দীর্ঘদিন পর তাঁর পুরনো পেটিকা খুলেছেন আহসান খাঁ। রেশমে মুড়লে কীটদষ্ট হতে পারে, তাই সুতি কাপড়ে মোড়া। মোড়ক থেকে ভাঁজের পর ভাঁজ খুলে প্রিয় চিত্রটি মেলে ধরলেন। সেই বিদ্যুৎ চিরে দেওয়া ঘন নীল আকাশ, মেঘের মাঝে কালো ভারী জলবিন্দু থমথম করছে, যেন এই মুহূর্তে হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়বে। সোনালি বনাতে ঢাকা বিলাসগৃহের বারান্দায় সঘন আলিঙ্গনাবদ্ধ দু’টি নারী-পুরুষ। পেখম মেলা ময়ূরের সম্মুখে পুরুষ মূর্তিতে কার আদল?
দীর্ঘশ্বাস ফেলেন খাঁ সাহেব। সম্মুখে প্রসারিত পুষ্করিণীর জলে, বাতাস তাঁর স্থির প্রতিবিম্ব কেটে দিচ্ছে। ওই প্রৌঢ় মুখখানির অতলে যেন সেই কিশোর প্রায় তরুণের ছায়া, যাকে একসময় ছবি আঁকার অপরাধে পালিয়ে আসতে হয়েছিল এই সুদূর বাংলা মুলুকে,আরও দূর পুবে। কে জানত, নিয়তি এখানেও পিছু ছাড়ে না? না তাঁর, না পণ্ডিত ব্রজদেবের!
জলে ঢিল ছুঁড়লেন আহসান। ভেঙেচুরে মিশে গেল তাঁর ছায়া। অপেক্ষা করলেন তিনি। পরমুহুর্তের গুমোট স্থির বাতাসে আবার জুড়ে গেল অনিচ্ছুক ছায়া। ঈষৎ ঘূর্ণায়মান জলে তাঁর প্রতিবিম্বের উপর ভেসে উঠল অপরূপ এক মুখ। হ্যাঁ, খাঁ সাহেব তাঁকে এখানেই ডেকে পাঠিয়েছেন। মালিহাটি ত্যাগের আগে উত্তরাধিকারীর হাতে তাঁর চিত্র-পেটিকা তুলে দিতে চান আহসান।
তিনি যেদিন ঘাটের পাশে ভাঙা বুরুজে দাঁড়িয়ে ব্রজদেবের পদস্খলন দেখে ফেলেন, সেদিনও বোঝেননি! পাশে বসা নারীমূর্তিটির দিকে তাকিয়ে এখন বুঝতে পারছেন পণ্ডিতের হুঁশ হারানো কত স্বাভাবিক! এই কারণেই বিশেষ করে তাকেও আহ্বান করা হয়েছিল! চিঠিতে লেখা ছিল, তাঁর পুরনো চিত্রগুলি যেন তিনি নিয়ে আসেন। কুলি খানের দরবারে পেশায় আজ তিনি গুপ্ত চিত্রকর হলেও খাঁটি চিত্রই তাঁর দুর্বলতা ও প্রাণ। চিত্রপেটিকার ভিতর কতদিন যেন ঘুমিয়ে ছিল তাঁর অতীত। এত সহজেই তিনি এই ফাঁদে পড়ে গেলেন।
মনে পড়ে গেল গত পরশুর কথা। তখন সভায় উঠেছে চন্দ্রাবলির বিষয়। ব্রজদেব কিছু সুস্থ হয়েছেন বলে স্বয়ং বসেছেন তর্ক সভায়। সুবাহু আগের দিনের খেই ধরে বলেছে, কামনার গন্ধ আছে বলেই রাধাতত্ত্ব ও চন্দ্রাবলিতত্ত্ব পৃথক। ব্রজদেব কথা শেষ করতে না-দিয়েই বলেছিলেন, তাহলেও তো আমাদের বক্তব্য সমর্থন করছেন আপনারা! চন্দ্রাবলি পরকীয়া বলে পরিত্যাজ্য! শ্রীরাধা স্বকীয়া বলে শ্রেষ্ঠ। জীব গোস্বামী গোপাল চম্পূতে রাধা ও কৃষ্ণের বিবাহ দিয়েছেন। তাঁর মতে পরকীয়া মায়ামাত্র। বহুকান্তা আস্বাদনের কারণে কৃষ্ণ যোগমায়া দিয়ে পরকীয়া ভাবের সৃষ্টি করেন। বস্তুত, পরকীয়া ভাব শ্রীকৃষ্ণের খেয়াল মাত্র!
ব্রজদেব ফিরে এসে আত্মপ্রতিষ্ঠা লাভের চেষ্টায় পুনরুদ্যত। তাঁর বক্তব্য পেশের পর সভায় গুঞ্জন শুরু হয়েছিল। পক্ষ-বিপক্ষের নিজেদের যুক্তি সাজাবার সময় তখন। এর মধ্যেই বিপক্ষে সভাপ্রান্তে বৈষ্ণবদের নির্দিষ্ট স্থান থেকে খর বিদ্যুতের মত এক নারীকণ্ঠ ভেসে আসে। বলে, বৈষ্ণব রসশাস্ত্রে আপনি সুপণ্ডিত। যে রূপ গোস্বামীর কথা উল্লেখ করলেন, তিনি তাঁর উজ্জ্বল নীলমণিতে রাধিকার বর্ণনায় বাৎসায়নের বর্ণনাই ব্যবহার করেছেন! কুট্টনির সঙ্গে বড়াই বুড়ির কোনওই তফাৎ নেই। দাম্পত্য প্রেমে আপনারা এই রুচিকে সমর্থন করেন তো?
ব্রজদেবকে বলার সুযোগ না দিয়ে হর্ষরথ কৌতূহলী মুখে প্রশ্ন করে, ঠাকুর মহাশয়ের পক্ষে বৈষ্ণবীরাও আছেন, এ সংবাদ জানা ছিল না তো? তবে আছেন বলেই উত্তর দিতে কি আমরা বাধ্য? যা-ই বলুন বাংলায় বড়ই বৈচিত্র্য! গৌড়ী রমণী যেমন লাজুক শুনি, তেমন তো নয় দেখছি! বেশ স্বাধীন স্বভাব! কী বলেন ঠাকুর মহাশয়? কৌতূকপূর্ণ লঘু স্বরে কথা শেষ করে রাধামোহন ঠাকুরের দিকে দৃষ্টি ফিরিয়েছিলেন তিনি।
রাধামোহনের মুখ থমথমে হয়ে উঠেছিল। তাঁর পক্ষের পণ্ডিত ও জনগণও হতভম্ব! সেই নারীকণ্ঠ পুনরায় স্পষ্ট করে বলেছিল, অকারণে ঠাকুরমশাইকে অপমান করছেন কেন? বৈষ্ণবীর প্রশ্নের উত্তর দিতে যদি মানে লাগে, তাহলে পরাজয় স্বীকার করে নিন! অন্ডালের কাব্য আলোচনা করবেন, শীল ভট্টাধিকার প্রসঙ্গ তুলবেন, আর ব্যক্তিজীবনে সে সব তুচ্ছ মনে করবেন, আপনাদের ভন্ডামির সীমা নেই!

হর্ষরথ ক্রোধে মুষ্টি পাকিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছিল। সভায় হইচই তীব্র। বজ্রদেব হর্ষরথের দলবল নারী-পণ্ডিত বিষয়ে বাঁকা কথা বলা শুরু করে দিয়েছিল। আখড়ার লাজুক যুবক মৃত্যুঞ্জয় মরিয়া হয়ে বলে উঠেছিল, আপনারা নারীর মান সম্মান বিস্মৃত হয়েছেন। উনি তো ঠিকই বলছেন। গোদা অন্ডাল নারী। শীল ভট্টারিকা নারী। নারী বলে তাঁর প্রশ্নের উত্তর দেওয়া যাবে না? কিঞ্চিৎ স্মরণ করুন, সম্বৃদ্ধি মানসম্ভোগের কথা। যেখানে নায়ক-নায়িকা পারতন্ত্র্য হেতু বিযুক্ত? এমনকি পরস্পরের দর্শনী যেখানে দুর্লভ, সেখানে উভয়ের যে উপভোগ, তাই তো সমৃদ্ধি মানসম্ভোগ। তাহলে দেখা যাচ্ছে পারতন্ত্র্য না থাকলে সম্ভোগ সমৃদ্ধ হয় না!
তার পক্ষ নিয়ে মৃত্যুঞ্জয় কথা বলতে উঠলেও বৈষ্ণবীকে দমানো যায়নি। মাথা নেড়ে বিনয়ের সুরে সে বলেছিল, ছোট মুখে বড় কথা বললে মার্জনা করবেন। আমরা নারীরা শাস্ত্রকে জীবনে পালন করার চেষ্টা করি। আপনারা শুধু যশ প্রতিষ্ঠার পথ প্রস্তুত করেন।পালন করেন না কিছুই। নানাভাবে সমাজকে ফাঁকি দেন অথচ সমাজের নিয়মের ফাঁস তৈরি করেন!
মুহূর্তের জন্য সভায় নুড়ি পতনের স্তব্ধতা নেমে এল। কয়েক মুহূর্ত মাত্রই, কারণ হৃদয়ঙ্গম করামাত্র হর্ষরথ প্রায় লাফ দিয়ে উঠেছিলেন। ক্রোধের বিষ তাঁর গলায়। বলেছিলেন, তাহলে ঠাকুরমশাই বৈষ্ণবদের আখড়ায় ঠাঁই দিয়েও নিস্তার পাননি? তাদের ঔদ্ধত্য এমনই, যে তর্ক সভায় আমন্ত্রিত পণ্ডিতদের অপমান করতে বাধে না! আশা করি রাধামোহন ঠাকুরের তাতে সায় নেই!
আখড়ার লাজুক যুবক মৃত্যুঞ্জয় মরিয়া হয়ে বলে উঠেছিল, আপনারা নারীর মান সম্মান বিস্মৃত হয়েছেন। উনি তো ঠিকই বলছেন। গোদা অন্ডাল নারী। শীল ভট্টারিকা নারী। নারী বলে তাঁর প্রশ্নের উত্তর দেওয়া যাবে না?
দ্বিধা ঝেড়ে ফেলে রাধামোহন উঠে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, আমরা ব্যক্তির স্বাধীনতায় বিশ্বাস করি। রাধা বা সত্যভামা যেই হোন, নারী বলে, বৈষ্ণবী বলে আমরা তাঁদের উপহাস করি না। ছোট মনে করি না। গৌরাঙ্গ মনে করতেন একই দেহে নারী ও পুরুষ। রাধা আচ্ছন্নতায় তিনি মাঝে মাঝেই নারীভাব অবলম্বন করতেন। বৈষ্ণবী যদি কোনও প্রশ্ন করেই থাকেন, তার উত্তর দেওয়াই বিধিসম্মত। যদিও আমার সম্মতি অনুযায়ী প্রশ্ন করেছেন, এমনও নয়! হর্ষরথ এবারে গাত্রোত্থান করেন না। বাহ্যিক ক্রোধ সংবরণ করে, যদিও তাঁর শরীরী-ভাষায় পূর্বের ব্যঙ্গই বজায় থাকে। বললেন, উত্তর অবশ্যই দেব ঠাকুরমশাই। আপনার সম্মতি না থাক, অসম্মতি যে নেই তা তো স্পষ্টই বুঝলাম! কী বলেন? বলে সমর্থন আদায়ের ভঙ্গিতে শ্রোতৃমণ্ডলীর দিকে তাকান।
রাধামোহন কিছু বলার আগেই বৈষ্ণবী উত্তর দেয়– মার্জনা করবেন পণ্ডিত। ঠাকুরমশাই আমার পিতার সমান। তাঁকে অকারণে অসম্মান করলে আপনি নিজেই নিচু হবেন।ওঁর মতো প্রকৃত বৈষ্ণবকে কোনও মালিন্য স্পর্শ করতে পারে না। বৈষ্ণবী করজোড়ে রাধামোহনকে দূর থেকে প্রণাম জানিয়েছিল। সভায় পূর্বের নৈঃশব্দ্য ফিরে এসেছিল। রাধামোহন স্মিত প্রসন্ন মুখে আসন গ্রহণ করেছিলেন।
বৈষ্ণবী পুনরায় বলেছিল, যে কৃষ্ণ লীলার আচরণ অনুকরণ করতে পারে সে-ই মহানুভব! যে পরকীয়াকে জীবনে গ্রহণ করে, স্বকীয়া নয় বলে মর্যাদা দিতে পারে না, পরস্ত্রীকে ফুঁসলিয়ে নিয়ে জাতি কুল মান নষ্ট করে, তাকে কি প্রকৃত মানুষ বলা যায়? স্বকীয়া নারী জীবনে থাকতেও যে পণ্ডিত পরকীয়াকে ব্যক্তিজীবনে গ্রহণ করেন, তিনি আবার কেমন বৈষ্ণব? ঘৃণায় কেঁপে গেছিল বৈষ্ণবীর আবেগমথিত বক্তব্য।
সুবাহু দীর্ঘক্ষণে যেন সাড় ফিরে পেয়েছিল। ইঙ্গিতে বৈষ্ণবীকে চুপ করে যেতে বলেছিল। কিন্তু রাধামোহন ঠাকুর পুনরায় বলে উঠেছিলেন, মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ কোরও না সুবাহু, ওকে বলতে দাও। প্রকৃত বৈষ্ণব কাউকে ছোট মনে করে না। ওর কথা বলে ভারমুক্ত হোক। বৈষ্ণবী কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে রাধামোহনের দিকে দৃষ্টি ফিরিয়েছিল। প্রত্যেকেই দেখেছিল সেই চোখে বিদ্যুৎজ্বালার সঙ্গে সঙ্গে অশ্রুর আভাস। বহুকষ্টে যেন উদগত অশ্রুকে ধরে রেখেছিল সে।

বৈষ্ণবী বলেছিল, মহাপ্রভু পরকীয়া রাধাপ্রেমকে স্বীকৃতি দিয়ে সম্মানের আশ্রয় দিয়েছেন। এঁটো করে ছুঁড়ে ফেলা পরস্ত্রী, পরকন্যাকে ভক্তির মর্যাদা দিয়েছেন, এত বড় মানের পরিচয় কি আপনার অসার সমাজনীতি দিয়ে ছোট করতে চান? আমরা পথের জীবন থেকে আলোয় শ্বাস নিয়ে বাঁচার সুযোগ পেয়েছি, এ বোধহয় সন্ধ্যামণির মতো নারী’রা স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারেনি। সমাধিতে শুয়ে মরণের শান্তি পেয়েছে! তাকে আর ভন্ড প্রতারক পণ্ডিতের মুখোমুখি হতে হয়নি। সভায় কোন শব্দ নেই। হর্ষরথও ব্রজদেবের এই নীরবতার কারণে বিভ্রান্ত! আহসান দেখেছিলেন, রাধামোহন ব্রজদেবকে গভীরভাবে নিরীক্ষণ করছেন।
ততক্ষণ অস্বাভাবিকভাবে নীরব থাকা ব্রজদেবের চোখ যেন মৃত মাছের মতো। তিনি তাকিয়ায় হেলান দিয়ে শূন্য দৃষ্টিতে চেয়ে আছেন। অন্যদিকে ক্রোধী নারীর কাঁঠাল কাঠের রঙের ছোট হলুদ শাড়ির ঘোমটা খসে গেছিল। গলায় ফণার মতো পেঁচিয়ে ছিল কৃষ্ণনামের নামাবলী। ঘৃণা, অভিমান স্ফূরিত হচ্ছিল সেই গর্বিত মুখমণ্ডল থেকে।
তীব্র আবেগে রাগলেখা বলেছিল, রাধা পরকীয়া হয়েই এত সম্মান পেয়েছেন, মহাপ্রভুর এত বড় দান কি আপনারা মুছে দিতে চান? এত এত মেয়েদের বেঁচে থাকার অধিকার কেড়ে নিয়ে আবার মানহীন আস্তাকুঁড়েয ফেলে দিতে চান? পশ্চিমে উত্তরাপথে যা করছেন করুন, বঙ্গদেশে এসব করতে আসবেন না! পায়ে ধরি আপনাদের- যথার্থই সে হতচেতনপ্রায় ব্রজদেবের পায়ের সামনে গিয়ে গলবস্ত্র হয়ে পড়েছিল।
প্রত্যেকের দৃষ্টি পড়েছিল ব্রজদেবের দিকে। সন্ত্রস্ত পণ্ডিত শিশুর মতো পা গুটিয়ে কুঁকড়ে যাচ্ছিলেন!
*ছবি সৌজন্য: artzolo, Pinterest
সেবন্তী ঘোষের জন্ম শিলিগুড়িতে, উচ্চশিক্ষা বিশ্বভারতী বিদ্যালয়ে। নব্বই দশকের গুরুত্বপূর্ণ বাংলা কবি ও লেখকদের মধ্যে সেবন্তী নিজের জায়গা করে নিয়েছেন। পেয়েছেন কৃত্তিবাস পুরষ্কার ও পশ্চিমবঙ্গ বাংলা একাডেমি পুরস্কার। সেবন্তীর পেশা শিক্ষকতা। নিয়মিত লেখালেখি করেন বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় এবং পোর্টালে। ওঁর প্রকাশিত বইয়ের মধ্যে 'আমাদের কথা', 'যে থাকে অন্ধকারে', 'ফুর্তি ও বিষাদ কাব্য', 'ফুল ও সুগন্ধ', 'দিল-দরিয়া' উল্লেখযোগ্য।
আমি পড়ছি এই ধারাবাহিক