সিউড়ির সোমনাথ মুখুজ্জে ইতিহাস পড়ায় কাছেই আমোদপুরের স্কুলে। বেশ কিছুদিন ধরে বলছে একবার ওদিকে যেতে। আপনারা তো বীরভুম বলতে শুধু শান্তিনিকেতন আর তারাপীঠ বোঝেন, সিউড়ির আশপাশেও অনেক কিছু দেখার আছে। আমাদের বাড়িতেই থাকবেন, সব নিয়ে যাব।’…ফোনে এসব শুনে বেরিয়ে পড়লাম জানুয়ারির মাঝামাঝি, কোভিডের থাবা একটু আলগা  হতেই। সহজ রাস্তা বলতে হাওড়া থেকে ট্রেনে সোজা আমোদপুর। সোমনাথ স্টেশনে গাড়ি নিয়ে হাজির, সকাল সবে সাড়ে ন’টা। হাতে অনেক সময়। তাই সিউড়ির পথে আমরা ঘুরে নিলাম হরিপুর গ্রাম, নিম্ববাসীনি কালী মন্দির আর বক্রেশ্বর নদীর পাড়, চারপাশে ইউক্যালিপ্টাসের জঙ্গল, তার ফাঁকে ইকো পার্ক, ছেলেপুলেরা চড়ুইভাতির তোড়জোড় চালাচ্ছে।

বুঝলাম এটা কেবল ট্রেলর, কাল পরশু আসল ছবি হবে। সোমনাথ ওর পুরো দোতলাটা ছেড়ে দিল আমাদের। ওর বৌ জুনের সঙ্গে আমার গিন্নিরও জমে গেল। পরদিন চারজনে গাড়ি করে বেরলাম। প্রথমে যাব মন্দিরগ্রাম মুলুটি দেখতে। সিউড়ি থেকে অনেকখানি পথ, পৌঁছতে বেলা হল। জায়গাটা আদতে ঝাড়খণ্ডের দুমকা জেলায়। তবে তিনশো বছর আগে এটা সুবে-বাংলার অংশ ছিল আর মন্দির বানানো শুরু হয় তখন থেকেই। আমরা পায়ে হেঁটে সিকি বর্গমাইলের মধ্যে ঘুরে ঘুরে গোটা তিরিশেক মন্দির দেখে ফেললাম। পোড়ামাটি নয়, একধরনের নরম পাথর দিয়ে তৈরি। বেশ কয়েকটাকে সারিয়ে সুরিয়ে রেখেছে। দরজার চারপাশে রিলিফের কাজগুলোও দেখবার মতো।

Maluti Terracotta Temples
মলুটির টেরাকোটা মন্দির

এর মধ্যে চওড়া দালানওলা সিকরিবাড়ির দুর্গামন্দিরটি একটু ভাঙাচোরা হলেও সামনের চওড়া সিঁড়িটা এখনো মজবুত আছে। অতএব বসে গেলাম সামনের জোড়া মন্দিরের ছবি আঁকতে। সব থেকে মনে ধরল এখানকার তিন শিখর শিবমন্দির, যার চুড়োগুলো মন্দির, মসজিদ আর গির্জার আদলে বানানো। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির চরম নিদর্শন বটে। অবাক হলাম সোমনাথের পরিচিত সৈয়দ মৈনুদ্দিন সাহেবের সঙ্গে আলাপ করে। এঁর পাথ ভাঙার জমজমাট ব্যাবসা আছে নদিয়ার দিকে, তারই মধ্যে এখানকার মন্দির নিয়ে রীতিমতো গবেষণা চালাচ্ছেন ভদ্রলোক। বাইক চেপে দাপিয়ে বেড়ান। আমাদের পেয়ে গড়গড় করে এ তল্লাটের যাবতীয় ইতিহাস বলতে শুরু করলেন।

মুশকিল হল, ওঁর সদ্য কলপ করে আসা চুল দাড়ি নিয়ে। কাঁচা কালো রঙ ঘামের সঙ্গে চারদিক থেকে গড়িয়ে নেমে এসে এক বিতিকিচ্ছিরি ব্যাপার হয়ে দাঁড়াচ্ছিল। উনি একটু হেঁ হেঁ করে ম্যানেজ দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করে গেলেন। পথে মৌলিক্ষা মাতার মন্দির পেরিয়ে এসেছিলাম ,ওখানে আমাদের ভোগ খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। ভক্তদের ভিড়ে সরগরম গোটা চত্বর। পাশেই একটা ঘেরা জায়গায় পাত পেতে খাওয়া দাওয়া শুরু হয়েছে। আমরা বসে পড়লাম প্যাচপ্যাচে মেঝের ওপর। ভাত, ডাল,ছ্যাঁচড়া আর একটা ট্যালট্যালে পায়েস। এদিকে বেলা গড়াচ্ছে। আমাদের এবার যেতে হবে রামপুরহাট আর নলহাটি পেরিয়ে ভদ্রপুরে অষ্টকোনা মন্দির দেখতে।

জায়গাটা ইতিহাস প্রসিদ্ধ হলে কী হবে, এর ভূগোলের অবস্থা শোচনীয়। মাইলের পর মাইল রাস্তা একেবারে চষা ক্ষেত যাকে বলে। সোমনাথ অনেক শখ করে আমাদের নিয়ে যাচ্ছে, বেচারা নিজে বহুকালের মধ্যে এদিকে আসেনি, কী করেই বা জানবে। একরাশ ধুলো মেখে আর প্রচুর সময় বরবাদ করে আমরা যখন ভদ্রপুর পৌঁছলাম, শীতের বেলা তখন পড়ে আসছে। মন্দিরের পিছনের গল্পটি কিন্তু জবরদস্ত। অষ্টধাতুর তৈরী দেবী সর্পমস্তার (মাথায়ে সাপ জড়ানো) একটি মুর্তি নাকি কাশীরাজ চৈত সিংয়ের প্রাসাদ লুট করে  গঙ্গাপথে কলকাতায় নিয়ে আসছিলেন ওয়ারেন হেস্টিংস। সেই সময়ে তৎকালীন দেওয়ান নন্দকুমার তাঁর বজরায় চড়াও হয়ে সেটি উদ্ধার করে ভদ্রপুরে এনে এই অষ্টকোনা মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন ১৭৭২ খ্রিস্টাব্দে। নন্দকুমারের নিজের বাড়িও পাশেই আকালিপুরে। যে খাল বেয়ে নন্দকুমার দেবীকে এনেছিলেন সেটিও মন্দিরের কাছেই। খালের ধারে বাঁধানো সিঁড়ি, দুপাশটা গাছগাছালিতে ভরা।

গিন্নি জুনকে নিয়ে দেবী দর্শন করে এলেন, মিটমিটে আলোয় অর্দ্ধেক কাপড়ে ঢাকা অবস্থায় রয়েছেন মা সর্পমস্তা। অষ্টকোনা মন্দির প্রদক্ষিণ করলাম সবাই। বাইরে থেকে আমার কেমন যেন জেলখানার পাঁচিলের মতো লাগল। পরেরদিন যাওয়া হল প্রথমে রাজনগরের ইমামবড়া দেখতে,সোমনাথ আগেই  বলে রেখেছিল ‘দেখবেন আজকের ঘোরাটা আপনার মনের মতো হবে।’ সিউড়ি থেকে রাজনগর ঘন্টাখানেকের পথ। বাজারের চৌমাথায় এসে থামলাম নবাবি আমলের প্রাচীন মতি মসজিদ দেখব বলে। নেহাতই পাড়ার ক্লাব ঘরের সাইজের একটা সৌধ, বাইরেটা কেমন বোঝা গেল না, কারন পেল্লায় একটা ট্রাক তখন পিকনিক পার্টির মালপত্র তুলছে ঢোকার মুখটা আড়াল করে, সেই সঙ্গে কান ফাটানো ডিজের  গান।

শীতকালের রবিবার, গিজগিজ করছে লোকজন। আমরা নিচু দরজা দিয়ে কোনওরকমে ভেতরে গেলাম। মতি মসজিদের মাহাত্ম্য হল এর দেওয়ালে পোড়ামাটির কারুকাজ, যা সুলতানি আমলের আরও অনেক মসজিদে আজও ছড়িয়ে আছে। চত্বরটা হেরিটেজের আওতায় তাও দেখাশুনোর বালাই নেই, স্থানীয় বাচ্চাদের এটা লুকোচুরি আর বল খেলার জায়গা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তুলনায়  ইমামবাড়াটি কিন্তু বেশ জমকালো দেখতে। সাদা পাথরের সারা গায়ে ছোপ পড়ে গেলেও ,তিনতলা সমান বাড়িটার ছাদ আর চারধারের খিলানওলা সরু বারান্দাগুলো ধরে হেঁটে চলে বেড়াতে বেশ লাগে। মনে হবে বৃদ্ধ মেহের আলি এসে দেখা দিল বলে।

Rajnagar Imambara
রাজনগরের ইমামবাড়া

সামনে মাঠের একদিকে গাছের তলায় গেলাম বাইরে থেকে বাড়িটার ছবি আঁকতে। বসার জায়গা দরকার। দূরে একটা দোকানের গায়ে একটা কাঠের বেঞ্চি দাঁড় করানো। হানা দিয়ে দেখলাম খাবার হোটেল, উনুনে রান্না চাপিয়েছে আব্দুস সুকুর, দাড়িতে লাল মেহেন্দি, চৌখুপি লুঙ্গি। এক কথায় বেঞ্চি ধার দিয়ে দিল। আঁকা দেখতে ভিড় জমল। লম্বা দাড়ির শেখ সালিম মাতব্বর গোছের, এই ইমামবাড়ার খাদিম অর্থাৎ পুরোহিত বলে পরিচয় দিল। বেঞ্চি ফেরত দিতে গিয়ে দেখি, ডেকচি ভর্তি মাংস নেমেছে। সুকুরকে বললাম ‘কীগো, মনে হচ্ছে বড়া গোস্ত? একবাটি দাও তো দেখি!’ চুপিচুপি গিন্নিকে ডেকে আনলাম। সোমনাথ আবার রোজ পুজোআচ্চা করে ,ওদের এসব জানিয়ে কাজ নেই। মাত্র কুড়ি টাকা প্লেট ঝাল ঝাল বিফ কারি, চেটেপুটে খেলাম দু’জনে। কোথায় লাগে কলকাতার জ্যাকেরিয়া স্ট্রিট।

ঠিক করা ছিল, সিউড়ি থেকে ফেরার পথে ক’দিন শান্তিনিকেতনে থাকব। মুখুজ্জে পরিবার ছলছল চোখে আমাদের বিদায় জানাল। এরই মধ্যে সোমনাথ আমার গিন্নিকে দিদি পাতিয়ে ফেলেছে আর আমি ওর জামাইবাবু। বহুদিন বাদে শান্তিনিকেতনে আমাদের পছন্দের জায়গা তিতলি গেস্ট হাউসে দোতলার উত্তরপশ্চিমের ঘরটা পেলাম। বারান্দায় বসে সামনের সোনাঝুরির জঙ্গল দেখে দিব্যি কাটানো যায়। ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের দু’ একজনকে জানিয়ে রেখেছিলাম আসছি, পরদিন সকালে গাড়ি নিয়ে দীপঙ্কর হাজির। এখানে ইংরিজি পড়ায়, ইদানীং এদের কাজের চাপ প্রচুর। তবু মনে করে এক বোতল নলেনগুড় এনেছে।

গল্পগুজব করতে করতে দীপঙ্কর আমাদের ডিয়ার পার্কে নামিয়ে দিয়ে চলে গেল। মাথাপিছু পঁচিশ টাকা দিয়ে ঢুকে আমরা সকালটা গাছপালা ঘেরা বিশাল খোলা জায়গায় সুন্দর কাটালাম। তারের বেড়ার ওপারে একপাল হরিণ তখন খেতে এসেছিল ছাউনির নীচে, বেশ কাছ থেকে দেখা গেল ওদের ঘোরাফেরা, ফাঁক ফোকর দিয়ে পুটপাট ছবিও তোলা হল। ওয়াচ টাওয়ারে উঠলাম ছবি আঁকতে, ক্যানাল ছাড়িয়ে আরও অনেকদূর পর্যন্ত চোখ চলে যায়।

Kopai River
কোপাই নদীর ধার

বিকেল হতেই গিন্নি পা বাড়ালেন সোনাঝুরি হাটের উদ্দেশে। আজকাল রোজই দোকান সাজিয়ে বসে সবাই। গিন্নির অবশ্য কেনাকাটার থেকে ঘুরে ঘুরে দেখতে বেশি মজা। মাঝেই মাঝেই গাছ ঘিরে বাঁশের মাচা করা, আয়েস করে বসা যায়। শীতের বিকেলে গুছিয়ে একটা সাদা কালো স্কেচ হয়ে গেল। তিতলির কাছেই গ্রামের মধ্যে আশীষ-চিতুদের বাড়ি শীতের সকালে নিয়ম করে টাটকা খেজুরের রস আনিয়ে রাখে আমাদের জন্য। গেলাস ভর্তি কনকনে ঠান্ডা রস খেয়ে চাঙ্গা হয়ে উঠি, সঙ্গে জোর আড্ডা চলে।

ওখান থেকে টোটো নিয়ে সোজা কোপাই নদীর ধার। শীতে জল কম। একপাশে চড়ার ওপর গাছপালার জঙ্গল হয়ে আছে, আশপাশের বৌ মেয়েরা জলের ধারে বসে বাসন ধুচ্ছে, কাপড় কাচছে। এসব দৃশ্য কতবার এঁকেছি তবু আজও পুরনো হল না। এবারও গিয়ে বসে পড়লাম নদীর কালভার্টের নীচে একটা পাথরের ওপর, আর গিন্নি আরও এগিয়ে গিয়ে চারপাশের সর্ষেক্ষেতের ছবি তুলতে লাগলেন।

কালভার্টটা পেরলেই ডানহাতে জ্ঞানরঞ্জন করের চায়ের দোকান। আমরা বসলাম। তারপর অতি বিস্বাদ লাল চা এল বটে, তবে জ্ঞানবাবু লোকটি আলাপী। আমি আঁকছিলাম এটা খেয়াল করেছেন। মৃদু গলায় খাতাটা দেখতে চাইলেন। লাঞ্চের এখনও অনেক দেরি। তার আগে হাজির হলাম সাঁওতাল গ্রাম বনেরপুকুরে, সার সার সব মাটির বাড়ি, কিন্তু লোকজন নেই। প্রায় খাঁ খাঁ অবস্থা। শালমুড়ি দিয়ে এক পাগলাটে ছোকরা ঝিম মেরে বসেছিল রাস্তার ধারে। ওকে সামনে রেখে তাও একটা স্কেচ হল।

Sonajhuri Fair
সোনাঝুরির হাটে বিকেল

গিন্নি বলল ‘ভিড়ভাট্টা চাও তো আজ বিকেলে আবার হাটে চল। তোমার দেখছি মুড এসে গেছে। এবার রঙিন ছবি হয়ে যাক।’ গিন্নির অবাধ্য হইনি, আলো পড়ে আসার আগেই জমিয়ে একটা রঙিন ছবি শেষ করে ফেললাম। গিন্নি এসে একফাঁকে তদারক করে গেলেন, ‘সবার মুখে মাস্ক দিচ্ছ তো?’ উনি নিজেও তখন দু’চারপিস মাস্ক কিনে ব্যাগে পুরেছেন। ঘুরতে ঘুরতে পাশেই একটা খোলামেলা রেস্তোরাঁয় গিয়ে বসলাম। গরম কফি সহযোগে চিকেন ফ্রাই আনতে বললাম। সামনেই বানাচ্ছে, মুচমুচে,সুস্বাদু। খেয়েদেয়ে আধো অন্ধকারের মধ্যে দু’জনে ধীরে ধীরে পায়ে হেঁটে ফেরার পথ ধরলাম।  

Debashis Dev

স্বনামধন্য এই অঙ্কনশিল্পী নিজেই এক সম্পূর্ন প্রতিষ্ঠান | তাঁর হাত ধরে নতুন করে প্রাণ পেয়েছে বাংলার কার্টুন শিল্প | সিগনেচার বেড়াল আর স্ব-নেচারটি কোমল, আত্মবিশ্বাসী, রসিক | বেড়ানো তাঁর নেশা | তাই ঝুলিতে রয়েছে বহু গল্প, সঙ্গে অসাধারণ সব স্কেচ | সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে তাঁর নিরলস সাধনার অমর ফসল ‘রঙ তুলির সত্যজিৎ’ |

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *