সৌরভ হাওলাদারের কণ্ঠে এই ফিচারটির পডকাস্ট শুনতে হলে ক্লিক করুন

প্রথমটায় কেউ লক্ষ করেনি। পাশের ফ্ল্যাটের ব্যালকনিতে একটা পায়রা ঘাড় গুঁজে বসে আছে। ছাই ছাই রঙ, গলার কাছে সবুজ আভা। আর সেই ব্যালকনি ঘেঁষে কার্নিশে একটা কমলা রঙের ধুলোমাখা বিড়াল লোভী লোভী চোখে তাকিয়ে আছে আর মাঝে মাঝে থাবা চাটছে।

রাই আর রাকা নিজেদের পড়ার টেবিলে বসে। ছুটির দিনে, দিদিমণি পড়াতে এসেছে। রাই বড়, আট বছর বয়স। আর রাকা ছোট, পাঁচ বছর। তবে পড়তে পড়তেই রাকার চোখ চলে গেছে, জানালা দিয়ে অন্যদিকের ফ্ল্যাটের ব্যালকনিতে। পাখিটা বোধহয় বলল, “পিকপিক”। দিদিমনি দু’জনকে পড়া দিয়ে সকালের খবরের কাগজে চোখ রেখেছে। রাকা ফিসফিসিয়ে বলে, “দিদি, ও কী করছে?”

নিজের খাতার দিকে তাকিয়ে রাই বলে, “কে?”
রাকা জানলা দিয়ে পাশের ফ্ল্যাটের দিকে ইশারা করে। ওদিকে তাকাতেই চোখ আটকে যায়। পায়রাটা ঘাড় কাত করে ওদের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। আর মাঝে মাঝে ডাকছে, “পিকপিক”।

দিদিমণি চলে যেতে দুই বোন ছুটে আসে নিজেদের জানালায়। পাখিটা কেমন এক জায়গায় গোল হয়ে ঘুরে চলেছে। ঘাড়টা কাত করেই রয়েছে, যেন খেলা দেখাচ্ছে। আর কার্নিশে বিড়ালটা মনোযোগী দর্শকের মতো বলল ‘ম্যাঁও’।

পাশের ফ্ল্যাট গৌতমবাবুদের। ওঁরা দিল্লিতে থাকেন, ছ’মাসে ন’মাসে কলকাতায় আসেন। ফ্ল্যাটের একটা চাবি রাই রাকাদের কাছে থাকে। গৌতমবাবু ওদের বাবার বন্ধু কিনা। দুই বোনে মা-কে গিয়ে বলে, “ও বাড়ির দরজাটা খুলে দেবে?”
মা জিজ্ঞেস করেন “কেন?”
রাকা বলে, “ব্যালকনিতে যাব।”
মা কৌতূহলে তাকান। রাই বলে, “ওই ব্যালকনিতে একটা পাখি আছে, আমাদের ডাকছে মনে হল।”

মা-ও অবাক। এরপর সকলে মিলে পাশের ফ্ল্যাটের দরজা খুলে ব্যালকনিতে যায়। পাখিটা তখনও অমন ঘাড় গুঁজে ঘুরে চলেছে। কার্নিশে দুই হাত জড়ো করে, তার ওপর মাথা রেখে বিড়ালটা চোখ বুঁজে আছে ।

yellow cat story of a pigeon
বিড়ালটা চোখ খুলে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে পাখিটা চলে যাচ্ছে

রাকা বলে, “কোলে নেব মা?”
“নাও তবে সাবধানে। দেখো যেন ব্যথা না পায়।”
ছোট্ট তুলোর বলের চেয়েও নরম যেন। রাকা কোলে নিতে একবার ডানা ঝাপটিয়ে পাখিটা স্থির হয়ে বসে। রাই বলে, “আমি একটু নিই?”

দুই বোনে পালা করে পাখিটাকে কোলে নিয়ে রাখে। ওর তখনও ঘাড় ঘোরানোই রয়েছে। মা বলেন, “বোধহয় বাসার থেকে পড়ে গেছে। ঘাড়ে লেগেছে।”

শুনে দুই বোন বেশ আতঙ্কিত। রাকা বলে, “তাহলে, ও তো উড়তে পারছে না। কী করে খাবে?”
রাই বলে, “ওকে আমাদের ফ্ল্যাটে নিয়ে যাই, মা?”
তিনজনে মিলে পায়রাকে নিজেদের ফ্ল্যাটে নিয়ে আসে। কমলা রঙের ধুলোমাখা বিড়ালটা এক চোখ খুলে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে পাখিটা চলে যাচ্ছে। একটু আড়মোড়া ভেঙে পাশ ফিরে শোয়।

পায়রার নামকরণ হয় “পিকপিক”। 

পিকপিকের জন্য নিজেদের ঝুলবারান্দা ছেড়ে দেয় রাই-রাকা। একটা বাটিতে জল আর আর একটা বাটিতে চালের দানা দেওয়া হল। পাখিটা ঘাড় কাত করে সব লক্ষ করে, কিন্তু কিছু খায় না। মা বলেন, “ওকে বিরক্ত কোরও না। আমাদের দেখে হয়তো ভয় পাচ্ছে। একা থাকলে সাহস হবে, তখন ঠিক খাবে।”

ব্যালকনি থেকে সকলে চলে আসে। রাই রাকা নিজের ঘরে এসে জানালা দিয়ে উঁকি মেরে পিকপিক-কে দেখতে থাকে। এমনি করে, পাখিটা ওদের বাড়িতে থেকে গেল। বিড়ালটাও এখন ওদের ফ্ল্যাটের নীচে আসে, ওপরে তাকিয়ে দেখে, যেন খোঁজ নেয়, ‘কেমন আছে?’ এখন পিকপিক বারান্দায় থাকে, কখনও ঘরের ভেতর চলে আসে, হেঁটে বেড়ায়। বিজ্ঞের মতো বকবকম আওয়াজ বের করে। আবার কখনও শুধু পিকপিক।

রাই-রাকাদের কমপ্লেক্সে অনেক পায়রা থাকে। তারা একসঙ্গে ফরফরিয়ে ওড়ে, হাততালির মতো শব্দ করে মাটিতে নেমে আসে। দানা খায়, জলে মুখ দেয় আবার উড়ে যায়, কার্নিশে, জানালার ফাঁকে, বারান্দার কোণায়। বিড়ালরাও ঘোরে। কমলা রঙের ধুলোমাখা-টি উদাসীন মুখ করে পাখি দেখে। সেদিন একটা পায়রা রাই-রাকাদের ব্যালকনির রেলিংয়ে এসে বসে।  রাকা দেখতে পেয়ে দিদিকে খবর দেয়, “পিকপিকের ফ্যামিলির লোক এসেছে, দেখা করতে।”

রাই বিজ্ঞের মতো বলে, “হুঁ, অনেকদিন বাড়ি ফেরেনি, তাই খোঁজ নিতে এসেছে।”
“ওকে কি নিয়ে যাবে?”
“পিকপিক তো উড়তে পারে না, কী করে যাবে?”
“উড়তে পারলে চলে যাবে?” রাকা বেশ দুঃখ পায়।
রাই বলে, “জানি না।”
“বিড়ালটা কেন আসে? ও কি পাখিদের ফ্রেন্ড?”
“ও শিকার ধরতে আসে।”
“শিকার কী?”
“আরে! বাঘ যেমন হরিণ ধরে, তেমন।”
রাকা শিউরে ওঠে, “বিড়াল পায়রা খায়?”
“খায় তো।”
“পায়রা কি ওদের চিকেন?”
“উফ জানি না।” রাই বিরক্ত হয়।

ছুটিতে রাই রাকা মামাবাড়ি যাবে। বাড়িতে পিকপিক একা থাকবে, তা কী করে হয়? একটা প্লাস্টিকের ঝুড়ি ব্যাগ আনা হল, সেখানে পিকপিক-কে ঢুকিয়ে নেওয়া হল। গাড়িতে যেতে পিকপিক চুপটি করে বসে রইল। মামাবাড়িতে লিলি আছে। মস্ত কালো ল্যাব্রাডর কুকুর। রাই রাকাদের গাড়ি আসতেই লিলি লেজ নাড়তে নাড়তে চলে আসে। সবার সঙ্গে পিকপিক-কে দেখে ওর কৌতুহল বেড়ে গেছে। পিকপিক ঘাড় বেঁকিয়ে লিলিকে দেখে আর মুখে পিকপিক করে আওয়াজ করে। 

কিছুক্ষণের মধ্যে পিকপিক আর লিলির ভাব হয়ে গেল। ওকে আর ঝুড়িতে রাখতে হচ্ছে না। এখানেও সারা বাড়ি ঘাড় কাত করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। রাই রাকাও খুশি। রাকা দিদিকে একবার ডেকে বলে, “এখানকার বিড়াল শিকার করে না?”
“কেন করবে না?”
“যদি পিকপিক-কে চিকেন ভেবে নিয়ে যায়?”
“এখানে লিলি আছে, ওর ভয়ে কোনও বিড়াল এবাড়িতে ঢোকে না।”

উত্তর শুনে রাকা নিশ্চিন্ত হয়। না হলে পিকপিক-কে আবার ওই ঝুড়ি ব্যাগের ভেতর রাখতে হবে। খানিক পরে, হঠাৎ পিকপিক-কে আর খুঁজে পাওয়া যায় না। রাই-রাকার সঙ্গেই পিকপিক আর লিলি খেলা করছিল। মাঝখানে একটু সময় অন্যদিকে ব্যস্ত হয়েছে। তারপরই হারিয়ে গেছে। রাই, রাকা, মা, মামা, মামি সবাই ঘরদোর তোলপাড় করে। খাটের তলা, ফ্রিজের পিছন, রান্নাঘর, সিঁড়ির নিচে সব খুঁজে ফেলা হল। পিকপিক-কে পাওয়া গেল না। দুই বোন মন খারাপ করে বসে রইল। স্নান করতে যায় না, খেতেও বসে না। কেউ বলে, বিড়ালে নিয়ে গেছে। শুনে দুই বোন হাপুশ নয়নে কাঁদতে বসে। শেষে বাড়ির বাইরে থেকে রাই রাকা-র বাবার গলা শোনা যায়, “এই যে ইনি এখানে।”

দুড়দাড় করে সবাই দৌড়ে আসে। ওবাবা! বড় নর্দমার ভেতর পিকপিক। নোংরা জলের ভেতর জবুথবু হয়ে বসে আছে। বাবা নর্দমায় নেমে দুই হাতে যত্ন করে পিকপিক-কে তুলে আনে। দুই বোনের আনন্দ আর ধরে না। পিকপিক তখন থরথর করে কাঁপছে।  

পিকপিক-কে ভাল করে পরিষ্কার করে, একটা মোটা তোয়ালে পেঁচিয়ে রাখা হল। পালক শুকিয়ে গেলে আবার সেই ঝুড়ির ভেতর ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। রাকা বলল,

“এখনও ছোট আছ, একা একা বাইরে যাবে না।”
পিকপিক কথা শুনে ঘাড় নিচু করে থাকে।

লিলি-র ডাক্তারবাবুকে খবর দেওয়া হয়, তিনি এসে পিকপিক-কে দেখে বলেন,
“ওকে প্যারামিক্সো ভাইরাস ধরেছে। ওকে বাঁচানো কঠিন। ওই জন্য, অন্য পাখিরা ওর কাছে আসে না।”
শুনে সবাই খুব দমে গেল। এতক্ষণ ওরা ভেবেছিল, পিকপিক বুঝি পড়ে গিয়ে ঘাড়ে আঘাত পেয়েছে। ডাক্তার বোঝায়,
“এটা একটা স্নায়ুর রোগ। পাখিদের হয়।”

রাই রাকা এখন ভাইরাস শব্দটির সাথে পরিচিত। করোনা ভাইরাসের জন্য স্কুল বন্ধ। রাকা বলে, “ওকে কি মাস্ক পরতে হবে?”
ডাক্তার বলে, “হ্যাঁ, পরলে ভাল হত। তাই অন্য পাখিরা ওকে এড়িয়ে চলে।”
রাই বলে, “কোয়ারেন্টিন?”
ডাক্তার বলে, “ঠিক তাই।”
“ও কি আর উড়তে পারবে না?”
“বাহাত্তর ঘন্টার বেশি বাঁচে না। তবে তোমাদের কাছে দেখছি অনেকদিন রয়েছে।”
রাকা বলে, “বাহাত্তর মানে কী?”
রাই বুঝিয়ে দেয়, “সেভেনটি টু।”

ডাক্তার যাই বলুক, পিকপিক কিন্তু ওদের কাছে থেকে গেল। মামাবাড়ি থেকে ফিরে এসে ফ্ল্যাটের বারান্দায় ঘাড় নিচু করে এখন সে বকবকম বলতে পারে। মাঝেমাঝে অন্য পায়রা রেলিংয়ের উপর এসে বসে। পিকপিক-এর খবরাখবর নেওয়ার চেষ্টা করে। ঝুল বারান্দার নীচে কমলা ধুলোরঙা বিড়ালটাও আসে।

নিজের ঘরের জানলা দিয়ে রাকা রেলিংয়ে বসা পাখিটাকে দেখে আর দিদিকে বলে, “ওকে নিয়ে যেতে এসেছে?”
“হতেই পারে। ফ্যামিলির লোকের মন খারাপ হচ্ছে।”
রাই খুব গম্ভীর হয়ে জবাব দেয়।

একদিন আবার ব্যালকনি থেকে উড়ে গেল পিকপিক। নীচে এক ঝাঁক পায়রা খুঁটে খুঁটে খাচ্ছে। তাদের দলে যোগ দেয়। খানিক বাদে সব পায়রা উড়ে যায়, শুধু পিকপিক ঘাড় কাত করে একা একা ঘুরে বেড়ায়। রাই রাকাদের আবাসনের সিক্যুরিটি মাসি দেখতে পেয়ে রাইকে ডাকে, “তোমাদের পাখিটা একা একা রয়েছে, নিয়ে যাও, নয়তো বিড়ালে ধরবে।”

শুনে রাই দুদ্দাড় করে নিচে নামে, পিকপিক-কে তুলে নিয়ে আসে। 
“ওকে কি খাঁচায় রাখব?” রাকা জিজ্ঞেস করে। রাই বলে,
“না, কাউকে খাঁচায় রাখা কি উচিত্‍? তোকে যদি খাঁচায় রেখে দিই, কেমন লাগবে?”
“খুব খারাপ লাগবে।”
পিকপিকের আবার ব্যালকনিতে ঠাঁই হয়। এখন তার একটু একটু ডানার জোর বাড়ছে। বারান্দা থেকে উড়ে যায় আবার একা একা ফিরেও আসে। 
কমলা ধুলোরঙা বিড়ালটা এখন ঠোঁট চাটে আর ম্যাঁও ম্যাঁও করে ঘুরে বেড়ায়।

ছবি সৌজন্য Pinterest

এক সর্বগ্রাসী হাঁ-করা চোখ নিয়ে, কলকাতা ও সংলগ্ন শহরতলিতে জন্ম ও বেড়ে ওঠা সৌরভের। যা দেখেন, তাই মনে হয় ছুঁয়ে দেখলে ভালো হয়। কিছুটা প্রকৌশল, কিছুটা ছবি আঁকা, ভাষা শিক্ষা, থিয়েটার এমন আরও অনেক কিছু। এভাবেই ভেসে চলা। শৈশবে স্কুল পত্রিকায় হাত পাকিয়ে রেল স্টেশনে দেওয়াল পত্রিকা, লিটল ম্যাগাজিনের পাতা থেকে প্রাতিষ্ঠানিক বাণিজ্যিক পত্রিকায় পৌঁছনো। জীবিকার তাগিদে কম্পিউটারের সাথে সখ্য। পাশাপাশি কয়েক মাইল ‘কোড’লেখা চলে সমান্তরাল। কর্পোরেটের হাত ধরে পৃথিবীর কয়েক প্রান্ত দেখে ফেলার অভিজ্ঞতা। সবই উঠে আসে লেখায়। আপাততঃ কলকাতা ও ঢাকা মিলিয়ে প্রকাশিত গ্রন্থ সংখ্যা সাত।

5 Responses

  1. ভাল লাগল। টার্গেট পাঠক পড়ুক।
    পশু পাখি ও প্রকৃতিকে‌ শিশু রাত নিজেদের জীবনে জুড়ে নিক। আজকাল তেমন দেখি কিছু অভিভাবক ‌‌স্বার্থপরতার পাঠ দিচ্ছেন ‌‌বাচ্চাদের‌,‌‌তার বিপরীতে এ গল্প স্নিগ্ধতা‌‌ ছড়ায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *