কিছু কথা যেটা জানি অবশ্যম্ভাবী, কিন্তু মেনে নিতে কষ্ট হয়, ঠিক তেমনটাই ঘটল ৬ ফেব্রুয়ারির সকালবেলায়। অভ্যাসমতো ইমেইল খুলেই দেখি গুল্লু অর্থাৎ অয়নেন্দ্রনাথ ঠাকুরের চিঠি— আমার বাবা আজ সকালে চলে গেলেন। ওঁর বয়স হয়েছিল ৯৮ বছর ৩ মাস ২৯ দিন। (My Father passed away this morning, he was 98 years 3 months and 29 days old.)
গত দেড় বছর বীরুদা-অরুন্ধতীদির সঙ্গে যোগাযোগ হত ওঁদের ছেলের মাধ্যমেই। ২০১৯-র জানুয়ারি মাসে শেষ দেখা বীরুদাদের সঙ্গে, ওঁদের সল্টলেকের বাড়িতে। খুব ঠান্ডা ছিল সেদিন। টুপি, মোজা, দস্তানা পরে বসেছিলেন বীরুদা। বললেন, ‘দেখেছ তো কেমন বুড়ো হয়ে গেছি আমি।’ তারপরেই হেসে বললেন, ‘আফটার অল ঠাকুর পরিবারের সবচেয়ে দীর্ঘায়ু সদস্য বলে কথা!’ (after all I am the longest living person in the Tagore family)।
বীরুদা সবসময় বই পরিবৃত। সামনের টেবিলে বেশ কয়েকটা বই, সবই রবীন্দ্রনাথের উপর লেখা। তবে লেখকরা অধিকাংশই আমার অচেনা। জিজ্ঞেস করলাম, ‘রিভিউ করছেন?’ মৃদু হেসে উত্তর দিলেন, ‘না। রবীন্দ্রনাথকে চিনতে চেষ্টা করছি। এঁরা কত তথ্য জানেন বল তো! আমরা তো কাছে থেকেও কিছুই জানতে পারিনি।’

এই আমাদের বীরুদা। কখনও কারও তীব্র সমালোচনা করতে শুনিনি ওঁকে। তার মানে এই নয় যে উনি স্বাধীন মতামত পোষণ করতেন না। ২০০৭ সালে ‘শান্তিনিকেতন আশ্রমিক সংঘ’, (নর্থ আমেরিকা শাখা) এখন যার নাম ‘শান্তিনিকেতন আশ্রম সম্মিলনী ইন্টারন্যাশনাল’– সেখান থেকে আমরা ‘এক সূত্রের সন্ধানে’ নামে একটি বই প্রকাশ করেছিলাম। তাতে বীরুদাকে লিখতে বলায় বলেছিলেন, ‘তুমি বরং আমাকে ইন্টারভিউ করে লেখ।’ ‘শান্তিনিকেতনের স্মৃতি’ নামে সে লেখাটি প্রকাশিত হয়েছিল। সেই কথোপকথনে বলেছিলেন, ‘সত্যি তখন বিশ্বভারতী বিশ্বের ছিল। কত বিভিন্ন জায়গা থেকে লোক আসত পড়তে বা পড়াতে। এখন তো নিঃস্ব হয়ে গিয়েছে। অর্থের দিক থেকে নয়, তবে এখন বিশ্ব বলতে শান্তিনিকেতনে আর কিছুই নেই।’
আমি শান্তিনিকেতনে ছাত্রী হিসেবে থাকাকালীন বীরুদার সঙ্গে মৌখিক আলাপ থাকলেও খুব একটা ঘনিষ্ঠ ছিলাম না। সুদর্শন, সুরসিক, আড্ডাবাজ এক ভদ্রলোককে দেখতাম, ভাল টেনিস খেলতেন। আমার কাছে তখন ওঁর পরিচয় ছিল, আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু সতুর (দেবদ্যুতি চক্রবর্তী) জামাইবাবু হিসেবে। সে সময় ওদের চা-চক্রের পাশ দিয়ে যেতে যেতে নানা মজার গল্প শুনতাম। সেখানে উপস্থিত থাকতেন প্রচুর গুণীজন। মাঝে মাঝে আমরা কয়েকজন ওদের কাছাকাছি কোনও বেদিতে বসতাম। ওঁদের প্রতিটি আড্ডা থেকে অনেক কিছু জানা যেত।
১৯৭০ সালে বিয়ে হয়ে এলাম মিশিগানে। কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই ডেট্রয়েটের রবীন্দ্রজয়ন্তীতে হঠাৎ দেখি বীরুদা ও অরুন্ধতীদি। খুব আনন্দ হল। জানতাম ওঁরা এ দেশে থাকেন। কিন্তু কোথায়, তা জানতাম না। তখন সবে বিদেশে এসেছি। সবই নতুন মুখ, দু’একজন ছাড়া। বললাম, ‘তোমাদের দেখে মনে হচ্ছে বাড়ির লোক পেলাম।’ বীরুদা বললেন, ‘মতো আবার কী? দাদার বাড়ি তো তোমারই বাড়ি।’ সেই শুরু হল ওদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ঘরোয়া সম্পর্ক।

বীরুদা অকল্যান্ড ইউনিভার্সিটি-তে পড়াতেন। অরুন্ধতীদি ছিলেন সেই ইউনিভার্সিটিরই লাইব্রেরিয়ান। ক্লার্কস্টনে একটা লেকের ধারে ওদের বাড়ি ছিল। বাইরে থেকে তো বটেই, বাড়ির ভিতরটাও ছিল ছবির মতো সুন্দর। ঠিক যেন একটা মিউজিয়াম। নানা দেশের শিল্পকলা আর বইয়ে ঠাসা। ওদের লাইব্রেরি ঘরে ছাদ পর্যন্ত বইয়ের তাক। ছোট একটি মই রাখা থাকত, উঁচু তাকের বইগুলোর নাগাল পাওয়ার জন্য। মইয়ের নীচে আবার চাকা লাগানো, যাতে সহজে সেটাকে নড়ানো যায়। আমার ছেলেদের মইটা খুব প্রিয় ছিল। আমি ওদের মইতে উঠতে বারণ করলেও বীরুদা ব্যাপারটায় খুব মজা পেতেন। বলতেন, ‘বই দেখতে দেখতেই বইয়ের উপর ইন্টারেস্ট হবে।’ বীরুদা পেটুলা ক্লার্কের ‘ডাউনটাউন’ গানটা ওদের শিখিয়েছিলেন। তখন থেকেই ওরা ওঁকে ডাউনটাউন মামু বলে ডাকত। ওঁর বাড়িতে গিয়ে খুব আনন্দ করত।
কত যে ছোটখাটো জিনিস শিখেছি ওঁদের কাছে। বাহুল্য নেই, কিন্তু আন্তরিকতা প্রচুর, সব ব্যাপারেই সেটা লক্ষ করেছি। বীরুদার ভাই বাদশাদা (সুমীতেন্দ্রনাথ ঠাকুর) ও তাঁর স্ত্রী মিতাবৌদি (শ্যামশ্রী ঠাকুর) প্রায়ই আসতেন দাদা-বৌদির সঙ্গে দেখা করতে। ওঁদের ছেলে বাপ্পা হাইস্কুল শেষ করে অকল্যান্ড ইউনিভার্সিটিতে পড়তে এসেছিল। সেই সময় ঠাকুরবাড়ির নানা মজার গল্প শুনতাম ওঁদের কাছে। তার অনেক পরে বাদশাদা লিখলেন ‘ঠাকুরবাড়ির জানা অজানা’ বইটি।
বীরুদা-বাদশাদা দুই ভাই ওঁদের দাদামশাই অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের যাত্রাপালা গেয়ে শোনাতেন। এ প্রসঙ্গে একটা মজার গল্প মনে পড়ে গেল। বীরুদার ‘শ্রুতি ও স্মৃতি’ বইতেও এর উল্লেখ পেয়েছি। বীরুদা একদিন ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষার জন্য রাত জেগে পড়াশোনা করছেন। হঠাৎ পিঠে কার হাত। ফিরে দেখেন, অবনীন্দ্রনাথ। তিনি হাতের চুরুটটি বীরুদাকে দিয়ে বললেন, ‘দেখ, খুব খেটে যখন পড়বি, তখন এই চুরুটটা একটু একটু টানবি। মাথার যত কিছু জট সব খুলে যাবে।’

বীরুদার অফুরন্ত ভাণ্ডার ছিল এইসব নানা গল্পের। তাঁর চিনা-ভবনে ভর্তি হবার গল্পটাও খুবই মজার। বি-কম পরীক্ষা দিয়ে বীরুদা শান্তিনিকেতনে গিয়েছিলেন দাদামশাই অবনীন্দ্রনাথের কাছে থাকবেন বলে। বীরুদার কথায়, ‘তখন আমার খেলাধুলোর খুব শখ। কিন্তু শান্তিনিকেতনের ছাত্র না হওয়ায় কোনও দলেই ঢুকতে পারতাম না। একদিন গিরিধারী লালা (রবীন্দ্রনাথের জামাই ও শান্তিনিকেতনের ডেন্টিস্ট) বুদ্ধি দিলেন, চিনা ভবনের ছাত্র হয়ে যেতে।’ বীরুদা তাই করলেন। শুধু ছাত্র নয়, একটা স্কলারশিপও পেয়ে গেলেন। তখন কিন্তু ওঁর চিনা ভাষা শেখার কোনও আগ্রহই ছিল না। পড়াশোনা শুরু করার পর চিনা সাহিত্য ও শিল্পকলার প্রতি ওঁর অনুরাগ জন্মায়। চিনা ভাষা থেকে বেশকিছু অনুবাদও করেছিলেন তিনি। ‘পুরাতন ও আধুনিক চিনা কবিদের কবিতা সংগ্রহ’ বই থেকে জাও ইউয়ান মিঙের একটি কবিতার অনুবাদ করেছিলেন বীরুদা। সেটি এখানে তুলে দিলাম:
‘মাঝ বসন্তে এল মরশুমি বৃষ্টি
পুব কোণে জাগে প্রথম বাজের ডাক,
পোকামাকড় দলে দলে চমকে ওঠে জেগে
চারিদিকে ঘাস দেয় নিজেকে বিছিয়ে
হালকা ডানায় হাওয়া কেটে আসে পাখির দল
দু’টি তে ঢুকে পড়ে আমার বাড়িতে
তাদের পুরনো বাসা এখনো আছে,
দু’জনে ফিরে আসে তাদের পুরনো আস্তানায়
সেদিন থেকে এই বিরহের শুরু
সেদিন থেকে ফটক, উঠোন, দুইই ফাঁকা, মানুষ নেই
আমার মন সত্যি পাথরে তৈরী নয়,
তোমার কি মনে হয়?’
১৯৬১ সালে ফুলব্রাইট স্কলারশিপ নিয়ে বীরুদা ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে ইউনিভার্সিটি অফ পেনসিলভানিয়া-তে আসেন। তারপর হাজার ১৯৬৪ সালে মিশিগানের অকল্যান্ড ইউনিভার্সিটির চাইনিজ ল্যাঙ্গুয়েজ এন্ড লিটারেচার বিভাগে যোগ দেন। ১৯৮৭-তে অবসর নেন। দেশে ফেরার আগে নিজেদের চিনা শিল্পকলার সংগ্রহ দান করে যান অকল্যান্ড ইউনিভার্সিটিকে। ইউনিভার্সিটি কর্তৃপক্ষ তাঁদের ওয়েবসাইটে লিখেছেন, ‘Amitendranath Tagore, known to his friends as Amit, first went to China in 1947… and was inexorably drawn to Chinese art and literature… He and his wife decided to donate their art collection to Oakland University before heading back to India The collection contains 29 scrolls, 11 calligraphies spanning range of calligraphic styles and 15 rubbings of Chinese stone monuments.’ এছাড়াও তারা ইউরোপের যে সব জায়গায় গিয়েছেন, সেখানকার সাহিত্য ও শিল্পকলার সংগ্রহও কিছু ছিল।
এ দেশ থেকে ফিরে গিয়েও অনেকদিন পর্যন্ত প্রতিবছরই প্রায় আসতেন এদেশে, ছেলের কাছে। ১৯৯০ সালের মাঝামাঝি এসে বেশ কয়েকবার আমাদের কাছে থেকেওছেন কয়েক সপ্তাহ করে। সে সময় আরও অনেক কথা শুনেছি ওঁর কাছে। উপলব্ধি করেছি, এক পরিপূর্ণ মানুষ তিনি। সত্যিই বিশ্বনাগরিক। নানা দেশের সংস্কৃতি-সাহিত্য-শিল্পধারার সঙ্গে পরিচিত হয়ে নিজেকে এক স্বতন্ত্র মানুষ হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন। এ ধরনের সজ্জন ব্যক্তিত্ব এখনকার পৃথিবীতে বিরল।

আমি এদেশে এসে যা কিছু করেছি, পড়াশোনা বা কাজ, সবকিছুতেই অনুপ্রেরণা পেয়েছি বীরুদা ও অরুন্ধতীদির কাছ থেকে। আমার ছেলেদের অন্নপ্রাশন থেকে গ্র্যাজুয়েশন, এমনকী বিয়ের অনুষ্ঠানেও আমাদের পাশে থেকেছেন পরমাত্মীয়ের মতো। বীরুদার জীবনস্মৃতি নিয়ে ‘অমিত কথা’ বলে একটি বই প্রকাশিত হয়েছে। তাতে ছেলেবেলা থেকে শুরু করে শান্তিনিকেতন এবং আমেরিকার বহু স্মৃতি লিপিবদ্ধ হয়েছে।
বীরুদাকে আমার জীবনের নানা অধ্যায়ে কাছ থেকে পেয়েছি। আজ প্রৌঢ়ত্বের সীমানায় এসে বারবারই মনে হচ্ছে, ওঁর জীবনদর্শনের সিকিভাগও যদি শিখতে পেরে থাকি, আমি ধন্য। ওঁরই একটি চিনা কবিতার উদ্ধৃতি দিয়ে ওঁকে চিরবিদায় জানাই।
পুরোনো অদ্ভুত এই দেশ থেকে
আমরা তোমায় বিদায় জানাচ্ছি,
একটি গাছের চারা,
অন্য দেশে চলেছে, আরো পুরোনো দেশে,
মনে হয় হেমন্ত বুঝি এল,
আর তুমি বসন্তের দখিনা বাতাস,
এদিক সেদিক ফিরবে
তোমাকে আমরা বিদায় জানাচ্ছি
তোমার চলে যাওয়ার পথে সে উঠেছে হলদে হয়ে
তোমার বিদায় এ হলুদ নদের সাথে
কত পাহাড়ী পাকদণ্ডীর মাঝে সাদা মেঘের মহলে,
কত যুগ ধরে।
তোমার বিদায়, সূর্যাস্তের মাঝে, তোমার বিদায়।
পড়াশোনা করেছেন শান্তিনিকেতনে বিশ্বভারতী বিদ্য়ালয়ে। দীর্ঘদিনের প্রবাসী চন্দনার বর্তমান ঠিকানা ওহায়ো।
ভারি ভাল লাগল চন্দনার এই স্মৃতি তর্পণ।
সতুর ভাল নাম দেবদ্যুতি চক্রবর্তী।
Chandana di, tomar lekha shob shomoy shabolil. Porte khub bhalo laglo. Tumi jemon tomar Biru dar theke anek kichhu shikhechhile, amio edeshe eshe tomar aar tomar motoi kichhu gunijoner theke anek kichhu shikhchhi, janchhi.
ভীষণ ভালো লাগলো।
কি সুন্দর স্মৃতিচারণ, খুব ভালো লাগলো।
চমৎকার মনোগ্রাহী লেখা, চন্দনা। খুব সুন্দর।
তোমার তর্পণটি আকর্ষণীয়।
ভালো লাগলো।
এমন আন্তরিক স্মৃতিচারণ পড়ে মুগ্ধ হলাম। অচেনা মানুষটিকে এমন ভাবে চিনিয়ে দেবার জন্য অশেষ ধন্যবাদ!