কবিতা চিরকাল মুষ্টিমেয় পাঠকের জন্য। রবীন্দ্র-উত্তর যুগের আধুনিক কবিতার পরিমণ্ডল যখন চারপাশে নির্মাণ করছে দুর্বোধ্যতার উঁচু প্রাচীর, কেটে রাখছে অলঙ্ঘ্য পরিখা, ঠিক তখনই সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের উত্থান বাংলা সাহিত্যের জগতে। যারা আধুনিক কবিতার দুরূহ ব্রহ্মলোককে দূর থেকে ভয়ে ভয়ে দেখত, দাঁত ফোটাতে সাহস করত না, সহজ লেখার ভঙ্গিমায় সুনীল তাদেরও এনে সামিল করলেন কবিতার মাটিতে।

যে সময়ে সুনীল কবিতা লিখেছেন, যে আকাশের নীচে তিনি শ্বাস নিয়েছেন, যে মাটির উপর তিনি পা রেখেছেন, সবকিছুর সঙ্গে বয়ে চলেছে আমাদের প্রজন্মের সময়। তাঁকে চর্মচক্ষে দেখেছে, পা ছুঁয়েছে, আবার ডাক দিয়েছে সুনীলদাবলে; মানুষের সঙ্গপ্রেমী সুনীল আমাদের আত্মার আত্মীয় হয়ে উঠেছেন; বাঙালি জাতির অভিমান প্রকাশের মন্ত্র হয়ে উঠেছে কেউ কথা রাখেনি। না-থেকেও সুনীল রয়ে গিয়েছেন আমাদের মননকে প্রভাবিত করে। বাংলাভাষার চর্চায়, কবিতার চর্চায়, তাই তাঁকে এড়িয়ে যাবার উপায় নেই।  




সুনীলের কবিতার পাঠকদের মতে, তাঁর বেশিরভাগ কবিতাই স্বীকারোক্তিমূলক। কবি নিজেও বহুবার বলেছেন, বেশিরভাগ কবিতায় আমিভীষণভাবে উপস্থিত। সারা পৃথিবীর কবিদের মতোই প্রকৃতি প্রভাব বিস্তার করেছে তাঁর কবিতায়। হয়তো তিনি চিরকাল লিখতে চেয়েছিলেন পাহাড় সমুদ্র আর অরণ্যের স্তব। স্বপ্ন দেখেছেন সমুদ্র আকাশ হবে, তৃণ হবে মহাবনস্পতি। তবে প্রকৃতি-বর্ণনায় মুগ্ধ দর্শক অথবা নির্মোহ দার্শনিকের মতো নিষ্ক্রিয় অবস্থান নয় তাঁর। বরং সেখানেও আছে আত্মকথন‒ হঠাৎ দিলাম জ্বেলে কয়েকটা সূর্য চাঁদ তারা। এরকম আন্তরিক উচ্চারণই যে সাধারণ পাঠকের মনের দরজার চাবিকাঠি, এ কথা তিনি বুঝেছিলেন এবং অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে প্রয়োগ করেছিলেন সাহিত্যকর্মে।

কবিতাপাঠ করতে গিয়ে সবার আগে প্রশ্ন ওঠে, লেখার প্রেরণা কবি কীভাবে পেয়েছেন? বাংলাভাষার অনেক কবিকেই শৈশব/ কৈশোর থেকেই কবিতা লিখতে দেখা যায়। সুনীল কিন্তু সেই ধরনের চর্চা কিম্বা পারিবারিক সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের মধ্য দিয়ে কবি হয়ে ওঠার জন্য প্রস্তুত হননি। একটি মেয়ের প্রেমে পড়ে ঝোঁকের মাথায় কবিতা লেখার শুরু; অর্থাৎ তিনি কবিতাকে মনোযোগ দিয়ে, জোর করে, তাড়না করে খুঁজে বেড়িয়েছেন, এমনটি কোনওদিন ঘটেনি। বরঞ্চ উল্টোটাই। কবিতাই এসে তাঁকে তাড়না করেছে, এবং তাঁকে দিয়ে লিখিয়ে নিয়েছে।

Sunil Gangopadhyay
‘বেদনাকে সান্ত্বনা দেয় যুক্তি’

যৌবনে কবিতা লেখার সূচনা হলেও, শৈশবের ঝলক আছে অনেক কবিতায়। বাংলাদেশে পূর্বজদের শিকড়ের প্রতি টানও দেখা যায় একাধিক রচনায়। অনেক পরে, সাহিত্যিক খ্যাতিপ্রাপ্ত সুনীল যখন আবার বাংলাদেশে গিয়েছেন আমন্ত্রণে, তখন আবিষ্কার করতে চেয়েছেন তাঁর ফেলে আসা ছেলেবেলা। পদ্মানদীর সামনে দাঁড়িয়ে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে গিয়েছে তাঁর সত্তা। শৈশব ও যৌবনের দু’রকম চোখ নিয়ে দেখছে নদীএক কবি; তাঁর বেদনাকে সান্ত্বনা দেয় যুক্তি।    




পূর্বজদের প্রতি শিকড়ের টান থাকলেও সুনীলের বেড়ে ওঠা কিন্তু এ শহরেই। এবং সেই কারণেই কলকাতা প্রবলভাবে উপস্থিত তাঁর কবিতায়। প্রথম যৌবনে আমেরিকার আয়ওয়া-তে নিশ্চিন্ত জীবনের আশ্রয় ছেড়ে দেশে ফিরে আসার অন্যতম কারণই হয়তো কলকাতা-প্রেম। নানাভাবে ছুঁয়ে-ছেনে দেখছেন এই শহরের রূপ এবং কবিতায় তাকে তুলে এনেছেন। অন্য কোনও কবির কবিতায় এত তীব্র উপস্থিতি নিয়ে ‘কলকাতা’ মানুষকে বিদ্ধ করে না। উদাহরণস্বরূপ
, ‘স্মৃতির শহরকাব্যগ্রন্থের প্রতিটি কবিতার কথা বলা যায়। তারা বুঝিয়ে দেয়, সুনীল কবিতার দ্বারা যতখানি আক্রান্ত, কলকাতার দ্বারাও ঠিক ততখানিই। কবিতার বিপরীত মেরুতে দাঁড়িয়ে কবিকে আক্রমণ করছে ‘কলকাতা’।

Sunil Gangopadhyay
“আমি কী রকম ভাবে বেঁচে আছি”

শহরের অস্তিত্বের নানাস্তরের মধ্যে অজস্র স্ববিরোধ কবিকে অনুতপ্ত করে তোলে কোথাও, আবার কোথাও দেখা যায় অদ্ভুত হিংস্রতা। স্বগতোক্তির টুকরো সংলাপের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠে কবিতার শরীরপ্রথম পাঠে হঠাৎ মনে হয়, কবিতা হয়ে ওঠার কোনও উপাদান বা ইচ্ছে হয়তো এই পঙক্তিগুলির নেইঅথচ একাধিকবার পাঠে বোঝা যায়, কবিতা যে রকম সততা দাবি করে, ‘কলকাতা’ ঠিক সেরকম সততার কষ্টিপাথরে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে তার কবিতায়। গোপন সব ছোট ছোট নরকএই শহরে থাকলেও, এখানেই সম্পূর্ণভাবে গ্রোথিত ছিল তাঁর মননের শিকড়। আমি কী রকম ভাবে বেঁচে আছিকাব্যগ্রন্থের অধিকাংশ কবিতাই তিনি আমেরিকায় বসে লিখেছিলেন, অথচ অনেক কবিতাতেই কেন্দ্রীয় চরিত্র অথবা পশ্চাৎপট হয়ে উঠেছে কলকাতা।      

১৯৫৮ সালে প্রকাশিত সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রথম কাব্যগ্রন্থ একা এবং কয়েকজন। অবশ্য তার পাঁচ বছর আগে থেকেই শুরু হয়ে গিয়েছে বাংলা কবিতার জগতে এক আলোড়ন সৃষ্টিকারী ঘটনা, ‘কৃত্তিবাসপত্রিকার প্রকাশ, যার সঙ্গে সুনীল সক্রিয়ভাবে জড়িত। সেই বিন্দু থেকে শুরু হয়ে সুনীলের কবিতাযাপন চলেছে আমৃত্যু। কবিতা নিয়ে চলেছে নানা পরীক্ষানিরীক্ষা। কবিতায় প্রেমের মধ্যে শুধু মিষ্টি রোম্যান্টিক অনুভব নয়, শরীরী ধাক্কা। কাচের চুড়ি ভাঙার মতন মাঝে মাঝেইনিয়ম ভেঙে কবিতা লিখে কবি স্বীকার করছেন আমরা সকলেই ভাঙনের প্রবক্তা… ঈশ্বর থেকে সুধীন্দ্রনাথ-বুদ্ধদেব বসুর ছন্দ পর্যন্ত আমরা ভাঙতে ভাঙতে এসেছি। 

Sunil Gangopadhyay
“বাতাসে পেট্রোল-ডিজেলের গন্ধের বদলে/ বনতুলসীর গন্ধ ফিরে আসবে”

প্রশ্ন জাগে, সুনীল তো ঈশ্বরবিশ্বাসী ছিলেন না, তাহলে তাকে ভাঙবেন কীভাবে? উত্তর পাই অন্য এক কবিতায়। ঈশ্বরকে নিয়ে নীরার সঙ্গেও কবির মনকষাকষি। রবীন্দ্রনাথকে আমি ভাঙবো, ছিঁড়বো, যা খুশি করবো/ সে সব আমার নিজস্ব ব্যাপার’- এই স্বগতোক্তির মধ্য দিয়েই বাইরে-না-মানা অথচ অন্তরের সিংহাসনে সযত্নে রাখা ঈশ্বরের অস্তিত্ব জানিয়ে দেন। তবে নিয়মগুলো পুঙ্খানুপুঙ্খ জেনেই তিনি নিয়ম ভাঙতে এসেছিলেন। ছন্দের হাত অসাধারণ ছিল বলেই সচেতনভাবে ছন্দ বিনির্মাণ করেছেন সুনীল। কবিতার মধ্য দিয়ে গল্প বলেছেন। 




১৯৬৩ সালে আমেরিকায় থাকাকালীন সুনীল আরও বেশি করে পরিচিত হতে লাগলেন বিশ্বসাহিত্যের নানা ধারার সঙ্গে। আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠলেন পরীক্ষানিরীক্ষায়। কবিতায় ছন্দ
, অন্ত্যমিল, এমনকি যতিচিহ্ন বাহুল্যমাত্র হয়ে উঠছিল। একটি কবিতা লেখাকবিতায় দেখি, কীভাবে সারাদিনের নানা ঘাতপ্রতিঘাত এবং ঘটনার মধ্য দিয়ে কবিতার পঙক্তিগুলি তাঁকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে। কবিতা লেখার প্রক্রিয়া, কবিতা স্বয়ং এবং কবিতা রচনার মধ্যবর্তী ঘটনাপ্রবাহ, সবকিছু মিশে গিয়ে ম্যাজিকের মতো তাঁর কলমে সম্পূর্ণ একটি কবিতা হয়ে উঠল। 

***

আন্তর্জাতিক হলেও সুনীল কিন্তু ভীষণভাবে ভারতীয় তথা বাঙালি। রামায়ণ-মহাভারত, লোককথা এমনকী লোকগানের আকৃতিও দেখি তাঁর কবিতায়। কবি লেখেন ঘরের মধ্যে নিউ মারকিট, ঘরেই চোরাবাজার। এ কি নিছক মনের ঘরের জটিলতা বিষয়ক স্বগতোক্তি? নাকি ব্যঙ্গের মোড়কে সমাজের অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ? হয়তো বড় অংশের মানুষকে ভাবিয়ে তুলতে চান বলেই বেছে নিয়েছেন লোকগানের চেহারা। কোনও কবিতায় মহারাজকে ভোলাতে গিয়ে তাঁর বালক ভৃত্য বলে –ইষ্টিকুটুম টাকডুমাডুম’, আবার কোথাও জেগে ওঠে ওঁ শব্দ’, নানা বস্তু, এমনকী মৃত্যুর উপমায়। শব্দ নির্বাচনে সুনীল অনন্য, তাঁর সৃষ্টি সার্থক। অথচ ঠিক এই বিন্দুতেই একটা সমস্যা তৈরি হয়। কারণ কবিতা সার্থক হলে তা প্রায় ব্রহ্মের মতোই অনুচ্ছিষ্ট এবং সেই কবিতার সমানুভব অন্য কোনও শব্দে বা ভাষায় আনা অসম্ভব। সুনীলের বহু কবিতা এমনই অমোঘ, যে  অন্য কোনও ভাষায় অনুবাদ করা হলে কবিতার নির্যাস যথাযথভাবে পাঠকের কাছে পৌঁছে দেওয়া যাবে না।                                

তবে নিয়মভাঙা চলন, সহজ প্রকাশভঙ্গিমা অথবা তীব্র শরীরী অনুভবের শব্দসমষ্টির জন্যই সুনীলের  কবিতা মানুষ মনে রাখবেন, এই সমীকরণও অবশ্য পুরোপুরি সঠিক নয়। প্রায় ষাট বছর ধরে লেখা তাঁর কবিতাগুলি আদতে সমকালীন সমাজ তথা সভ্যতার দর্পণ। দেশভাগ, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, নকশাল আন্দোলনের উত্তাল সময়, আটাত্তরের বন্যা থেকে শুরু করে ওপেনহাইমার, চে গুয়েভারা, স্টিফেন হকিং, লোরকা, রামমন্দির, গ্রিনহাউজ এফেক্ট পর্যন্ত নানা ব্যক্তিত্ব এবং প্রসঙ্গ উঠে এসেছে কবিতায়। মধ্যবিত্তের সঙ্কটের কাঠকাঠ কথাগুলিও কাব্যিক হয়ে উঠেছিল‒ আমি মাছহীন ভাতের থালার সামনে বসেছি/ আমি দাঁড়িয়েছি চালের দোকানের লাইনে/ আমার চুলে ভেজাল তেলের গন্ধ

Sunil Gangopadhyay
নীরা সুনীলের স্বপ্নের নির্মাণ

শুধু তো নিজের কথা নয়, কবি বলছেন সমাজের বড় অংশের মানুষের কথা‒ হাতে-পায়ে  শৃঙ্খলিত বিষণ্ণ মানুষ/ হারিয়ে ফেলেছে সব চাবি। চাবির সঙ্গে দাবির অন্ত্যমিল কবিতায় খুবই প্রত্যাশিত হলেও এক্ষেত্রে মানুষের অসহায়তাকে ব্যক্ত করে প্রচণ্ড তীব্রতায়। প্রেয়সীর কাছে আবেদন করেন হলুদ শাড়ি আর পরো না, এবার মাঠে হলুদ ধান ফলেনিভুবনডাঙার মেঘলা আকাশউপহার দিতে ইচ্ছে হয়েছিল যাঁকে, তাঁকে দেখেই হয়তো কলমে এসেছিল এখন ইস্কুল বন্ধ, বালক সীমান্তে যায় চাল কিনতে। তৃতীয় বিশ্বে নষ্ট হওয়া জীবনের কথা প্রতিফলিত‒ মানুষ হল সংখ্যা… এবার কত মানুষ গেল?’-তে। মানুষে মানুষে হিংসা, অস্ত্রের ঝঙ্কার, যুদ্ধের হুঙ্কারে ব্যথিত কবির বিবৃতি- রক্তমাখা নোংরা এই সিঁড়ি দিয়ে আমি কোনো স্বর্গেও যাবো না। 

আত্মকথনে উঠে আসে অনুতাপ‒ আমি ক্ষমা চাই, আমি সভ্যতার নামে ক্ষমা চাই। হতাশা তাঁকে দিয়ে লিখিয়ে নেয় রক্তমাখা ঠোঁট নিয়ে দুনিয়া দাপায় আজ অমৃত শিশুরা। ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে আক্ষেপে যন্ত্রণায় বলে ওঠেন, ‘আঃ, ধর্ম শব্দটি একদা কত সুন্দর ছিল, এখন/ পুঁজ-রক্ত আর স্বার্থপরতায় মাখাকিম্বা ক্ষুধিত মানুষ ধর্ম খাচ্ছে, মাথায় ও পায়ে ধর্ম মাখছে। নরম পালকের মত শব্দে তিনি প্রতিবাদ লেখেন, লেখেন সত্য উপলব্ধি‒ সুন্দরের পীঠস্থান এই বসুন্ধরা/ যারা কলুষিত করে, তারা কি জানে না/ এ জীবন অসীমের একটি ফুৎকার। দেশ নিয়ে মানুষের স্বপ্নের মৃত্যুর হতাশা ফুটে ওঠে ‘… এ আমার দেশ বলে চিৎকার করে উঠি/ কর্ণপাত করে না একজনও/ এমনকি আমার দেশও কোনও উত্তর দেয় না।    





একুশ শতকে পা দিয়ে সুনীল বলে ওঠেন‒
ইন্টারনেটে দেখি বিশ্বকে… আমার কিছুতেই পছন্দ হচ্ছে না এই সেঞ্চুরিটা। যন্ত্রনির্ভরতার মাঝে সভ্যতার সঙ্কটের কথা বারে বারে এসেছে‒ স্বপ্ন অপছন্দ হলে পুনরায় দেখাবার নিয়ম হয়েছেকিম্বা কেউ কিছু লেখেনি; যন্ত্র, তুমি বলো ভালবাসি। পরিপার্শ্ব নিয়ে সদা সচেতন কবি ক্ষমা চেয়েছেন ব্যাকুল প্রণিপাতে অরণ্যের ছায়ার কাছে, পরিবেশ নষ্ট হওয়ার আশঙ্কায় লিখেছেন আমাদের বাল্যকালের সব চড়াই পাখিরা/ চলে যাচ্ছে মহাশূন্যের বিপুল অন্ধকারে। আবার প্রবল আশাবাদে লিখছেন বাতাসে বিষের ধোঁয়া ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে গেছে/ পশু-প্রাণী, বৃক্ষ-লতা আবার পেয়েছে ফিরে/ নিজস্ব মাটির অধিকার।       

আমাদের পরবর্তী প্রজন্মও সুনীলের কবিতা পড়ছে এবং পড়বে। আরও নানা নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে আবিষ্কার করবে তাঁর পঙক্তিগুলির বিস্তার। প্রেমের কবিতায় তাঁর নৈপুণ্য অসাধারণ, সেই কারণে সেগুলি বহুলচর্চিত। প্রেমের কবিতা প্রসঙ্গে নীরার কথা উঠবেই। নীরা সুনীলের স্বপ্নের নির্মাণ। কোনও বিশেষ একক মানুষ, রক্তমাংসের মানবী, কেউ নয় নীরা। নীরাকে বাদ দিলে দেবী, মাতৃমূর্তি কিম্বা দেবত্বের বিপরীত মেরুতে থাকা নারী ছাড়া বাস্তব জগতের নারী সেভাবে উপস্থিত নয় তাঁর কবিতায়। এই কারণেই হয়তো নানা চর্চায় একথা বলা হয়েছে, যে সুনীল নারীবাদীকবি একেবারেই নন, বরঞ্চ অনেকাংশে নারীবিদ্বেষী। 

এই জায়গাটায় কোথাও কি আমাদের বুঝবার ভুল থেকে যাচ্ছে? আমরা সুনীলের প্রেমের উপস্থাপনের সঠিক মর্মোদ্ধার করতে পারছি কি?

কোনও কবিতায় মহারাজকে ভোলাতে গিয়ে তাঁর বালক ভৃত্য বলে –ইষ্টিকুটুম টাকডুমাডুম’, আবার কোথাও জেগে ওঠে ওঁ শব্দ’, নানা বস্তু, এমনকী মৃত্যুর উপমায়। শব্দ নির্বাচনে সুনীল অনন্য, তাঁর সৃষ্টি সার্থক।

আমি ভুল সময়ে জন্মেছি, তাই আমায় কেউ চিনতে পারে না কবির অভিমান ছিল কি? নারীকে তিনি যে চোখে দেখেছেন, অমন প্রেমের মায়াকাজল সবার চোখে থাকে না। অমন ভালোবাসার হীরের গয়নানিয়েও সবাই জন্মায় না। সেই ভালবাসার তরঙ্গদৈর্ঘ্যে আর যা-ই থাক, ‘বিদ্বেষনেই। সেই রোমান্টিকতা বর্তমান সময়ে নেই, যেখানে প্রেমিক মাধুর্যের বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা নারীকে ভালবাসার মুঠোয় ঘেরা মনের ঘরের কথা বলে। অবলুপ্তি ঘটেছে সেই চিরপ্রেমিকের, যে প্রেয়সীর পায়ের কাছে বসে প্রেমভিক্ষা করে, প্রচণ্ড পুরুষালী ভঙ্গিতে ঈপ্সিত বস্তুর মতো তাকে অধিকার করবার চেষ্টা করে না কখনও। নীরার বয়স বাড়ে না, সে অমৃত খুকী। কবি চোখে হারান তাকে… অনেক জন্ম বদল বাকি আছে, হারিয়ে যেও না। 

আসলে নারীকে ঈশ্বরের জায়গায় বসিয়ে প্রেমে জন্ম-বদলের প্রত্যয় বুঝে উঠবার মতো মন হারিয়ে ফেলছি আমরা, এই আধুনিক যান্ত্রিক সভ্যতায়। সভ্যতার নানা সঙ্কট, হিংসা, যুদ্ধ, মানুষে মানুষে বিভেদ‒ সব কিছুকে মুছে দেবার অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত ভালবাসার গভীরতা কীভাবে বুঝব আমরা

আমাদের প্রজন্মের অনেকেই এখনও চোখ বুজলে শুনতে পান সুনীলদার আলতো উচ্চারণের মাত্রাবৃত্ত‒ মন ভালো নেই। সুনীলদার মতো আমাদেরও দিন কাটবে আশায়, আশায়’, তাঁর প্রবল আশাবাদে জারিত কবিতাগুলি দিনের শেষে ঘরে ফিরে মানুষ পড়বে, বাংলাভাষা নিয়ে তাঁর স্বপ্ন হয়তো সার্থক হবে‒ বাতাসে পেট্রোল-ডিজেলের গন্ধের বদলে/ বনতুলসীর গন্ধ ফিরে আসবে/ শরীরের উন্মাদনাকে ঘিরে থাকবে একটা কিছু পবিত্রতা/ রাত জেগে আয়ুক্ষয় করবে কবিরা/ চার অক্ষরের শব্দের মধ্যে বাংলা ভালোবাসা/ প্রথম স্থান অধিকার করে নেবে?’… এবং পঙক্তিগুলির শেষে প্রশ্নবোধক চিহ্ন থাকবে না।

*আকর হিসেবে ব্যবহৃত সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কাব্যগ্রন্থের তালিকা‒     

একা এবং কয়েকজন
বন্দী জেগে আছো
আমি কী রকম ভাবে বেঁচে আছি
দাঁড়াও সুন্দর
স্মৃতির শহর
জাগরণ হেমবর্ণ
সেই মুহূর্তে নীরা
মন ভালো নেই
আমার স্বপ্ন
দেখা হল ভালোবাসা বেদনায়
সাদা পৃষ্ঠা, তোমার সঙ্গে
স্বর্গ নগরীর চাবি
নীরা, হারিয়ে যেও না
বাংলা চার অক্ষর
যার যা হারিয়ে গেছে

*ছবি সৌজন্য: wikipedia, seiboi

জন্ম জুলাই, ১৯৭১, কলকাতায়। ২০০৩ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভূবিদ্যায় পিএইচডি। গল্প, কবিতা লেখালেখি ছাড়াও ইংরেজি এবং জার্মান ভাষা থেকে অনুবাদের কাজ বিশেষ পছন্দের। ২০১৬ সালে প্রকাশিত প্রথম কবিতার বই ‘অরণ্যমেঘবন্ধুর দল’ বিশেষ সমাদৃত হয়েছে।

9 Responses

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *