যাঁকে প্রায় ষাট বছর ধরে শঙ্খদা বলে ডাকি, তাঁর ছড়ার আলোচনা করতে গিয়ে এ লেখায় নৈর্ব্যক্তিক দূরত্ব রাখতে ‘শঙ্খ ঘোষ’ কথাটা ব্যবহার করতে হবে, হয়তো মাঝে মধ্যে ওই অবস্থানের সঙ্গে তাল রেখে ‘শঙ্খবাবু’ও লিখতে হবে— সে কথা ভাবতেই বেদম হাসি পাচ্ছে। কিন্তু সমালোচনা হাসির বিষয় নয়, ‘হাসির বিষয়’ কথাটা সমালোচনা প্রসঙ্গে উচ্চারিত হতে শুনলে সমালোচকেরা আমার দিকে তীক্ষ্ণ ডটপেন ছুড়ে মারবেন বিদেশি ডার্ট খেলার নিশানার মতো, কাজেই আমি হাসির প্রসঙ্গ এখানেই প্রত্যাহার করছি।
অথচ ছড়া তো হাসবার জন্যই, অন্তত আনন্দের জন্য, অন্তত শিশুপাঠ্য ছড়া, আমরা যেগুলি এখন পড়ব। শঙ্খ ঘোষ বড়দের জন্য ছড়ার ছন্দে একটি মেয়ের খাদ্যের দাবিতে মিছিলে হাঁটা এবং গুলি খেয়ে মৃত্যুর মর্মান্তিক কবিতা লিখেছেন তা সকলেই জানেন, এই ছড়াগুলি সেই জাতের হবে না, তা আমরা ধরে নিতেই পারি। ভালো যে ‘ছড়াসমগ্র’ বইটিতে শঙ্খ ঘোষের এ পর্যন্ত প্রকাশিত সাতটি ছড়ার বইয়ের সমস্ত ছড়া এক সঙ্গে তুলে ধরা হয়েছে। এর বাইরেও তাঁর ছড়া নিশ্চয়ই আছে, কিন্তু তাঁর বেশিরভাগ ছড়ার পাঠ এখানে পাওয়া যাবে। কী পাওয়া যাবে না? পাওয়া যাবে না ‘সব কিছুতেই খেলনা হয়’-এর মূল সংস্করণে (১৯৮৭) গণেশ পাইনের, ‘আমন ধানের ছড়া’-তে পূর্ণেন্দু পত্রীর, আর ‘বল্ তো দেখি কেমন হতো’ বইয়ের (২০০৫) রামানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছবি। কৃষ্ণেন্দু চাকী আর দেবব্রত ঘোষের ছবিরও আমি ভক্ত, তা-ও ছিল কোনও কোনও বইয়ে। অর্থাৎ আলাদা আলাদা বইয়ে ছবির বিপুল বৈচিত্র্য ছিল। এখানে সব ছবি এঁকেছেন দেবব্রত ঘোষ। তাঁর ছবির মজাও অসাধারণ, কিন্তু আলাদা আলাদা বইয়ের যে দৃশ্যস্বাদ, তা তো এখানে নেই। থাকবার কথাও নয়। তবু দেবব্রত ঘোষের কাজ নিঃসন্দেহে অভিনন্দনযোগ্য। বোঝাই যায়, এই ছড়াগুলির মজা তাঁকে সংক্রামিত করেছে, তাই তাঁর ছবিগুলিও সেই মজাকে ধারণ করছে।
২
এবারে মূল পাঠে ফিরে আসি। যাঁরা ছড়া লেখেন তাঁরা এক অর্থে ছড়ার মধ্যে একটু ছুটি, একটু ছেলেমানুষির সুযোগ খুঁজে নেন। শব্দ (শব্দের ধ্বনি, অর্থ দুইই) নিয়ে খেলা, মিল নিয়ে খেলা, কল্পনাকে বাস্তবের শিকল কেটে দশ দিকে ছুটোছুটি করবার পরিসর তৈরি করে দেওয়া, কিন্তু এই সূক্ষ্ম সীমারেখাটি মানা যাতে সেই পরিসর শিশুর আরামপ্রদ বোধসীমানার মধ্যে থাকে, তার শব্দের অভিজ্ঞতা আর কল্পনার শক্তিকে যেন অতিরিক্ত চাপে না ফেলে। কিন্তু এই ভূগোলের বিরুদ্ধেও তো কথা থাকতে পারে। তবে কি শিশুকে (বা যে বয়সের পাঠকের জন্য ছড়া) তাকে একটু অভিজ্ঞতার বাইরের দিকে আমন্ত্রণ করা যাবে না, একটু চ্যালেঞ্জ রাখা যাবে না তার জন্য, যাতে সে তার সীমানার ওপারে কী আছে সে সম্বন্ধেও একটু উৎসুক হয়ে ওঠে। আর বাংলা ছড়ার লেখকেরা প্রায়ই কতকগুলি উৎসকে ছুঁয়ে থাকার চেষ্টা করেন। প্রথমত প্রচলিত ছড়া, প্রাচীন গ্রামীণ পরম্পরার সেই সব উচ্চারণ, যা রবীন্দ্রনাথকেও গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল, সুকুমার রায়, সুনির্মল বসু, অন্নদাশংকর রায় প্রভৃতি। না, অনুকরণ নয়, অনুকরণ শুধু বড়দের নয়, ছোটদের চোখেও ধরা পড়ে যায়, এ হল স্পর্শ করে থাকা। নিজের ভূমির শক্ত মাটিতে পা রাখা।
আমরা শঙ্খ ঘোষের প্রথম বই ‘সব কিছুতেই খেলনা হয়’-এ শব্দ নিয়ে খেলা আর ঐতিহ্য উভয়কেই ছুঁয়ে থাকা দেখি। ‘নামতা ভুলে আমতা গেলে সামতাবেড়ের গা-য় শালুক-মুখে ভালুক উঠে দাঁড়াচ্ছে জ্যোৎস্নায়’-এ যেমন শব্দের অন্তর্মিলের খেলা আছে, তেমনই ‘রাগ কোরো না রাগুনি, মুখ কোরো না বেগুনি, বাস আসবে এখুনি, ছুটতে হবে তখুনি’র মধ্যে আবার পুরোনো ছড়ার স্মৃতি। এই স্মৃতিকেই বোধ হয় আজকালকার ভাষায় intertextuality বলে, জানি না ভুল বললাম কি না।
প্রথম থেকেই শঙ্খ ঘোষের ছড়ার যে লক্ষণটা চোখে পড়ে তা হল তাঁর ছড়ার শরীর-সংগঠনের অগাধ বৈচিত্র্য। বাঙলা ছড়ার ঐতিহ্যে পয়ার বন্ধের চাপ খুব বেশি, ৪+৪+৪+২-এর এই চেনা ছকের প্রলোভন এড়ানো খুব মুশকিল। এমন নয় যে বাংলার প্রথাগত ছড়াতেই অন্য বন্ধ নেই, বিশেষ করে বাচ্চাদের খেলার ছড়া যেগুলি, তাতে নানা ধরনের ছক আছে। তবু ‘যমুনাবতী সরস্বতী কাল যমুনার বিয়ে’ ধরনের চোদ্দ মাত্রার লাইন, কখনও দুটি ছত্রে ৮-৬ করে ভেঙে লেখার সম্মোহন অনেকেই এড়াতে পারেন না দেখি। কাগজে পত্রে যত ছড়া বেরোয় তার একটা পরিসংখ্যান নিলে দেখা যাবে শতকরা ষাট ভাগ এই বাঁধনের ছড়া। কিন্তু শঙ্খ ঘোষ মনে হয় একেবারে প্রথম থেকেই এই ছকটি যথাসম্ভব এড়িয়ে চলার সংকল্প নিয়েছিলেন। তাঁর প্রথম থেকে শেষ বইয়ের ছড়াগুলোতে এই অগাধ বন্ধবৈচিত্র্যের পরিচয় আছে। ‘উলুকঝুলুক সুলুক পাতায়/কন্টিকারি ফুল’ এই ছক মানল তো তার একটি ছড়া পরেই ‘ঢাক’ নামে প্রচ্ছন্ন এক বেদনার ছড়ায় দেখি অন্য ছক—
পথ ছিল না আর তবু
কদম কদম বাড়।
স্বস্তি ছিল না তবু
যখনতখন গা।
ছন্দবন্ধের পরীক্ষায় শঙ্খ ঘোষের মতো নিপুণ শিল্পী বাংলা কবিতায় আর বেশি আছেন কি না সন্দেহ, কিন্তু তা যখন ছোটদের ছড়ায় সঞ্চারিত হয় তখন ছোটদের কাছেও তা আনন্দের উপহার হয়ে ওঠে।
ছড়ার ছন্দ বলতে প্রচলিত অর্থে যাকে প্রবোধচন্দ্র সেনের ভাষায় দলবৃত্ত বলে, আমরা উপরে তাই বুঝিয়েছি। কিন্তু বাংলা ছড়া বা ছোটদের কবিতা আধুনিক হয়ে ওঠে যখন অনেক পরে উদ্ভাবিত কলাবৃত্ত ছন্দও আধুনিক ছড়াকারেরা অনায়াসেই ব্যবহার করেন বাংলা ছড়ায়। এ বিষয়ে সম্ভবত সুকুমার রায় পথিকৃৎ, আমরা একবার পরিসংখ্যান নিয়ে দেখিয়েছিলাম যে, তাঁর ছোটদের কবিতায় দলবৃত্তের চেয়ে কলাবৃত্তের ব্যবহার বেশি। রবীন্দ্রনাথের ‘আমাদের ছোট নদী’ বা ‘দুন্দুভি বেজে ওঠে’-তে তা রীতিমতো সম্ভ্রম লাভ করে। রবীন্দ্রনাথও ‘খাপছাড়া’-র ছড়াগুলিতে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে কলামাত্রিক ছন্দই ব্যবহার করেছেন। যেমন প্রথম বইয়ের ‘বর বউ’ কবিতায়—
বরবেশে এসে
দরবেশ খায়
গর্বে সে মাতোয়ারা
বরযাত্রীরা
দই আর চিঁড়া
করে ভাগ-বাঁটোয়ারা
এখানেও সেই পয়ার বন্ধের একটা দীর্ঘ ছত্রের আভাস আছে, কিন্তু শঙ্খ ঘোষ তাকে এমনভাবে ৬+৬+৮ ছকে ভেঙেছেন যে, তার স্থাপত্যই পুরো আলাদা হয়ে গেছে। কিংবা ‘ওরে ও বায়নাবতী’ বইয়ের এই ছড়াটি—
‘এখানে একলা ঘরে
ও দিশা করছে কী এ?’
‘কী আবার করব বলো—
বাবা-মা যায় বেরিয়ে
আমি তাই একলা ঘরে
আরো এক ঘর বানালাম
এখানে সব সময়ে
সকলে পায় বাবা-মাম্,
যায় না কেউ বেরিয়ে
সকলে ঘরেই থাকে
এ ঘরে কেউ কখনো
পড়ে না ঘূর্ণিপাকে।
ছড়ার এই স্থাপত্যের কত রকম সম্ভাবনা থাকতে পারে তা বোঝবার জন্য শঙ্খ ঘোষের ছড়া ছড়াকারদের শিক্ষাক্রমের পাঠ্য হওয়া উচিত। আশা করি স্থাপত্য দেখতে গিয়ে তার আত্মাটিকেও দেখতে ভুলবেন না, যেমন এক ছড়ায় একলা মেয়ের কল্পনা দিয়ে তার একাকীত্বের ক্ষতিপূরণের বিষণ্ণ প্রয়াস।
আমি ভাষার দোকানদারি করি বলে ভাষার ব্যাপারটাই আমার আগে চোখে পড়ে, তাই ছন্দ, শব্দবন্ধ, ছত্রনির্মাণ, মিল— এই সব কথা নিয়ে আগে বলতে নেমে পড়েছি। এমন কথা আমি বলতে চাই না যে, ভাষাকে বক্তব্য থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখা যায়। তা সম্ভব হলেও উচিত কি না সন্দেহ। মিলের ব্যাপারে যে এই ছড়াগুলিতে কত রকমের পরীক্ষা-নিরীক্ষার দুঃসাহস আছে তা বলা যায় না। ছন্দ আর অনুপ্রাসের ঢেউয়ে তিনি মিলকে সম্পূর্ণ উড়িয়ে দিতেও দ্বিধা করেন না দেখি, কিংবা স্বরব্যাঞ্জনের মিলের প্রত্যাশিত ছক সম্পূর্ণ বর্জন করে শুধু স্বরন্যাস বজায় রাখেন—
কিচ্ছু পড়া হচ্ছে না
দুঃখ হলো
সাতটা পাঁচ
মাথায় ঘুমের পড়ল হাত
দুঃখ গেল
পৌনে আট।
‘কিচ্ছু’, ‘হচ্ছে’, ‘দুঃখ’, ‘সাতটা’ এই একই শারীরিক সংগঠনের শব্দগুলি (ব্যঞ্জন+স্বর+ব্যঞ্জন+ব্যঞ্জন+স্বর বা CVCCV) শরীরের শব্দগুলি কীভাবে ছত্রগুলিকে দুলিয়ে দিচ্ছে দেখুন। আর ‘পাঁচ’ আর ‘আট’-এ শুধু স্বরের মিল, ইংরেজিতে যাকে বলে assonance। কিন্তু তাতে কী হল? পাঠকেরা, শিশু হোক, বয়স্ক হোক, ওই ধ্বনির নৃত্যে আর ছন্দের আন্দোলনে এমন মজে যায় যে, মিলের উপরি-পাওনার ব্যাপারটা সে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে, প্রচলিত প্রকট মিল যে নেই তা সে বুঝতেই পারে না। আর শঙ্খ ঘোষ বেপরোয়াভাবে ‘জুতো’র সঙ্গে ‘দুটো’র মিল দেন, ‘বোনটি’র সঙ্গে ‘জয়ন্তী’ আবার ‘কোকিলকণ্ঠী’র বিপুল সংগতি, যেমন ‘কেন’র সঙ্গে ‘জ্ঞানও’র। এ সব যত দেখি তত চমৎকৃত হই, আর ভাবি, ছড়া-লিখিয়েদের কথা, যাদের এক দলের মিল সম্বন্ধে ধারণা দুর্বল, আর-এক দল মিল সম্বন্ধে অতি সতর্ক— তাঁদের দু-দলেরই শঙ্খ ঘোষের ছড়া কেন পড়া দরকার। এক, ভালো ছড়ার মিল কী তা শেখার জন্য, আর দুই, সাহস করে অতি সংগত মিলের সীমানা ডিঙিয়ে যাওয়ার জন্য। ‘পায় না কোনোদিনই’র সঙ্গে ‘শতাব্দীনন্দিনী’র মিল কে ভাবতে পারি আমরা?
শঙ্খ ঘোষের ছড়ায় খুব উদ্ভট, পুরোপুরি কল্পিত কোনও পৃথিবী বা তার বাসিন্দা নেই। এ বিষয়ে তিনি সুকুমার রায় থেকে বেশ কিছুটা আলাদা। তাঁর চোখ মূলত ছোটদের জগৎকেই লক্ষ করে, তাদের ভিতরবাইরেকার খবর নেয়। তাদের আচার- আচরণ, বিশেষ করে বড়দের আচরণে তাদের প্রতিক্রিয়া, তাদের সুখদুঃখের বিচিত্র উৎস ও হিসেব– ইত্যাদি তাঁর ছড়ায় ছন্দের দুলুনি লাভ করে। তাদের সম্বন্ধে বড়দের আচরণও তাঁর ছড়াকে দখল করে, যেমন ‘বায়নাবতী’ ছড়াতেই। একটি মেয়ে বায়না করে কাঁদছে, তখন এক অভিভাবক তাকে উপদেশ দিচ্ছেন—
এত আজ কান্না কিসের?
চুনি আর পান্না মিশে
আকাশে দেখ্ জড়োয়ার
গয়না।
জানি না এই কবিত্বময় সৌন্দর্যের আমন্ত্রণে মেয়েটি সাড়া দেবে কি না, কিন্তু আমন্ত্রণ তো জানানো যেতেই পারে, কারণ শিশুর কান্নাকে আমরা চাঁদ দেখিয়েও তো ভোলানোর চেষ্টা করি! শিশুর খাওয়া নিয়ে খুনসুটি, শিশুর ‘বেয়াদবি’ (‘একটু যদি রাগাই? / গাইতে বললে না গাই?/ বরং যদি বইতেই দিই ডুব?’), বড়দের বকুনিতে তার অভিমান (‘বড্ড তুমি বকো আমায় যখন তখন বকো/ থাকবে না কি একটুআধটু খেলাধুলার শখও?’), তাদের একাকিত্বের সমৃদ্ধ ও পরিপূর্ণ পৃথিবী, যেমন একটি ছড়ায় (আমায় তুমি লক্ষ্মী বলো)—
যখন আমি একলা থাকি তখন কি আর একলা থাকি
জানো তখন সঙ্গে থাকে কারা?
থাকে সবুজ গাছপালা আর তার ভিতরে চলে যাওয়ার
পথও থাকে ঠিক যদি পাই সাড়া।
একটা আছে কাঠবেড়ালি আমার দিকে তাকায় খালি
এদিক-ওদিক টানতে থাকে আমায়–
যেই-না তাকে ধরতে যাব ভুলিয়ে দেবে সব হিসাব ও
ছুট দেয় আর কেই বা তাকে থামায়!
বাড়িতে নিঃসঙ্গ শিশুর মনোবেদনা শঙ্খ ঘোষকে বড় বেশি কষ্ট দেয়, তাই তার জন্য নানারকম সান্ত্বনা রচনা করতে তাঁকে তৎপর দেখি। ঘরে শিশু এলে তাকে দেখতেই হয়, তার দুঃখ আনন্দ সবই খুব তীব্র হয়ে চোখে পড়ে, বিশেষত এক প্রজন্ম পার হয়ে যখন অন্য প্রজন্মের শিশুরা ঘরে আসে। আমি জানি না শঙ্খ ঘোষ নিজের সন্তানদের শিশুকাল নিয়ে এমন ছড়া লিখেছেন কি না, কিন্তু সন্তানের সন্তানেরা যেন তাঁর কাছে আরও তীব্র আর হৃদ্য এক উপস্থিতি, তাদের প্রতিটি মুহূর্ত যেন তাঁর চোখে ছায়া ফেলে। তাই দৌহিত্রী আমনকে নিয়ে আছে বহু ছড়া— তার নাম, তার জন্মদিন, তার নাচ, তার ঠোঁট কেটে বিড়ম্বনা—
বালতিতে কে উলটে পড়ে
তুলতে গিয়ে দেখি
একচিলতে ঠোটের পরে
আলতা ঝরে– এ কী!
ওমা ওমা! আলতা তো নয়
রক্তে মাখামাখি—
বচ্ছরকার দিনে আমন
কষ্ট পেল নাকি?
ঠোঁট ফুলিয়ে চোখের জলে
ভাসে স্রোতস্বিনী—
লাগাও চিনি, ও দুই ঠোঁটে
লাগিয়ে দাও চিনি।
শিশুদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে কদাচিৎ বাইরের দিকেও তাকান শঙ্খ ঘোষ। তাতেও জেগে ওঠে কৌতুকময় ছবি, বাস্তব যেমনই হোক।
বৃষ্টি পড়ে টাপুরটুপুর
কোলকাতাতে বান
খালের থেকে একটা দুটো
নৌকো তুলে আন্।
কলকাতাটা ভেনিস হল,
গন্ডোলা ওই নাও—
এ দেশ ছেড়ে অন্য কোথাও
যাব না এক পা-ও।
এ কথা কিছুটা শিশুর, কিছুটা কবির, কিংবা শিশু হয়ে যাওয়া কবির। ‘চড়ুইগুলো মানুষ হলো’ (বল্ তো দেখি কেমন হতো)-
দেখো দেখো চড়ুইগুলির
কী মানুষিক স্বভাব হলো।
এই কি তবে ইতিহাসের
মুখের মতো জবাব হলো।
দিনরাত্তির আটকে থেকে
এইটুকুনই রুদ্ধ ঘরে,
ওরাও যেন মানুষ এখন
সব সময়ে যুদ্ধ করে।
এত হিংসে শিখল কোথায়?
ঠুকরে বুকে রক্ত ছোটায়।
ওদেরও আজ মানবপ্রথায়
ভালোবাসার অভাব হলো—
এই সব ছড়ায়, হয়তো একটু পরের দিকে এসে, ছোটদের শঙ্খ ঘোষ বড়দের শক্ত ঘোষের হাত ধরেন, যে শঙ্খ ঘোষকে স্বৈরাচারী শাসক ভয় পায়, মানবাধিকার কর্মীরা শ্রদ্ধা করে, যিনি মানবিক, মানুষের অবিচার, হিংস্রতা, স্ফীত আত্মপ্রসাদ, উদাসীনতা আর আত্মম্ভরিতাকে যিনি আক্রমণ করেন, যিনি, সহজ কথায়, মানুষের মুক্তি, অধিকার, আর স্বপ্নের কবি। এই স্বপ্নের ছবিটা দিয়ে এ লেখা শেষ করি, ‘ধরো’র (বল্ তো দেখি কেমন হতো) ছত্রগুলি দিয়ে– এই ছড়াতে ধরে নিতে বলা হয়েছে এমন একটা দেশ যেখানে কেউ কারও ক্ষতি করে না, কেউ কারও বস্তু কাড়ে না, সবাই উদার, সকলে প্রতিযোগিতাহীন বন্ধুত্বে আবদ্ধ; সেখানে ‘দুর্ভাগা’ বলে কিছু নেই, যুদ্ধ নেই,
ধরো সেখানে সবাই আছে
সবার চোখে চেয়ে
সে-দেশে এসে হাত বেঁধেছে
লক্ষ ছেলেমেয়ে
যে-কোনো দিন যে -কোনো রাতে
সেখানে বিস্ময়
জেগে থেকেছে ভালোবাসাতে
ভরাট দৃশ্যয়—
সে দেশ তবে দিতাম তুলে ওই বড়োদের হাতে
বলে দিতাম, শোনো
একটা কোনো আঁচড় যেন লাগে না আর তাতে।
ছোটদের হয়ে বড়দের এই তিরস্কার শঙ্খ ঘোষ ছাড়া আর কে করবেন?
পবিত্র সরকার বাংলা ভাষা ও চর্চার এক প্রতিষ্ঠানস্বরূপ। তাঁর শিক্ষা ও অধ্যাপনার উজ্জ্বল জীবন সম্পর্কে এই সামান্য পরিসরে কিছুই বলা অসম্ভব। তিনি প্রায় চারদশক অধ্যাপনা করেছেন দেশে ও বিদেশে। রবীন্দ্র-ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন সাত বছর এবং ছ'বছর পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য শিক্ষা সংসদের সহ-সভাপতি। লেখাতেও তিনি অক্লান্ত ও বহুমুখী। ভাষাবিজ্ঞান ও ব্যাকরণ, নাটক ও নাট্যতত্ত্ব, লোকসংস্কৃতি, ইংরেজি শিক্ষা, রম্যরচনা, শিশুদের জন্য ছড়া গল্প উপন্যাস রবীন্দ্রসংগীত, আত্মজীবনকথা— সব মিলিয়ে তাঁর নিজের বই সত্তরের উপর, সম্পাদিত আরও অনেক। গান তাঁর প্রিয় ব্যসন। এক সময়ে নান্দীকারে অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশনায় অভিনয়ও করেছেন।
অসাধারণ লেখা। সশ্রদ্ধ প্রণাম জানাই ।সুস্থ থাকুন,ভালো থাকুন।
Asadharan,,,,,,pranam,,,,
খুব ভালো হয়েছে লেখাটা, আপনার লেখার নিয়মমতই।
ছড়া নিয়ে এমন লেখা, সেটাও আপনার কাছে শেখার। প্রণাম, ভালো থাকবেন।
আমাদের চেনা শঙ্খ ঘোষকে তাঁরই ছড়ায় ছড়ায় কেমন ধরিয়ে ধিলেন, চিনিয়ে দিলেন পবিত্রদা! পড়তে পড়তে একটা হাহাকার গলার মধ্যে গুমরে মরল – এই কলম থেমে গেছে! শুধু এমন নতুন করেই পড়তে হবে, নতুন লেখা আর পড়ব না!! স্তালিনদাকেও বলিহারি। অতি কৃপণ কয়েকটি রেখায় এমন ছবি এঁকেছেন যে বুকে আগলে রাখতে ইচ্ছে হয়, সরানোই যায় না চোখ।