সদ্যপ্রয়াত কবি শঙ্খ ঘোষকে শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলেন অভীক মজুমদার। অভীকের জন্ম ১৯৬৫ সালে। তিনি বর্তমানে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক বিভাগের অধ্যাপক এবং পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বিদ্যালয় সিলেবাস কমিটির চেয়ারপার্সন। তবে তাঁর প্রথম এবং প্রধান পরিচয় কবি হিসেবে। প্রাবন্ধিক এবং অনুবাদক হিসেবেও সুপরিচিত। নানা সময়ে প্রবন্ধ-নিবন্ধ রচনা করেছেন সাহিত্য, সংস্কৃতি, ইতিহাস এবং সমকাল নিয়ে। বাংলায় তর্জমা করেছেন আন্তর্জাতিক তথা ভারতের আঞ্চলিক ভাষার সাহিত্য। সদ্যপ্রয়াত শঙ্খ ঘোষ গুরু হিসেবে, অগ্রজ হিসেবে, পথপ্রদর্শক হিসেবে কীভাবে ছাত্রদের মধ্যে জারিত করে গিয়েছেন তাঁর বোধ, শিক্ষা, চেতনা, তাই নিয়েই অভীক মজুমদারের সঙ্গে একান্ত আলাপে দেবর্ষি বন্দ্যোপাধ্যায়।
আমার গুরুর আসন কাছে…
দেবর্ষি: শঙখ ঘোষ প্রয়াত হলেন দিনকয়েক আগে। সারাজীবন আপনার তাঁর সঙ্গে পথচলা। কখনও ছাত্র, কখনও শ্রোতা, কখনও পাঠক হয়ে। এই শোকের আবহের মুহূর্তে যে কোনও কথা বলাই কঠিন..
অভীক মজুমদার: আসলে, একটা মর্মান্তিক শূন্যতা অনুভব করছি। আমার মনে পড়ছে, সুবীর রায়চৌধুরী যখন প্রয়াত হলেন, স্যার আমায় সকালে ফোন করে শ্মশানে যেতে বলেছিলেন। তো, সেখানে আমি দাঁড়িয়ে চোখের জল ফেলছিলাম। খানিক পরে স্যার এসে বললেন, ‘ব্যক্তিগত শোকপ্রকাশের সময় এটা নয়। তোমরা যদি এখন কাজগুলো না কর, কাজগুলো কে করবে?’ প্রসঙ্গত, সুবীরবাবু অকৃতদার লোক ছিলেন। এবং সত্যি তখন অনেক কাজ বাকি ছিল। আজও স্যারের এ কথাটা কানে বাজছে। সেদিনের পর থেকে আমরা অনেকেই আজও নানা দায়িত্ব পালন করে চলেছি। স্যারের পরিবারের সদস্যরা অসুস্থ। চেষ্টা করে চলেছি, যতটা তাঁদের সাহায্যে লাগতে পারি।
দেবর্ষি: শঙখবাবুর সঙ্গে আপনার প্রথম আলাপ?
অভীক মজুমদার: ১৯৮৮ সালে প্রথম স্যারের বাড়ি যাই। আজ ৩২ বছর হয়ে গেল। ওই বাড়িতে এক রকম বড় হয়েছি বলাই যায়। বয়সে তো বড় হয়েছিই, কিন্তু চিন্তায়? জানি না। স্যার যা শেখাতে চেষ্টা করেছেন, কতটা শিখতে পেরেছি? তবে মনে পড়ে, অজস্র দিনরাত আমি ওই বাড়িতে কাটিয়েছি। চোখ ঝাপসা হয়ে গেলে, অতীতের ছবিগুলির মধ্যে কোনও স্পষ্টতা বা পারম্পর্য টের পাওয়া যায় না। আমিও একটু ঝাপসাই দেখছি এ মুহূর্তে সবটা, স্যারের সঙ্গে কাটানো আমার সুদীর্ঘ দিনগুলো..
দেবর্ষি: আমরা ব্যক্তিগতভাবে শঙখবাবুকে ততটা কাছ থেকে দেখিনি। কিন্তু যাদবপুরে পড়তে গিয়ে, শিক্ষকদের কাছে তাঁর কথা বারবার শুনেছি। আপনি সেই শিক্ষকদের একজন। আর, আপনার ভেতর আবার আপনার শিক্ষক শঙখবাবু সব সময় জেগে ছিলেন, থাকবেনও..
অভীক মজুমদার: অবশ্যই। থাকবেন। এবং তাঁর সঙ্গে আমার কথাও হবে আবার। আসলে, স্যার একজন অত্যন্ত বড় মাপের মানুষ ছিলেন। এই ‘বড়‘ শব্দটা জরুরি। স্যারের লেখালেখি, মেধা আর সাহস-মিলেই তাঁর এই বিপুলতা। রবীন্দ্রনাথের পরে এই বিপুল কর্ম আর কেউ নিয়মিত এভাবে করে গেছেন বলে জানা নেই। এত ধরনের, এত গুরুতর কাজ করে গেছেন বলেই আমার মাঝে মাঝে স্যারকেই আস্ত একটা বিশ্ববিদ্যালয় মনে হত। আমরা তাঁর সান্নিধ্যে কাজগুলো দেখতে পেয়েছি, তাতে কখনও অংশ নিতে পেরেছি, এটাই তো সৌভাগ্য! আর স্যারের কাছে গেলে আর একটা কথা বারবার মনে হত, এরকম হওয়ার চেষ্টা করা উচিত। জয় গোস্বামীর একটা কবিতার লাইন মনে পড়ছে, ‘বামন হলেও চাঁদ ধরে কিন্তু কবি…‘ স্যারের মতো হতে তো পারিনি। কিন্তু আন্দাজটুকু হয়তো পেয়েছি…। সেই আদর্শকে সামনে রাখার চেষ্টা করেছি। কিন্তু এটা শুধু চেষ্টা দিয়ে হয় না, এটা জীবনচর্যা আর জীবনবোধের বিষয়…।

দেবর্ষি: শঙখবাবু কবিতা-গদ্যের বাইরেও বারবার সমাজকে নিয়ে এগিয়ে চলেছেন, দায়িত্ব নিয়েছেন সময়ের। একদিকে, তাঁর রক্তকরবীর ক্লাস, তাঁর মেধাবী সহকর্মীরা আর অন্যদিকে তাঁর বাড়িতে রবিবারের আড্ডা, একদিকে, বারবার তাঁর রাস্তায় নামা আর অন্যদিকে একজন আন্তর্জাতিক বড় বাঙালি হিসেবে উপস্থিতি। তাঁর থাকা আর না-থাকায় কলকাতার সাংস্কৃতিক তাপমাত্রা বদলে গেল..
অভীক মজুমদার: তাঁকে কাছ থেকে দেখা আর লেখা-সবটা মিলেই তাঁর নন্দনতত্ত্ব। জীবন আর শিল্প মিলেই তাঁর এই যাপন। জীবনাচরণ এই সমগ্রতাতেই দেখতে পাই। ওঁর একটা বই রয়েছে, ‘কথার পিঠে কথা‘- সাক্ষাৎকারের সংকলন৷ সেখানে কাজ করতে গিয়ে দেখেছি, নতুন সময়ের খোঁজ তাঁর নিত্য। এমন অনেক নতুন লেখকের খোঁজ আমরা রাখিনি, যাঁদের উনি চেনেন। ওঁর ‘অবিশ্বাসের বাস্তব‘ বইটি বা বক্তৃতাগুলি পড়লেও বোঝা যায়, বর্তমানে কিছু পাওয়া যাচ্ছে না তা আংশিক সত্য হলেও নতুনেরাও তো কাজ করছেন! তাঁদের কি আমরা খুঁজে নিচ্ছি? এই পজ়িটিভিটিটা বারবার ওঁর মধ্যে খুঁজে পেতাম। বর্তমান আর আগামীদিনের সঙ্গে একটা নিত্য সংলাপ উনি জারি রেখেছেন আজীবন। নানা বয়সী ছাত্রদের সঙ্গে তাঁর তাই সমান অন্তরঙ্গতা, সবাই খোলামেলা তাঁর সামনে…। স্যার বারবার আমাদের শেখাতেন, তর্কে হার-জিতের চেয়েও বড়, কাজটা ঠিকভাবে শেষ করা। এবং নতুনদের কেবল তাচ্ছিল্য না করে, তাদের বুঝতে চেষ্টা করা। স্যারের সঙ্গে তাই আমার পুত্রের যে ঘনিষ্ঠতা, তা কিন্তু আমার সঙ্গে ছিল না…
দেবর্ষি: শঙখবাবুর রোববারের আড্ডায় তিনি বারবার নতুন মুখ খুঁজতেন, পুরনোদের সঙ্গেই। তাঁর জীবনচর্যাজুড়েই সংবেদন, স্নেহ, বন্ধুতা, শুশ্রূষা সকলের জন্য। আজ সারা দুনিয়ায় এ শব্দগুলি হারাচ্ছে। ওঁর লেখাতেও বারবার, ‘বেঁধে বেঁধে থাকা‘, ‘জলের স্পর্শ‘র কথা। পাশাপাশি, সুনীল-শক্তি-সন্দীপন থেকে ভাস্কর চক্রবর্তী-নবারুণ ভট্টাচার্য বা শিশিরকুমার দাশ, এঁরা সবাই যাঁকে সম্মান করেন, তিনি একজন তরুণেরও বন্ধু!
অভীক মজুমদার: স্নেহশীল‘ শব্দটাকে আমরা খুব সহজেই ব্যবহার করি। কিন্তু উনি প্রকৃতই স্নেহশীল ছিলেন। প্রত্যেককে আলাদাভাবে ভেতর থেকে জানতেন তিনি। তাই, আমাদের আড্ডার শেষে কাউকে কাউকে ভেতরের ঘরে ডাকতেন আলাদা। আলাদা কথা বলতেন তাঁর সঙ্গে। আমাদের অনেক বন্ধুদের পারিবারিক সংকটেরও রোজকার খবর রাখতেন। সবার কঠিনতম, গোপন, ব্যক্তিগত সমস্যা স্যার এভাবেই জানতেন। স্যারের মতো শ্রোতা বিরল। অন্যের সমস্যা শুনতে শুনতে আমরা ক্লান্ত হয়ে যাই। কিন্তু ওঁর কোনও ক্লান্তি ছিল না। অথচ স্যারের কথা আমরা কিন্তু খুব কম জানতে পারি। এখন আমাদের সামনে একটা পিশাচ সময়। প্রত্যেকে নিজেকে সুরক্ষিত করতে চেষ্টা করছি। অথচ উনি প্রত্যেকের সমস্যা নিজের ভেতর নিতেন নীলকণ্ঠের মতো…ওঁর কবিতাতে যেমন আছে, ‘বাড়ি ফিরে মনে হয়, বড় বেশি কথা বলা হল…’ আসলে, এই যে আমাদের হিংস্র স্মার্টনেস, এক ধরনের কর্পোরেট প্রোজেকশান নিজেদের প্রত্যহ, স্যার কিন্তু তার ঠিক উল্টো মেরুতে দাঁড়িয়ে ছিলেন আজীবন। তাঁর হাত ধরে আমাদের প্রত্যেকের জীবনের ক্ষত থেকে শস্যের দিকে যাত্রা..
দেবর্ষি: শঙখবাবুর শেষ বার বাইরে বেরনোর সঙ্গে আমাদের সবার স্মৃতি জড়িয়ে। এ বছরের গোড়ায় ‘পাঁচটি তারার তিমির‘ শীর্ষক একটি প্রদর্শনীতে আপনার পরিচালনায় অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত, মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, দেবেশ রায়, অরুণ সেন, সুধীর চক্রবর্তী প্রমুখ পাঁচজনকে সম্মাননা জানানো হয়। সে প্রদর্শনীতে এসেছিলেন শঙখবাবু স্বয়ং। আপনাকে জড়িয়ে ধরেছিলেন শেষে..
অভীক মজুমদার: হ্যাঁ। সেই স্পর্শ আজও লেগে রয়েছে শরীরে। আসলে স্যারের সঙ্গে কথা চলবেই। সামনে থাকুন বা না-থাকুন, কথাবার্তা চালু থাকবেই। আমার সমস্যার দিনে আমি স্যারের সঙ্গে কথা বলবই। রবীন্দ্রনাথের প্রয়াণের পর সুধীন্দ্রনাথ দত্ত লেখেন, It is going to make a difference… কোন ফারাকের কথা তিনি বলছেন, সবাই জানতে চাইলে তিনি জানান, A Calcutta with Rabindranath and without Rabindranath…। আজ আমার সে কথাটাই বারবার ঘুরে ঘুরে মনে আসছে। শুধু কলকাতা নয়, আমার জীবনটাও কোথাও আলাদা হয়ে যাবে আগের থেকে, এবারে।

আসলে স্যার তো একটা মাত্র লোক নন। একটা মানুষের মধ্যে অনেকগুলো মানুষ। একজন যিনি মানুষের জন্য বারবার পথে নামেন, আমরা যখন অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে গিয়ে লালবাজারে আটক হই- আমাদের পাশে এসে দাঁড়ান। তিনিই আবার ‘দিনগুলি রাতগুলি’ থেকে ‘গান্ধর্ব কবিতাগুচ্ছ’ হয়ে ‘সমস্ত ক্ষতের মুখে পলি’ লেখেন। আবার এই একই মানুষ যখন প্রবন্ধে নানাভাবে নানা আধুনিক চিন্তার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথকে চিনিয়ে দিতে পারেন বা আমার বা আমার মতো বহু মানুষের পারিবারিক বিপর্যয়ের দিনে পাশে এসে দাঁড়ান নিশ্চুপে, সেই একই শঙখ ঘোষ যখন ফেলে আসা দিনের কথা লেখেন ‘জার্নাল’ বা ‘সামান্য অসামান্য’ লেখাতে, তিনিই আবার সতীনাথ ভাদুড়ির রচনা সংগ্রহ সম্পাদনা করে অসামান্য একটি জরুরি অধ্যায় সূচিত করেন। কখনও আবার শেষদিকে ইকবাল অনুবাদ করেন, নানা ভাষণে ‘দেখা’ বা ‘সংযোগ’ নিয়ে নতুনতর কথা বলে ভেতরের দিকে একটা টান দেন, ‘ইশারা অবিরত’ বইতে তিনিই আবার সাহিত্য ও অন্যান্য শিল্পকর্ম নিয়ে কথা বলেন, কথা বলেন ছোটদের নিয়েও নানা ছড়ায় ও আখ্যানে-এ জন্যেই আজ মনে হয়, স্যার নিজেই একটা আস্ত বিশ্ববিদ্যালয়, যার নানা বিভাগ রয়েছে ছত্রে-ছত্রে। এবং সমস্ত গুণকে ছাপিয়ে যায় মানুষ হিসেবে আমাদের মনে তাঁর উপস্থিতি।
সবাইকে এই ভাবে ছুঁতে পারার যে শক্তি স্যারের, তার কোনও তুলনা নেই। স্যার আসলে আমার একটা আলোকবর্তিকা বা দীপশিখা, যার ভেতর দিয়ে আমি কীভাবে মহৎকে চিনতে হয় তা শেখবার চেষ্টা করেছি। কীভাবে প্রুফ দেখতে হয়, সম্পাদনা করতে হয়, শব্দের মানে নিয়ে কতটা ভাবা যায়- এসবই তো ওঁকে দেখে শেখা। স্যারকে আমরা হয়তো আর সামনে পাব না, কিন্তু তাঁর লেখা ও সমস্ত কাজ থেকে আগামী যেন খুঁজে নেয় কীভাবে স্যার পরিকল্পনা ও কল্পনার মিশেল ঘটাতেন, সেখানেই হয়তো ব্যক্তিগত উচ্ছ্বাস আর শোকপ্রকাশ পেরিয়ে আগামীর মুক্তি…
পেশা মূলত, লেখা-সাংবাদিকতা। তা ছাড়াও, গান লেখেন-ছবি বানান। শখ, মানুষ দেখা। শেল্ফ থেকে পুরনো বই খুঁজে বের করা। কলকাতার রাস্তা ধরে বিকেলে ঘুরে বেড়ানো।
Sir er chhobi baro sundor. Avik er lekha khub antorik, samridhya holam.
একটা যুগ চলে গেল আর আমরা নির্বিকার ঐ মানুষ টির অস্তিত্ব আর কর্ম কান্ড সম্মন্ধে।সরকারী তাচ্ছিল্য, উদাসীনতা, উপেক্ষা এমন লোক কে জীবদ্দশায় দেখে এবং শুনে যেতে হলো!! কি অকৃতজ্ঞ, অর্বাচীন আমরা।তবুও… শঙ্খ বেজে যাবে। থামবে না। শঙ্খ থামে না।