কীভাবে সম্বোধন করবে? ডিয়ার? না, তাদের স্কুলে বলেছে ডিয়ার বলে অপরিচিত মানুষকে চিঠি লিখতে নেই। তাহলে? রেস্পেক্টেড? ধুস, বাজে। বাংলায় লেখাই ভাল। ‘প্রিয়?’ কী খারাপ ! তার থেকে কোনও রকম সম্বোধনের দরকার নেই। আর কীভাবে লিখবে? ইনিয়ে বিনিয়ে? নাহ, সরাসরি বলা উচিত। বড় চিঠি লিখলে পড়বার ধৈর্য্যই থাকবে না হয়ত। টুনু মাঝে মাঝেই ক্লাসে সব কিছু ভুলে গিয়ে অন্যমনস্কের মত জানালা দিয়ে তাকিয়ে থাকার কারণে বেশ কয়েকবার গার্ডিয়ান কল হয়েছে। তার ডায়রির সেসব চিঠিতে একটা লাইন লেখা থাকত, কেজো স্টাইলে। You are requested to see me.  সে ওইরকম চিঠি লিখবে। 

অনেকবার খসড়া করল টুনু। কাটল, ঘষাঘষি করল পেন্সিল। আস্তে আস্তে একটা চিঠি স্পষ্ট হয়ে উঠছিল, কিন্তু বেশি কথা বলা হয়ে যাচ্ছে বলে আবারো বাদ দিল। মাথা তুলল ঘণ্টা দুই পর।

 

দিদার কথাটা লিখবে কি না বুঝে উঠতে পারছিল না, তারপর মনে হল, লেখা উচিত, যদি মন গলে একটু। এটুকুই, ব্যাস। যথেষ্ট। বুঝবে, টুনু ফালতু কান্নাকাটি করার ছেলেই নয়। চিঠি হওয়া উচিত ছোট, কাজের কথা লেখা থাকবে। এখানেও তাই আছে। 

রাত্রের খাবার শান্ত হয়ে খেল টুনু। রুটি আর চিকেন স্টু, আজ তার খেতে ভাল লাগছে। দিদা গুবলুকে আদর করছিল, টুনুও খেলল একটু। গুবলু খালি মাটিতে গড়াগড়ি দিতে ভালবাসে, আর দিদা খিলখিল হেসে তার পেছন পেছন ছুটছে। ‘তোমাকে আর আজ আমার ঘরে শুতে হবে না দিদা। আমি একলাই পারব।’ 

‘পারবি?’ মাথা তুলে দিদা জিজ্ঞাসা করল। ‘রাত্রে শরীর খারাপ হয় যদি?’ 

‘ডাকব তাহলে। আর হবে না, আমি তো  ভাল হয়ে গেছি।’ 

দিদাও মনে হল যেন হাঁফ ছাড়ল। হয়ত এই ক’দিনেই বিরক্ত হয়ে গেছে টুনুর ওপর। তার ওপর টুনু আবারও গত পরশু বিছানা ভিজিয়েছে, দিদার শাড়িতেও, সকালবেলা উঠেই কাচতে হয়েছে সেসব। গুবলুকে কোলে নিয়ে দিদা বলল, ‘ভয় পাবি না তো বাবা? কষ্ট হবে না?’ 

দিদা না থাকলেই ভাল, কিন্তু তবুও, যদি জোর দিয়ে বলত একবার, ‘না থাকব’, কিন্তু দিদা জিজ্ঞাসা করল কষ্ট হবে কী না, আর একটা হাওয়া বেরিয়ে টুনুর বুকটা দশমী রাতের দুর্গাপুজোর মণ্ডপ হয়ে গেল। নিশ্বাস ছেড়ে বলল, ‘কিচ্ছু অসুবিধে হবে না দিদা। তোমরা তো আছই পাশের ঘরে।’ 

ঝিমঝিম রাত্রে যখন দিদা -দাদু পাশের ঘরে গভীর ঘুমে, দাদু ঘুমের ওষুধ খায় সে জানে, চট করে জাগবে না, আর পরপর তার ঘরে রাত কাটিয়ে দিদাও ক্লান্ত, নিঃসাড় তন্দ্রায় আচ্ছন্ন এখন, টুনু পা টিপে টিপে উঠল। নীচের বড় দরজার খিল খুলে ফেলা তার পক্ষে কঠিন হবে না, তবে ছিটকিনি–হাত পাবে কি?  বেড়াল থাবায় সিঁড়ি বেয়ে নেমে এল টুনু। অন্ধকার নেই, রোয়াকে একটা মৃদু বাল্ব সবসময় জ্বলে। কিন্তু হলদে আধো আলোতে জায়গাটা এখন যেন অন্যরকম লাগছে। 

পকেট থেকে চিঠিটা বার করে টুনু  তালগাছের গোড়ায় রাখল। একটা ইট চাপা দেওয়া উচিত। কিন্তু শিশিরে ভিজে যায় যদি? ঘাসের ওপর রাখা চলবে না। অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে শুকনো মাটি পেল কিছুটা। চিঠিটা রেখে সোজা হল। এটুকুই যথেষ্ট। এখানে আর অপেক্ষা করে লাভ নেই। উত্তর পেতে কিছুটা সময় যে লাগবেই, জানা কথা। 

খিলটা খুলতে গিয়ে ক্যাঁচ করে একটা শব্দ হবার সঙ্গে সঙ্গে টুনু পাথর হয়ে গেল। হাতে ধরা আলগা খিল, এই অবস্থায় তাকে যদি দিদা দেখে আর রক্ষে রাখবে না। কয়েকটা মুহূর্ত, কেউ নীচে নেমে এল না। বড় নিশ্বাস ফেলে টুনু দরজার পাশে রাখা চেয়ারটা সাবধানে এনে তার ওপর উঠল। খুট করে খুলে গেল ছিটকিনি, আর এক ঝলক হিমেল হাওয়া তার চামড়ায় নখ বসিয়ে দিল। 

জ্যোৎস্নাভেজা অন্ধকারে টুনু দেখল, বিশ্বমামার ঘরের আলো নেভানো। এখন রাত এগারোটা, আসানসোলে এই সময়ে তাদের ও আশেপাশের বাড়িতে টিভি চলছে গান বাজছে, কত আওয়াজ, আর এখানে ন’টার মধ্যেই সব শুনশান। ধীরে ধীরে বাগানের গেটের কাছে এসে দাঁড়াল টুনু। গেট বন্ধ, ভারী তালা ঝুলছে। কিন্তু পেছনের বাগানের পাঁচিলের একটা জায়গা ধ্বসে গিয়েছে, দাদুর সঙ্গে বাগানে ঘুরতে গিয়ে দেখেছিল। গতবছরের কালবৈশাখীর সময়ে নাকি। বাগানের ঝোপ, গুলঞ্চলতা, নিঃসীম জামগাছ, মৃত পাখিদের বাসা পায়ে ঠেলতে ঠেলতে টুনু নির্ধারিত জায়গাটিতে আসল। ভাঙা জায়গা দিয়ে তার চোখের সামনে এখন মাঠটি জ্যোৎস্নার পায়েস খেয়ে টইটুম্বুর। 

মাঠে পা দিয়ে হাওয়ার কামড় টের পেল এবং পায়ের নীচে ভেজা মাটি। সোয়েটার পরে না বেরনো ভুল হয়েছে খুব। টুনু দৌড়তে শুরু করল, ঠাণ্ডা কম লাগবে, কিন্তু হাঁফিয়ে গেল কয়েক পা গিয়েই। খেলায় তাকে কেউ নেয় না, কারণ সে দৌড়তে পারে না, আর এখন তো  এমনিতেই অসুস্থ। চেষ্টা করল যত দ্রুত পারা যায় পা চালাতে। 

তালগাছের নীচে এসে দাঁড়াল টুনু। নীচটায় ঝোপঝাড় সমাচ্ছন্ন। মাথা তুলে দেখল, কিছুই বোঝা যাচ্ছে না অন্ধকারে। একটা পাখি নড়ে  উঠল কি? খচমচ আওয়াজ হল হালকা। হয়ত কোনও ছুঁচো তাকে দেখে পালাল মাঠের মধ্যে দিয়ে। গাছটা সটান উঠে গেছে দশতলা উঁচু। গাছের গায়ে হাত রাখলে খড়খড়ে অনুভূতি হয়। এখান থেকে তাদের বাড়িটা দূরে দেখা যাচ্ছে অস্পষ্ট। হালকা কুয়াশা এখন মাঠময়, তার মধ্যে অন্ধকার বাড়িটাকে একটা ভাসমান জাহাজের মত লাগছে।

হঠাৎ একটা খড়মড় করে আওয়াজ উঠল সামনের ঝোপে। টুনু চমকে উঠে পিছিয়ে গেল এক পা, এবং দেখল ঝোপ থেকে আস্তে আস্তে উঠে আসছে একটা বকপাখি। তার দিকেই তাকিয়ে। বকটার গায়ের রং যে কালো, সেটা আধো জ্যোৎস্নার মধ্যেও বোঝা যাচ্ছিল। এত রাত্রে জেগে কেন? নাকি টুনু তার ঘুম ভাঙিয়ে দিল? 

পকেট থেকে চিঠিটা বার করে টুনু  তালগাছের গোড়ায় রাখল। একটা ইট চাপা দেওয়া উচিত। কিন্তু শিশিরে ভিজে যায় যদি? ঘাসের ওপর রাখা চলবে না। অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে শুকনো মাটি পেল কিছুটা। চিঠিটা রেখে সোজা হল। এটুকুই যথেষ্ট। এখানে আর অপেক্ষা করে লাভ নেই। উত্তর পেতে কিছুটা সময় যে লাগবেই, জানা কথা। 

বকটা একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে তার দিকে। নিথর, যেন পাথুরে মুর্তি। পেছন ফিরল টুনু। কেউ কি তাকে ওপর থেকে দেখছে? নিঃসাড়ে লক্ষ্য করে যাচ্ছে তার হাঁটা? চারপাশ এতটাই চুপচাপ যে এ চরাচরে আর অন্য কেউ আছে বলে মনে হচ্ছে না। কাজটা যতক্ষণ করছিল, টুনুর অত ভয় লাগেনি। কিন্তু এখন তার বুক কাঁপতে শুরু করল। কীভাবে পারল? তার ঘাড়ের কাছেই কি তালগাছটা ঝুঁকে আসছে? এক্ষুণি কেউ পিঠে টোকা মারবে? টুনুর মনে হল, সে ছুটলেই পেছনে ধপ ধপ পায়ের আওয়াজ পাবে। এগিয়ে আসবে তার থেকেও দ্রুতবেগে। দাঁত চিপে পা টিপে টিপে হাঁটতে লাগল টুনু। এসে গেছে, আর মাত্র কয়েক পা। এই তো  স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে বাড়িটাকে এখন। ওই যে, সামনে পাঁচিল। 

এবং টুনু দাঁড়িয়ে পড়ল। হ্যাঁ, এখন স্পষ্টই দেখতে পাচ্ছে। 

ছোটমামার ঘর এই জায়গা থেকে দেখা যায়। অন্ধকারেও বোঝা যাচ্ছে জানালা। বোঝা যাচ্ছে, কারণ জানালা খোলা। কিন্তু সে খোলা থাকে বরাবরই। 

টুনু দাঁড়িয়ে পড়ল, কারণ একটা হাতকে দেখা গেল এক ঝলক, ভেতর থেকে হাত বাড়িয়ে জানালার একটা পাল্লা টেনে বন্ধ করে দিল। 

এবার আর কোনও ভুল নেই, স্পষ্ট দেখেছে সে। পাল্লাটা এখনো বন্ধ। ভেতরে কী আছে, বোঝা যাচ্ছে না। টুনুর পা পাথরের মতো ভারী হয়ে আছে। খুব ধীরে ধীরে একবার ঘাড় ঘোরাল। পেছনেই দাঁড়িয়ে আছে একজন, যার কাঁধে একটা ঝোলা। 

এবং পেছনে কেউ নেই। অন্ধকার মাঠে শুধু একঠেঙে তালগাছ, নিস্পন্দ। 

ঝিমঝিম রাত্রে যখন দিদা -দাদু পাশের ঘরে গভীর ঘুমে, দাদু ঘুমের ওষুধ খায় সে জানে, চট করে জাগবে না, আর পরপর তার ঘরে রাত কাটিয়ে দিদাও ক্লান্ত, নিঃসাড় তন্দ্রায় আচ্ছন্ন এখন, টুনু পা টিপে টিপে উঠল। নীচের বড় দরজার খিল খুলে ফেলা তার পক্ষে কঠিন হবে না, তবে ছিটকিনি–হাত পাবে কি?  বেড়াল থাবায় সিঁড়ি বেয়ে নেমে এল টুনু।

কতটা সময় এভাবে দাঁড়িয়ে ছিল, খেয়াল নেই। তারপর পা যেন চালাতে শুরু করল তাকে। মন্ত্রমুগ্ধের মতো টুনু পাঁচিল পেরল। চেয়ার টেনে দরজার ছিটকিনি দিল। খিল তুলল। সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠল। 

একটা মৃদু ঠকঠক শব্দ হচ্ছে। কোথায়? চারপাশে তাকিয়েও বুঝতে পারল না, তার ওপর অন্ধকার। কিন্তু আওয়াজটা হয়েই চলেছে, খুব আস্তে, এবং তাকে টানছে। টুনু ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল। হ্যাঁ, ধ্বনি আস্তে আস্তে বাড়ছে। 

ছোটমামার ঘর। দরজা এখন খোলা। হাওয়ার ধাক্কায় দরজার পাল্লা পাশের দেওয়ালে গিয়ে লাগছে, আর আওয়াজ হচ্ছে, ঠক ঠক ঠক। 

এক পা এক পা করে এগিয়ে গেল টুনু। ঘরের ভেতর অন্ধকার। টুনু চৌকাঠে পা রাখল। থমকে গেল একটু। তারপর ঢুকে গেল ভেতরে। 

বাইরে তখনো হিমেল বাতাস হা হা বইছিল। চাঁদ রক্তাক্ত, মৃত পাখিরা জাগরূক, স্রোত শান্ত এবং প্রকৃতি নিথর হয়ে ছিল।

পরবর্তী পর্ব : ১১ জানুয়ারি, সন্ধে ছটা। 

একনড়ে পর্ব ৮

শাক্যজিৎ ভট্টাচার্যের জন্ম ১৯৮২ সালে কলকাতায়। প্রথম গল্প বেরিয়েছিল পরিকথা পত্রিকায়, ২০০৩ সালে। এ পর্যন্ত লিখেছেন সাতটি উপন্যাস ও প্রায় চল্লিশটি ছোটগল্প। মূলত লিটল ম্যাগাজিনই তাঁর লেখালেখির জায়গা। এ পর্যন্ত পাঁচটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে।

2 Responses

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *