রবীন্দ্রনাথের সঙ্গীতসৃষ্টির কোনও একটি দিক নিয়ে আলোচনা করতে গেলে  ঠাকুরপরিবারের সঙ্গে গানের হৃদ্যতার ইতিহাস নিয়ে কিছু কথা বলা  জরুরি। রবীন্দ্রনাথের প্রতিভা বিকাশের ক্ষেত্রে জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের অবদান অনেকখানি। 

রবীন্দ্রনাথের পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের (১৮১৭-১৯০৫ খ্রি.) সঙ্গীতপ্রীতি উত্তরাধিকার সূত্রেই এসেছিল। জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির আদিপুরুষ নীলমণি ঠাকুর (মৃত্যু ১৭৯১ খ্রি.) নিষ্ঠাবান বৈষ্ণব ছিলেন।  বাংলা কীর্তন গানের প্রতি তাঁর অনুরাগ ছিল। নীলমণির গৃহে কোনও কালোয়াতি গানের চর্চা হত কিনা, সে বিষয়ে কিছুই জানা যায়নি। নীলমণির জ্যেষ্ঠপুত্র রামলোচন ছিলেন উদারমনস্ক। জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির জামাতা, বরেণ্য পণ্ডিত কৃষ্ণ কৃপালনী লিখেছেন: “রামলোচনের পিতা নীলমণি ছিলেন ধর্মভীরু মানুষ ও গোঁড়া বৈষ্ণব, রামলোচন কিন্তু আদৌ সেরকম ছিলেন না। তিনি ছিলেন সংস্কারমুক্ত উদারপন্থী মানুষ, জীবনটা পুরোপুরি উপভোগ করতে চাইতেন এবং অন্যান্য ধনী লোকের মতো জনপ্রিয় নাচ গানের পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। দেশ পুরোপুরি ইংরেজদের দখলে আসার পর, মুর্শিদাবাদের রাজধানী তুলে দিয়ে কলকাতায় রাজধানী স্থাপিত হয়। তার ফলে বিত্তশালী অভিজাতবর্গ মুর্শিদাবাদ ছেড়ে চলে আসেন কলকাতায়। তাঁদের পিছু পিছু চলে আসে তাঁদেরই পৃষ্ঠপোষকতাপুষ্ট বহু নট-নটী, কালোয়াত-তবলচি, বাঈজী, সেতারী, গণিকা-বারাঙ্গনা। তাদের অনেকে আশ্রয় নেয় চিৎপুরে — কারণ, চিৎপুর তখন ছিল দিশী পাড়ার মধ্যে সবচেয়ে সমৃদ্ধ। এইসব গাইয়ে-নাচিয়েদের একজন সমঝদার পৃষ্ঠপোষক ছিলেন জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাবু — রামলোচন।”* 

রামলোচন ঠাকুর নিজে সঙ্গীতজ্ঞ ছিলেন না ঠিকই, কিন্তু সঙ্গীতের সমঝদার ছিলেন। এ বিষয়ে ‘বঙ্গের জাতীয় ইতিহাস’ গ্রন্থে প্রাচ্যবিদ্যা মহার্ণব নগেন্দ্রনাথ বসু মহাশয় লিখেছেন — “রামলোচনের সময় বাইনাচ ও কালোয়াতী গান ভিন্ন অন্য কোনও মজলিসী আমোদ ছিল না। মহারাজা নবকৃষ্ণের কবি ও হাফ আখড়াই বেশ জমিয়াছিল বটে কিন্তু খুব বেশি বিস্তৃত হয় নাই। রাম বসু, হরু ঠাকুর প্রভৃতি তখন বাঁচিয়াছিলেন বটে কিন্তু তাঁহাদের আদর তখনও সর্বজনীন হয় নাই। রামলোচন ঠাকুরই এই সকল কবি ও কালোয়াৎগণকে আহ্বান করিয়া নিজ বাড়ীতে মজলিসী আমোদে বৈঠক করিতেন এবং আত্মীয়-স্বজনকে নিমন্ত্রণ করিয়া শুনাইতেন। এইরূপে রামলোচন হইতেই উহাদের আদর সাধারণের মধ্যে বিস্তৃত হইয়া পড়ে।”

দেশ পুরোপুরি ইংরেজদের দখলে আসার পর, মুর্শিদাবাদের রাজধানী তুলে দিয়ে কলকাতায় রাজধানী স্থাপিত হয়। তার ফলে বিত্তশালী অভিজাতবর্গ মুর্শিদাবাদ ছেড়ে চলে আসেন কলকাতায়। তাঁদের পিছু পিছু চলে আসে তাঁদেরই পৃষ্ঠপোষকতাপুষ্ট বহু নট-নটী, কালোয়াত-তবলচি, বাঈজী, সেতারী, গণিকা-বারাঙ্গনা।

রামলোচনের দত্তকপুত্র দ্বারকানাথও ঠাকুরপরিবারের এই ঐতিহ্যের রক্ষক ছিলেন। তিনি কেবল সঙ্গীতপ্রেমী বা সঙ্গীত পৃষ্ঠপোষকই ছিলেন না, ছিলেন একজন সঙ্গীতশিল্পীও। তিনি প্রথাগতভাবে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যসঙ্গীত শিখেছিলেন। প্রাচ্যবিদ্যা বিশারদ জার্মান পণ্ডিত ম্যাক্সমুলার সাহেব মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের মধ্যমপুত্র সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরকে (১৮৪২ — ১৯২৩ খ্রি.) বলেছিলেন,”…তিনি (দ্বারকানাথ ঠাকুর) প্রায়ই আমাকে (ম্যাক্সমুলারকে) নিমন্ত্রণ করতেন এবং আমি গিয়ে সারা সকালটা তাঁর কাছে প্রায়ই কাটিয়ে আসতাম। …তিনি অত্যন্ত সঙ্গীতপ্রিয় ছিলেন এবং ইটালীয় ও ফরাসী সঙ্গীত খুব পছন্দ করতেন। তিনি গান করতেন। তিনি গান করতেন আর আমি সেই গানের সঙ্গে পিয়ানো বাজাতাম — এইভাবে আমাদের দিনগুলি বেশ আনন্দে কেটে যেত। তিনি বেশ সুকণ্ঠ ছিলেন। একদিন আমি তাঁকে বল্লাম, একটি খাঁটি ভারত-সঙ্গীত গাইতে, তাতে তিনি যে গানটি প্রথমে গাইলেন, সেটি ঠিক ভারতীয় নয়, পারসিক গজ়ল এবং আমিও তাতে বিশেষ কোন মাধুর্য্য পেলাম না। খাঁটি ভারত-সঙ্গীত গাইবার জন্য পুনঃ পুনঃ অনুরোধ করায় তিনি মৃদু হেসে বল্লেন, ‘তুমি তা উপভোগ করতে পারবে না।’ তারপর আমার অনুরোধরক্ষার জন্যে একটি গান নিজে বাজিয়ে গাইলেন। সত্য বলিতে কি, আমি বাস্তবিকই কিছু উপভোগ করতে পারলাম না। আমার মনে হ’ল যে, গানে না আছে সুর, না আছে ঝঙ্কার, না আছে সামঞ্জস্য। দ্বারকানাথকে এই কথা বলায় তিনি বল্লেন, ‘তোমরা সকলেই এক রকমের। যদি কোন জিনিস তোমাদের কাছে নতুন ঠেকে বা প্রথমেই তোমাদের মনোরঞ্জন করতে না পারে, তোমরা অমনি তার প্রতি বিমুখ। প্রথম যখন আমি ইটালীয় গীতবাদ্য শুনি, তখন আমিও তাতে কোন রস পাইনি, কিন্তু তবু আমি ক্ষান্ত হইনি; আমি ক্রমাগত চর্চা করতে লাগলাম যতক্ষণে না আমি তার মধ্যে প্রবেশ করতে পারলাম। সকল বিষয়েই এইরূপ।… ইউরোপ যাহা প্রকাশ করে আমরা চেষ্টা করি তাহা বুঝতে ও হৃদয়ঙ্গম করতে, কিন্তু তাই বলে ভারতবর্ষ যাহা প্রকাশ করে তাকে অবহেলা করি না। আমরা যেমন তোমাদের সঙ্গীতবিদ্যা, কাব্যদর্শন আলোচনা করি, তোমরাও যদি তাই করতে তাহলে তোমরাও আমাদের দেশের বিদ্যাগুলির মর্ম বুঝতে পারতে।…”**

দ্বারকানাথ বিলেতেই দেহত্যাগ করেছিলেন। কিন্তু কলকাতায় থাকাকালীন তিনি ব্যবসায়িক কারণেই বেশ কয়েকটি নৃত্যগীতের আয়োজন করেছিলেন। তিনি প্রচুর অর্থব্যয় করতেও কুণ্ঠাবোধ করতেন না। দ্বারকানাথের অনুসরণে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে দেবেন্দ্রনাথ যে সাঙ্গীতিক পরিমণ্ডল গঠন করেছিলেন, তার ফল হয়েছিল সুদূরপ্রসারী। ব্রাহ্মসমাজের প্রার্থনাসঙ্গীতের মাধ্যমে তিনি শুধুমাত্র পরিশীলিত রাগাশ্রিত বাংলা গানের পথপ্রদর্শক ছিলেন তা-ই নয়, শিক্ষিত বাঙালির মধ্যে সঙ্গীতচর্চার বিকাশও ঘটিয়েছিলেন। এই মহৎ দৃষ্টান্ত সর্বপ্রথম তিনি স্বপরিবারে স্থাপন করেছিলেন। 

মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পৃষ্ঠপোষকতায় নানা গুণীর সমাগম হয়েছে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে। তাঁদের কয়েকজন — বিষ্ণু চক্রবর্তী, যদুভট্ট, মৌলা বখস (বরোদা), শ্রীকণ্ঠ সিংহ, শ্যামসুন্দর মিশ্র, রমাপতি বন্দ্যোপাধ্যায় (চন্দ্রকোণা), রামচন্দ্র রায় (শান্তিপুরের পাখোয়াজী) প্রমুখ। এঁদের সাহচর্যে জোড়াসাঁকো ঠাকুর পরিবারের অনেকেই সঙ্গীতে পারদর্শী হয়ে ওঠেন। এঁদের মধ্যে দ্বিজেন্দ্রনাথ, সত্যেন্দ্রনাথ, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ, সোমেন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রনাথ প্রমুখ পুত্রগণ অগ্রগণ্য। কন্যাদের মধ্যেও সৌদামিনী দেবী ও স্বর্ণকুমারী দেবী সঙ্গীতে যথেষ্ট প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছিলেন। 

জোড়াসাঁকো ঠাকুর পরিবারে শুধুমাত্র হিন্দুস্থানী শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ব্যাপক চর্চা হয়েছিল এমন নয়, তার সঙ্গে বাংলা কীর্তন, পাশ্চাত্য সঙ্গীত, দক্ষিণী সঙ্গীত, লোকসঙ্গীত প্রভৃতিরও উল্লেখযোগ্য অনুশীলন হয়েছিল। ব্রাহ্ম দেবেন্দ্রনাথ  নিজে বেশ কিছু খেয়ালাঙ্গ ব্রহ্মসঙ্গীত রচনা করেছিলেন। সন্তানদের ধ্রুপদ-ধামার, খেয়াল, টপ্পা-ঠুমরি প্রভৃতি রাগ-ভিত্তিক সঙ্গীতশিক্ষার সুব্যবস্থা করার পাশাপাশি সঙ্গীত রচনার ব্যাপারেও উৎসাহ দিতেন। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রনাথ প্রমুখের পাশাপাশি মহর্ষির ভাই গিরীন্দ্রনাথের দুই পুত্র গণেন্দ্রনাথ এবং গুণেন্দ্রনাথও সঙ্গীতরচনায় যথেষ্ট দক্ষতার পরিচয় রেখেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের কিশোর বয়সে দেবেন্দ্রনাথের তত্ত্বাবধানে ব্রহ্মসঙ্গীত রচনা করা ঠাকুরবাড়ির প্রতিটি তরুণ সঙ্গীতস্রষ্টার কাছে ছিল আনন্দময় প্রতিযোগিতা। এই প্রসঙ্গে প্রাক-রবীন্দ্রযুগে বাংলা গানের ক্রমিক সমৃদ্ধিতে ব্রাহ্মসমাজের ‘ব্রহ্মসঙ্গীত’ সম্বন্ধে কিঞ্চিৎ আলোচনা করা যেতে পারে। 

তথ্যসূত্র:

*দ্বারকানাথ ঠাকুর — বিস্মৃত পথিকৎ / কৃষ্ণ কৃপালনী, অনু: ক্ষিতীশ রায়/ পৃ: ১৯

**আমার বাল্যকথা / সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর/ পৃ: ১১-১২

খ্যাতিমান সঙ্গীতশিল্পী অর্ণব রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রবীন্দ্রনাথের গান বিষয়ে গবেষণা সম্পন্ন করেছেন। প্রবাদপ্রতিম সঙ্গীতগুরু আশিস ভট্টাচার্যের সুযোগ্য ছাত্র অর্ণব রবীন্দ্রসঙ্গীতে বিশেষভাবে পারদর্শী, এ ছাড়াও অন্য ধরনের গানেও তিনি যথেষ্ট পারঙ্গম। তিনি পেশায় শিক্ষক। গান তাঁর সবচেয়ে প্রিয়। তিনি ভ্রমণপিপাসু, সেই সঙ্গে উদ্যানচর্চায় আগ্রহী।