কথায় বলে ‘শেষপাতে মিষ্টিমুখ’। তবে যদি ‘মিষ্টিমুখ’-এর বদলে ‘মিষ্টিসুখ’ বলি, তাহলে বেশ একটা সুখী বাঙালির মিষ্টির জন্য উসখুশে স্বভাবের কথা মনে পড়ে যায়। কলকাতার রসগোল্লা তো আর শুধু বাগবাজারের নবীন ময়রার ভিয়েনেই গোল্লা পাকিয়ে গড়িয়ে নেই রসে; সে এখন বড়ই হল্লা তুলেছে। খালি বলে-
আমি রসময় নই, রসরাজ নই;
কেবল মিষ্টি রসগোল্লা
আহা! তিনি তো থাকবেনই। ওই যে গোলে পড়লে একখানেতেই শুরু, একখানেতেই শেষ। তবে বাপু ওনার চরণে পেন্নাম ঠুকেও বলতেই হয় জেলায় জেলায় রসবাজি কিছু কম নয়। ওরে ভাই-
খোঁজো খোঁজো রস ভাঁজো ওরে ব্যাটা হ্যাংলা।
সন্দেশ, জিলিপি-তে ম ম করে বাংলা।

হ্যাঁ হ্যাঁ। উত্তর থেকে দক্ষিণ, পুব থেকে পশ্চিম। সবেতেই একখানা না একখানা গোঁফ পাকিয়ে সামন্ত রাজার মতো যেন ফুলেফেঁপে ঢোল। এমনই কিছু রসের হাঁড়ি খুঁজতে আমরা বেরিয়ে পড়ি। যাব কোথায়? হাওড়া থেকে কাটোয়া লোকাল ধরে নামো গুপ্তিপাড়ায়। বলি তবে সেই কাহিনি।
“একপাশেতে কুমোরপাড়া হচ্ছে ঠাকুরগড়া
আর এক কোণেতে বসে ভোলা গড়ছে কত ছড়া।”
হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন। এ আমাদের ভোলা ময়রা কবিয়ালের পদ। আণ্টুনি ফিরিঙ্গির সঙ্গে চাপান-উতোর পর্বের সে এক জমজমাট কাল। উনিশ শতকের বাংলার সংস্কৃতি থেকে আমরা যে দুটো সংস্কৃতিকে একেবারেই বাদ দিতে পারি না, তার মধ্যে প্রথমটা ‘বিদ্যাসুন্দর পালা’ আর পরেরটা কবির লড়াই। হ্যান্সম্যান অ্যান্থনির সাথে কবির লড়াইয়ে তার রসবোধের পরিচয় আমরা পেয়েছি। এখনকার ছেলে-ছোকরাগুলো ওসব গান শোনে না। আর না শোনাই ভালো, বাবা!! না হলে আধখানা গান শুনেই রটিয়ে দেবে হয়তো ‘ভোলা কবি আমাদের খোদ কলকাতার লোক’। কী বিচিত্র! কিন্তু ভোলা ময়রা সত্যিই যদি বাগবাজারের না-ই হয়ে থাকেন, তবে তিনি কোথাকার?

হ্যাঁ!! সে যে সেই গুপ্তিপাড়ায়! আরে হ্যাঁ, সেই গুপ্তিপাড়া-তেই যেখানে বাংলার প্রথম বারোয়ারি পুজো হয়েছিল। সেটা সেই ১৭৬১ সাল (মতান্তরে ১৭৯০ সাল)। তবে তা মা দুর্গার পুজো নয়। তিনি হলেন মা বিন্ধ্যবাসিনী জগদ্ধাত্রী। দুগ্গা বলে চালালে দুগ্গতির অন্ত রইবে না। এই ময়রার জন্ম তারই কিছু আশেপাশে। তবে তিনি কখনও জাতব্যবসায় নামেননি।
গুপ্তিপাড়ার বড়বাজারে সীতারাম ওঙ্কারনাথ মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের সঙ্গে যদিও ওই বংশের একটা সম্পর্কের সুতো রয়ে গেছে বলেই তাঁদের বক্তব্য। ২৪ ঘণ্টা না মিললেও দিনের একবার অন্ততঃ ট্রে-তে থ্যাবড়া ঘুঁটের মতো জোড়া-লাগানো এক মিষ্টি দেখা যাবেই। জল ঝরানো ছানার সঙ্গে চিনির পাক দিয়ে ভালভাবে নেড়ে হাতের মুঠিতে গোল করে পাকিয়ে ছোড়া হয়। এমন করেই দুটো মণ্ড জুড়ে তৈরি হয় গুপো সন্দেশ।
নামের পেছনে তেমন কোনও রোমাঞ্চকর ইতিহাস নেই। গুপ্তিপাড়া নাম থেকেই ‘গুপো’। আরও বড় কথা কী জানেন! গুপো-ই হ’ল বাংলার প্রথম ব্র্যান্ডেড সন্দেশ। যদিও ‘হুগলী জেলার ইতিহাস ও বঙ্গসমাজ’ বইয়ে গুপোর নাম নেই। তাই এই মিষ্টি খুব পুরনো নয় বলেই মনে হয়। বিশ শতকের দ্বিতীয় ভাগেই এর নামকরণ। আসলে ভাগীরথীর পশ্চিমে মাখা সন্দেশের খুব সুনাম। তাকেই একটা রূপ দিয়ে গুপো সন্দেশ। বীরভূম, বর্ধমানের দিকে আবার একে ‘মণ্ডা’-ও বলে।

তা বুঝলেন! মাহেশের রথের মতোই এখানেও রথে উপচে পড়া ভিড় হয়। এ রথযাযাত্রাও খুব পুরনো। সে সময়েই সৌভাগ্যক্রমে কলা বেচার বদলে বগলদাবা করে ঘরে নিয়ে আসুন গুপো সন্দেশ। তাছাড়াও একটু স্থানীয় লোকজনদের থেকে খোঁজখবর নিয়ে একবার নতুন সেনবাড়ির দিকটা ঘুরে আসুন। পুরোনো বনেদি-বাড়ি, জোড়া শিবমন্দির পাবেন। আর টেরাকোটা মন্দির চান ? তাও পাবেন। বৃন্দাবনচন্দ্র মন্দিরের চত্বরেই চার-চারখানা মন্দির। মুখ মরবে না হে এর স্বাদ নিলে!
এবার যাব উত্তরে। সেই গৌড় দেশ। নমো নমো। চৈতন্যপ্রভুর স্মৃতিধন্য। মালদহ টাউন স্টেশন থেকে রিক্সা, টোটো ধরে রথবাড়ি মোড় ধরে চলতে হবে। মে মাসের শুরুতেই হঠাৎই প্ল্যান হ’ল মালদহ-গৌড়-পাণ্ডুয়া দেখবার। ব্যাস! শিয়ালদহ থেকে সোজা কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেস ধরে মালদা টাউন। বিকেল পড়তেই বেরিয়ে পড়া গেল। অমিত আর দিব্যেন্দুকে বললাম ‘চল, আজ তোদের একটা নতুন মিষ্টি খাওয়াব’, যার সঙ্গে শ্রীচৈতন্যদেবের গভীর সম্পর্ক রয়েছে।
তখন হুসেন শাহী আমল! মহাপ্রভু গৌড়ে এলেন। ১৫১৫ সালের জৈষ্ঠ্য সংক্রান্তির দিন রামকেলি গ্রামের কদম্বতলায় রূপ-সনাতনের সঙ্গে তাঁর মিলন হল। জনশ্রুতি অনুসারে সেই সময়ে গ্রামের মহিলারা কদমফুলের মতো দেখতে এক মিষ্টান্ন নিবেদন করেন মহাপ্রভুকে। রথবাড়ি মোড় থেকে হেড পোস্ট অফিসের দিকে রবীন্দ্র অ্যাভেন্যু ধরে হেঁটে সোজা ঢুকে পড়লাম পাবনা সুইটসে। থরে থরে সাজানো রসকদম্ব। সাইজের হেরফের রয়েছে।
কলকাতা বা অন্য জায়গায় পোস্তদানা ছেটানো গোল গোল রসকদম্বের দেখা মিললেও এখানকার মতো মোটা সাদা দানা নয়। লোকে এটাকে সাবুদানা বলে ভুল করে। কিন্তু ব্যাপারটা তা নয়। পোস্তদানার ওপর চিনির রস ঢেলে সেটা জমাট বাঁধতে দিলেই ওইরকম হোমিপ্যাথি বড়ির মতো দানা তৈরি হয়ে যায়। প্রথমে ছোট্ট রসগোল্লা বানিয়ে তা থেকে রস ঝরিয়ে তার ওপর ক্ষীরের মণ্ডের আবরণ দিয়ে সাদা দানা মাখিয়ে নেওয়া হয়।

তবে শুধু পোস্তদানাও চলে। দাম দুটোরই এক। ১০ টাকা পিস। পাবনা সুইটসের প্রতিষ্ঠাতা হলেন সুবল চন্দ্র কুণ্ডু। ৫৫ বছর আগে ওপার বাংলা থেকে এসে মালদায় ব্যবসা শুরু করেছিলেন। এখন দোকানে বসেন তাঁরই ছেলে সুবোধবাবু। যেই বলেছি ‘আপনরা তাহলে বাংলাদেশের মানুষ?’ ওমনি মুখের কী ভাব! বললেন ‘বাংলাদেশ নয়, পূ্র্ব পাকিস্তান।’
তা না হয় গেল। কিন্তু মালদহ যখন আসাই গেল, তখন সুন্দরী চা-বাগিচা না দেখলে চলে? ট্রেনে নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন। নেমে পড়তে হবে। অদূরেই ডুয়ার্স, জলপাইগুড়ির নিতান্তই এক মফঃস্বল শহর বেলাকোবা। অথচ সেখানেই রয়েছে এক বিখ্যাত ‘মিষ্টান্নভোগ’, যার নাম ‘চমচম’। তা বলি, চমচম তো সারা পশ্চিমবঙ্গ জুড়েই পাওয়া যায়। লম্বাটে, সাদা ধরনের। মালদহের লোকজনরা তাকে আবার বলে ‘কানসাট’। ওপার বাংলা থেকে এসেছিল কিনা!
চমচম বলতে গেলে ওপার বাংলারই মিষ্টি। পোড়াবাড়ির চমচমের খ্যাতি প্রায় দেড়শো বছর আগেই ছড়িয়ে পড়েছিল। দেশভাগের সময় থেকেই ওপারের কিছু ময়রাদের সঙ্গে চমচম পশ্চিমবাংলায় ঢুকে পড়ে। কালী দত্ত-ও তেমনই একজন যিনি তাঁর মায়ের নামে(শান্তি) দোকান খুলেছিলেন।

বেলাকোবার চমচমের আসল রহস্য লুকিয়ে আছে ছানার মধ্যেই। গরম ছানাকে বেঁধে জল ঝরিয়ে ঠান্ডা না করলে স্বাদ আসবে না। এই চমচমের রং কমলাটে লাল ধরনের। ওপরে ক্ষীরের গুঁড়ো। শোনা যায় এখানকার চমচম আমেরিকাতেও পাড়ি দিয়েছে। অভিনেত্রী দেবশ্রী রায়েরও খুব পছন্দের এই চমচম। গরমের বা পুজোর ছুটি পড়লেই লোকে উত্তরবঙ্গ ঘুরতে আসে, পাহাড়ি মোমো-ই তখন অমৃত। পড়ে থাকে এই বেলাকোবার চমচম। গেঁয়ো যোগী তো। তাই চোখ মেলে আর ভিখ মেলে না।
সমীপেষু পেশায় বঙ্গবাসী কলেজের অধ্যাপক। টেগোর রিসার্চ ইনস্টিটিউটে রবীন্দ্রসাহিত্য নিয়ে গবেষণা করছেন। গবেষণা করছেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়েও। তাঁর নেশা বাংলার ইতিহাস। কলকাতার কথকতা দলের অন্যতম সদস্য সমীপেষু ভালবাসেন এই বিষয় নিয়ে নতুন নতুন তথ্য অনুসন্ধান এবং লেখালিখি।