আগের পর্বের লিংক: [পর্ব ১], [পর্ব ২], [পর্ব ৩], [পর্ব ৪]

প্রায় মাঝরাত। দুধের শিশুকে বুকে করে কুয়োর পাশে দাঁড়িয়ে আছে কাশীবাঈ। বাচ্চাটা আরামে ঘুমোচ্ছে মায়ের কোলে। মাত্র দু’দিন আগেই তো সে পৃথিবীতে এসেছে। মা, মানে কাশীবাঈকে ছাড়া কাকেই বা চেনে। 

দূর থেকে কুকুর ডেকে উঠল। চমকে উঠল কাশীবাঈ। তার অসুস্থ শরীর, দুর্বল স্নায়ু আর পারছে না। গত কয়েকমাস ধরে যা চলেছে। মিথ্যে পরিচয়ে দূরসম্পর্কের এক আত্মীয়ের বাড়িতে এসে উঠেছে সে। বলেছে, সদ্য বিধবা হয়েছে। দেখার কেউ নেই। অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় কোথায় যাবে? এসব করে কোনওমতে একটু মাথা গোঁজার ঠাঁই মিলেছে এই কয়েকদিনের জন্য। তাও অনেক প্রশ্ন, অনেক সন্দেহ এড়িয়ে কোনওমতে থাকা। বর মারা গেছে তো কী, শ্বশুরবাড়ির কেউ দেখা করতে আসে না কেন, বাপের বাড়ির লোকজনই বা কোথায়।

কী করে সত্যি কথাটা বলবে কাশীবাঈ, যে সে আসলে বাল্যবিধবা! সন্তানের পিতৃপরিচয় সকলের সামনে আনা তো দূরের কথা, বালবিধবার এই আচরণের কথা জানাজানি হলে কত লাঞ্ছনা যে সহ্য করতে হবে, তার ঠিক নেই। শেষে মৃত্যুর নিদান তো আছেই। নিজের অপমান, মৃত্যু নিয়ে মাথা ঘামাবার অবস্থায় নেই কাশীবাঈ। কিন্তু নিজের চোখের সামনে এই ফুটফুটে মেয়ের উপর অত্যাচার কাশীবাঈ সহ্য করতে পারবে না। তার থেকে নিজের হাতেই শেষ করবে সব। 

হঠাৎ কোথা থেকে একসঙ্গে ডেকে ওঠে অনেকগুলো কুকুর। চমকে যায় কাশীবাঈ, আর তাতেই ঘটে যায় বিপদ। কুয়োর পাশে দাঁড় করানো বালতিটা খুব শব্দ করে মাটিতে পড়ল। পাশের রাস্তাতে টহল দিচ্ছিল গোরা পুলিশ। অনেক অনুনয় বিনয় করল কাশীবাঈ। জল খেতে কুয়োর পাশে এসেছিল এমন কথাও বলল। লাভ হল না। বাচ্চা মেয়েটা যাতে না কাঁদে, তার মুখ কাপড় দিয়ে বেঁধে দিয়েছিল কাশীবাঈ, তা কারও নজর এড়াল না। 

ইংরেজ সরকারের শাসনের নিয়ম, এধার ওধার হবার জো নেই। মেয়েকে নিয়েই জেলে যেতে হল কাশীবাঈকে।

***

খবরটা কাগজে পড়লেন সাবিত্রীবাঈ। সংবাদপত্রেই প্রকাশিত হয়েছিল যে পুণের অসহায় বিধবা কাশীবাঈ উপয়ান্তর না দেখে শিশুকন্যাকে হত্যা করতে যায় আর সেই অপরাধে দণ্ডিত হয় সে। 

১৮৬২ সাল। সিপাহী বিদ্রোহের প্রভাবে সরকারি অনুদান বন্ধ হয়ে গেছে সাবিত্রী ও জ্যোতিবার স্কুলের। প্রায় সব স্কুলই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। বরোদার মহারাজার মতো অন্যান্য পৃষ্ঠপোষকদের অনুদানে এক এক করে আবার খুলছে স্কুলগুলি। ১৮৫৬ সালে মোট আঠেরোটি স্কুল ছিল। এখন তার সংখ্যা ছয়। তবে আশা ছাড়েননি জ্যোতিবা-সাবিত্রী কেউই। পুণের স্কুলটি নতুন করে শুরু হয়েছে। তারপর বম্বে প্রেসিডেন্সিরটাও। নতুন করে আশার আলো দেখতে শুরু করেছেন ফুলে দম্পতি। 

Plight of the widows
সেকালে বিধবাদের অবস্থা ছিল ভয়ঙ্কর

এমন সময় এইরকম এক ঘটনা! বিধবা, বালবিধবাদের এরকম দুর্দশার কথা তো নতুন নয়। একদিকে মেয়েদের পড়াশোনা, বৃত্তিমূলক শিক্ষা দিয়ে স্বনির্ভর করার চেষ্টা করছেন জ্যোতিবা, সাবিত্রীরা। অন্যদিকে, একই বয়সের কত মেয়ে শুধু বৈধব্যের অপরাধে এরকম অত্যাচার সহ্য করছে। মুণ্ডিত কেশ, সাদা শাড়িতে ঘরের অন্ধকার কোণায় বন্দি হয়ে অনাহারে, অত্যাচারে দিন কাটে তাদের।

কাশীবাঈয়ের মতো পিতৃপরিচয়হীন সন্তানের মৃত্যু, সন্তানকে নিয়ে নির্বাসন বা সন্তান জন্মানোর আগেই সমাজের অপবাদের ভয়ে বিধবা মেয়েটির সকরুণ মৃত্যুর কথা কান পাতলেই শোনা যায়। তবে স্পষ্ট করে, সজোরে উচ্চারণ করে না কেউই। স্বামীর মৃত্যুর অভিশাপে নরকযন্ত্রণা শেষ হয় না বিধবাদের।

জ্যোতিবা-সাবিত্রী ঠিক করেন, আর নয়। মেয়েদের পড়াশোনা শেখানোর জন্য এত পরিশ্রম, অনুদানের জন্য চিঠিপত্র লিখে কী লাভ, যদি তাদেরই বয়সী অতগুলি মেয়ের জীবন এমন অন্ধকারে পড়ে থাকে? কাশীবাঈয়ের ঘটনাই চোখের সামনে আসে বারবার। আর তার শিশুকন্যার কথা মনে পড়ে। কী অপরাধে বিধবার পিতৃপরিচয়হীন সন্তানকে মারা যেতে হবে? বিধবার পিতৃপরিচয়হীন সন্তানদের জন্য অনাথ আশ্রম গড়ে তুললেন সাবিত্রী। 

Jyotiba phule
জ্যোতিবা ভাবলেন, অনাথ আশ্রমই যথেষ্ট নয়, বিধবা মা যদি নিরাপদে সন্তানের জন্মই দিতে না পারেন?

স্বাভাবিকভাবেই ‘অবাঞ্ছিত’ বলে যাদের মেরে ফেলার কথা হয়, তাদের জন্য এই ব্যবস্থাতে তর্জনী তোলে সমাজ। তাতে পিছিয়ে যাবার মানুষ তো জ্যোতিবা-সাবিত্রী নন। অনাথ আশ্রমই যথেষ্ট নয়, বিধবা মা যদি নিরাপদে সন্তানের জন্মই দিতে না পারেন? যদি তার আগেই হত্যা করা হয় মা কে? একরকম জন্মদানকেন্দ্র গড়ে তোলেন সাবিত্রী। বিধবা মায়েরা নিজেদের ইচ্ছানুসারে সেখানে থেকে, নিরাপদে সন্তানের জন্ম দিতে পারেন। জন্মের পর সন্তানকে নিয়ে যেতে পারেন নিজের সঙ্গে আর উপায় না থাকলে আশ্রমেই রেখে যেতে পারেন। প্রতিদিন, নিজে গিয়ে  যত্ন করতেন বিধবা মায়েদের। সন্তানের পরিচর্যার যাতে কোনও অসুবিধা না হয়, তার চেষ্টা করতেন। 

এর জন্য কম লাঞ্ছনা সহ্য করতে হয় না সাবিত্রীকে। বাড়ি থেকে বেরনোমাত্র নোংরা, কাদা ছেটানো হয় তাঁর শাড়িতে। উপায় বের করেন সাবিত্রী। দুটো পরিষ্কার শাড়ি সঙ্গে করে নিয়ে যান। বিধবাদের আশ্রমে গিয়ে শাড়ি পরিবর্তন করেন। তাতেই শেষ হয় না। আশ্রম থেকে মেয়েদের স্কুলে যাওয়ার পথেও আবারও জঞ্জাল আবর্জনা ফেলা হয় তাঁর শাড়িতে। দ্বিতীয়বার শাড়ি বদলান স্কুলে গিয়ে। দিনের শেষে নোংরা শাড়ি নিয়ে, অশ্রাব্য কথন শুনে বাড়ি ফেরেন সাবিত্রী। পরের দিনের জন্য শাড়ি ধুয়ে সাফ করেন। তারপর আলোচনায় বসেন জ্যোতিবার সঙ্গে, আর কী করা যায় বিধবাদের দুর্দশা মোচন করতে? যথাসাধ্য পুষ্টিকর খাবার, পরিষ্কার জামাকাপড় দেওয়ার চেষ্টা করেন সাবিত্রীরা। তবু বিধবা, বিশেষত বালবিধবাদের এই চেহারা দুঃস্বপ্নের মতো হানা দেয়। 

Widows
বালবিধবাদের এই চেহারা দুঃস্বপ্নের মতো হানা দেয়

যদি বিধবাদের চুল কেটে দেওয়াটা অন্তত আটকানো যায়? যেমন ভাবা তেমনই কাজ। প্রথমে বিধবাদের বোঝাবার চেষ্টা করলেন, সমাজপতিদের বোঝালেন। কোনও কাজ না হওয়ায় অন্য পথ ধরলেন। সেই কবে থেকে নিচু জাতের ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে স্কুল চালান ফুলে দম্পতি। সেই ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে ক্ষৌরকারও আছে। যদি ক্ষৌরকাররা অরাজি হয়, তাহলে তো মস্তকমুণ্ডন সম্ভব নয়। আর ছাত্রছাত্রীরা যে তাদের শিক্ষক শিক্ষিকাদের কথা ফেলতে পারবে না, তা জানতেন জ্যোতিবারা।

ইতিহাসে নজিরবিহীন এমন এক ঘটনা সত্যিই ঘটল পুণে শহরের বুকে। ক্ষৌরকাররা বিধবাদের মুণ্ডনের কাজ বন্ধ করে দিল, আজকের ভাষায় বন্‌ধ বলা চলে হয়তো। বিধবাদের মাথা কামানো বন্ধ রইল সারা শহরে। আর বিধবারা কিছুদিনের জন্য হলেও অনুভব করলেন, তাঁদের জন্তুসদৃশ সাজিয়ে রাখা হলেও তাঁরা মানুষ। 

Ishwarchandra Vidyasagar
যাঁর একার লড়াইয়ে বিধবাদের জীবন সহনীয় হয়ে উঠেছিল আংশিকভাবে

সময়টা ১৮৬৩। এই সময় বাংলাদেশের এক ব্রাহ্মণসন্তান গোটা সমাজের বিরুদ্ধে একা লড়াই করছেন, বিধবাদের স্বার্থরক্ষায়। অনেক কুৎসা, তীব্র আক্রমণ সহ্য করে চেষ্টা করছেন বিধবাবিবাহের প্রচলন করার– যে বিধবাবিবাহের আইন ১৮৫৬ সালে অনেক কষ্টে শাস্ত্রের প্রমাণ দেখিয়ে, সই সংগ্রহ করে ইংরেজ সরকারকে দিয়ে পাশ করিয়েছেন তিনি। সেই খবর জানতে পারেন জ্যোতিবা-সাবিত্রীও, ১৮৬৪ সাল নাগাদ। চেষ্টা শুরু করেন তাঁদের অঞ্চলেও বিধবাবিবাহ প্রচলনের। 

একদিকে দলিতদের পড়াশোনা, মেয়েদের স্কুলের পাশাপাশি চলতে থাকে অনাথ আশ্রম, জন্মদানকেন্দ্রের কর্মকাণ্ড। কাশীবাঈ, মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসা শিশুকন্যা এবং আরও কত কত কাশীবাঈ– অতীত ও ভবিষ্যতের বৈধব্য মাথায় নিয়ে তাকিয়ে রইল ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের দিকে, সাবিত্রী-জ্যোতিবা ফুলের দিকে। এরও বেশ কিছুদিন বাদে ওই অনাথ আশ্রম থেকেই সন্তান দত্তক নেবেন সাবিত্রী-জ্যোতিবা। ভবিষ্যত আরও অনেক বেশি ঋণী হয়ে থাকবে অতীতের কাছে।

আগের পর্বের লিংক: [পর্ব ১], [পর্ব ২], [পর্ব ৩], [পর্ব ৪]
*ছবি সৌজন্য: লেখকের সংগ্রহ, bbc, Wikipedia
* তথ্যঋণ:

‘দ্য লাইফ অ্যান্ড টাইমস্‌ অফ ধ্যানজ্যোতি ক্রান্তিজ্যোতি সাবিত্রীবাঈ ফুলে’; আলোক, নূপুর প্রীতি; ২০১৬

‘কাস্ট, কনফ্লিক্ট অ্যান্ড আইডিওলোজিঃ মাহাত্মা জ্যোতিরাও ফুলে অ্যাড লো কাস্ট প্রোটেস্ট ইন্ নাইন্টিন্থ সেঞ্চুরি ওয়েস্টার্ন ইন্ডিয়া’; ও’হানলন, রোজালিন্ড; ২০০২

‘এ টেল অফ টু রিভোল্টস্‌’; গান্ধী, রাজমোহন; ২০০৯

‘কালেক্টেড ওয়ার্কস্‌ অফ্‌ মাহাত্মা জ্যোতিরাও ফুলে’ ভলিউম ১-২, গভর্নমেন্ট অফ মহারাষ্ট্র, ১৯৯১

Isha Dasgupta Author

ঈশা আদতে অর্থনীতির ছাত্রী, শিক্ষিকা ও সমাজকর্মী। বিধাননগর কলেজের স্নাতক ঈশার পড়াশোনা ও শিক্ষকতার ক্ষেত্র ছুঁয়ে ছুঁয়ে গেছে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, ইউনিভার্সিটি অফ ম্যাসাচুসেটস, আমহের্স্ট। ছোটবেলা কেটেছে পিতামহী শিক্ষাবিদ মৃণালিনী দাশগুপ্তের ছত্রছায়ায়, অনেক গল্প, গল্পের বইদের সঙ্গে। গল্প বলার ছায়ারা পিছু নিয়েছে তখন থেকেই। ছোটবেলার স্মৃতিদের নিয়ে লেখা 'আমার রাজার বাড়ি' প্রথম প্রকাশিত গদ্যগ্রন্থ। প্রকাশিত হয়েছে 'রাই আমাদের' নামে ছোটদের গল্পের বইও। কবিতার বই 'চাঁদের দেশে আগুন নেই' আর 'রোদের বারান্দা' আছে ঈশার ঝুলিতে। কবিতার জন্য কৃত্তিবাস পুরস্কারও পান। বড়দের গল্প লেখেন অল্পস্বল্প- 'দেশ' পত্রিকা সাক্ষী। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখেন গবেষণামূলক লেখা, যার বিষয় মহিলাদের বিভিন্ন সমস্যা ও তার সামাজিক ঐতিহাসিক স্থানাঙ্ক। মহিলাদের প্রতিবাদের ইতিহাস তুলে আনাই এখন মূল লক্ষ্য ঈশার।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *