রোজ় আউসল্যান্ডারের কুমারী নাম ছিল রোজ়ালি বিয়াত্রিচে শ্যের্জার। জন্ম ১৯০১ সালের ১১ মে, বুকোভিনায়, যা ছিল জারনোভিৎস্-এ, অস্ট্রো-হাঙ্গেরীয় সাম্রাজ্যের অংশ। ১৯২১ সালে বন্ধু ইগনাজ় আউসল্যান্ডারের সঙ্গে নিউ ইয়র্কে চলে যান, তাঁর সঙ্গে বিবাহ হয় ১৯২৩ সালে। আমেরিকায় কবিতাচর্চা, জার্মান ভাষায় পত্রিকা সম্পাদনার কাজ অব্যাহত ছিল। ১৯২৬ সালে আমেরিকার নাগরিকত্ব পেলেও ফিরে আসেন বুকোভিনায়, অসুস্থ মাকে দেখাশোনার জন্য। এর মধ্যে ঘটে গিয়েছে বিবাহবিচ্ছেদ। ১৯৩৯ সালে প্রকাশিত হল প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘ড্যের রেগেনবোগেন’ (Der Regenbogen, অর্থ – রামধনু)। বইটির একটা বড় অংশের প্রিন্ট নষ্ট হয় ১৯৪১ এ বুকোভিনায় নাৎসি আগ্রাসনের ফলে। ইহুদি হওয়ার দরুণ সেই সময় প্রায় বছর দুয়েক ক্রীতদাসীর মত ঘেটোতে (Ghetto) থাকতে বাধ্য করা হয়েছিল তাকে। নাৎসিবাহিনীর অত্যাচার থেকে বাঁচবার জন্য রোজ় অসুস্থ মাকে নিয়ে অজ্ঞাতবাসে ছিলেন প্রায় ১৯৪৪ অবধি, যতদিন না রাশিয়ান সেনা যুদ্ধে জিতে অধিকার করে নিয়েছিল বুকোভিনা।
এই সময়ে তাঁর দেখা হয় পল সেলানের সঙ্গে; তৈরি হয় মুক্তমনা সাহিত্যিকদের সঙ্ঘ। কবিতার ভাষা বদলে যায় রোজ়ের। হতাশা, যুদ্ধের অস্থিরতা, উঠে আসতে থাকে তাঁর লেখায়। বিরতিহীন অস্থিরতার প্রকাশ হিসেবেই কবিতায় কোনও যতিচিহ্ন থাকছিল না সে ভাবে। ১৯৪৪ সালে মায়ের মৃত্যুর পরে মানসিক, শারীরিকভাবে বিধ্বস্ত রোজ় ফিরে যান নিউ ইয়র্কে। যুদ্ধে বেঁচে পালিয়ে আসা জার্মান ভাষাভাষী ইহুদিদের সমিতি ‘দ্য নিউ ইয়র্কার্স’-এ যোগ দেন। ১৯৪৮ সালে আমেরিকান নাগরিকত্ব ফিরে পান। জার্মান ভাষার পাশাপাশি ইংরেজিতেও শুরু হয় লেখালেখি। ১৯৫৬ সালে প্রকাশিত হয় কাব্যগ্রন্থ ‘ব্লিন্ডার্ জোম্মার্’ (Blinder Sommer, অর্থ -অন্ধ গ্রীষ্ম)। আবার ইউরোপে যাতায়াত চলতে থাকে। অবশেষে ১৯৭১ সালে ডুসেলডর্ফে থিতু হন। অসুখে প্রায় পঙ্গু হয়ে গেলেও বন্ধ হয়নি তাঁর সৃষ্টি। মুখে বলে যেতেন কবিতা, খাতায় টুকে রাখতেন তার সহকারী। ১৯৮৮ সালে মৃত্যুর আগে শেষদিন পর্যন্ত জার্মানিতেই ছিলেন রোজ় আউসল্যান্ডার।
স্বীকারোক্তি
আমি আমার ঋণ স্বীকার করছি
পৃথিবীর কাছে
তার সমস্ত গোপন রহস্যের কাছে
তুষারকণা এবং বৃষ্টির কাছে
গাছ এবং পাহাড়ের কাছে
মাতৃত্বময়ী হন্তারক
সূর্যের কাছে
জলের কাছে
তার বহতা ধারার কাছে
দুধের কাছে এবং রুটির কাছে
কবিতার কাছে
সব মানুষের রূপকথার কাছে
যা বোনা হয়
মানুষকে ঘিরে
সবার কাছে ঋণ স্বীকার করছি
সমস্ত শব্দ দিয়ে
যা আমাকে নির্মাণ করেছে
[‘বেকেন্টনিস্’ (Bekenntnis) কবিতা অবলম্বনে লেখা]
বৃষ্টি হয়
হেমন্তের বেলায়
বাড়িগুলোর সেরকম কোনও
ঠিকানা থাকে না।
তুমি জানো না
কোথায় হারিয়ে যাবে
তুমি দেয়ালের সঙ্গে
বসন্তঋতুর বিষয়ে
কথা বল।
জানালা খুলে তুমি
রামধনু দেখতে পাও।
নতুন বিদেশী আগন্তুক
বাড়ি খুঁজতে আসে।
তাদের ভেজা পদক্ষেপে
ধাক্কা লাগে তোমার
হৃদিস্পন্দনে
তুমি বিদেশি বসন্তের বিষয়ে
দেওয়ালের সঙ্গে কথা বল।
বৃষ্টি হয়ে চলে।
[‘এস্ রেগ্নেট’ (Es regnet) কবিতা অবলম্বনে লেখা]
বিস্মিত
টেবিল যখন রুটির সুগন্ধে ভরে থাকে
ওয়াইনের ক্রিস্টাল গ্লাসে স্ট্রবেরি
তখন ধোঁয়া দিয়ে তৈরি চেম্বারটার কথা ভাবি
ধোঁয়া-গ্যাসের কোনও আকার নেই
এখনও ছাড়া হয়নি
ঘেটোর পোশাক
আমরা সুরভিত টেবিলটা ঘিরে বসি
বিস্মিত
যে আমরা এখন এখানে বসে আছি
[‘ফারভুন্ডার্ট’ (Verwundert) কবিতা অবলম্বনে লেখা]
মাতৃভূমি
আমার পিতৃভূমি এখন মৃত
ওরা তাকে কবর দিয়েছে
আগুনের মধ্যে
আমি বাস করি
আমার মাতৃভূমি
শব্দের মধ্যে
[‘মুট্টারলান্ড’ (Mutterland) কবিতা অবলম্বনে লেখা]
শব্দের মধ্যে
আমরা বসবাস করি
এক একটা শব্দের মধ্যে
বলো তুমি
হে আমার বঁধূ
আমি যে শব্দে থাকি
সেটা হল
‘তুমি’
[‘ভর্ট আন ভর্ট’ (Wort an Wort) কবিতা অবলম্বনে লেখা]

সৌভাগ্য
আমি ঘুমোতে চাই
হাওয়া এসে দোলা দেয় আমাকে
আমার অপেক্ষা ঘুমপাড়ানি গান গায়।
আমি কাঁদতে চাই।
এমনকী ফুলগুলো একা একা আমার কাছে
ফিসফিসিয়ে অশ্রুপাত করে।
গাছের পাতাগুলির দিকে তাকাও
ওরা হাওয়ায় ঝিকমিক করছে
এবং কোথাও যেন স্বপ্ন বুনে দিচ্ছে আমার জন্য।
হ্যাঁ, এবং তারপরেই
কোথায় যেন হেসে উঠছে একটি শিশু
এবং কোথায় যেন জেগে উঠছে আশা।
অপেক্ষা আছে আমার
সৌভাগ্যের জন্য?
সৌভাগ্যের জন্য।
আমি তাকে প্রশ্ন করব:
তুমি কি ফিরে এসেছ?
তাহলে আর কখনও ফিরে যেও না।
[‘দাস্ গ্ল্যুক’ (Das Glück) কবিতা অবলম্বনে লেখা]
জন্ম জুলাই, ১৯৭১, কলকাতায়। ২০০৩ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভূবিদ্যায় পিএইচডি। গল্প, কবিতা লেখালেখি ছাড়াও ইংরেজি এবং জার্মান ভাষা থেকে অনুবাদের কাজ বিশেষ পছন্দের। ২০১৬ সালে প্রকাশিত প্রথম কবিতার বই ‘অরণ্যমেঘবন্ধুর দল’ বিশেষ সমাদৃত হয়েছে।
বাঃ! অনেক ধন্যবাদ এই অনুবাদের জন্য!
স্বাগত!