জয়ন্তিয়া পাহাড়ের আদি বাসিন্দাদের অনেকেরই উত্তরাধিকার সূত্রে কমবেশি জমিজায়গা আছে। জমির গভীরে জমে থাকা কয়লার খবরও তাঁদের অজানা নয়। আগের পর্বেই বলেছি, যে এখানে জমির মালিক ভূগর্ভস্থ কয়লারও স্বত্বাধিকারী। কিন্তু মাটি খুঁড়ে সেই কয়লা ওপরে তুলে আনার সামর্থ্য তাঁদের নেই। অর্থবলও নেই। তার উপর রয়েছে আইনি বিধান। অরণ্য এবং পরিবেশ সংরক্ষণ আইনের আওতায় থাকা জমিতে মাটি কেটে অর্থাৎ খোলামুখ খনি বা ‘ওপেনকাস্ট মাইন’ তৈরি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।



কথায় আছে, ইচ্ছে থাকলে উপায় হয়। মাটি কেটে কয়লা তুলে আনা নিষেধ হলেও মাটি খুঁড়ে গভীরে যাওয়ায় তো বারণ নেই। তাই প্রথমেই একটা গর্ত খুঁড়ে ফেলা হয়। গর্তের মাপ ৫ থেকে ১০০ বর্গমিটার। যেখানে যেমন জায়গা পাওয়া যায়, সেই হিসেবে মাটির গভীরে এগিয়ে যেতে হয়। কত গভীরে? নিদেনপক্ষে ৬০ মিটার। প্রয়োজনে ১০০ মিটার পর্যন্ত খুঁড়তে হয়। মোদ্দা কথা, কয়লার স্তরের খোঁজ না পাওয়া পর্যন্ত গর্ত খোঁড়া বন্ধ করা চলবে না। 

কয়লার খোঁজ পাওয়ার পর শুরু হয় ভূপৃষ্ঠের সঙ্গে সমান্তরাল যাত্রা। সামনে, পিছনে, ডাইনে, বামে যেদিকে মন চায়, কয়লার স্তর কাটতে কাটতে এগিয়ে যাওয়ার সময় আপনা থেকেই একটা সুড়ঙ্গ তৈরি হয়ে যায়। এখানকার কয়লার স্তর, যাকে বলে ‘সিম’, মোটেও পুরু নয়। বড়জোর এক মিটার। কাজেই সুড়ঙ্গের উচ্চতা এক মিটারের সামান্য বেশি। সিম কেটে কয়লা তোলার যন্ত্র বলতে একটা কুঠার বা গাঁইতি। প্রমাণ মাপের নয়, ছোট। ডানহাতে কুঠার আর বাঁ হাতে টর্চ নিয়ে কয়লার সিম কাটতে কাটতে এগিয়ে চলেন খনিশ্রমিক। তাঁর সহকর্মী পিঠে বাঁধা ঝুড়ির মধ্যে জমা করতে থাকেন সদ্য-কাটা কয়লার চাঙড়। ঝুড়ি ভরে গেলে শুরু হয় ফেরত যাত্রা। সুড়ঙ্গের গোড়া পর্যন্ত ফিরে গেলে পাওয়া যায় মাটির উপরকার খনিমুখ থেকে নেমে আসা বড় ঝুড়ি। সংগৃহীত কয়লা সেই ঝুড়িতে ভরে দিলেই উপরে বসে থাকা কোনও একজন কপিকলের দড়ি টানা শুরু করে দেয়। খনিমুখের পাশে সেই কয়লা জমা করে আবার খালি ঝুড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয় কুয়োর গভীরে। 

এ যেন আধুনিক খনি প্রযুক্তির প্রাচীনতম সংস্করণ। এখনকার ভূগর্ভস্থ খনি থেকে এইভাবে চলতে থাকে যাবতীয় খনিজ উত্তোলনের কাজ, যা ‘আন্ডারগ্রাউন্ড মাইনিং’ বলে পরিচিত। খনিমুখের মাটি কাটা শুরুর অনেক আগেই সম্পন্ন হয় বিশদ ভূতাত্ত্বিক সমীক্ষা। তারপর বিশেষজ্ঞরা তৈরি করেন ভূগর্ভস্থ খনির নীলনকশা। অবশেষে শুরু হয় খনন। খনি-নিরাপত্তা সংক্রান্ত সমস্ত সতর্কতা অবলম্বন করে ভূগর্ভে প্রবেশের অনুমতি মেলে। উপযুক্ত পোশাক, মাথায় শক্তপোক্ত হেলমেট, হেলমেটের সামনে লাগানো টর্চের আলোয় আলোকিত সুড়ঙ্গের ভেতরে অতঃপর কাজ শুরু করার অনুমতি পাওয়া যায়। 



সিম কেটে বের করে আনা কয়লার চাঙড় একটা ট্রলিতে চড়িয়ে দিলে যান্ত্রিক উপায়ে তা খনিমুখের তলদেশে পৌঁছে যায়। তারপর লিফটে চেপে চলে যায় মাটির ওপরে। কয়লার সিম কেটে এগনোর সময় মাঝে মাঝেই কিছুটা এলাকা ছেড়ে দেওয়া হয়। উপরের জমির চাপে সুড়ঙ্গের মধ্যে হঠাৎ করে যদি ধস নামে, তা প্রতিরোধের জন্যই এই ব্যবস্থা। এত সতর্কতা এবং নিরাপত্তাবিধি মেনে চলার পরেও অবশ্য মাঝেমধ্যেই দুর্ঘটনা ঘটে। কখনও সুড়ঙ্গের ভেতর জমে থাকা গ্যাস শ্রমিকের শ্বাসরুদ্ধ করে দেয়। কখনও আবার কয়লাস্তরের ফাটল ভেদ করে ভূগর্ভস্থ জল সুড়ঙ্গে ঢুকে পড়ে।

জয়ন্তিয়া পাহাড়ে অবশ্য এসবের বালাই নেই। ভূতাত্ত্বিক সমীক্ষা, সুড়ঙ্গের নীলনকশা, এসব নিয়ে কে ভাবে? কোনওরকমে কয়লা জমির ওপরে এনে ট্রাকে তুলে দেওয়াই এক এবং একমাত্র করণীয়। খনিমুখের আয়তন যথেষ্ট প্রশস্ত না-হলে পাহাড়ের মধ্যবর্তী সমভূমিতে বৃত্তাকারে পুঁতে দেওয়া হয় তিন-চারটি বাঁশ। বাঁশগুলির গোড়া মাটিতে একটা নির্দিষ্ট দূরত্বে পোঁতা থাকলেও মাথাগুলো ঝুঁকে পড়ে একসঙ্গে বাঁধা। আরও ভাল করে নজর করলে দেখা যায়, সেই ঝুঁটি বাঁধা বাঁশের খাঁচা থেকে একটা কপিকল দিয়ে দুটি তারের দড়ি ঝুলছে। কাছে গিয়ে খুঁটিয়ে দেখলে চোখে পড়বে, তারের দুই প্রান্তেই আটকানো রয়েছে একটা করে খালি ঝুড়ি। একটি চলে গেছে মাটির গভীরে। আর অন্যটি অপেক্ষারত। ঝুড়ির ঠিক নীচেই রয়েছে গর্ত। গর্তের আশপাশে ছড়িয়ে ছোট ছোট কয়লার স্তূপ। সে এক অদ্ভুত দৃশ্য! 

পাহাড়ের পাদদেশে পড়ে থাকা স্বল্পায়তন সমভূমিতে এমন কাঠামো নিঃসন্দেহে কৌতূহল সৃষ্টি করে। সময় এবং উৎসাহ থাকলে এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাওয়া যায়। হঠাৎ করে হ্যাঁচকা টানে খালি ঝুড়িটাকে মাটির গভীরে পাঠানো শুরু হয়। ফলে, কপিকলের অন্য পাশের দড়িটি ঝুড়ি সমেত উপরে উঠতে শুরু করে। কিছুক্ষণের মধ্যেই উপরে উঠে আসে এক ঝুড়ি কয়লা। আর দিনের শেষে উঠে আসেন একের পর এক বেশ কয়েকজন খর্বকায় শীর্ণ মানুষ। দিনের শুরুতে এই পদ্ধতিতেই তাঁরা সুড়ঙ্গ কেটে কয়লা সংগ্রহ করতে নীচে নেমেছিলেন। 



খনিমুখ প্রশস্ত হলে নীচে নামা-ওঠার জন্যে একটা নড়বড়ে কাঠের সিঁড়ি লাগানো থাকে। অনেক খনিমুখের উপরে বাঁশের খাঁচায় টাঙানো কপিকলের বদলে লোহার কাঠামো গড়ে তোলা হয়। সেখানে হয়তো যন্ত্রচালিত ঝুড়িতে করে নীচে নেমে যান শ্রমিক। আর উপরে উঠে আসে কয়লা।

unplanned coal mining
যখন যেদিকে কয়লা পাওয়া যায়, সেদিকেই কুঠার বা গাঁইতি মারতে মারতে এগিয়ে চলেন শ্রমিকের দল

এইভাবেই প্রচলিত পদ্ধতিতে মাটিতে গর্ত খুঁড়ে, তার ভেতর সুড়ঙ্গ তৈরি করে তুলে আনা হয় প্রকৃতির নিজস্ব সম্পদ। সুড়ঙ্গ বেশি গভীর নয়, প্রশস্তও নয়। কিন্তু অসংখ্য শাখা-প্রশাখার সমন্বয়ে গঠিত এই খনি কত গভীরে ছড়িয়ে রয়েছে, তা কারও জানা নেই। না হয়েছে তার কোনও সমীক্ষা, না আছে নকশা। যখন যেদিকে কয়লা পাওয়া যায়, সেদিকেই কুঠার বা গাঁইতি মারতে মারতে এগিয়ে চলেন শ্রমিকের দল। তাঁদেরও জানা নেই, যে কোথায় গাঁইতি চালালে হঠাৎ করে নদীর তলদেশে ছিদ্র হয়ে যেতে পারে অথবা ভূগর্ভস্থ জলস্তর মুক্ত হয়ে যেতে পারে। সবমিলিয়ে ইঁদুরের গর্তের এ এক পরিবর্ধিত সংস্করণ। আন্ডারগ্রাউন্ড মাইনিং-এর এক প্রাচীন সংস্করণ, যা প্রযুক্তির পরিভাষায়‒ র‍্যাটহোল মাইনিং (rathole mining)।

*ছবি সৌজন্য: Livelaw, Livemint, Scroll এবং লেখক

Amitabha Ray Author

প্রশিক্ষিত প্রযুক্তিবিদ ও পরিচিত পরিকল্পনাবিশারদ। পড়াশোনা ও পেশাগত কারণে দেশে-বিদেশে বিস্তর ভ্রমণের অভিজ্ঞতা। তার ফসল বেশ কয়েকটি জনপ্রিয় বই। জোয়াই, আহোম রাজের খোঁজে, প্রতিবেশীর প্রাঙ্গণে, কাবুলনামা, বিলিতি বৃত্তান্ত ইত্যাদি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *