়ে ঠিক হলে বাড়ির একটা অংশ বেচে কিছু টাকা তুলব। কিন্তু তোমার কথা যদি সত্যি হয়, সেই সময়ও তো হাতে নেই। 

শ্যামলী: বাড়ি বিক্রি টিক্রির কোনও প্রয়োজন নেই। এমনি বিয়ে করতে হলে করবে, নাহলে ফোট! বিয়ে না করলেও আমার চলে যাবে। 

মানসী: মিত্তিররা বলেছে মেয়ে পছন্দ হলে ওরা একপয়সাও নেবে না। বিয়ের সব খরচ ওদের। ছেলে নাকি কড়া ভাষায় জানিয়ে দিয়েছে। 

শ্যামলী: মিত্তির? মিত্তির কে? 

মৃত্যুঞ্জয়: এই যা! বলে ফেললে? 

(মানসী উসখুস করে। সুজয় ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে তাকিয়ে থাকে) 

মানসী: আমি যাই রান্না চাপাতে হবে। 

শ্যামলী: কোথাও যাবে না। বল, মিত্তির কে? 

মানসী: মিত্তির, মানে তোর শান্তি কাকিমার দেওর –  নামটা আমার মনে নেই। (মৃত্যুঞ্জয় কে) আঃ তুমি বল না। 

মৃত্যুঞ্জয়: সুশান্ত – সুশান্ত মিত্র – 

মানসী: ওর ছেলে আমেরিকায় থাকে। নিজের কোম্পানি, বিশাল রোজগার, বাড়ি গাড়ি, কী নেই। গত সপ্তাহে দেশে এসেছে। আজ তোকে – দেখতে আসবে। 

শ্যামলী: দেখতে আসবে? তার মানে? আমি কি সিনেমা নাকি যে আমাকে দেখতে আসবে?

মানসী: না না, সেরকম দেখতে আসা নয়। ওরা এমনি আসবে, গল্প স্বল্প করবে।  তোকে সাজতে গুজতে হবে না, মিষ্টি দিতে হবে না – ওরা পরিষ্কার বলে দিয়েছে – মেয়ে যেন জানতে না পারে আমরা দেখতে আসছি। 

সুজয়: মাসিমা আপনি এটা করতে পারলেন? মেসোমশাই, এটা কী হল? এমন তো কথা ছিল না।  আমেরিকার বড়লোক ছেলে পেয়ে আমাকে ভুলে গেলেন? আমি এতদিন ধরে আপনাদের কাছে আসছি, আপনাদের সুখে দুঃখে – আর সেই আমাকে আপনারা এভাবে অবহেলা করলেন? 

মৃত্যুঞ্জয়: আহা কিছুই তো ঠিক হয়নি। তাছাড়া তোমাকে তো আমরা কোনও দিনই সেভাবে ভাবিনি – 

সুজয়: ঠিকই তো।  কেন ভাববেন? আমি গরিব। গাড়ি তো দূরের কথা, সাইকেল ছাড়া আমার দ্বিতীয় বাহন নেই। জয়েন্ট ফ্যামিলিতে এক কোণে একটা ছোট্ট ঘরে থাকি, তাও এক খুড়তুতো ভাইয়ের সঙ্গে শেয়ার করে। তবু আমি স্বপ্ন দেখেছিলাম, ভেবেছিলাম শ্যামলীর সঙ্গে এক নতুন পৃথিবী গড়ব। আমাদের নিজস্ব ছোট্ট পৃথিবী – কিন্তু সেই পৃথিবী আজ ভেঙে চৌচির হয়ে গেল। 

শ্যামলী: এখনও দশ দিন বাকি আছে – 

সুজয়: শ্যামলী তুই বল। আমি তোর মুখ থেকে শুনতে চাই? তুই কি করবি? তুই কি আমেরিকার ওই ছেলের সঙ্গে – 

শ্যামলী: যদি মঙ্গল গ্রহে যাবার ব্যবস্থা করে দেয়, তাহলে তো কনসিডার করতেই হবে। 

সুজয়: শুনলেন? শুনলেন মাসিমা? শুনলেন মেসোমশাই? ও এখনও আমার সঙ্গে ঠাট্টা করছে। করতে পারছে। 

মৃত্যুঞ্জয়: কিন্তু তুমি তো বললে বিয়ের খরচ না দিলে তুমি বিয়ে করতে পারবে না। 

সুজয়: কখন? কখন বললাম সেকথা? হ্যাঁ মুশকিল হবে বলেছি। কিন্তু বিয়ে করব না বলিনি তো। 

মানসী: কিন্তু তুমি কি বিয়ে করে সংসার চালাতে পারবে? তোমার রোজগারপাতি তো তেমন নয় – 

সুজয়: মাত্র দশটা তো দিন। ও আমরা ঠিক ম্যানেজ করে নেব। কিরে শ্যামলী, পারব না? 

(দরজায় একটা টোকা শোনা যায়। সৌবীর মাথা বাড়িয়ে বলে) 

সৌবীর: আসতে পারি? 

চলবে

ছবি সৌজন্যে: Unsplash

সুদীপ্ত ভৌমিক একজন প্রতিষ্ঠিত নাট্যকার, নির্দেশক ও অভিনেতা। ওঁর নাটক অভিবাসী জীবনের নানা দ্বন্দ ও সংগ্রামের কথা বলে। সুদীপ্তর নাট্যদল একতা (ECTA) উত্তর আমেরিকা ও পশ্চিমবঙ্গের নাট্যপ্রেমীদের কাছে এক পরিচিত নাম। ভাষানগর পুরস্কার, নিউ জার্সি পেরি এওয়ার্ড নমিনেশন, সিএবি ডিস্টিংগুইশড সার্ভিস এওয়ার্ড ইত্যাদি সম্মানে ভূষিত সুদীপ্ত ড্রামাটিস্ট গিল্ড অফ আমেরিকার পূর্ণ সদস্য। ওঁর পডকাস্ট স্টোরিজ অফ মহাভারত অ্যাপল আইটিউনস-এ শ্রেষ্ঠ পডকাস্টের স্বীকৃতি পেয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *