সকাল আটটায়, যখনও রোদের গায়ে হালকা শীতের আঁচড় লেগে আছে, টুনু চোখ মুছতে মুছতে নীচে এসে দেখল বিশ্বমামা কুয়োতলায় খালি গায়ে একটা দা দিয়ে অনেক ডাব ছাড়াচ্ছে। টুনুর গায়ে সোয়েটার, মাফলার গুঁজে পরা, বিশ্বমামার পাশে বসে পড়ল। গলা দিয়ে না বেরতে পারা চোয়া ঢেকুরের মত এই পুরনো বাড়ির বুকে আটকে গেছে সে, পেছনকার বড়বাগান, অনেক তালাবন্ধ ঘর, জানালা দিয়ে দেখা যায় সেসব ঘরে সারবাঁধা মোষের মুণ্ডু, হরিণের শিং, গুদোম ঘরে জমানো বড় বড় বস্তাগুলো দেখলে মনে হয় তাদের ভেতরে বসে খেলনাবাটি খেলছে বাচ্চা মেয়েরা, আর দুপুরবেলা যেন ছাদের আলসে থেকে কারা ঝুঁকে থাকে, একমনে দেখে যায় প্রাচীন বাগানটিকে,  নীচের মাঠকে, তবু তাদের মুখ দেখা যায় না, টুনু তালগাছের দিকে তাকাল। মাথার ওপর কয়েকটা পাখি উড়ছে। আবছা ধোঁয়া ধোঁয়া। সে বিশ্বমামাকে বলল, ‘আজ বিকেলবেলা মেলায় নিয়ে যাবে বলেছিলে।’ 

‘ওরে বাপ রে,’ বিশ্বমামা হাসি মুখে উত্তর দিল, ‘তুমি ভোলবার বান্দা নও দেখছি !’ 

বিশ্বমামার ছেলে গুবলু তার দিকে তাকিয়ে ফিক করে হেসে দিল, হাত তুলে বাগানের শিরীষ গাছে বসা একটা পাখি দেখিয়ে দুর্বোধ্য গলায়  বলল, ‘অ অ অ !’ তখন বাড়ির ভেতর থেকে দিদা বেরিয়ে এল, হাতে ফোন। এগিয়ে এসে বিশ্বমামার বাচ্চাকে কোলে তুলে নিল, ‘এ কী রে  গুবলু? এমন ধুলোয় কেউ গড়াগড়ি খায়? চল, তোর জন্যে দুধ  গরম করব।’ টুনুর দিকে ফোন বাড়িয়ে ধরল দিদা, ‘নে, তোর মা’। 

‘হ্যালো, কে টুনু? লক্ষ্মী হয়ে আছ তো? দাদু দিদাকে জ্বালাচ্ছ না তো?’ 

মরা নদীর গলায় কথা বলছে। টুনু দেখল, বিশ্বমামার ফর্সা বউ, যাকে সবাই রীণা বলে ডাকে, সে গেট পেরিয়ে ভেতরে ঢুকছে, হাতে একরাশ ময়লা জামাকাপড়। টুনুকে দেখে অল্প হাসল, আর কালো মেঘের দল গুড়গুড়িয়ে উঠল টুনুর ভেতর।

‘হ্যালো, টুনু?’ 

‘হুঁ?’ 

‘কী হল? কথা বলছিস না কেন?’ 

‘তুমি কবে আসবে?’ 

মা একটু চুপ করে থাকল। তারপর বলল, ‘এই তো বাবা, আর কয়েকদিন মাত্র। তারপরেই–‘ 

‘আমার তো পুজোর ছুটি শেষ। স্কুল খুলে গেছে।’ 

‘আমি কথা বলে এসেছি হেডস্যারের সঙ্গে। একটা মেডিকাল সার্টিফিকেট–যাক গে, আরো কয়েকদিন ছুটি মিলেছে মোট কথা। আমি আসব খুব তাড়াতাড়ি।’ 

‘বাবাও কাল রাতে বলল, আসবে। আসেনি। তুমিও আসবে না।’

 ‘টুনু’, ধমকে উঠল মা, ‘তুমি বড় হয়েছ না? এমন কথা কেউ ভাবে? আমি ঠিক এসে আসানসোল নিয়ে যাব তোমাকে। তুমি দুষ্টুমি করবে না, কেমন? মন খারাপ করবে না একদম।’ 

ফোন নামিয়ে টুনু দেখল, দিদা ভুরু কুঁচকে গম্ভীরমুখে তার দিকে তাকিয়ে। আঁচলের প্রান্ত ফোকলা মুখে চিবোচ্ছে গুবলু, সারা মুখ লালায় মাখামাখি। দিদা, যাকে সকালের কমলালেবু আলোতে মোমের মুর্তি, কোলে গুবলুকে বসিয়ে একটি নিখুঁত পটচিত্র হতেই পারে, বস্তুত বাড়ির সবাইয়ের মধ্যে একমাত্র গুবলুকে দেখেই দিদা যখন হেসে ওঠে, মনে হয় বাগানে সবুজতা এসেছে। টুনু বলল, ‘পাঁচুঠাকুরের মেলায় যাব দিদা। বিশ্বমামা নিয়ে যাবে।’ 

‘তুমি  আবার বিছানায়  হিসি করেছ টুনু।’ 

‘আমি? কই না তো…’ 

‘হ্যাঁ, তুমি !’ টুনুর মুখ বিবর্ণ হয়ে উঠল। দিদা তাহলে বিরক্ত হচ্ছে? ‘রোজ রোজ আমাকে চাদর কাচতে হচ্ছে! ঘুমোবার আগে পেচ্ছাপ করো না কেন? তোমার মা-কে বলব এবার।’ 

মনে হচ্ছিল, মাটি ফাঁক করে টুনু ঢুকে লুকিয়ে পড়ে, এতটাই অসহ্য রাগ ধরছে নিজের ওপর ! সে তো বাচ্চা নয়, ক্লাস ফোরে পড়ে–আশেপাশে কি রীণামামিমা, টুনুর কানে যেন আবীর ঢেলে দিয়েছে কেউ। দিদা বাড়ির ভেতর ঢুকে যাচ্ছে, সবার সামনে এভাবে কেউ কী করে বলতে পারে? টুনুর হাত মুঠো হয়ে এল অজান্তেই। একদিন সে সত্যি সত্যি অনেক বড় হয়ে উঠবে। দিদা এগিয়ে যাচ্ছিল, টুনু পেছন থেকে ডাকল, ‘দিদা !’ 

পেছন ফিরল দিদা। ‘আর করব না।’ 

একলা টুনু চটি খুলে পায়ের আঙুল দিয়ে শিশিরভেজা কাদামাটি দলে নিল, জোরসে পা চালিয়ে দিল ঘাসের ভেতর। একটা পোকা সরসর করে আঙুলের গলি দিয়ে যাতায়াত করছে, টুনু দুই আঙুল চিপে পোকাটার দমবন্ধ করে পিষে দিল। আপাতত একটাই পাখি তালগাছটিকে ঘিরে বৃত্তাকারে ঘুরছে। অত উঁচুতে উড়তে থাকা কোনও পাখিকেই চেনা যায় না, তবুও টুনু শকুনটাকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিল।

কিছু তো বলতে পারত ! তবুও চলে গেল নিরুত্তর ! বিশ্ব নিশ্চুপে ডাব ছাড়াচ্ছে। একটা ডাবের খোলায় লম্বা তিনটে আঁচড়, নখের দাগের মত। এমন ভাব করেছে, যেন শুনতে পায়নি। বিশ্বমামার প্রতি কৃতজ্ঞতায় তার মন ভরে উঠল। ‘বিশ্বমামা?’ 

‘হুঁ?’ 

‘ছোটমামার কী হয়েছিল?’ 

বিশ্বমামার হাত থেমে গেল, ‘কে বলল তোমাকে?’ 

‘মা বলেছিল একবার। ছোটমামা নাকি আর ফিরে আসেনি?’ 

একটু চুপ থাকার পর বিশ্বমামা আবার ডাব ছাড়াতে শুরু করল। ‘বিশ্বমামা?’ 

‘কী গো?’ 

‘কী হয়েছিল?’ 

বিশ্ব থামল আবার। কিছু একটা ভেবে নিয়ে উত্তর দিল,  ‘ওই তো, তোমার দিদা যার কথা বলেছে। একানড়ে। একানড়ে ধরে নিয়ে গেছে।’  

‘একানড়ে?’ একঝলক রক্ত ছিটকে এল টুনুর গলায়। 

‘হ্যাঁ। একানড়ে খুব সাংঘাতিক, টুনুবাবু ! ওই জন্যেই তো সেদিন তোমার দিদা অত রেগে গেছিল।’ 

টুনু স্তব্ধ বসে, একটু পর বিশ্ব বলল, ‘জন্ম থেকে এ বাড়িতে কাজ করি। আমার বাপও তাই করত। আমার কিছু বলা সাজে না। তাও বলছি, তোমার দিদার কাছে ছোটমামার কথা তুলো না টুনু ! কষ্ট পাবে।’ 

‘একানড়ে মামাকে ফিরিয়ে  দিল না কেন? দিদা তো  চাইতে পারত!’ 

ম্লান হাসল বিশ্বমামা, ‘তোমার দিদা এখনো ভাবে, ফিরে আসবে। কিন্তু যে যায়, সে তো আর–যাক বাদ দাও ওসব কথা,’ হঠাৎ যেন সম্বিত ফিরে পেয়ে কথার মোড় ঘোরাতে চাইল তাড়াতাড়ি,  ‘আজ কিন্তু দুপুরবেলা ভাল ছেলে হয়ে ঘুমিয়ে নেবে, নাহলে মেলায় নিয়ে যাব না।’ 

রীণামামিমা ঘরের ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে টুনুর পাশে বসল। ‘ আমিও যাব তাইলে। কী গো টুনুবাবু, নিয়ে যাবে তো?’ 

‘আমাকে বাবু বলো কেন? আমার ভাল লাগে না।’ 

‘তুমি তো বাবু-ই !’ হেসে উঠল রীণা, তার দাঁতে সূর্যের আলো পিছলে যাওয়া দেখে টুনুর ভাল লাগল, যেন ভুলে যাচ্ছিল একটু আগেকার লজ্জা, যেন ঠিক সেভাবেই রীণার কোলে মুখ গুঁজে দেয় যেমনটি কিনা গুবলু, এবং এখন গুবলু ভিতরবাড়িতে মহা আদরে দুধ খাচ্ছে, কাজেই রীণামামিমা কোলখালি, টুনু আলতো হেসে বলল, ‘আমাদের আসানসোলেও রথের মেলা হয়। তুমি যাবে?’ 

‘শহরের  মেলা ভাল হয় না বাপু! আমি কাকদ্বীপের মেয়ে। সেখানে বুড়িমার থানে যেমনটি  মেলা বসে, তেমনধারা আর কোথাও দেখিনি। আজ দেখবে, পাঁচুঠাকুর পাঁচি ঠাকরাণীর মন্দির ঘিরে কত বাচ্চারা আসে, আর সবার মাথা ন্যাড়া। চুল মানত দেয় তো!’ 

‘আমি একদিন ওই গম্বুজটায় যাব। ওখানে নাকি ভূত আছে, মা বলেছে।’ 

‘না না, ভূতপ্রেত বলে কিছু হয় নাকি?’ 

‘তাহলে একানড়ে?’ 

‘সে ভূত, কে বলল তোমাকে?’ বিশ্বমামা বাড়ির দিকে পা বাড়াল। 

টুনুর চুল একটু ঘেঁটে দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে আলগা হাসল রীণামামিমা। সেই হাসি দেখতে দেখতে টুনুর মনে পড়ল, আসানসোলের বিছানায় সে ঘাপটি মেরে শুয়ে থাকত, কখন পাশের ঘর থেকে দাঁতচাপা হিশহিশে শিকারি শব্দগুলো তার ওপর লাফিয়ে পড়ে, তাকে কুঁকড়ে গুটিয়ে একটা কোণার দিকে ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে যেতেই থাকে, যেতেই থাকে। ‘লজ্জা করে না গায়ে হাত দাও?’ ‘ছেনাল মেয়েছেলের আবার সম্মান !’ ‘তুমি চাইলে চলে যাও জয়রামতলা কিন্তু ছেলেকে নিয়ে যাবে না !’ ‘গলা উঁচু করবে না, এরকম অনেক দেখেছি ! তোমার তেজকে ভয় পাই ভেবেছ?’ কথাগুলো যখন ছিটকে আসত, তার ভেতরের ভয়গুলো ফ্রিজে রাখা দুধের প্যাকেটের মত ঘেমে উঠত এবং এঁদো গলির পচা ড্রেনের পাশে অন্ধকারে তখন মাতালের হড়হড়ে আওয়াজ যখন এই ভয়গুলোর ওপর ওয়াক বমি করেই আবার পরক্ষণেই উধাও, তখন সমস্ত মনখারাপের ঢেউয়ের ওপর তেলের মত ভেসে থাকত দুইপাশে বাবা মা দুজনকে রেখে মধ্যিখানে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়বার ইচ্ছে। আর এখন বাগানের নিম আম কাপাস শিরিশের মধ্যে বন্দী টুনু, আর মা অনেক দূরে কোথাও। রীণামামিমাও চলে গেল এক্ষুণি ঘরের ভেতর। একলা টুনু চটি খুলে পায়ের আঙুল দিয়ে শিশিরভেজা কাদামাটি দলে নিল, জোরসে পা চালিয়ে দিল ঘাসের ভেতর। একটা পোকা সরসর করে আঙুলের গলি দিয়ে যাতায়াত করছে, টুনু দুই আঙুল চিপে পোকাটার দমবন্ধ করে পিষে দিল। আপাতত একটাই পাখি তালগাছটিকে ঘিরে বৃত্তাকারে ঘুরছে। অত উঁচুতে উড়তে থাকা কোনও পাখিকেই চেনা যায় না, তবুও টুনু শকুনটাকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিল। স্কুলের বইতে ভালচারের ছবি ছোটবেলা থেকেই দেখে আসছে। আর কোথাও কেউ ছিল না। বাগান নির্জন, খাঁ খাঁ করছে স্তব্ধ গাছের দল। শকুনটা কি অনেক বছর আগেও উড়ত? অনেক উঁচু থেকে কি দেখতে পেয়েছিল ছোটমামাকে?

পরবর্তী পর্ব : ২৪ নভেম্বর, ২০২০ সন্ধে ৬টা।

একানড়ে পর্ব ১ 

শাক্যজিৎ ভট্টাচার্যের জন্ম ১৯৮২ সালে কলকাতায়। প্রথম গল্প বেরিয়েছিল পরিকথা পত্রিকায়, ২০০৩ সালে। এ পর্যন্ত লিখেছেন সাতটি উপন্যাস ও প্রায় চল্লিশটি ছোটগল্প। মূলত লিটল ম্যাগাজিনই তাঁর লেখালেখির জায়গা। এ পর্যন্ত পাঁচটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *