সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বাংলা চলচ্চিত্র জগতের এতখানি জুড়ে ছিলেন, যে তিনি আজ নেই এ কথাটা এখনও অসম্ভব বলেই মনে হচ্ছে। সৌমিত্রদার কথা মনে পড়া মানেই কলকাতার শান্ত পাড়া গলফগ্রিনে তাঁর বাড়িটা চোখের সামনে ভেসে ওঠা। সেখানে যে কতবার গিয়েছি, তার ইয়ত্তা নেই।
আমি মোট তিনটে ছবি ওঁকে নিয়ে বানিয়েছিলাম। ফলে, ছবির প্রস্তাব নিয়ে যাওয়ার পর্ব থেকেই ওঁর বাড়িতে যাতায়াত শুরু হত। তারপর বাকি নানা পর্বে, বিভিন্ন প্রয়োজনে সেই যাওয়া-আসা লেগেই থাকত। প্রতিবারই চেষ্টা করেছি ওঁর দেওয়া নির্ধারিত সময়ে পৌঁছতে ও কাজের কথা শেষ হলেই উঠে আসতে, যাতে ওঁর মহামূল্যবান সময় অকাজের কথায় নষ্ট না হয়। কিন্তু প্রতিবারই লক্ষ করেছি, কাজের কথা শেষ করেই তুমি চলে যাও, এমন কোনও ইঙ্গিত ওঁর দিক থেকে আসত না। বরং মনে হত উনি চাইছেন, ‘কাজের কথা তো হল, এবার একটু গল্পগুজব হোক!’
আমি যেহেতু ওঁর খুব কাছের মানুষ ছিলাম না, তাই ওঁর সঙ্গে গল্প জমানোর ইচ্ছে বা সাহস আমার কখনওই হয়নি। সব সময় মানুষটার বৌদ্ধিক উচ্চতা আমায় সচেতন করে রাখত। অথচ খেয়াল করে দেখেছি, উনি নিজে কিন্তু কোনও দিন সেই উচ্চতার জায়গা থেকে আমার সঙ্গে মিশতেন না। ওঁর প্রাজ্ঞতা খুব সহজ ও স্বাভাবিকভাবে ওঁর স্বভাবের সঙ্গে মিশে গিয়েছিল। আমার বিশ্বাস, প্রকৃত শিক্ষা মানুষের চরিত্রে এই গুণটি যুক্ত করে। ফলে, কথা বলার সময় তাঁকে আর পাঁচটা সাধারণ মানুষের মতোই মনে হত। অথচ সৌমিত্রদা যে সাধারণ ছিলেন না, সে কথা আলাদা করে বলার কোনও প্রয়োজন নেই। সৌমিত্রদার অসাধারণত্বকে জানতে ও বুঝতে গেলে তাঁর অতীতকে জানতে হবে, যা আজ হয়তো অনেকেরই অজানা। বিশেষ করে এই মুড়ি-মিছরি এক করার যুগে সৌমিত্রদা ছিলেন একজন ‘গালিভার’, যাঁর সামনে আমরা সকলে লিলিপুটসম, যাঁর দিকে তাকাতে হলে ঘাড়টা বেশ খানিকটা উপর দিকে তুলতে হত।
‘গালিভার’ বলছি এইজন্য, যে সৌমিত্রদা তাঁর দীর্ঘ অভিনয়-জীবনে নিজের সমকালকে অতিক্রম করে এসে পৌঁছেছিলেন এমন এক সময়ের প্রান্তে, যেখানে তাঁর চারপাশের সকলেই উচ্চতায় তার চেয়ে নিম্নতর পরিসরে ছিলেন। তাঁর চেতনা এবং বোধকে অনুধাবন করার বা তাঁকে সঙ্গ দেওয়ার ক্ষমতা খুব কমজনেরই ছিল। যাঁদের তিনি সেই স্তরে দেখতে পেতেন, তাঁদেরই টেনে নিতেন নিজের একান্ত বৃত্তে। এই নির্বাচন তিনি নিজেই করতেন। সেখানে এমন অনেকেরই হয়তো জায়গা হয়েছে, যাঁরা তাঁর চেয়ে বয়সে নবীন, হয়তো কোনও বৌদ্ধিক স্তরেই দাঁড়িয়ে নেই। কিন্তু তবু তাঁদের সঙ্গ সৌমিত্রদাকে আনন্দ দিয়েছে।

সৌমিত্রদা চিরকাল মানুষের সঙ্গ পছন্দ করতেন। যে কোনও অভিনয়ের প্রস্তাব এলে, চিত্রনাট্য হাতে পড়লে, কয়েক পাতা উলটেই বুঝে নিতেন সেখানে নতুন কোনও ভাবনার ছোঁয়া আছে কিনা। বেশির ভাগ সময়েই থাকত না। তবু কখনও কখনও তাঁকে বলতে শুনেছি “অমুক খুব সুন্দর করে ভেবেছে। চরিত্রটা বেশ ইনটারেস্টিং।” ভাল চরিত্রের খোঁজ তিনি আজীবন করে গিয়েছেন। আমার প্রজন্মের পরিচালকরা যখন তাঁর সঙ্গে কাজ করতে শুরু করেন, তখন সৌমিত্রদা শারীরিকভাবে অনেকটাই দুর্বল হয়ে পড়েছেন। গতিবিধি সীমিত হয়ে এসেছে। ‘ফিজ়িকাল অ্যাকটিং’ বলতে যা বোঝায় তা আর তাঁর পক্ষে তখন সম্ভব নয়। কলকাতার মধ্যে ইনডোর শ্যুটিংয়েই তিনি বেশি স্বচ্ছন্দ। বাইরে হলে বড়জোর শান্তিনিকেতন পর্যন্ত যেতে রাজি হতেন। শ্যুটিংয়ের সময় সকালের দিকে হলে খুশি হতেন। সারাদিনে চার ঘণ্টার বেশি তাঁকে নিয়ে শ্যুটিং করা যেত না। ফলে ষাট থেকে নম্বইয়ের দশক পর্যন্ত যে সব পরিচালকেরা তাঁকে নিয়ে কাজ করেছেন, তাঁরা যে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে পেয়েছিলেন, আমাদের প্রজন্ম তা পায়নি।
তবু সেই সীমিত ক্ষমতা নিয়েই তিনি অজস্র ভাল ভাল কাজ করেছেন। নিজের অভিজ্ঞতায় দেখেছি, যদি তাঁর পছন্দমতো পরিবেশ, সহ-অভিনেতা ও পরিচালক পেতেন, তবে বসে বসেই যে স্তরের অভিনয় করতেন, তা অবাক করার মতো। কেবল মুখের অভিব্যক্তি ও সংলাপ উচ্চারণের সাহায্যেই চরিত্রকে জীবন্ত করে তুলবার অনায়াস দক্ষতা তাঁর করায়ত্ত ছিল। আমার শেষ ছবি ‘আ হোলি কন্সপিরেসি’-তে সৌমিত্রদাকে দেখেছি নাসিরুদ্দিনের বিপরীতে দাঁড়িয়ে যাবতীয় শারীরিক প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে উঠে কীভাবে অভিনয় করছেন। আমার নিজের আনন্দ যেমন হয়েছে, তেমনি সঙ্কোচও বোধ করেছি, মানুষটাকে কষ্ট দিচ্ছি ভেবে। তবু বরাবর চেষ্টা করেছি তাঁকে যতটা সম্ভব কম ক্যামেরার সামনে বসিয়ে রাখার। ইচ্ছে হলেও দ্বিতীয়বার টেক করতে যাইনি।
তবে সৌমিত্রদা নিজের এই সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে পুরোপুরি সজাগ ছিলেন। তাই ডাবিং করতে এসে অভিনয়ের যাবতীয় দোষত্রুটি নিজেই চিহ্নিত করে সংলাপ উচ্চারণের মুনশিয়ানায় ঢেকে দিতেন। ‘আ হোলি কন্সপিরেসি’ অতিমারী পার হয়ে যেদিন দর্শকদের সামনে আনতে পারব, সেদিন তাঁরা এক অন্য সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে দেখতে পাবেন বলেই আমার বিশ্বাস।
*ছবি সৌজন্য: Eros Entertainment এবং বাংলালাইভ
শৈবাল মিত্র এ কালের একজন গুরুত্বপূর্ণ চিত্রপরিচালক। পড়াশোনা শান্তিনিকেতনে। চলচ্চিত্রের একাধিক ধারায় কাজ করে আসা শৈবাল প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্যের ছবি বানান ২০০৭ সালে, 'সংশয়' নামে। শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের গোয়েন্দাকাহিনি অবলম্বনে ধৃতিমান চট্টোপাধ্যায়, অর্পিতা চট্টোপাধ্যায় ও কঙ্কণা সেনশর্মাকে নিয়ে ২০১৫ সালে বানান 'সজারুর কাঁটা'। বিএফজেএ সেরা পরিচালকের সম্মান রয়েছে তাঁর ঝুলিতে। ইন্ডিয়ান প্যানোরামাতেও দু'বার নির্বাচিত হয়েছে তাঁর ছবি। ঘুরেছে দেশবিদেশের ফিল্মোৎসবে।
খুব ভাল লাগলো! ‘আ হোলি কন্সপিরেসি’ ছবির জন্য এখন সাগ্রহ প্রতীক্ষায়!