অর্থনীতিতে দ্বিতীয় নোবেলজয়ী সাইমন স্মিথ কুজ়নেৎস বলেছিলেন, “অর্থনৈতিক উন্নয়নে একটি নির্দিষ্ট ক্ষেত্রের অবদান রাখার ক্ষমতা তার নিজের উপর নির্ভর করে না।” এর অর্থ হল, যে দেশের মোট অর্থনীতির দুই তৃতীয়াংশ গ্রামীণ ক্ষেত্রের অন্তর্গত, সেই দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক বৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ৫% হলে, গ্রামীণ ক্ষেত্রের বৃদ্ধি যদি ২% হয়, তবে আমাদের সেই লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করার জন্য শিল্প ক্ষেত্রে ৪২% বৃদ্ধির প্রয়োজন হবে। কিন্তু, কৃষি ক্ষেত্রের বৃদ্ধি ৪% হলে, শিল্প ক্ষেত্রে ৮% বৃদ্ধির মাধ্যমেই সামগ্রিক ৫% বৃদ্ধির লক্ষ্যপূরণ করা সম্ভব।
চার দশক পর ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার রূপকার রাজ কৃষ্ণ সিদ্ধান্তে আসেন যে, ভারতে মাত্র সাড়ে তিন শতাংশের “হিন্দু বৃদ্ধি হার” (Hindu rate of growth) দেখা যেত। প্রাথমিকভাবে এর কারণ হল, আমরা সরকারি এবং বেসরকারি ক্ষেত্র সম্বলিত আধুনিক ক্ষেত্রের উপর বেশি জোর দিয়েছিলাম। আমরা ভেবেছিলাম, এর ফলে অর্থনীতির উপরে উঠবে। এই পরিকল্পনা ভুল ছিল, কারণ এই ক্ষেত্রটি অত্যন্ত মূলধন নিবিড় (Capital intensive) – শ্রমশক্তির মাত্র ১০% গ্রহণ করে। সর্বোপরি, ভারতে অধিকাংশ মানুষই কৃষি থেকে জীবিকা নির্বাহ করেন এবং এখানে জীবিকা-কাঠামোয় কোনও পরিবর্তন ঘটেনি।
তিনি আরও বলেন যে, প্রতি বছর ষাট লক্ষ যুবক-যুবতী কর্মক্ষম বয়সে পৌঁছয়, তারপরেও আধুনিক ক্ষেত্রে একশো শতাংশ বৃদ্ধি এবং উৎপাদন দ্বিগুণ হওয়া সত্ত্বেও, এই ক্ষেত্রের বেকারত্ব শোষণের ক্ষমতা ৫ লক্ষ থেকে ১০ লক্ষ হয়েছে। “কুকুর তার লেজ নাড়াতে পারে, কিন্তু লেজ কুকুরকে নাড়াতে পারে না।” কাজেই তিনি জোর দিয়ে বলেন, একটি সুসংহত গ্রামোন্নয়ন পরিকল্পনাই ন্যায়সঙ্গত বৃদ্ধি, পরিকাঠামগোত ভিত্তি, সক্ষমতার কম ব্যবহার, ছদ্ম-বেকারত্বের মতো সমস্যার একমাত্র উত্তর হতে পারে।
অস্ট্রেলিয়ার মতো উন্নত দেশ সুসংহত গ্রামোন্নয়নের উপর জোর দিয়েছে। কৃষিক্ষেত্রে ৪% বৃদ্ধি শিল্পক্ষেত্রে দ্বিগুণ বৃদ্ধি সৃষ্টি করতে পারবে। এমন কোনও শিল্প আছে কি, যা বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় সহায়তা পাবে না? প্রক্রিয়াকরণ থেকে প্যাকেজিং, হিমায়িতকরণ থেকে ঋণ প্রদান, ব্যাংক ব্যবস্থার ডিজিটাইজ়েশন থেকে প্রযুক্তির উন্নতি, বিদ্যুৎশক্তি থেকে প্রক্রিয়াকরণ, যানবাহন থেকে সামগ্রিক যোগাযোগ ব্যবস্থা, স্বাস্থ্য সেবা থেকে আতিথেয়তা, শিক্ষা থেকে গবেষণা ও উন্নয়ন, আমদানির বিকল্প উৎপাদন থেকে রফতানির পৃষ্ঠপোষকতা, মূলধন নিবিড় উন্নয়ন থেকে মূলধন বিমুখ উন্নয়ন – সুসংহত গ্রামোন্নয়ন পরিকল্পনা (IRDP) প্রতিটি ক্ষেত্রকেই উদ্দীপকের জোগান দেয়।
‘আত্মনির্ভর ভারত’ হল এমনই একটি কর্মসূচি, যা এই বিষয়গুলির উপর জোর দিয়েছে। এর সঙ্গে, অধিকাংশ ব্যবসার সমন্বয়ে গঠিত অতি ক্ষুদ্র–ক্ষুদ্র–মাঝারি সংস্থার (MSME) উপর গুরুত্ব শিল্প ক্ষেত্রের উৎপাদন বৃদ্ধিতে যথেষ্ট সুবিধা প্রদান করবে। এর ফলে ভারতের বেকার সমস্যা এবং অর্থনৈতিক বৃদ্ধির সমস্যার সমাধান করা যাবে।
প্রস্তাবিত বাজেটে ২০২২ সালের জন্য রাজকোষ (Fiscal) উদ্দীপকের পরিমাণ হবে ৫.৫ ট্রিলিয়ন মূলধনি ব্যয় (Capex)। পরিকাঠামোয় খরচ হল সামাজিক উপরি মূলধন (social overhead capital), এটি জরুরি হলেও এর ফলে খুব জোরালো মুদ্রাস্ফীতির সম্ভাবনা রয়েছে। এই খাতে খরচ আয়কে বহুগুণ বাড়িয়ে দিতে পারে (multiplier effect)। যদিও প্রকল্প রূপায়নে দেরি কেবলমাত্র পরিকল্পিত খরচে ব্যাঘাত ঘটায় এবং উপর্যুপরি মুদ্রাস্ফীতির হার বাড়িয়ে চলে।

যেহেতু বাজার থেকে মোট ঋণ নেওয়ার উচ্চমাত্রা ১২ ট্রিলিয়ন টাকায় সীমাবদ্ধ রাখা হয়েছে, তার উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি সৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে। আয়কে বহুগুণ বাড়ানোর ক্ষমতা এই ধরনের সরকারি ঋণের সর্বাধিক। একে “দাক্ষিণ্য প্রভাব” (Please effect) বলা হয়। ঋণ ছাড়াও, সরকার বিনিয়োগ প্রত্যাহারের (Disinvestment) মাধ্যমে ১.৭ ট্রিলিয়ন টাকা রাজস্ব লাভের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছে, যা আগে ২.১ ট্রিলিয়ন টাকা প্রস্তাব করা হয়েছিল। মাত্র ৩২ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ প্রত্যাহারের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয়েছে। বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে, রাজস্ব আদায় নিশ্চিত করার জন্য, বেসরকারিকরণের পিছনে সরকারের উদ্দেশ্যটিও স্পষ্টভাবে প্রকাশ করা হয়েছে। ২০২২ অর্থবর্ষে দু’টি সরকারি মালিকানাধীন সংস্থা (PSU) এবং একটি সাধারণ বিমা সংস্থা থেকে বিনিয়োগ প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। পর্যাপ্ত পরিমাণ রাজস্ব উদ্দীপক পাওয়ার জন্য এটা হল এক অনিবার্য পদক্ষেপ।
এবার কয়েকটি দেশের গৃহীত রাজস্ব উদ্দীপক নিয়ে সংকোচনের সঙ্গে সেগুলির তুলনা করা যাক। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জিডিপির ১১%, জাপানে জিডিপির ১০.৪%, চিনে জিডিপির ৫.৫%, ব্রাজ়িলে জিডিপির ৮.৬%, রাশিয়ায় জিডিপির ৬.৫%, ভারতে জিডিপির ৪%। অন্যান্য দেশগুলি যতটা পেরেছে, শতাংশের নিরিখে আমরা এর বেশি ততটা আর এগোতে পারব না। প্রতিটি দেশেই সংকোচন ঘটেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সংকোচন ৩.৪%, জাপানে সংকোচন ৫.১%, চিনে সংকোচন ঘটেনি, তবে বৃদ্ধির হার বেশ ধীর, ২.৩%, ব্রাজ়িলে সংকোচন ৪.৫%, রাশিয়ায় সংকোচন ৩.৬%, ভারতে সংকোচন ৮%। অর্থাৎ, যেহেতু আমরা বেশি অর্থ বরাদ্দ করতে পারিনি, প্রাথমিকভাবে সেই কারণেই ভারতীয় অর্থনীতি ৮% সংকুচিত হয়েছে।
জিডিপি (বৃদ্ধির হার)
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ১১.০% -৩.৪%
জাপান ১০.৪% -৫.১%
চিন ৫.৫% +২.৩%
ব্রাজ়িল ৮.৬% -৪.৫%
রাশিয়া ৬.৫% -৩.৬%
ভারত ৪.১% -৮.০%
নিঃসন্দেহে কোভিড-১৯-এর জন্য অর্থনীতি বড়সড় ধাক্কা খেয়েছে এবং ভারত এর ব্যতিক্রম নয়। মানুষ কাজ হারিয়েছেন, ব্যবসা বন্ধ হয়েছে, দেশজুড়ে লকডাউন কার্যকর হওয়ার পর কারখানা এবং অফিস বন্ধ থাকার ফলে লক্ষ-লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিককে আয় হারানো, খাদ্যাভাব এবং অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মতো সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছে। তাঁদের মধ্যে হাজার-হাজার মানুষ পায়ে হেঁটে বাড়ির দিকে যাত্রা শুরু করেছেন, লকডাউনের কারণে কোনও যানবাহন পাওয়া যায়নি। পুনর্বাসন, ত্রাণ এবং স্বাস্থ্যসেবার জন্য সরকারকে সমস্ত সম্পদ নিয়োগ করতে হয়েছে। সরকার যখন অতিরিক্ত কর চাপাতে পারছে না, তখন এটা খুব স্বাভাবিক যে, তারা বাজেটে করদাতাদের কোনও সুরাহাও দিতে পারবে না।
তা হলে, খরচ মেটানোর টাকা কোথা থেকে এসেছিল? অর্থনৈতিক সমীক্ষা জানাচ্ছে, গত বছরের তুলনায়, যখন ঋণ এবং অন্যান্য দায়বদ্ধতার পরিমাণ ছিল ২০% এবং সুদ বাবদ খরচ ছিল ১৮%, ঋণ এবং অন্যান্য দায়বদ্ধতা লাফিয়ে ৩৬%-এ পৌঁছে যাবে আর সুদের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়াবে ২০%, এর মানে হল সরকারি ঋণ প্রচুর পরিমাণে বৃদ্ধি পাবে এবং রাজস্ব ঘাটতি বেড়ে হবে ৯.৫%, যা ২০১৮-১৯-এর চেয়ে ৩.৪% বেশি। ঋণের ক্ষেত্রে একটা সমস্যা হল, পরিশোধের প্রক্রিয়া শুরু হয় ৫ বছর পর থেকে, কাজেই আমাদের নিশ্চিত করতে হবে যে, তা উৎপাদনশীলভাবে ব্যবহার করা হয়েছে।
আগামী পর্বে আমি বাজেটের পাটিগণিত, রাজস্ব ঘাটতির যুক্তি এবং বিনিয়োগ প্রত্যাহারের সমস্যা ও সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করব
ড. সুমনকুমার মুখোপাধ্যায় একজন অর্থনীতিবিদ ও শিক্ষাবিদ। সুদীর্ঘ ৪৬ ধরে তিনি অধ্যাপক এবং গবেষক হিসেবে বিভিন্ন দেশী বিদেশি সংস্থার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন যার মধ্যে এক্সএলআরআই, আইআইএসডব্লুবিএম, সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ কলকাতা, আইআইটি দিল্লি, উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও সুমন কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের একাধিক উপদেষ্টা পর্ষদের সদস্য হিসেবে কাজ করেছেন। তিনি সেন্ট জেভিয়ার্স কলকাতা, সেন্ট স্টিফেনস দিল্লি ও দিল্লি স্কুল অফ ইকনমিকসের প্রাক্তনী। বর্তমানে অ্যাডভাইসরি বোর্ড অন অডুকেশন, গভর্নমেন্ট অফ ওয়েস্ট বেঙ্গলের সদস্য, চেয়ারম্যান ইন্টারন্যাশনাল মার্কেটিং অ্যান্ড বিজনেস কমিউনিটির সদস্য, ফেডারেশন অফ স্মল অ্যান্ড মিডিয়ম ইন্ডাস্ট্রিজের সদস্য, ওয়েস্ট বেঙ্গল ইকনমিকস সাব কমিটি, বিসিসিঅ্যান্ডআই, এমসিসিঅ্যান্ডআই, অ্যাসোচ্যাম ইত্যাদি বোর্ডের সদস্য। তিনি সেনার্স-কে নামক আন্তর্জাতিক উন্নয়ন বিষয়ের গবেষকদের সংগঠনের আজীবন সদস্য। বর্তমানে ভবানীপুর গুজরাটি এডুকেশন সোসাইটি কলেজের ডিরেক্টর জেনেরাল।