আমার দেখা খড়দার সাবেক গিন্নিদের তিন সেট কাপড় থাকত। একটা হল গঙ্গা নাওয়ার। দুই হল রান্না করার, আর তিন নম্বরটি হল ‘গণ’, মানে খাটা পায়খানায় যাবার, ‘হেগো কাপড়।’ এসবে খুব মানামানি ছিল। না মানলে প্রায় জাত যাবার অবস্থা আর কি! আর এ জন্যেই রান্নার কাপড় হত, তেলচিটিনি গন্ধে ভরা এবং হলুদ ও মর্চে রঙের ছোপে ভর্তি। গঙ্গা-নাওয়া কাপড়ের রং ঘোলা আর মাটি মাটি গন্ধতৃতীয় কাপড়টি মাপে খাটো, পুরনো একটা যা হোক তা হোক, হলেই হল। ফলে গুলিয়ে যাবার জো ছিল না। সকালবেলা কাপড় ছেড়ে হেঁশেলে ঢোকা মানেই, বাসি কাপড় ছেড়ে, ন্যাতা ন্যাতা কাপড়খানি ঘরোয়া ভাবে পরে হাল ধরা। বেলায় কেচে শুকিয়ে, সেটি কুঁচিয়ে রাখা থাকত রান্না ঘরের হুকে। সাদাসিধে করে ঘরোয়াভাবে পরে, আঁচলের একটা খুঁট কোমরে গোঁজা মানেই সারাদিনের মতো কস্ট্যুমটি গায়ে চড়ল। বিধবা ঠাকুমারা গরমকালে খালি গায়ে কাপড় পরতেন, মিডির মাপে সায়ার ওপর। মাঝবয়সী সধবা  গিন্নিরা পরতেন বোতামের বদলে, দড়ি বাঁধা ঢিলে ব্লাউজ। শীতকালে অবশ্য গায়ে থাকত হাতে বোনা উলের ব্লাউজ়। চাদর গায়ে কাউকে রান্না করতে দেখেছি বলে তো মনে পড়ে না। 

ওই পরনের কাপড়ের খুঁটেই গলা মুখের ঘাম মোছা, বাচ্চাদের ভিজে মুখ বা হাতের তেলো মুছিয়ে দেওয়া এবং অভিমানে লুকিয়ে চোখ মোছাও। কড়ার তরকারিতে হাত ধোওয়া জল দিয়ে সে হাতও নিজের আঁচলেই মুছতেন। ডান হাতের পাঁচ আঙুলের কাজ সারা মানেই, পরনের কাপড়ে হাতখানি ডলে নেওয়া  তবে কিছু গিন্নি এর ব্যতিক্রম ছিলেন। যথেষ্ট সচেতন থাকার গর্ব চিহ্ন ছিল এই যে, এঁদের কাপড়ে দাগ ধরত না। কেচে মেলে দেবার পর বোঝাই যেত না, ওটা যে হেঁশেলের কাপড়। এই হেঁশেল  কাপড় প্রতিদিন কাচা হত সোডা মেশানো সাবান জলে, যাতে তেল গন্ধ ধুয়ে যায়। কিন্তু ঝাঁঝ ঝাঁঝ সোডা গন্ধ ম’ ম’ করত শুকনো কাপড়েওরান্নার পর এই কাপড় কেচে, স্নান করে একখানা ‘ফর্সা’ কাপড় পরে খেতে বসতেনসেই ভাতের কাপড় আবার ছাড়তেন বিকেলে গা ধোয়ার সময়তখন একখানি পাটভাঙা সরেস বসন, গুছি দিয়ে বাঁধা খোঁপা ও তেল সিন্দূরের টিপে একেবারে ভিন্ন চরিত্রে অবতরণ। 

বিধবা ঠাকুমারা গরমকালে খালি গায়ে কাপড় পরতেন, মিডির মাপে সায়ার ওপর। মাঝবয়সী সধবা  গিন্নিরা পরতেন বোতামের বদলে, দড়ি বাঁধা ঢিলে ব্লাউজ। শীতকালে অবশ্য গায়ে থাকত হাতে বোনা উলের ব্লাউজ়। চাদর গায়ে কাউকে রান্না করতে দেখেছি বলে তো মনে পড়ে না। ওই পরনের কাপড়ের খুঁটেই গলা মুখের ঘাম মোছা, বাচ্চাদের ভিজে মুখ বা হাতের তেলো মুছিয়ে দেওয়া এবং অভিমানে লুকিয়ে চোখ মোছাও। কড়ার তরকারিতে হাত ধোওয়া জল দিয়ে সে হাতও নিজের আঁচলেই মুছতেন।

ঠাকুমা এবং মায়ের জন্য, দর্জি দিয়ে দু’টি এপ্রন শখ করে বানিয়ে দিয়েছিলেন বাবা। দাঁড়িয়ে বা উঁচু টুলে বসে রান্নার ব্যবস্থাটা মেনে নিলেও, মা বা ঠাকুমা কেউই ওই এপ্রন পরে শাড়ি বাঁচাতে রাজি হননি। ইংরেজি বইয়ের ইলাস্ট্রেশান, সিনেমা, আর পার্ক স্ট্রিট রেস্তোরাঁয় এপ্রন পরা লোকজন দেখেছি, যারা কেউই আমার পরিচিত নন। তবে সত্যি সত্যি ঘরেদোরে সেই প্রথম দেখলাম,  সাহেবপাড়ার পার্ক স্ট্রিট -ওয়েলেসলি ক্রসিংয়ে থাকা নতুন মাসির বাড়িতে। হাঁটুর নিচে ফ্রকের ওপর এপ্রন পরা নতুন রাঁধুনিকে দেখে, মেসোর গজগজ, আর এপ্রনের সঙ্গে শেফ টুপির ব্যবস্থা হয়নি বলে, লিডা নামে সেই রাঁধুনির ফোঁস ফোঁস। তখন আমার মনে পড়েছিল, ইশকুলের হোম সায়েন্স ক্লাসে, আমাদের এপ্রন পরার কথা। আমার মেয়ে ছোট থাকতে যখন রান্নাবাটি খেলত,  মা ওকে একটা রংবাহারি এপ্রন সেলাই করে দিয়েছিলেন। ও খালি গায়ে সেটা পরে, বাবাজি হয়ে নিজের হেঁশেল সামলাত।  

আশির মাঝামাঝি চৌরঙ্গি পাড়ার কলেজে পড়াতে এসে, লাগোয়া দোকান বেঙ্গল হোমে গিয়ে তো মুগ্ধ। একই কাপড়ের গ্লাভস, এপ্রন এবং ন্যাপকিন সেট — একরঙা, ফুলছাপ এবং চেক কাপড়ের। অনেক সহকর্মীর বাড়ি গিয়ে দেখেছি যে, এসব তাঁরা অনায়াসে ব্যবহার করেন। তবে, তাঁদের রান্নার আয়োজন এবং রান্নাঘরখানি সম্পূর্ণ বিদেশি কেতার। এইসব রান্নাঘরে দামি শাড়ি এবং জুতো পরে, নানা অ্যাপ্লায়েন্স সহযোগে রান্না করতে হয়। হোটেল ম্যানেজমেন্ট পড়ার চল হলে, রান্নার একেবারে আটপৌরে পোশাক হয়ে গেল শেফ টুপি এবং এপ্রন; এখন এই সময়ে যেমন মাস্কআর টিভি-তে রান্নার শোগুলোতে শেফ সেজে রান্না দেখতে দেখতে চোখও বেশ সয়ে গেল। বিভিন্ন শপিং মলেও এখন ঝুড়ি ভরে রাখা থাকে এপ্রন ও গ্লাভস। একালের গিন্নিরা সপ্রতিভভাবেই সে সব কেনে।  

সেবার একখানি নতুন গ্যাস ওভেন কিনলে, তার সঙ্গে উপহার এসেছিল এপ্রন আর গ্লাভস। মাইক্রো বা ওটিজি থেকে গরম খাবার বার করার সময় বেশ কাজে লাগল দেখে, ব্যবহার শিখলাম। কিন্তু এপ্রন গায়ে উঠল না। দামি বিপণির সেই এপ্রনটি কাজে লাগিয়ে, আমি তাই দিয়ে একটি নয় – দু’দুটি সুদৃশ্য ঝোলা বানিয়েছিলাম। কারণ, বিভিন্ন সময়ে, আমার বাড়ি রান্নার কাজে আসা কাজল-কবিতা-মঙ্গলাদেরও সেটি পরাতে পারলাম না, হাজার সাধাসাধি করেও। সকলের মুখেই, মাথা নিচু এক সলাজ হাসিআর ওদের টান টান করে প্লিট দিয়ে পরা শাড়িতে, ঘণ্টাখানেক ধরে রান্না করেও , না তেল বা মশলার ছিটেফোঁটা দাগটুকু। এদের দেখে মনে পড়ে মেজমাসিকে–  ধপধপে সাদা কাপড় পরে রাশি রাশি রান্না করেও , কাপড়ে হলুদ ছোপ ধরত না। থোড়, মোচা এসব কাটার সময় যেমন পাশে গোছানো থাকত, ছোট ছোট বাটিতে সর্ষের তেল, নুন, লেবু বা তেঁতুল; তেমন আয়োজনেই কোলের ওপর পেতে নিতেন ভাঁজ করা  একখানি বড় গামছা। আমি এখন, টেবিলে পা ঝুলিয়ে বসে এসব কাটাকাটি করলেও, ওই আয়োজনটুকু কিন্তু গুছিয়ে নিতে ভুলি নাফলে না আঙুলে দাগ, না কাপড়ে। কিন্তু আমার এখনকার পরিচারিকা পিয়া এবং পুতুল দু’জনেই, ক্রমাগত জলহাত করতে করতে, গলা থেকে পেট অবধি সব ভিজিয়ে ফেলেপুতুল পাঁচবাড়ি কাজ করে, তাই গায়েই শোকায়; যদিও তার জলহাত মোছার জন্য, তাকে একটা হাত গামছাও দিয়ে রেখেছি। কিন্তু সেটা ওই থুতনির নীচে মাস্কের মতো, ওর কোমরেই গোঁজা থাকে, একেবারে পাট ভাঙা শুকনোতবে আমার বাড়ি কাজে ঢুকে, সাবান দিয়ে হাত ধুয়েই রান্নাঘরের টাওয়েল রেল থেকে একটানে সেটা নামিয়েই, ও কিন্তু নিজের কোমরে ঝুলিয়ে নিতে কখনও ভোলে নাকিন্তু তারপর যতবার হাত মোছার দরকার, সব তার ওই কাপড়ে। কোমর থেকে দু’পাশের হাঁটু অবধি তার শাড়ি তাই নানা ছোপে ছয়লাপ। পুতুলের এসবে তোয়াক্কা না থাকলেও পিয়াকে কিন্তু রান্না শেষ করেই স্নানে ঢুকতে হয়, ভিজে কাপড় ছাড়তে। আর কুর্তি থেকে দাগ ছোপ তুলতে, প্রতিদিন উটকো ঝ্যামেলার মতো, তার জন্য বরাদ্দ গামছা টুকরোখানি কাজে না-লাগিয়ে, সে ব্যবহার করতে ভালবাসে আমার সংগ্রহে রাখা পোশাকি ‘ভ্যানিশ’ লিকুইড।  

এখনকার আত্মবিশ্বাসী, কুচো গিন্নিরা ভারী মজার। বাড়ির পোশাক মানেই, হয় কেপ্রি, নয়তো হাফপ্যান্ট বা কুর্তি। মডুলার কিচেনে ঢুকে একই সঙ্গে বাটা, কাটা এবং রাঁধা সব করে ফেলবে । এর কাছাকাছি ছবি দেখেছি আমার এখনকার ড্রাইভারের শ্যালিকার অষ্টমঙ্গলায় নেমন্তন্ন পেয়ে গোবিন্দপুর বস্তিতে। ছোট্ট একটা খোলা উঠোনে বসে আড্ডা মেরেছিলাম এক ঝাঁক মেয়ে-বউদের সঙ্গে। ওই উঠোনেই বড় উনান রেখে, হৈ হৈ করে নিজেরাই তারা মাংস পোলাও রাঁধছে। এপ্রনের বদলে ওড়নাটা কাঁধের ওপর দিয়ে ঘুরিয়ে পরে, কোমরে বেঁধেছে। অনেকে আবার নাইটির ওপর থেকে একটা লম্বা গামছা ঝুলিয়ে নিয়ে, দুটো খুঁট লম্বা ঝুলিয়ে, বাকি দুটো খুঁট বেঁধে নিয়েছে গলা পেঁচিয়ে। সঙ্গে হাত লাগিয়েছে কিছু উৎসাহী ছেলে।   

সেবার একখানি নতুন গ্যাস ওভেন কিনলে, তার সঙ্গে উপহার এসেছিল এপ্রন আর গ্লাভস। মাইক্রো বা ওটিজি থেকে গরম খাবার বার করার সময় বেশ কাজে লাগল দেখে, ব্যবহার শিখলাম। কিন্তু এপ্রন গায়ে উঠল না। দামি বিপণির সেই এপ্রনটি কাজে লাগিয়ে, আমি তাই একটি নয় – দু’দুটি সুদৃশ্য ঝোলা বানিয়েছিলাম। কারণ, বিভিন্ন সময়ে, আমার বাড়ি রান্নার কাজে আসা কাজল-কবিতা-মঙ্গলাদেরও সেটি পরাতে পারলাম না, হাজার সাধাসাধি করেও। সকলের মুখেই, মাথা নিচু এক সলাজ হাসিআর ওদের টান টান করে প্লিট দিয়ে পরা শাড়িতে, ঘণ্টাখানেক ধরে রান্না করেও , না তেল বা মশলার ছিটেফোঁটা দাগটুকু।

ছেলেদের রান্না করা মানেই যে বামুনঠাকুর, তা তো নয়। বাড়ির কর্তারা অনেকেই আলুর দম, মাংস এবং পায়েস দারুণ রাঁধতেন। শেয়ালদা ধরে যত মেস, ওখানে খেতে গেলে এখনও রাঁধুনি ঠাকুরেরা মাঝে  মাঝে বেরিয়ে এসে মাস-বাবুদের পাতে এটা ওটা দিয়ে যান– ঠিক যেন তাঁদের কোলপোঁচা খোকাটিকে খেতে দিচ্ছেনতাঁরা এখনও ধুতি গামছায় অভ্যস্ত। পাঁচতারা হোটেলের রান্নাঘরেও উঁকি মেরে দেখেছি – সেখানে সব সাহেবি উর্দি এবং ছেলেমেয়ে নির্বিশেষে। আর সবার মাথাতেই বড় বড় টুপি এবং হাতে গ্লাভস।      

সাবেককালে মেয়েদের, চুল বেঁধে রান্না করার রেওয়াজ ছিল, যাতে রান্নায় চুল না খসে। এখনকার মেয়েরাও এ ব্যাপারে সচেতন। লম্বা চুলেরা তাই মাথায় একটা ওড়না জড়িয়ে নেয়। এবং রান্নাঘরের দরজার পিছনে দু একটা হুকে ঝুলে থাকে, হাউসকোট আর ফেস টাওয়েলযখন যেমন দরকার– ফোন ধরা বা অতিথিকে দরজা খোলার সময়এখন আবার ওপেন কিচেনের রেওয়াজ। কালি নেই, ঝুল নেই, ধোঁওয়া নেই – তাই আব্রু কিসের! একেবারে ড্রইংরুম আবেশে টিভি চ্যানেল বা মুভি দেখতে দেখতে রান্না এবং খাওয়া। আর বাড়িতেই এলাহি রান্নার চলটাও এত কমে আসছে যে, আলাদা করে ওই হেঁশেল পোশাক নিয়ে কাউকেই আর ব্যতিব্যস্ত হতে হয় না। খাবারটা স্বাদের  হল কিনা সেটাই আসল কথা।  

রান্নার পোশাকের নাম বদলে তাই হয়েছে ‘ফিল গুড কম্ফর্ট ড্রেস’– যেটা গামছা দিয়ে বানানো হলেও গামছা বা আব্রু এর কোনওটাই নয়, সুবিধেজনক অঙ্গবাস মাত্র। কারণ হেঁশেল এখন কিচেন এবং তা ওপেন হলেও মোটামুটি এক রাঁধুনির হাতে, আর প্রতিদিন বড়জোর তিনজনের মতো রান্নার তদারকিতে।

Mandar Mukhopadhyay

আড্ডা আর একা থাকা,দুটোই খুব ভাল লাগে।
লিখতে লিখতে শেখা আর ভাবতে ভাবতেই খেই হারানো।ভালোবাসি পদ্য গান আর পিছুটান।
ও হ্যাঁ আর মনের মতো সাজ,অবশ্যই খোঁপায় একটা সতেজ ফুল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *