পুবের জানলার পাশে, বাগানের যেদিকটায় ঝাঁকড়া জামরুলগাছটা আছে, সেখানে আজকাল রোজ সকাল হলেই একটা কালচে নীল পাখি এসে বসে। তার ঠোঁটের রং ডিমের কুসুমের মতো হলুদ আর বুকের কাছটা বরফের গোলার মতো সাদা। বিছানায় শুয়ে শুয়ে রুমি রোজ অপেক্ষা করে থাকে ওই পাখিটার জন্য। রুমির ভারী কঠিন অসুখ হয়েছে। যত ভুগছে, ততই খিটখিটে আর ঘ্যানঘ্যানে হয়ে যাচ্ছে মেয়েটা! ক্লাস থ্রির অ্যান্যুয়াল পরীক্ষার পরেই কী যে বিচ্ছিরি অসুখ করল! তার অল্প কিছুদিনের মধ্যেই আবার দাদুও মারা গেলেন! সত্যি কিন্তু, বিপদ কখনও একা আসে না ! দাদুর বড্ড ন্যাওটা ছিল মেয়েটা। এমন অদ্ভুত, এখন একেবারে দাদুর নাম পর্যন্ত করে না! শুধু সকাল হতে না হতেই বায়না করতে থাকে জানলার পাল্লাদুটো হাট করে খুলে দেওয়ার জন্য।
পুজো কেটেছে সবে, ভোরের দিকটায় একটু একটু হিম পড়ছে; এদিকে ডাক্তারবাবু বলে দিয়েছেন মোটেই ঠান্ডা লাগানো চলবে না। রুমির মা আর ঠাকুমার হয়েছে যত জ্বালা! কোথায় পাখি, কে জানে বাবা! তাঁরা তো কিছুই দেখতে পান না! আসলে রুমির দাদু তাঁর আহ্লাদী নাতনিকে বানিয়ে বানিয়ে এমন সব আজগুবি গল্প শোনাতেন, যে মেয়েটার মাথায় হাবিজাবি কল্পনা জট পাকিয়ে বসে থাকে সারাক্ষণ!
এই যেমন রুমি প্রথম প্রথম ভাবত, অসুখ করেছে যখন… তার কাছে হয় দইওয়ালা আসবে, অথবা সুধা। দাদুর কাছে রবি ঠাকুরের লেখা অমলের গল্প শুনেছে তো সে! ঘুমের ভান করে পড়ে থেকে ডাক্তারজেঠুর কথাও কানে এসেছে তার। সে আর কক্ষনও সারবে না! এখন তো শুধু পা দুটোয় একেবারে জোর পায় না; এরপর একটু একটু করে হাত-পা শুকিয়ে লিকপিকে হয়ে যাবে; তারপর টুপ করে একদিন আকাশের তারা হয়ে যাবে। না, তারা হয়ে যাওয়ার কথা ডাক্তারজেঠু মোটেই বলেননি; তবে সকলে যা শুকনো মুখে ঘোরাঘুরি করছিল… ঠিক বুঝে গেছে সে।
তখন তো দাদু ভালই ছিলেন, সুস্থ ছিলেন। দাদুই তো বললেন অমলের গল্প! দইওয়ালা সত্যি, সুধাও তো সত্যি! আর রাজার চিঠি? সেও তো দাদুর হাতে লিখে পাঠিয়ে দিয়েছে রুমি। গোটাগোটা অক্ষরে, রুলটানা কাগজে। পাশ ফিরে শুয়ে শুয়ে লেখা বলে একটু বেঁকেচুরে গেছে বটে সব অক্ষরগুলো; কিন্তু একটাও বানান ভুল নেই। এমনকি সে শুরুতে ‘শ্রীচরণেষু রাজামশাই’ আর চিঠির শেষে ‘আপনি আমার প্রণাম নেবেন’ লিখতেও ভোলেনি। দাদু পকেটে করে নিয়ে গেলেন চিঠিটা, বললেন ঠিকানা লিখে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। ঠিক তার তিনদিনের মাথায় তো ঘুমের মধ্যে দাদু নিজেই চলে গেলেন! কে জানে, সে চিঠি ডাকবাক্সোয় আদৌ ফেলা হয়েছিল কিনা!
কিন্তু আশ্চর্য কাণ্ড! দইওয়ালা আর সুধা এল না বটে; তার বদলে এই ছোট্ট নীল পাখিটা আসতে শুরু করল! দাদু যেদিন চলে গেলেন, তার ঠিক পরদিন থেকে। এসে আস্তে করে শিস দেয় আর রুমি দেখতে পায় পাতার আড়ালে বসে পাখিটা চকচকে কালো পুঁতির মতো চোখে সটান তার দিকেই তাকিয়ে আছে। ঘরে কেউ না থাকলে পাখিটার সঙ্গে বিড়বিড় করে অনেক গালগল্পও করে রুমি। একদিন তো কাজের মাসি সরলাদিদি ঘরে ঢুকে তাই দেখে গালে হাত দিয়ে কত কথা! ‘মা গো মা, ও রুমিসোনা, পেগলে গেলে নাকি? আপনমনে বিড়বিড় করছ কেন?’
এমন রাগ হয়ে যায়! নিজের মনে কথা বললে কি কেউ পাগল হয় নাকি? সব কথা বুঝি জনেজনে ডেকে ডেকে বলতে হবে? নিজের সঙ্গে কথা বলা যাবে না কক্ষনও? তবে তারপর থেকে সাবধান হয়ে গেছে সে। কারও পায়ের শব্দ পেলেই চুপ করে যায়। কেউ না থাকলে পাখিটা এক আধবার জানলার ধাপিতে এসে বসে আর জ্বলজ্বলে চোখে তাকিয়ে থাকে রুমির দিকে। সন্ধে নামে যেই, ফুড়ুৎ করে উড়ে গিয়ে হারিয়ে যায় ঘন সবুজ পাতার পর্দার আড়ালে। রুমির এখন আর একা লাগে না। রাতে তার স্বপ্নে দাদু থাকেন আর দিনের বেলায় নীল পাখি।
ডাক্তার মোহিত সান্যাল এবাড়ির প্রায় সদস্য বললেই চলে। বহু বছর তিনি এদের পারিবারিক চিকিৎসক। চেষ্টার তো কোনও ত্রুটি করছেন না; কিন্তু কিছুতেই রুমি সেরে উঠছে না। প্রায় বছর ঘুরতে চলল; এখনও তার অবস্থা ঠিক আগের মতোই। অবশ্য একটাই ভরসার কথা যে নতুন করে তেমন অবনতি হয়নি। বিদেশের বন্ধুবান্ধব, অন্য সব অচেনা বা আধচেনা ডাক্তারদেরও চিঠিপত্র লিখছেন মোহিত; যদি কোনওভাবে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যায়।
আজ এ বাড়িতে মোহিত এসে নিজের ল্যাপটপ খুলে ডাকলেন রুমির মা-বাবাকে। বিলেত থেকে এক নিউরোসার্জেন মেল করে জানিয়েছেন যে তিনি কয়েকদিন বাদে মুম্বই আসছেন। সেখানকার হাসপাতালে কিছু কাজ আছে। রুমির বাড়ির লোক রাজি থাকলে তিনি একবার অপারেশন করে দেখতে চান।
আশা আছে, রুমি সেরে উঠবে। তবে অপারেশনের পরে কিছুদিন ফিজিওথেরাপি জরুরি; সেটার ব্যবস্থা কলকাতাতেই করা যেতে পারে। আরও আশ্চর্যের ব্যাপার হল, ইনি রুমিদের সম্বন্ধে কিছু কিছু কথা জিজ্ঞেস করেছিলেন। সেই প্রসঙ্গেই জানতে পারা গেছে, রুমির দাদুর অনেক পুরনো ছাত্র ইনি; বিলেতে পড়াশুনো করতে যাওয়ার সময়ে রুমির দাদু নাকি নিজের বিয়েতে পাওয়া সোনার হাতঘড়িটি বিক্রি করে কৃতি ছাত্রের বিলেত যাওয়ার খরচ দেন। তারপর যা হয়, প্রথমদিকে বেশ কয়েক বছর যোগাযোগ ছিল। তারপর রুমিরা দু’তিনবার বাসাবদল করে, দাদুও অবসর নেন, ডাক্তারবাবুরও দেশে আসা কমতে কমতে একেবারে বন্ধ হয়ে যায় এবং যোগাযোগের সুতো ছিঁড়ে যায়।
এতদিন পরে নিছক কাকতালীয়ভাবেই আবার এই চিঠিচাপাটির আদানপ্রদান। ডাক্তারবাবু স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, একটি পয়সাও নিতে পারবেন না তিনি আর মুম্বইয়ের হাসপাতালে যে সময়টুকু রুমিরা থাকবে, সেই কয়েকদিনের যাবতীয় খরচও তিনিই বহন করবেন। রুমির ঠাকুমা সব শুনে হাঁ। ছেলেকে বললেন, ‘কী লোক ছিলেন তোর বাবা, একবার দ্যাখ! আমাকে বলেছিলেন ঘড়ি নাকি অসাবধানে রাস্তায় হারিয়ে এসেছেন! আচ্ছা, আমি কি অমন একটা ভাল কাজের জন্য বলেকয়ে ঘড়িটা বিক্রি করলে বাধা দিতুম?’
সেই রাতে খুব সুন্দর আর রঙিন স্বপ্ন দেখেছিল রুমি। একেবারে রামধনুরং স্বপ্ন। তাতে একটা মস্তবড় জামরুল গাছে ঘন সবুজ ভেলভেটের মতো মসৃণ পাতার ঝালর আলো করে বসেছিল সেই নীল পাখি। সে হলুদ ঠোঁট বেঁকিয়ে মিষ্টি করে হাসল। এই প্রথম রুমি জানতে পারল পাখিও খুশি হলে হাসতে জানে!
রুমি স্বপ্নে বলছিল, ‘জানো দাদুভাই, এই পাখিটা রোজ আমার কাছে এসে বসে। আমার সব কথা শোনে! ও ঠিক তোমার মতো, দাদুভাই। তুমি তো ওকে দেখতেই পেলে না! আগেই আকাশে চলে গেলে!’
দাদুর গমগমে গলা শোনা যাচ্ছিল, ‘কী করে আসি বলতো দিদিভাই! আমি যে তখন অনেক দূরে ছিলাম গো, রাজার বাড়িতে। সেখানে চিঠি পৌঁছে দিলাম, রাজাই তো চিঠি পড়ে ডাক্তার-বদ্যি সবকিছুর ব্যবস্থা করলেন!’
‘রাজার চিঠি! কিন্তু কই, সে তো আমার চিঠি! রাজা তো চিঠি পাঠাননি আমাকে!’
‘সব চিঠি কি আর কাগজ-কলম-খামে হয় দিদিভাই! অন্যভাবেও আসে। এই যে নীল পাখিটা! ওই তো তোমার চিঠির জবাব!’
‘তাহলে তো ও আমার ! এখন থেকে আমার কাছেই থাকবে?’
‘না দিদিভাই, তুমি এরপর হাঁটবে, দৌড়বে, ইস্কুল যাবে, খেলার মাঠ, নাচের ক্লাস … আরও কত কী! রাজার কাছে কি আর ওই একটা চিঠি আসে গো? অমন একগোছা চিঠি এসে পড়ে আছে। পাখির ঠোঁটে দেখেছ, একটা ফিকে নীল কাগজের টুকরো?’
‘ও মা, দাদুভাই! সত্যি তো! গায়ের রঙের সঙ্গে কী মানিয়েছে! ওটা কী?’
‘কাল ভোরবেলা যেখানে যেতে হবে ওকে, সেই ঠিকানাটা লেখা আছে। এতদিন তোমার কাছে, তোমার জন্য এখানে ছিল… কাল থেকে অন্য কোথাও…। অন্য কোনও রুমি, অন্য কোনও অনি-চিনু-বুবলির কাছে।’
‘আর তুমি? তুমিও আসবে না আর আমার কাছে?’
‘রোজ তো আসতে পারব না দিদিভাই! আমি যে এখন রাজার ডাক-হরকরা! পাখিটাকে পৌঁছে দিতে হবে পরের ঠিকানায়, কিছুদিন পরে আবার অন্য কোনও ঠিকানায়।’
পরদিন ভোরে যখন রুমির মা পুবের জানলার পাল্লাদুটো খুলে দিলেন, রুমি দেখল পাখিটা কেমন ঘন নীল ডানাজোড়া ছড়িয়ে দিয়েছে দু’পাশে। একটু পরেই কেমন আলগোছে শূন্যে ভাসিয়ে দিল ছোট্ট নরম শরীর… উড়ে যাচ্ছে, উড়ে যাচ্ছে…
রুমি জানে, ওর ঠোঁটে এখন ওই ফিকে নীল চিরকুটটা আর নেই। ওটা এখন দাদুর জিম্মায়। খাকি রঙের ঝুলির ভেতরে শুয়ে আছে অন্ধকারে। অপেক্ষা করে আছে ঠিকঠাক ঠিকানায় পৌঁছবে বলে। আলো দেবে বলে।
ইলেকট্রনিক্সের ছাত্রী ঈশানী রায়চৌধুরী তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে ভাষান্তরের কাজে যুক্ত। নিজস্ব লেখালেখির মাধ্যম হিসেবে সবচেয়ে পছন্দ রম্য গদ্য আর ছোট গল্প | আর্নেস্ট হেমিংওয়ে, ফ্রিডা কাহলো, খলিল জিব্রান, আর কে নারায়ণ প্রমুখ লেখকদের কাজ ভাষান্তর করেছেন। 'কৃষ্ণচূড়া আর পুটুস ফুল', 'আবছা অ্য়ালবাম', 'বাবু-টাবুর মা', ওঁর কয়েকটি প্রকাশিত বই।
ভীষণ মন ভালো করা একটা গল্প। লেখিকা এতো সুন্দর করে ডাকঘরের অমল, দাদু, এবং অন্য চরিত্রের সঙ্গে এই গল্পের চরিত্রদের মিলিয়েছেন যে গল্প টা একটা অন্য মাত্রা পেয়েছে।