১৯২৯ সাল। ২১ নভেম্বর তারিখে লেখা একটি চিঠি রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের কাছে এসে পৌঁছেছিল। উক্ত পত্রে লেখা ছিল,

 “রামকৃষ্ণ পরমহংস যেদিন আমাদের বাড়িতে পিতৃদেবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আসেন সেদিন আমি বাড়িতে ছিলাম কিন্তু তাদের পরস্পরের সাক্ষাৎকারের স্থলে উপস্থিত ছিলাম না।”

যে বাড়ির উল্লেখ এখানে পত্রকার করেছেন এই মহানগরের যেমন তেমন সাধারণ বাড়ি নয়। বাড়িটি জোড়াসাঁকোর ঐতিহাসিক ঠাকুরবাড়ি। এবং পত্রলেখক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। 

এই পত্রের তেষট্টি বছর আগের ঘটনা এটি। রবীন্দ্রনাথ তখন নিতান্তই ছয় বছর বয়সী এক বালকমাত্র। উনপঞ্চাশ বছর যাঁর বয়স, যিনি ব্রাহ্মধর্মের পুরোধা, সেই মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের কাছে এসেছিলেন উনিশ বছরের ছোট তিরিশের যুবা কালীসাধক গদাধর চট্টোপাধ্যায়। কেন এসেছিলেন? এই প্রশ্নের উত্তর খুব সহজ করে বলেছিলেন তিনি,

“তুমি সংসারে থেকে ঈশ্বরে মন রেখেছ শুনে তোমায় দেখতে এসেছি; আমায় ঈশ্বরীয় কথা কিছু শোনাও!”

এও বলেছিলেন, 

“বললুম, তুমি কলির জনক। জনক এদিক-ওদিক দুদিক রেখে খেয়েছিল দুধের বাটি।”

সেদিন মহর্ষি বেদ থেকে কিছু বাণী শুনিয়েছিলেন। বলেছিলেন,

“এই জগৎ আসলে একটি ঝাড়ের মতো। জীব হল এক একটি ঝাড়ের দীপ।” 

সেদিন পরমহংস রামকৃষ্ণদেবের একথা শুনে মনে হয়েছিল, পঞ্চবটীতে ধ্যানের সময় তাঁর ঠিক এমনটাই মনে হত। ফলে মহর্ষির কথার সঙ্গে মিল খুঁজে পেয়েছিলেন তিনি। এবং বুঝেছিলেন মহর্ষি ‘খুব বড়ো লোক।’

portrait of rabindranath tagore by gaganendranath tagore
গগনেন্দ্রনাথের আঁকা রবীন্দ্রনাথের পোর্ট্রেট

অর্থাৎ সেদিন মহর্ষির ঈশ্বরদর্শনের স্বরূপ চিনতে ও অনুধাবন করতে পেরেছিলেন রামকৃষ্ণদেব। সেদিন বালক রবীন্দ্রনাথ এবং রামকৃষ্ণের কিন্তু সাক্ষাৎ  হয়নি। এদিকে জোড়াসাঁকোর বাড়ির সেই ঐতিহাসিক ঘটনার প্রায় ষোলো- সতেরো বছর পর ১৮৮৩ থেকে ১৮৮৫ সাল নাগাদ রামকৃষ্ণদেবের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের পরিচয় ঘটল একটু ভিন্নভাবে। এবং তা ঘটল রামকৃষ্ণের ভাবশিষ্য নরেন্দ্রনাথের মাধ্যমে। হ্যাঁ, ‘কথামৃত’-র ইতিহাস বলছে, ১৮৮৩ থেকে ১৮৮৫ সাল পর্যন্ত নরেন্দ্রনাথ শ্রীরামকৃষ্ণকে রবীন্দ্ররচিত একাধিক গান গেয়ে শোনান। এমনকী মাঘোৎসবে গাওয়া গানও ১৮৮৬ সালে একাধিকবার নরেন্দ্রনাথ শুনিয়েছিলেন। গানটি ‘দুখ দূর করিলে দরশন দিয়ে মোহিলে প্রাণ’। অতএব দেখা যাচ্ছে শ্রীরামকৃষ্ণের দরবারে রবীন্দ্রনাথ পৌঁছে যাচ্ছেন বিবেকানন্দের মাধ্যমে। যদিও  ১৮৮১ সালে রাজনারায়ণ বসুর চতুর্থ কন্যা লীলাবতী দেবীর বিয়ে উপলক্ষ্যে নরেন্দ্রনাথ দত্ত, যিনি পরবর্তীকালে স্বামী বিবেকানন্দ হন তিনি গান করেছিলেন। সেদিনের ইতিহাস জানা লীলাবতী দেবীর ডায়েরির পাতা থেকে,

“নগেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়, সুন্দরীমোহন দাস, কেদারনাথ মিত্র, অন্ধ চুণীলাল ও নরেন্দ্র দত্ত মহাশয়গণ সংগীত করিয়াছিলেন।… শ্রীযুক্ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মহাশয় — দুই হৃদয়ের নদী (সাহানা – ঝাঁপতাল), জগতের পুরোহিত তুমি (খাম্বাজ- একতালা), শুভদিনে এসেছে দোঁহে (বেহাগ-তেতালা) প্রভৃতি সংগীত রচনা করিয়া গায়কদিগকে শিখাইয়া দিয়াছিলেন।”

অতএব ইতিহাস বলছে নরেন্দ্রনাথ রবীন্দ্রনাথের কাছে গানের তালিম নিয়েছিলেন। 

এই ঘটনার ছয় বছর পর নরেন্দ্রনাথ দত্ত ও বৈষ্ণবচরণ বসাককৃত ‘সঙ্গীত কল্পতরু’ নামের সংগীতের গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। এই গ্রন্থে রবীন্দ্ররচিত দশটি গান যথোপযুক্ত মর্যাদায় মুদ্রিত হয়েছিল। এবং স্বয়ং সংগ্রাহক নরেন্দ্রনাথ দত্ত ভূমিকায় লিখেছিলেন,

“ব্রাহ্মসমাজ হইতে যে-সকল বাংলা ভাষায় ধ্রুপদ রচিত হইয়াছে, তাহা কি কোনো অংশে হিন্দী ভাষায় রচিত ধ্রুপদ অপেক্ষা মন্দ?”

তার মানে তিনি ব্রাহ্মদের সংগীত রচনার প্রশংসাই করেছেন। এবং মূলত তা রবীন্দ্রনাথকেই করা। এদিকে ১৮৯৯ সালের ২৯ জানুয়ারি ভগিনী নিবেদিতা একটা চা-পানের আসরের আয়োজন করেছিলেন। এ খবর জানা যায় নিবেদিতা লিখিত একটি পত্রে। মিস জোসেফিন ম্যাকলাউডকে ৩০ জানুয়ারি লেখা পত্রটিতে লেখা হয়…

“On Saturday also I had a sort of unarranged party. Mr. P.K Roy and young Mr. Mukherjee, Mr. Mohini and the Poet [Rabindranath] and presently Swami with Dr. Sirkar [Mahendralal]. It was quite a brilliant little gathering, for Mr. Tagore sang 3 of his own compositions in a lovely tenor — and Swami was lovely.”

এই চিঠিই বলে দেয় যে সেই আসরে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে বিবেকানন্দের দেখা হয়েছিল। অথচ আশ্চর্যের কথা এই দুই মহামানবের ব্যক্তিগত লেখাপত্রে কিন্তু কখনোই এই সাক্ষাৎকারের বিষয়ে কোনো প্রকার প্রসঙ্গ উল্লিখিত হয়নি। বিবেকানন্দর অকাল প্রয়াণের পর অবশ্য রবীন্দ্রনাথ কলম ধরেছিলেন এই সন্ন্যাসীর জন্য। ১৯০২ সালের জুলাই মাসের ৪ তারিখে বিবেকানন্দ ইহলোক ত্যাগ করেন। ঠিক তার পরেই জুলাই মাসের ১২ তারিখে ভবানীপুর সাউথ সাবার্বান স্কুলে একটি শোকসভায় সভাপতির আসন অলংকৃত করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। এরপর সাধারণ ব্রাহ্মসমাজে এক ছাত্রসভায় রবীন্দ্রনাথ উপস্থিত থেকে তাঁর স্মরণে বলেন,

“অল্পদিন পূর্বে বাংলাদেশে যে-মহাত্মার মৃত্যু হইয়াছে, সেই বিবেকানন্দও পূর্ব ও পশ্চিমকে দক্ষিণ ও বামে রাখিয়া মাঝখানে দাঁড়াইতে পারিয়াছিলেন। ভারতবর্ষের ইতিহাসের মধ্যে পাশ্চাত্যকে অস্বীকার করিয়া ভারতবর্ষকে সংকীর্ণ সংস্কারের মধ্যে চিরকালের জন্য সংকুচিত করা তাঁহার জীবনের উপদেশ নহে।” 

এও বলেছেন,

“গ্রহণ করিবার, মিলন করিবার, সৃজন করিবার প্রতিভাই তাঁহার ছিল। তিনি ভারতবর্ষের সাধনাকে পশ্চিমে ও পশ্চিমের সাধনাকে ভারতবর্ষের দিবার ও লইবার পথ রচনার জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করিয়াছিলেন।”

Vivekananda by Rabindranath facsimile ‘বিবেকানন্দ’ শিরোনামে রবীন্দ্রনাথের লেখা পাণ্ডুলিপি

১৯০৮ সাল নাগাদ রবীন্দ্রনাথের ‘পূর্ব ও পশ্চিম’ প্রবন্ধে এই বক্তৃতা মুদ্রিত হয়। পরবর্তীকালে তিনি বহু রচনায় বিবেকানন্দ সম্পর্কে অনেক উচ্চকিত প্রশংসাও করেছেন। যেমন ‘পথ ও পাথেয়’, ‘প্রাচ্য ও প্রতীচ্য’ প্রবন্ধ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ১৯২৮ সালে ৯ এপ্রিল, সরসীলাল সরকারকে একটি চিঠিতে লিখেছেন,

“বাংলাদেশের যুবকদের মধ্যে যে সব দুঃসাহসিক অধ্যবসায়ের পরিচয় পাই তার মূলে আছে বিবেকানন্দের সেই বাণী যা মানুষের আত্মাকে ডেকেছে, আঙ্গুলকে নয়। ভয় হয় পাছে আচারের সংকীর্ণ অনুশাসন সেই নবোদ্বোধিত তেজকে চাপা দিয়ে ম্লান করে দেয় — কঠিন তপস্যার পথ থেকে যান্ত্রিক আচারের পথে দেশের মনকে ভ্রষ্ট করে।” 

এছাড়াও ১৯২৯ সালের ফেব্রুয়ারি-মার্চ নাগাদ স্বামী অশোকানন্দকে চিঠিতে বিবেকানন্দের বাণীর প্রসঙ্গে অনেক কথা লেখেন। বলেন, বিবেকানন্দের বাণী সম্পূর্ণ মানুষের উদ্বোধন বলেই কর্মের ও ত্যাগের মধ্যে দিয়ে মুক্তির বিচিত্র পথ দেখায়। এর আগে, ১৯২৬ সালে ফরাসি দার্শনিক রঁমা রঁলার সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় কবি এই বীর সন্ন্যাসীর আত্মত্যাগের কথা গভীরভাবে স্মরণ করেন। একটি কথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে রবীন্দ্রনাথ তাঁর সমসাময়িক মনীষীদের মতের সঙ্গে অমিল সত্ত্বেও মানবতার স্বার্থে সবসময়ই তাঁদের জীবন দর্শনের মাহাত্ম্যকে প্রাধান্য দিয়েছেন। এখানেই তিনি অনন্য। 

গ্রন্থ ঋণ:

১) রবিজীবনী ৪র্থ ও ৫ম খণ্ড : প্রশান্তকুমার পাল
২) রবীন্দ্রজীবনী ১ম-৪র্থ খণ্ড : প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়
৩) বিশ্বভারতী পত্রিকা ১৩৭১ মাঘ-চৈত্র
৪) প্রবাসী ১৩৩৫ জৈষ্ঠ্য
৫) The Bengalee পত্রিকা ২৩ অক্টোবর ১৯০৪
৬) সঙ্গীত-কল্পতরু ১২৯৪ বঙ্গাব্দ
৭) প্রবন্ধ পঞ্চাশৎ প্রসঙ্গ রবীন্দ্রনাথ: অমিত্রসূদন ভট্টাচার্য 

Pitam Sengupta

প্রাক্তন সাংবাদিক। পড়াশোনা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে। ষোলো বছর বয়স থেকে কলকাতার নামী পত্রপত্রিকায় লেখালেখির হাতেখড়ি। ছোটোদের জন্য রচিত বেশ কিছু বই আছে। যেমন 'বিশ্বপরিচয় এশিয়া', 'ইয়োরোপ', 'আফ্রিকা' সিরিজ ছাড়া 'দেশবিদেশের পতাকা', 'কলকাতায় মনীষীদের বাড়ি', 'ঐতিহাসিক অভিযান', 'শুভ উৎসব' ইত্যাদি। এছাড়া বর্তমানে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে নানা গবেষণার কাজে নিবেদিত। ইতিমধ্যেই এই বিষয়ে দুটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। 'রবীন্দ্র-জীবনে শিক্ষাগুরু' এবং 'রবীন্দ্র-গানের স্বরলিপিকার'। বর্তমানে একটি বাংলা প্রকাশনা সংস্থায় সম্পাদক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *