কাশ্মীর যাব… আর..?

পহেলগাঁওতে, একপাশে বরফ, অন্যপাশে গাছের ডালে রেড বিলড ম্যাগপাই দেখতে দেখতে গুশতবা (gushtaba) খাব… আর খাব রাস্তার ধারে ঠেলাওলার বিফ কাবাব, রুটি দিয়ে। আর… গুলমার্গে শিকারা থেকে নেমে বরফ পড়া উপত্যকায় হাঁটতে হাঁটতে স্নো বান্টিংয়ের ডানায় লাগা বরফ গলা দেখতে দেখতে লাহাবি কাবাব খাব। আর..

সোনমার্গের সাদা রাস্তায় ঘোড়ার পিঠে চলতে চলতে, কোথাও থেমে, ধোঁয়া ওঠা কাহওয়া আর কাশ্মীরী বেকারির কেক বিস্কিট খাব। এটা খাব সেটা খাব… আর সব শেষে, ডাল লেকের হাউসবোটের বারান্দায় বসে দুটো সোয়ালোর খুনসুটি দেখতে দেখতে, কাংরির উষ্ণতায় মন ভাসিয়ে, রোগান জোশ আর কাশ্মীরী নান খাব…।

Kashmir
শুধু কি বরফ? কাশ্মীর মানেই পেটপুজোর আয়োজন

খালি খাব আর খাব ধর্মে সইল না। সেবার এমন বন্যা হল যে কাশ্মীর ভেসে গেল। ফলে আমাদের প্ল্যানও জলে! তবুও দমিনি, পরেরবার টিউলিপ গার্ডেন আর ফালুদা আর শিরমল আর ফিরনিও যোগ করলাম। আর শেষমেশ একদিন পৌঁছলাম, ফিরদৌস-এ-জ়মিন-এ!

তারপর? পেট রোগা বাঙালির রানট্যাক আর এনজাইমের ভরসায়, স্বপ্নপূরণ শুরু হল। পুরো গল্পটা বলার সময় এটা নয়। তাই সরাসরি চলে আসি শেষ পর্যায়ে। বরফঢাকা গুলমার্গের সৌন্দর্য সান্নিধ্যের রেশ নিয়ে পৌঁছলাম হাউসবোটের ভাসমান আস্তানায়। আর তৎপরেই রোগান জোশের স্বপ্নপূরণ!

খাওয়া শেষে শিকারা ভ্রমণ। শিকারা ঠিক নয়, ছোট্ট পানসি নৌকো। আমাদের চালক বশির ভাই, বহুক্ষণ ডাল লেক ঘুরিয়ে নিয়ে চলল লেকের ধারে নিজের বাড়িতে। বন্যাবিধ্বস্ত সে বাড়িতে কোথাও কিন্তু হাসিমুখের অভাব নেই। সেদিন খেলাম পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ কাহওয়া। পাশে বশিরজি, সে বাড়ির সবচেয়ে বয়ঃজ্যেষ্ঠ, আর তাঁর নাতি-নাতনী রাবেয়া, রায়হানা, বাহীর চোখে সারল্য আর উৎসাহ! কম্বলের, কাংরির আর কাহওয়ার উষ্ণতা নিতে নিতে অনেক কিছু শিখলাম। 

Bashirji in Kashmir
নিজার বাড়িতে আসল কাশ্মীরী কাহওয়া দিয়ে আপ্যায়ন করলেন বশিরজি

বাকি কথা থাক। আসি আসল কথায়। বশিরজির কথায় কথায় জানলাম, তৈমুর লংয়ের হাত ধরে কাশ্মীরে নতুন রান্না আসার কথা। সমরকন্দের সঙ্গে কীভাবে রান্নার রাস্তা ধরে মিশে গেল কাশ্মীর, তার কথা আর রোগান জোশের মশলার কথা। কয়েকটা ভুল ধারণাও ভাঙল।

রোগান জোশের লাল রং কাশ্মিরী লঙ্কাগুঁড়োর জন্যে নয়। আর এতে টমেটোও ব্যবহার হয় না। মুসলিম ওয়াজ়ারা সর্ষের তেলেই রান্না করেন রোগান জোশ। তার অদ্ভুত মায়াবী লাল রং আর স্নিগ্ধ স্বাদ আসে মাওয়াল পাউডার কিম্বা রতন জোট থেকে। জানলাম কাশ্মিরী পণ্ডিতি রান্না আর মুসলিম ওয়াজ়াদের রান্নার তফাৎ, রোগান জোশ দুই ঘরানাতেই হয়। পণ্ডিতি স্টাইলে দই, আদাগুঁড়ো হিং আর রতনজোট… মুসলিম স্টাইলে পেঁয়াজ, রসুন আর মাওয়াল পাউডার। 

Wazwan
আহদুস আর মুঘল দরবারে ওয়াজ়ওয়ান

তারপর শ্রীনগরে দুদিন, আহদুস আর মোগল দরবারে মন ভরে ওয়াজ়ওয়ানের স্বাদ গ্রহণ। এবং তারপর ঘরের মেয়ে ঘরে ফেরত।

আচমকা লকডাউনের সময় হঠাৎ খেয়াল চাপল রতনজোট বা মাওয়াল গুঁড়ো খুঁজি তো, রোগান জোশ এক্ষুনি না খেলেই নয়, মন একদম নেতিয়ে পড়ছে ক্রমে। ওমা, আমাজ়নে সবে অর্ডার দেব, ছবিতে দেখি, মাওয়াল তো আর কিছু নয়, মোরগঝুঁটি ফুল শুকিয়ে গুঁড়ো করা! যেই ভাবা সেই কাজ! ছাদভর্তি মোরগ ফুল, বেছে বেছে টুকটুকে দেখে তুলে এনে মিক্সারে পেস্ট করে ছেঁকে রস বের করলাম।

Morog Jhuti flower
মাওয়াল গুঁড়ো তৈরি হয় মোরগঝুঁটি ফুল শুকিয়ে

বাকি কী কী জোগাড় করে কী করলাম? এই যে… লিখে দিচ্ছি…

মাংস স্টকের জন্য:

এক কেজি মাংস
থেকে আট কোয়া রসুন
দুটো বড় এলাচ
তিনটে ছোট এলাচ
তিনটে লবঙ্গ
তিন টুকরো দারচিনি
এছাড়া অল্প কাশ্মীরি লঙ্কাগুঁড়ো জলে গোলা

রোগান জোশের পেস্টের জন্যে:

টা ছোট কাশ্মিরী পেঁয়াজ অথবা ওই মাপের পেঁয়াজ কুচি
আধ কাপ সর্ষের তেল

লাল রঙের জন্যে:

৫০ গ্রাম মাওয়াল পাউডার, অথবা আমার মতোই টাটকা মোরগ ফুলের রস
কয়েকটা কেশর দুধে গুলে
আধ চা চামচ হলুদগুঁড়ো

mawal sauce
মোরগঝুঁটি ফুল বেটে তৈরি করা মাওয়াল সস

শেষে দেবার জন্যে:

একটা এলাচের গুঁড়ো
একটু ঘি
ওহ নুন ছাড়া স্বাদ হয় নাকি!

এই যে সব মাপজোখ বললাম, রান্নার সময় কিন্তু সবটাই হাতের আন্দাজে হয়ে যায়! যাকগে…

কুচি করা পেঁয়াজ বাদামি করে ভেজে পেস্ট করে নিচ্ছিলাম যখন, আহা গন্ধেই মনে হয় অনেক বিষাদ দূর হয়ে যায়। 

তারপর পরিষ্কার করা মাংস অল্প নুন আর রসুন দিয়ে অল্পই ফুটিয়ে রাখা হল। কড়ায় অল্প ঘি দিয়ে গোটা গরমমশলা ভেজে একটু জল দিয়ে, তাতে পেঁয়াজভাজা বাটা, হলুদগোলা জল, একটু কাশ্মীরি লঙ্কা-ভেজা জল দিয়ে মাংস দিয়ে দিলাম। একটু নাড়াচাড়া করে মাংসের স্টক দিয়ে ঢাকা দিয়ে রাখলাম, যতক্ষণ না ওটা নরম তুলতুলে হচ্ছে। তারপর ঢাকা খুলে মাওয়ালের লাল জল আর দুধে গোলা কেশর দিয়ে টগবগ করে ফুটিয়ে নামিয়ে দেওয়া! ব্যাস! তৈরি!

Rabeya and her siblings
রাবেয়ারা সব্বাই

সেদিন রোগান জোশ খেতে খেতে খুব মনে পড়ছিল রাবেয়াদের কথা, অনুমতি নিয়ে ছবিও তুলেছিলাম, গলা জড়িয়ে বলেছিল, পাঠিয়ে দেবে তো ছবিগুলো? পাঠিয়েছিলাম। সরকারি নিয়মের ফাঁসে বোধহয় পৌঁছয়নি! নাকি পৌঁছেছিল, তার সংবাদ পাইনি? আজ ছবিটা দিলাম, বাধা পেরিয়ে সে যদি কোনওদিন তাদের চোখে পড়ে….

*ছবি সৌজন্য: লেখক

Shruti Gangopadhyay Author

শ্রুতি অনেকদিন ধরে চক ডাস্টার নিয়ে স্কুলের ব্ল্যাকবোর্ডে ফিজিক্স লিখতেই স্বচ্ছন্দ। সামান্য ও এত ক্ষুদ্র মানুষ, যে জীবনেও কখন হাইজে়নবার্গস আনসার্টেনটি প্রিন্সিপল কাজে লেগে গেছে অজান্তে। বর্ধমানে থাকার অবস্থানটি এতটাই সুনিশ্চিত, যে পিএইচডি উত্তর, উচ্চশিক্ষার মোমেন্টাম সম্পূর্ণ অনিশ্চিত। হাজার মানুষের সঙ্গে কথা বলা শেষ হলেও বাকি থাকে নিশ্চিন্তে আকাশ নদী পাখি আর প্রজাপতির গল্প শোনা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *