সাহিত্যিক রমানাথ রায় প্রয়াত হলেন। তিনি ছিলেন “শাস্ত্রবিরোধী আন্দোলন”-এর পুরোধা, যে আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল মূলধারার তথাকথিত বাস্তববাদী সাহিত্যকে বর্জন করা। অ্যাবসার্ড সাহিত্যের রচনাশৈলীকে গ্রহণ করে সম্পূর্ণ নতুন সাহিত্য-ভাষা সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিলেন রমানাথ রায়। বিশ্বসাহিত্যে তাঁর ছিল অগাধ পড়াশোনা। নানান বিদেশি ভাষার সাহিত্যিকদের কাজ নিয়ে বাংলালাইভে একটি কলাম শুরু করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। প্রথম কিস্তির লেখাও পাঠিয়ে দেন সময়মতো। কলামটা আর শুরু করা গেল না, তবে প্রথম কিস্তির লেখাটি বাংলালাইভের পাঠকদের সমৃদ্ধ করতে প্রকাশ করা গেল। লেখকের বানানরীতি অপরিবর্তিত রেখে এই অসম্পাদিত লেখাটি প্রকাশিত হল। বাংলালাইভের পক্ষ থেকে ওঁর পরিজনদের জন্য রইল গভীর সমবেদনা। 


 

রেমঁ কনো (Raymond Queneau) কোন জনপ্রিয় নাম নয়। আমাদের দেশে রেমঁ কনোর নাম কেউই প্রায় জানেন না। আমি যে বইটির কথা বলব, সে বইটির নামও কেউ প্রায় জানেন না। অথচ ফরাসি সাহিত্যে শুধু নয়, বিশ্বসাহিত্যে এটি একটি আশ্চর্য গ্রন্থ। এ রকম বই এর আগে লেখা হয়নি, এর পরেও হয়ত লেখা হবে না। বইটির নাম এক্সসারসাইজ ইন স্টাইল। (Exercises in Style, মূল ফরাসি. Exercices de style)। ১৯৪৭ সালে বইটি প্রকাশিত হয়। 

রেমঁ কনো

রেমঁ কনোর জন্ম ১৯০৩ সালে, মারা যান ১৯৭৬ সালে। তিনি একজন অঙ্কবিদ। মানে অঙ্কে রীতিমত পণ্ডিত। কিন্তু সাহিত্যে তাঁর ছিল প্রবল নেশা। তিনি পেটাফিজিক্সের একজন সভ্য ছিলেন।  পেটাফিজিক্স ফরাসি লেখক আলফ্রেড জারির তৈরি করা একটা মতবাদ। তার সঙ্গে তিনি যুক্ত ছিলেন। তারপরে তিনি উলিপো দলের সঙ্গেও যুক্ত হন। পেটাফিজিক্স ও উলিপোর কথা না হয় আর একদিন বলা যাবে। 

তিনি উপন্যাস লিখেছেন, গল্প লিখেছেন, কবিতা লিখেছেন, প্রবন্ধ লিখেছেন। সর্বত্রই তিনি স্বচ্ছন্দে বিচরণ করেছেন। তাঁর একটি উপন্যাসকে নিয়ে বিখ্যাত একটি সিনেমা নির্মিত হয়েছিল। উপন্যাসটির তথা সিনেমাটির নাম ‘জাজি দঁ ল্য মেট্রো’ (Zazie dans le métro)।  অর্থাৎ ‘Zazie in the Metro’। এই সিনেমাটি লুই মাল পরিচালনা করেছিলেন।  কলকাতাতেও মুক্তি পেয়েছিল ফিল্মটা। রীতিমত কৌতুক ভরপুর ছিল এই সিনেমাটি। 

‘জাজি দঁ ল্য মেট্রো -এর লেখক একটি অসম্ভব কাজ করেছিলেন। সেটা হচ্ছে, ‘এক্সাসাইজেস ইন স্টাইল’ নামক একটি বই লেখা। এই বইটি ফরাসি থেকে ইংরাজিতে অনুবাদ করেছিলেন বারবারা রাইট। খুব ভালো অনুবাদ করেছিলেন বইটি। যাই হোক, ‘এক্সাসাইজেস ইন স্টাইল’- এটাকে কী বলব আমরা বাংলায়? শৈলীচর্চা? বলা যতে পারে। অথবা অন্য কিছুও বলা যেতেই পারে। এখন প্রশ্ন হল, কি আছে এই বইতে যার জন্য এত কথা?   

না, এই বইতে কোনও পান্ডিত্য নেই। এই বইটি একটি অর্থহীন ঘটনাকে কেন্দ্র করে তৈরি হয়েছে। সে ঘটনাটা কী? এই বইটিতে একজন ন্যারেটার বা অবজার্ভার আছে। সে একদিন একটা ভিড় বাসে ওঠে। সেই বাসে একটা লোককে দেখে সে। লোকটা খ্যাপাটে মতো। লোকটা আর একজনের সঙ্গে তর্কাতর্কি করছিল। তারপর একটা ফাঁকা সিট দেখতে পেয়েই খ্যাপাটে লোকটা সেখানে বসে পড়ে। 

ঐ দিনই অন্য এক সময়ে অন্য এক জায়গায় ন্যারেটার আবার সেই লোকটিকে দেখতে পায়। তখন লোকটির সঙ্গে তার এক বন্ধু ছিল। বন্ধুটি লোকটির কোটের বোতামের জায়গাটা দেখিয়ে বলে, ‘আর একটা বোতাম কোটের এখেনে লাগাও।‘ 

এই হচ্ছে ঘটনা। এ রকম একটা তুচ্ছ ঘটনাকে বেছে নিয়েছেন বা তৈরি করেছেন রেমঁ কনো। তারপর তিনি নিরানব্বই বার এই ঘটনাকে নানা ভাবে লিপিবদ্ধ করেছেন। অর্থাৎ এই ঘটনাটা যে কত ভাবে লেখা যায় তারই নমুনা হচ্ছে এই গ্রন্থ। পাঠক হয়ত ভাবছেন কী ভাবে এটা করা সম্ভব। কী ভাবে এক নয়, দুই নয়, নিরানব্বই রকম ভাবে একই অকিঞ্চিতকর ঘটনার বর্ণনা করেছেন কনো?  সেটা যে কী ভাবে সম্ভব হয়েছে তা জানার জন্য বইটা পড়তে হবে। এ ছাড়া আর কোনও উপায় নেই। 

কথা হচ্ছে, এই নিরানব্বই বার একই ঘটনা লেখার মানে কী? এটা আসলে একটা মজা। সাহিত্যের মজা। আমাদের অনেকের ধারণা, কোনও লেখা এক বারই লেখা হয়। তা কিন্তু নয়। এক বইতে কনো সেটাই করে দেখিয়েছেন। 

এই গ্রন্থটি থেকে এই শিক্ষা আমরা নিতেই পারি যে, কোনও গল্পের একটা নির্দিষ্ট ফর্ম আছে এমনটা নয়। আমরা ইচ্ছে করলে সেই ফর্মটাকে ভেঙে দিয়ে আবার নতুন ভাবে বা নতুন ফর্মে লিখতে পারি। আবার তাকে ভেঙে দিয়ে অন্য ভাবে লিখতে পারি। অর্থাৎ একটা ঘটনা কেবল একই রূপের মাধ্যমে বেরিয়ে আসতে পারে তা নয়। নানা রূপে তাকে প্রকাশ করা যায়। এই শিক্ষাটি অন্তত আমাদের এখানে দরকার। কারণ আমাদের এখানে লেখকেরা মনে করেন যে, যেটা একবার লেখা হয়ে গেল সেটাই একমাত্র রূপ, সেটাই চুড়ান্ত রূপ। 

আমাদের দেশে এই বইটি এসে পৌঁছোয়নি। কিন্তু বইটি সকলেরই পড়া উচিৎ। বিশেষ করে যাঁরা সাহিত্য রচনা করেন তাঁদের জন্য এটি অবশ্যপাঠ্য গ্রন্থ।  

স্বাধীনতা পরবর্তি কথাসাহিত্যে পথিকৃৎ। তাঁর অদ্বিতীয় গদ্য স্টাইল পাঠকের কাছে খুব পরিচিত। প্রথম গল্প প্রকাশ ১৯৬২ সালে। সমালোচকেরা তাঁর লেখাকে ব্ল্যাক হিউমার, অ্যাবসার্ড, ম্যাজিক রিয়ালিজম ইত্যাদি আখ্যা দিয়েছেন। ১৯৮২ সালে প্রকাশিত তাঁর প্রথম উপন্যাস 'ছবির সঙ্গে দেখা' -কে বাংলা সাহিত্যের প্রথম অ্যান্টি নভেল বলা হয়। ষাটের দশকে, প্রচলিত গল্পরীতির বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা শাস্ত্রবিরোধী আন্দোলনের প্রবর্তক তিনি। সেই আন্দোলনের অন্যতম বক্তব্য ছিল- বহু ব্যবহারে বাস্তববাদী রীতি জীর্ণ হয়ে গেছে। পরবর্তি কালে একটি প্রবন্ধে রমানাথ লেখেন- এই সময় বাস্তববাদী রীতির চর্চা করা হল নতুন করে ইলেকট্রিক বাল্‌ব আবিষ্কারের চেষ্টা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *