যে কালান্তক ভাইরাসকে নিয়ে কথা বলছি, এতদিনে সবার জানা, তার নাম সার্স-কোভ-২। যে রোগ সৃষ্টি করে তা হল কোভিড-১৯ এবং ফলাফল? আমাদের জীবিতাবস্থায় দেখা সবচেয়ে মারাত্মক প্যান্ডেমিক বা অতিমারী। “ওয়ার্ল্ডোমিটার”-এর তথ্য অনুযায়ী (২.১২.২০২০)– সমগ্র বিশ্বে মোট সক্রিয় করোনাভাইরাস আক্রান্তের সংখ্যা ৬৪,৩২৮,২৫৯; মৃত্যুর সংখ্যা ১,৪৮৯,৮১৭, সেরে উঠেছেন ৪৪,৬১১,৬৭৯। মৃত্যুর সংখ্যা যেখানে প্রায় ১৫ লক্ষ, এবং সেরে উঠেছেন ৪ কোটির ওপরে সেখানে প্রশ্ন আসবে – প্রায় একবছর পরেও পৃথিবীর সর্বোচ্চ স্তরের মেধা, প্রযুক্তির ব্যবহার এবং শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী ও চিকিৎসকদের দিন-রাত এক করে ফেলা পরিশ্রমের পরেও যে ভাইরাসের মানুষের দেহের ভেতরে কার্যকলাপ যৎকিঞ্চিৎ বুঝে ওঠা গেছে, সে ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে সেরে ওঠার পরে রোগীর শরীরে কি ধরনের দীর্ঘস্থায়ী ছাপ থেকে যায়?

একথা বোঝার জন্য আগে সংক্ষেপে বুঝতে হবে কিভাবে আরএনএ ভাইরাসটি দেহের ভেতরে প্রবেশ করে এবং কোন গঠনগত বৈশিষ্ট্যের জন্য ভাইরাসটি এত সংক্রামক।
ভাইরাসটি হল প্রকৃতপক্ষে একটি “জেনেটিক ইন্সট্রাকশন” যার মধ্যে ২৯,৯০৩টি আরএনএ “লেটার”-কোড রয়েছে। একটি সংক্রমিত মানব কোষে লক্ষ কোটি ভাইরাস তৈরি হয়, যাকে বলে রেপ্লিকেশন। এই রেপ্লিকেশন যখন হচ্ছে তখন প্রাকৃতিক নিয়মে কিছু “ভুল” হয়। এবং হতে পারে আরএনএ পলিমারেজের মধ্যে ভুল করার একটি প্রবণতা রয়েছে। এমনও হতে পারে, আরএনএ থেকে ডিএনএ তৈরি হওয়ার পর আরও বহু সংখ্যক ডিএনএ তৈরি হওয়ার সময় অথবা ডিএনএ থেকে আরএনএ তৈরি সময় ভুল ঘটে যায়। এই ভুল করার ফলে জিনের গঠনে যে পরিবর্তন ঘটে তাকে বিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় মিউটেশন।

এই ভাইরাসের গায়ে থাকে স্পাইক প্রোটিন এবং স্পাইক প্রোটিন গিয়ে জোড় বাঁধে মানবশরীরে বিভিন্ন কোষের গায়ে থাকা ACE2 রিসেপ্টরের সাথে। এজন্য শরীরের বিভিন্ন জায়গায় আক্রমণের ফলে বিচিত্র সমস্ত উপসর্গ তৈরি হয়। গতবছর ডিসেম্বর মাসে যে প্রাথমিক লক্ষণগুলোকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল, একবছর পরে সেসব উপসর্গের চরিত্রও বদলে গেছে। স্পাইক প্রোটিনের ৬১৪তম স্থানে একটি অ্যামাইনো অ্যাসিড অ্যাস্পার্টেট (যাকে বায়োকেমিক্যাল ভাষায় সংক্ষেপে D বলা হয়) আরেকটি অ্যামাইনো অ্যাসিড গ্লাইসিন (যাকে G বলা হয়) দিয়ে নিয়মিত প্রতিস্থাপিত হচ্ছে। একে ভাইরাস বিশেষজ্ঞরা বলছেন D614G মিউটেশন। এই মিউটেশনই আপাতত রোগের বিস্তারের একটি প্রধান কারণ। নীচের ছবিটি থেকে কিভাবে ভাইরাসটি কোষে ঢুকে সংক্রমণ ঘটায় তা বুঝতে সাহায্য করবে।

post-covid complaications

ফুসফুসে ভাইরাসটি সহজে শ্বাসনালি দিয়ে ঢুকে সংক্রমণ ঘটায়। ফুসফুস ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এখানে বলার কথা যে এই ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে কারও মুক্তি নেই। পৃথিবীর যে কোনও মানুষ সংক্রমিত হতে পারে। তথাকথিত কোনও “ইমিউনিটি পাসপোর্ট” নেই। শরীরের প্রায় সমস্ত অঞ্চল আক্রান্ত হতে পারে। এবং একেক অঞ্চলের সংক্রমণ একেক ধরনের উপসর্গ ও ক্ষতির খতিয়ান তৈরি করে।

এমনকী এ প্রশ্নও এখন বিজ্ঞানীমহলে উঠছে যে কোভিড-১৯ কি প্রাথমিকভাবে শ্বাসযন্ত্রের সমস্যা নাকি রক্তসঞ্চালনের বা রক্তনালির রোগ। যাহোক, নেচার পত্রিকা থেকে সংগৃহীত নীচের চিত্রটি মানব শরীরের কোন কোন অঞ্চল কিভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় তার একটি গ্রাফিক রূপরেখা হাজির করেছে।

graphic representation of post covid human body

এবারে আলাদা আলাদা অঙ্গ এবং সামগ্রিকভাবে করোনা সংক্রমণ পরবর্তী কী কী ক্ষতি/সমস্যা রোগীর হতে পারে সেগুলো দেখা যাক।
১. ফুসফুস – সেরে ওঠার পরে লাং ফাইব্রোসিস এবং ইন্টারস্টিসিয়াল নিউমোনিয়া হতে পারে। বিশেষ করে লাং ফাইব্রোসিস একটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা যা পৃথিবী জুড়েই রোগীদের মাঝে দেখা যাচ্ছে। এতে ফুসফুসের স্থিতিস্থাপকাতা অনেকটা হারায়, ফলে স্বাভাবিক সংকোচন-প্রসারণ ঘটে না। একটু হাঁটলে বা স্বাভাবিক কথাবার্তা বলার সময়েও রোগী হাঁপিয়ে পড়ে। বেশিদিন এই অবস্থা চললে রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা কমতে শুরু করে। ধীরে ধীরে রোগীর জীবনের স্বাভাবিকতা নষ্ট হয়। যাদের বয়স ৬০ বা তার বেশি এবং যাদের ব্লাড শুগার, ব্লাড প্রেশার, হার্টের সমস্যা ইত্যাদি আছে তাদের ক্ষেত্রে শুধু লাং ফাইব্রোসিস নয় অন্য সব রেসিড্যুয়াল ফলাফলের ক্ষেত্রেও অতিরিক্ত সমস্যা দেখা যায়।
২.হার্ট এবং রক্তনালি – হার্টের মাংসপেশি দুর্বল হয়ে পড়ে (আমাদের শরীরের সাধারণ মাংসপেশিও দুর্বল হয়)। একে ডাক্তারি পরিভাষায় মায়োপ্যাথি বলা হয়। এছাড়া রক্তনালিতে রক্ত জমাট বাঁধার প্রবণতা বেড়ে যায় এবং রক্তনালির ভেতরের আস্তরণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর ফলে পরবর্তীতে রক্তসঞ্চালন সংক্রান্ত বিভিন্ন ধরনের উপসর্গ দেখা দিতে পারে। কিছু বিরল রোগও দেখা যায় – যেমন Takotsubo cardiomyopathy এবং কাওয়াসাকি ডিজিজ ধরনের রোগ দেখা যায়।
৩. মস্তিষ্ক/স্নায়ুতন্ত্র – Gullain-Barre সিন্ড্রোমের মতো স্নায়ুতন্ত্রের রোগ দেখা যায়। এছাড়াও মানসিক অবসাদ, উদ্বেগ, আবেগের ওঠা-নামা, স্মৃতিশক্তি কমে যাওয়া এবং সময় ও স্থানের হিসেব গুলিয়ে ফেলার মতো সমস্যাও দেখা যেতে পারে কিছু ক্ষেত্রে। দেখা যেতে পারে এনসেফালোপ্যাথি।
৪. কিডনি – কিডনি হঠাৎ করে আঘাত পেতে পারে যার থেকে পরবর্তী সময়ে প্রস্রাবের সাথে রক্ত এবং অ্যালবুমিন নিঃসরণ, এমনকী কিডনির কার্যকারিতা বন্ধ অবধি হতে পারে।
৫. ডায়াবেটিস – কোভিড-১৯ শাঁখের করাতের মতো। যাদের ডায়াবেটিস ছিল না তাদের ক্ষেত্রে নতুন করে ডায়াবেটিস হতে পারে। আবার যাদের ডায়াবেটিস আছে তাদের ক্ষেত্রে গুরুতর চেহারা ধারণ করতে পারে, যেমন রক্তে শর্করার মাত্রা স্বাভাবিক থাকলেও রক্তে কিটোসিস ঘটতে পারে।
৬. লিভার – কোভিড থেকে সেরে ওঠার পরে জন্ডিস এবং অন্যান্য সমস্যা দেখা দিতে পারে।
৭. ত্বক – চুল পড়ে যাওয়া।
সার্স-কোভ-২ ভাইরাস সরাসরি ভাইরাসের বিষাক্ত প্রভাবে কিংবা শরীরের বিভিন্ন এনজাইম ও প্রোটিন তৈরিকে এলোমেলো করে দিয়ে এত বিচিত্র সমস্ত ঘটনা ঘটায় যা এর আগে অন্য কোনও আরএনএ ভাইরাসের সংক্রমণে দেখা যায়নি। অথচ আমরা এখনো ভাইরাসটিকে করায়ত্ত করতে পারিনি। ভ্যাক্সিনও সম্ভবত শেষ উত্তর হবে না। এরপরে ইংল্যান্ডে ভাইরাসটির নতুন মিউটেশন (বি.১.১.৭) এবং নতুন স্ট্রেনের আবির্ভাব আমাদের আবার শঙ্কিত করে তুলছে। তবে বিজ্ঞানীরা মনে করছেন ভ্যাক্সিন নতুন স্ট্রেনের ক্ষেত্রেও কাজ করবে। সময় বলবে সে কথা। কিন্তু আমাদের ভবিতব্য হল ভাইরাসের সাথে সহবাস।
কিন্তু তাই বলে মনোবল হারালে চলবে না।
“মন্বন্তরে মরিনি আমরা
মারী নিয়ে ঘর করি”!

ছবি সৌজন্যে লেখক ও Pexels

পরের পর্বে আরও বিশদে নিবন্ধে উল্লিখিত রোগসমূহের ব্যাখ্যা দেওয়া হবে।

পেশায় ডাক্তার। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সংস্কৃতি বিষয়ে গবেষণায় নিযুক্ত। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখালেখি করেন। বর্তমান ঠিকানা রায়গঞ্জ।

6 Responses

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *