১৯৬১ থেকে ১৯৯৫ ‘এক্ষণ’ পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছিল। ঘোষণায় দ্বিমাসিক থাকলেও পত্রিকাটি প্রথম কয়েক বছর নিয়মিত প্রকাশিত হয়ে পরবর্তীকালে অনিয়মিত ভাবে প্রকাশ হতে থাকে। পরে বছরে একটি সংখ্যাই প্রকাশিত হত। এই চৌত্রিশ বছরে বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতির জগতে ‘এক্ষণ’ একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বাঙালি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত মহলে ‘এক্ষণ’-এর এই অসামান্য প্রতিষ্ঠাপ্রাপ্তির অন্যতম কারণ, বন্ধু নির্মাল্য আচার্যের সঙ্গে তৎকালীন সিনেমায় সত্যজিৎ রায়ের ‘অপুর সংসার’-এ অভিনয়ের সুবাদে খ্যাতিমান অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের নাম যুক্ত হয়। সত্যজিৎ রায়ের নামটিও এই পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত হয়ে গেল প্রাথমিকভাবে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সুবাদে। ‘এক্ষণ’ নামটি সত্যজিৎ রায় নির্বাচন করেছিলেন। সম্পাদকদ্বয় সেই নাম সানন্দে শুধু নয়, সাগ্রহে গ্রহণ করেন। শিল্পী সত্যজিৎ রায়ের অসাধারণ ক্যালিগ্রাফিতে সমৃদ্ধ হল ‘এক্ষণ’ পত্রিকার প্রচ্ছদ। ফলে প্রচ্ছদ হয়ে উঠল অন্যতম ঐতিহাসিক আকর্ষণ।



এই পত্রিকায় সত্যজিৎ রায়ের বন্ধু কমলকুমার মজুমদার-সহ অনেকেই লেখা শুরু করলেন। অতীতের প্রখ্যাত মহিলাদের আত্মজীবনী, কলকাতা নিয়ে গবেষণামূলক প্রবন্ধ এবং সত্যজিৎ রায়ের চিত্রনাট্য ছাপা হল ‘এক্ষণ’-এ। সেই সঙ্গে প্রকাশিত হল মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ডায়রি, মার্কস সংখ্যা, দান্তে সংখ্যা। শিক্ষিত বাঙালির গর্বের পত্রিকা হয়ে উঠল ‘এক্ষণ’। যাঁরা সচরাচর বাজারি পত্রিকায় লিখতেন না, সেই সব প্রাবন্ধিকরা ‘এক্ষণ’-এর নিয়মিত লেখক হয়ে উঠলেন৷ সত্যজিৎ-সুবাদে কুরোসাওয়ার লেখা ছাপা হল ‘এক্ষণ’-এ। অর্থনীতিবিদ অশোক মিত্র ‘এক্ষণ’ প্রসঙ্গে লিখেছিলেন:

“কফি হাউসে যে তরুণ সম্প্রদায় এই টালমাটাল সময়ে আড্ডা দিতেন সকাল থেকে নিশিমুহূর্ত পর্যন্ত এ-টেবিল থেকে ও-টেবিলে ছিটকে ফেরা, তর্কে মাতামাতি, সিগারেটের ধোঁয়া, কল্পনা, শপথ উচ্চারণ, প্রতিজ্ঞা। এরকম হঠাৎ একটি প্রতিজ্ঞা থেকে ‘এক্ষণ’। তখন সৌমিত্র থাকতেন পূরবী সিনেমার উলটো দিকের রাস্তায়। নির্মাল্য থাকতেন নবীন কুণ্ডু লেন-এ। সৌমিত্র আকাশবাণীর চাকরি এবং অভিনয়ের কারণে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এম.এ পড়া ছেড়েছেন; কিন্তু বাংলা সাহিত্যের ছাত্র সৌমিত্র সাহিত্যচর্চা, কবিতা লেখা ছাড়েননি। ছাড়েননি বন্ধুদের। সেই বন্ধুদের উৎসাহ প্রণোদনায় এক সন্ধ্যায়ে সৌমিত্র রাজি হলেন একটি বাংলা পত্রিকার সম্পাদক হতে, যার নাম তখনও স্থির হয়নি।”

সৌমিত্রের নিজের মুখের কথায় আমরা জানতে পারি ‘এক্ষণ’-এর সূচনার কাহিনি। ‘অনুষ্টুপ’ পত্রিকার এক সাক্ষাৎকারে এ-বিষয়ে সৌমিত্র বলেছেন:

“এক্ষণ প্রকাশিত হবার বহু আগে থেকেই একটা কথা বারবার ভাবা হয়েছে। বন্ধুদের মধ্যে। আমরা বারবার আলোচনা করেছি, একটা নতুন করে পত্রিকা করা দরকার। আশপাশের কয়েকজন বন্ধু মিলে ‘বীক্ষণ’ নামে একটা কাগজ বার করেছিল। এরকম দু’চার জন অন্য কাগজ বের করেছে। আমরা ভেবেছি বের করব, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেটা মেটেরিয়ালাইজ করেনি। সেই ইচ্ছেটা অনেক পরে ষাট সালের আগে এরকম দানা বাঁধেনি। ১৯৬১ সালে ‘এক্ষণ’ বের করার আগে নির্মাল্য একদিন আমায় বলে (তখন আমরা কফি-হাউস থেকে ফিরছি) একটা কাগজ সিরিয়াসলি বার করতে হবে, সাহিত্য-সংস্কৃতি বিষয়ক কাগজ। আমি বললাম, সে তো ভালো কথা। নির্মাল্য বলল, আমার একটা কন্ডিশন আছে। কী? না তোকে থাকতে হবে। আমি উলটো শর্ত দিলাম, আমি না থাকলে তুই যদি চালাতে পারিস তাহলে বল। আমি এর পেছনে আছি বা তোর সঙ্গে থাকব। নির্মাল্যর বক্তব্য ছিল, সেটা হয় না। সে কী করে বলব? তোকে আমার লাগবে, তুই না থাকলে আমি পারব না।”

হয়তো এভাবেই উল্লেখযোগ্য একটি পত্রিকার জন্ম হয়। নির্মাল্য আচার্য ঠিকই ভেবেছিলেন, যে সৌমিত্র ছাড়া ‘এক্ষণ’ হয়ে ওঠা অসম্ভব ছিল। কারণ সাহিত্যের প্রতি সৌমিত্র-র অনুরাগ তাঁর নিজের অধ্যয়ন, পারিবারিক সংস্কৃতি নিজের কবিতা লেখার আগ্রহ থেকে৷ সেই সঙ্গে তাঁর বন্ধুপ্রীতির কথা উল্লেখ করতে হয়৷ ভুললে চলবে না, সৌমিত্র তখন সত্যজিৎ রায়ের সিনেমা ‘অপুর সংসার’-এ নায়কের ভূমিকায় অসাধারণ সাফল্যের সুবাদে নতুন নায়ক। বাঙালি মধ্যবিত্তদের চোখে তিনি একজন আইকন। সবে পা দিয়েছেন তাঁর সাফল্যের প্রথম সিঁড়িতে। এই সময় তিনি একটি পত্রিকার যুগ্ম-সম্পাদক হতে রাজি হচ্ছেন বন্ধুর অনুরোধে। দরিদ্র পরিবারের বন্ধু নির্মাল্যকে সঙ্গে করে নিয়ে যাচ্ছেন সত্যজিৎ রায়ের কাছে। সত্যজিৎ রায় সৌমিত্রর অনুরোধে পত্রিকার নাম ঠিক করে দিচ্ছেন এবং প্রচ্ছদ এঁকে দিচ্ছেন—এই ত্রিবেণী সঙ্গমে জন্ম হচ্ছে বাংলা ভাষায় সাহিত্য সংস্কৃতিচর্চার এক নয়া পরিসর। সৌমিত্র না থাকলে পত্রিকার নাম ‘এক্ষণ’ হত না হয়তো, আর সৌমিত্র না থাকলে এই পত্রিকার জয়যাত্রার সূচনাও হত না।

পত্রিকা করার সিদ্ধান্তে রাজি হবার পর কী কী কাজ করতেন সৌমিত্র? কীভাবে জড়িত ছিলেন শত ব্যস্ততার মধ্যে? পরে নির্মাল্য আচার্য আশুতোষ কলেজে বাংলা পড়াতেন, ইন্দ্রনাথ মজুমদারের প্রকাশনা সুবর্ণরেখায় বসতেন। কিন্তু প্রথমদিকে যখন সুবর্ণরেখা হয়নি, ১৯৬৬ পর্যন্ত তো নয়ই, তাহলে কোথা থেকে প্রথম প্রকাশিত হল ‘এক্ষণ’? সৌমিত্রের বয়ানে তা জানা যায়:

“কথাশিল্পে আমরা বসতাম পরে। প্রথম সংখ্যা যখন বার করছি তখনই কলেজ রো-তে নির্মলেন্দু ভদ্র বলে একজন ছিলেন, তাঁর একটা পাবলিশিং হাউস ছিল, সেটাই আমাদের প্রথম অফিস। সেখান থেকেই প্রথম ‘এক্ষণ’ বেরিয়েছিল। সেখান থেকে পরে সরে যেতে বাধ্য হই, কথাশিল্পে আশ্রয় নিই।”

এক্ষণ পত্রিকার বিভিন্ন সময়ের প্রচ্ছদ*


সৌমিত্র যে কেবল সত্যজিৎ রায়কে ‘এক্ষণ’-এর প্রচ্ছদ আঁকার ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ রেখেছিলেন তাই নয়, সত্যজিতের বন্ধুদের দিয়ে লেখানো শুরু করেছিলেন, যাঁদের মধ্যে কমলকুমার মজুমদার অন্যতম। সৌমিত্রর ভাই অভিজিৎ, স্ত্রী দীপা এবং অশোক পালিতের মতো বন্ধুরা লেগে পড়েছিলেন ‘এক্ষণ’-এর কাজে। প্রসঙ্গটা যখন উঠলই, তখন জানাতে হয় লেখা শুধু সংগ্রহ নয়, নিয়মিত সে-সব লেখা পড়ে দেখতেন সৌমিত্র। সাহিত্যরুচি বোধ তাঁকে একজন ভাল সমালোচকের ক্ষেত্র নির্মাণে সাহায্য করেছিল যা তাঁর অভিনয় জীবনের ক্ষেত্রেও সহায়ক হয়েছিল। তিনি কমলকুমার মজুমদার সম্পর্কে বলছেন:

“… কমলকুমার সম্বন্ধে বেশি কিছু জানতাম না, জাস্ট ভাসা ভাসা জানতাম, কমলদার নাটকের ব্যাপার, সাহিত্যকৃতি সম্বন্ধে সম্যক পরিচয় ছিল না৷ ‘বাতায়ন’ বলে একটি পত্রিকায় ওঁর উপন্যাস বেরিয়েছিল, নাম ‘অন্তর্জলি যাত্রা…গল্পটা আনার সময় অশোক (পালিত) গিয়েছিল, তখন থাকতেন উনি কেষ্টপুরের বারিতে। গল্পটা এখনও মনে আছে। রুলটানা কাগজে লেখা। অসাধারণ ভালো হাতের লেখা। নাম ‘গোলাপসুন্দরী’, নামেতেই একটা বিস্ময় জাগে। এটা কী নাম?…সত্যি কথা বলতে কি আমরা মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। তখন এই ধরনের গল্প পড়িনি, বিশেষ করে এই ভাষা…পরীক্ষা-নিরীক্ষা। ভাষাকে গদ্য গল্পের মধ্যে যে কবিতা করে তোলা যায়…ইঙ্গিতময় করে তোলা যায়…অথচ আপাত একটা পুরাতনী চাল। পুরাতন বাংলার চালচলন গ্রহণ করে নতুন ভাষা তৈরি করছেন। কথ্য রীতি সিনট্যাক্স থেকে ইচ্ছে করে সরিয়েই পুরাতনী, কিন্তু জিনিসটা মোটেই পুরাতন জিনিস নয়…এটা বিদ্যাসাগরের ভাষা হতে পারে না। এটা একজন আধুনিক লেখকের ভাষা।”

কমলকুমার মজুমদারের লেখা নিয়ে সেই ১৯৬১ সালের প্রেক্ষিতে আলোচনা করছেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, যখন তাঁর এই গদ্যরীতি নিয়ে তীব্র সমালোচনা করছেন অনেকে, বলছেন, ইচ্ছে করে এমন দুর্বোধ্য লেখা লেখেন কমলকুমার। কিন্তু অভিনেতা সৌমিত্রর বাংলা ভাষা-সাহিত্যের ওপর কতখানি দখল থাকলে তিনি কত আগে থেকে ভাবতে পেরেছিলেন এই নিগূঢ় সত্য যে কমলকুমার একজন সত্যিকারের আধুনিক লেখক। বৌদ্ধিক ক্ষেত্রে এই অসামান্যতা আমরা অন্য সম্পাদকের কাছ থেকে পাইনি। যে জন্য শেষ দিকে দুঃখ করে নির্মাল্য আচার্যকে চিঠি লিখেছিলেন কমলকুমার এই মর্মে যে ‘এক্ষণ’-এ তাঁর লেখা নিয়মিত ছাপা হলেও সম্পাদক ‘পড়িয়া’ দেখেন না। এই চিঠি যখন লেখা হয়েছিল সৌমিত্র তখন ‘এক্ষণ’ থেকে সরে গিয়েছেন।



তিনশোর ওপর বাংলা সিনেমায় অভিনয় করা এই মানুষটির বৌদ্ধিক চেতনার ক্ষেত্রে এই সম্পাদনার কাজ ছিল গুরুত্বপূর্ণ। সেই কলেজজীবনে বন্ধু গৌরমোহনের হাত ধরে শিশির ভাদুড়ীর কাছে দীক্ষা এবং শিক্ষা গ্রহণ করে তিনি যে ধীশক্তি এবং অসাধারণ চরিত্র সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন তার পেছনে ‘এক্ষণ’ পত্রিকা সম্পাদনার ভূমিকা সৌমিত্র কখনও অস্বীকার করেননি।

এখন পর্যন্ত সৌমিত্রর বয়ানে আমরা সম্পাদক সৌমিত্র সম্বন্ধে জেনেছি, এবার দেখা যাক সৌমিত্রর স্ত্রী দীপা চট্টোপাধ্যায়ের বলা কাহিনিটিতে আমরা সমবেতভাবে সম্পাদনার অন্য এক ইতিহাস পাই কিনা। কেননা সৌমিত্র প্রথম থেকে জানতেন যে কোনও কাজ একা বা দু’জন করা যায় না। সেজন্যই খুবই দূরদর্শিতার সঙ্গে সত্যজিৎ বা তাঁর প্রিয় মানিকদার শরণাপন্ন হয়েছিলেন। প্রেসের কাজ প্রুফ দেখার কাজ করতেন নির্মাল্য আচার্য, কিন্তু অর্থ সংগ্রহের কাজ, বিজ্ঞাপন জোগাড় করা ইত্যাদি মূলত করতেন সৌমিত্র। বলা বাহুল্য, সৌমিত্র অন্যতম সম্পাদক না হলে ‘এক্ষণ’ পত্রিকা গৌরবান্বিত হত না, অন্তত প্রাথমিক পর্যায়ে। দীপা চট্টোপাধ্যায়, ‘এক্ষণ’-এর সূচনার কর্মকাণ্ড সম্পর্কে সাক্ষাৎকারে অনেক কথা বলেছিলেন:

“১৯৬০ সাল থেকেই ওকে একটা কাগজ করার ব্যাপারে ভাবতে দেখেছি। আমার বিয়ের কিছুদিন পর থেকেই এ-কথা নিয়ে আলোচনা, বসা। একদিন কফি-হাউস থেকে বার হচ্ছি আমি সৌমিত্র, সঙ্গে নির্মাল্য ছিল—পুরো রাস্তা হাঁটতে হাঁটতে এক্ষণের জন্ম হল বলতে পার। আমি খুব সক্রিয়ভাবে ছিলাম। গগনদার ভাই তপনদা, সৌমিত্রর ভাই অভিজিৎ—এরাও সবাই ছিল। সবাই খুব স্বতঃস্ফূর্তভাবে কাজ করত। কাঁধে করে প্রেস থেকে পত্রিকা নিয়ে আসত। হ্যাঁ, কত লোকের কাছে যে কত ঋণ আছে তা বলার নয়।
তারপর ধরো, এখানে যাওয়া, ওখানে যাওয়া, গ্রাহক সংগ্রহ করা। বড় বড় লোকেরা আসছেন তাঁদের ডিনারে ডাকা, কখনও একে ডাকা, ওকে ডাকা—ড্রিঙ্কস্, স্ন্যাকস্—মানে এগুলো সব আমিই দেখতাম। বিনয় ঘোষ আমার রান্না খেতে খুব ভালবাসতেন—তারপর পার্থসারথি চৌধুরী।— তারপর কাগজের দাম বাড়ল—এই যে সব ভাল-মন্দ—ভাল লেখা, নতুন লেখকদের লেখা—বুঝতে পেরেছ, প্রত্যেকটি বড় এপিসডিক প্রাইস ছিল, আনন্দটা ছিল। অনেক সময় পত্রিকা কম বিক্রি হল, তার জন্য মনঃক্ষুণ্ণ হওয়া…”

‘এক্ষণ’-এর মতো পত্রিকার সূচনা পর্বে, আমার মতে, নির্মাল্য আচার্যের চাইতে বড় এবং বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের ভূমিকা। নির্মাল্য ছিলেন গম্ভীর প্রকৃতির এবং সবার সঙ্গে মেলামেশার ধাত তাঁর ছিল না। তা ছাড়া তাঁর পরিচিতি খুব একটা ছিল না, তিনি প্রথম থেকেই বুঝেছিলেন একটা লম্বা ইনিংসের গোড়াপত্তনে সৌমিত্র হবেন গাভাসকার। তারপর যুক্ত হলেন ডন ব্র্যাডম্যান স্বরূপ সত্যজিৎ রায়, ফলে খুব দ্রুত এল ‘এক্ষণ’-এর প্রতিষ্ঠা। সাহায্য সহযোগিতার অভাব হল না। সৌমিত্রের সহযোগিতা বন্ধুত্বের কারণে এবং সেই সঙ্গে সৌমিত্র-র পরিচালক সত্যজিতের সংস্পর্শে আসার সুবাদে নির্মাল্য আচার্যর নামডাক হল। সৌমিত্র ব্যস্ততা বৃদ্ধি পাওয়ার জন্য সময় দিতে পারছিলেন না, তখন ‘এক্ষণ’ পত্রিকার মেন্টর হয়ে উঠলেন সত্যজিৎ রায়। কিন্তু সেটা আর একটু পরের কথা।

এই প্রসঙ্গে আমি আমার একটি অভিজ্ঞতার কথা না লিখে পারছি না৷ ১৯৬৯-৭০ সালে আমি তখনকার বড় কোম্পানি ‘ডানলপ’-এর পিআর-র সঙ্গে দেখা করার অনুমতি পেলাম একদিন সকাল ১০টা নাগাদ। উদ্দেশ্য, অনুষ্টুপ-এর জন্য একটি বিজ্ঞাপন সংগ্রহ করা। সকাল দশটা থেকে তীর্থের কাকের মতো বসে আছি। এগারোটা, বারোটা, একটা এমনকী দুটো বেজে গেলেও মহামান্য পিআর-এর ডাক আসে না। এর মধ্যে এক চাঞ্চল্য, নায়ক সৌমিত্র এলেন, সঙ্গে দীপা চট্টোপাধ্যায়। এক ঘণ্টা থাকলেন, তারপর পিআর সহাস্যে বেরিয়ে এলেন। সঙ্গে একজন বেয়ারা, একটি কাঠের পাত্রে বিজ্ঞাপন-এর ব্লক। সৌমিত্র ও দীপা হাত নেড়ে বিজ্ঞাপন নিয়ে চলে গেলেন। সেদিন আর বাঙালি জনসংযোগ কর্তা আমার সঙ্গে দেখা করলেন না। খুব রাগ হচ্ছিল, কেননা এই লোকটি আমাকে আসতে বলে সময় দিয়েছিলেন। অসহায় হয়ে স্ট্যান্ডার্ড ফটো এনগ্রেভিং-এর দ্বিজেনবাবুর কাছে গেলাম। সেখানে আমাদের প্রচ্ছদ ছাপা হত। তিনি হেসে জিজ্ঞাসা করলেন, “কী ব্যাপার৷ মুখটা এত শুকনো দেখাচ্ছে কেন?” দুঃখে অসহায় আমি বললাম, “এখনই প্রচ্ছদ ছাপা যাবে না, বিজ্ঞাপন পাইনি। আমাদের তো আর ম্যাটিনি আইডল নেই, যে বিজ্ঞাপন জোগাড় করে দেবেন।” দ্বিজেনবাবু, নির্মাল্যবাবুকে কথাটা বলে দিয়েছিলেন, কেননা তখন একই জায়গায় অনুষ্টুপ-এর প্রচ্ছদ ছাপা হত, নির্মাল্যবাবু রেগে গিয়ে দ্বিজেনবাবুকে বলেছিলেন, “ছোঁড়াটা অতি পক্ব তো!”

আমার এই কাহিনি বলার কারণ, সৌমিত্র যতদিন যুগ্ম-সম্পাদক ছিলেন, ‘এক্ষণ’-এর কাজ করে দিয়েছেন। কিন্তু অভিনেতা সৌমিত্রর ওপর চাপ বাড়ছিল, তিনি আর সময় দিতে পারছিলেন না। ‘এক্ষণ’-এর সংকট সেই সময় থেকে শুরু হল। সেই সংকটের কথা কবি শঙ্খ ঘোষের লেখা থেকে জানা যায়,

“দান্তে সংখ্যা বেরিয়ে যাবার কিছুদিন পরে সেই নির্মাল্য এক দুপুরবেলায় একদিন হাজির হয়েছিলেন সৌমিত্রকে নিয়ে। দুপুরবেলাতেই কেন? সৌমিত্রকে নিয়ে কেন? বহুক্ষণ সেদিন কথা হয়েছিল ‘এক্ষণ’-এর ভাবী পরিকল্পনা নিয়ে এবং এমন একটা সম্ভাবনা নিয়ে যে হয়তো বন্ধ হয়ে যেতে পারে ‘এক্ষণ’, সে কী কথা! সৌমিত্র তাঁর অভিনয় জীবন নিয়ে তখন এতই ব্যস্ত যে তাঁর মনে হচ্ছে পত্রিকার জন্য তিনি আর সময় দিতে পারছেন না, আর তাই একেবারে একা হয়ে পড়েছেন নির্মাল্য, সেই কারণেই, ওঁদের প্রস্তাব, নির্মাল্যর সঙ্গে বা এককভাবে আমি যদি নিই সম্পাদনার ভার।”



বলা বাহুল্য, শঙ্খ ঘোষ রাজি হননি সেই প্রস্তাবে। থেকে গিয়েছিলেন সৌমিত্র, অনেকটা বাধ্য হয়েই আরো বেশ কিছুকাল। এই হলেন সৌমিত্র, নাম ছাপা হবে অথচ দায়িত্ব থাকবে না, এটাতে সায় দেয়নি তাঁর অন্তরাত্মা। তিনি জানতেন ভবিষ্যতে সমস্যা হতে পারে, তবু অন্তর্গত সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রীতিবোধ তাকে বাধ্য করেছিল ‘এক্ষণ’-এর যুগ্ম সম্পাদক থাকতে।

‘এক্ষণ’ নিয়ে সৌমিত্র-নির্মাল্য যে সবসময় একমত ছিলেন, এমনটা নয়। দু’জনের মধ্যে মতভেদের কারণটা বোঝা খুব দুঃসাধ্য নয়। গল্প-কবিতার ক্ষেত্রে নির্মাল্য ছিলেন কিছুটা ঢিলেঢালা যদিও কখনো কখনো অসাধারণ গল্প ছাপা হয়েছে, যেমন– মহাশ্বেতা দেবীর ‘স্তনদায়িনী’, ‘গুরু’, অভিজিৎ সেন-এর ‘বর্গক্ষেত্র’। তিনি মূলত প্রবন্ধের দিকটাই বেশি ভাবতেন। কবিতাকে নির্মাল্য লেখা বলে ভাবতেন না। নির্মাল্য আচার্যের এমন ধারণা সম্পর্কে শঙ্খ ঘোষ, কিছুটা মজা করেই লিখেছিলেন:

“আমার সঙ্গে অবশ্য তার মৃদু দু’একটা রঙ্গ চলত কবিতার কথা নিয়ে৷…সেটা ছিল বোধহয় উনিশশো সত্তর সাল। শ্যামাচরণ দে স্ট্রিটের মুখে দাঁড়িয়ে অনুযোগ করে নির্মাল্য, অনেকদিন আমি লিখিনি তাঁর পত্রিকায়, সেই দান্তে সংখ্যার পর, হতভম্ব হয়ে যাই আমি। কেননা তারপর পরপর কয়েকটা সংখ্যাতেই ছাপা হয়েছে আমার লেখা—“লিখিনি? এমনকী গত সংখ্যাতে তো লিখেছি”, আন্তরিক বিস্ময়ে নির্মাল্য বলে, “গত সংখ্যায়? সে কী? কী লেখা আছে গত সংখ্যায়?” ‘ভূমধ্যসাগর’ নামে একটি কবিতা যে ছাপা হয়েছিল ক’দিন আগেই, সেটা মনে করিয়ে দিতেই ঠোঁটের কোনে তার বিখ্যাত সেই এক চিলতে হাসি ফুটিয়ে আর চোখের কৌতুক খেলিয়ে নির্মাল্য বলে। 
-“কবিতা? না-না আমি বলছিলাম লেখার কথা,”, 
-“কবিতা বুঝি লেখা নয়?”
-“কবিতা আবার লেখা হলো কবে? না-না কবিতা নয়, লেখা চাই।”

সাহিত্যের ছাত্র হিসেবে নির্মাল্য কি জানতেন না, কবিতা ‘লেখা’? কবিতা তো মনের নিগূঢ় অভিব্যক্তি। কবিতায় তো সাহিত্যের সৃষ্টিপথের সূচনা। বাল্মীকির সেই শোকদুঃখের অভিব্যক্তি দিয়েই তো শুরু মহাকাব্য রামায়ণের। হয়তো বাঙালি বেশি কবিতা-ঘেঁষা বলে, সুযোগ পেলেই কবিতা নামক পদ্য লেখে বলে সম্পাদকরা কখনো কখনো বিরক্ত হয়ে থাকেন। কিন্তু তাই বলে কবিতা ‘লেখা’ নয়, সৌমিত্রর পক্ষে সেটা মেনে নেওয়া সম্ভব ছিল না। 



 

আমি অন্য টেবিল থেকে নির্মাল্য আচার্যকে দেখতাম, তাঁকে কদাচিৎ হাসতে দেখেছি। সৌমিত্র কিন্তু তুলনায় সদা হাস্যময়। যখন পূরবী সিনেমার গলিতে থাকতেন, তখন ফাঁকা থাকলে কফি হাউসে আসতেন। পরে যখন দক্ষিণ কলকাতায় চলে গেলেন, তখন রোববার করে তাঁকে দেখা যেত। আমরা নিয়মিত দেখতে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম। নির্মাল্য আচার্য, পার্থসারথি চৌধুরী, সুনীল, শক্তিরা থাকতেন। একবার আমার স্ত্রীর এক বন্ধু, এক রোববার হঠাৎ সৌমিত্রকে কফি হাউসে সামনাসামনি দেখে ভ্যাবাচাকা খেয়ে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে সৌমিত্র-র অনিন্দ্যসুন্দর চেহারা দেখতে থাকল, অমনি পেছন থেকে আওয়াজ, ‘সিনেমার হিরো দেখে দাঁড়িয়ে পড়লে বালিকা?’ মেয়েটি বুঝতে পারে এখানে সৌমিত্রকে কেউ সিনেমার হিরো হিসেবে দেখে না, তিনি তাতেই স্বচ্ছন্দ, কেননা তিনি ‘উত্তমকুমার’ হওয়া পছন্দ করেন না। অন্যদিকে কফি হাউসে নিয়মিত সকালে দুপুরে একটি ফাঁকা টেবিলে বসে নির্মাল্য প্রুফ দেখেন, গম্ভীর তাঁর মুখ, কেউ তাঁর ধারে কাছে ঘেঁষতে পারে না। কাছে থেকে তিনি অনেক দূরের লোক। নির্মাল্য তাঁর নেহাত পছন্দের লোক ছাড়া কারো ঘনিষ্ঠতা পছন্দ করতেন না। সৌমিত্র সব রকমের মানুষের সঙ্গে মিশতেন রূপালি পর্দার নায়ক হওয়া সত্ত্বেও।

সৌমিত্রর ব্যস্ততা যখন বাড়তে থাকল, নির্মাল্য এবার মেন্টর হিসেবে খুবই কাছাকাছি চলে গেলেন সত্যজিৎ রায়ের। দীর্ঘকাল সৌমিত্রর সঙ্গে সম্পাদনায় লিপ্ত থাকার ফলে নির্মাল্য আচার্যের পরিচিতি তখন অনেক বেড়ে গিয়েছে। ফলে পত্রিকাটি হয়ে উঠল সত্যজিৎ-নির্ভর। স্ক্রিপ্ট ছাপার অনুমতি ছাড়া তিনি নিজে লেখা সংগ্রহ করে দিতেন। একবার দেখা গেল ‘শতরঞ্জ কি খিলাড়ি’ সিনেমাটি যখন বেরল, সেই সংখ্যা ‘এক্ষণ’-এ গুজরাটের হিরে-জহরতের অনেক বিজ্ঞাপন। সৌমিত্র ‘এক্ষণ’ থেকে নিজের নাম প্রত্যাহার করার পর, কখনো কখনো নির্মাল্যবাবুকে বিজ্ঞাপন যোগাড় করতে বেরোতে হত। প্রশ্ন হল, সৌমিত্র ‘এক্ষণ’ থেকে নিজের নামটি প্রত্যাহার করলেন কেন? নির্মাল্য-র সঙ্গে সম্পর্কটা কি এমন তিক্ততায় পৌঁছে গেল যে এক সময়ের ঘনিষ্ঠতম বন্ধুর সংস্রব তিনি ত্যাগ করতে বাধ্য হলেন? 



আমি এবং অশোক পালিত, নির্মাল্য আচার্যের প্রয়াণের পরে সৌমিত্রর সাক্ষাৎকার নিতে গিয়েছিলাম। অনুষ্টুপে ‘এক্ষণ নির্মাল্য আচার্য’ ক্রোড়পত্রে তা ছাপা হয়েছিল। তখন নির্মাল্যর সঙ্গে তাঁর দূরত্বের কারণ নিয়ে নানা ঘটনার কথা তিনি বলেছিলেন। পরে সে-সব কথা এডিট করে বাদও দিয়েছিলেন। এরকম একটি ঘটনার কথা মনে আছে, যা আর কোথাও লেখা যাবে না। সত্যজিৎ, শেষের দিকের সিনেমার এক পর্যায়ে কিছুদিন অসুস্থ হয়ে পড়েন। সৌমিত্র তাঁকে দেখতে যান। নির্মাল্য তখন সেখানেই ছিলেন৷ তিনি সৌমিত্রকে বলেন, “মানিকদার সঙ্গে এখন দেখা করা যাবে না। তিনি বিশ্রাম করছেন।” সৌমিত্র তখন নির্মাল্যকে বলেন, “আমি তোদের পুলু হলেও আমি সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। আমি মানিকদার কাছে যাব, আর তুই আমাকে আটকাবি?” নির্মাল্যর হাত ঠেলে সৌমিত্র ঘরে ঢোকেন। সত্যজিৎ তাঁর প্রিয় অভিনেতাকে সাদরে বসিয়ে অনেকক্ষণ কথা বলেন। একথা তিনি বললেও ছাপতে দেন নি। ছাপতে দেননি আরো অনেক ব্যক্তিগত কথা। এক্ষণ প্রসঙ্গে অনেক দুঃখের ক্ষোভের কথা। কিন্তু নির্মাল্য সম্পর্কে তার গভীর বন্ধুত্ব এবং একসঙ্গে এক্ষণ পত্রিকা করাটা ছিল তার গর্বের অভিজ্ঞতা৷ 

এই প্রসঙ্গে আর-একটি কথা না বললেই নয়৷ জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত বামপন্থী ভাবধারার শরিক ছিলেন সৌমিত্র। শোনা যায়, সরোজ দত্তের মত্যুর কথা উত্তমকুমারের কাছ থেকে শুনে তিনি মর্মাহত হয়েছিলেন এবং বন্ধুমহলে জানিয়ে দিয়েছিলেন। এক্ষণে বামপন্থী ভাবধারায় অজস্র প্রবন্ধ প্রকাশিত হবার পেছনে সৌমিত্র-র ভূমিকা অনস্বীকার্য৷ জীবনের শেষ লেখাটিতে তিনি বামপন্থা যে অবিকল্প সেকথা বলে গিয়েছেন। 

*ছবি সৌজন্য আন্তর্জাল 

লেখক, কবি ও প্রাবন্ধিক। 'অনুষ্টুপ' পত্রিকা ও প্রকাশনা সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা। পেশাগতভাবে ছিলেন ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *