সেপ্টেম্বর ২৭ থেকে অক্টোবর ৩ গোটা পৃথিবী নিষিদ্ধ বই সপ্তাহ অথবা ব্যানড বুকস উইক পালন করল। ১৯৮২ সাল থেকে শুরু হওয়া এই উদযাপনের মূল উদ্যোক্তা অ্যামেরিকান লাইব্রেরি অ্যাসোসিয়েশন। বিশ্বের পাঠকমহলের কাছে রাষ্ট্রযন্ত্রের দ্বারা নিষিদ্ধ বইয়ের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করাই ছিল এর প্রধান উদ্দেশ্য। প্রকাশনার ইতিহাসে বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন সময়ে অসংখ্য বইকে নিষিদ্ধ বলে ঘোষণা করা হয়েছে। দেশ এবং বিদেশের তেমনই নানান ইতিহাসের খোঁজ করলেন কবি ও সাহিত্যিক বিভাস রায়চৌধুরী।
আমাদের কত চিন্তা ধারণ করে বই। বারবারই নতুন চিন্তার মুখোমুখি সন্ত্রস্ত সমাজ-শাসকেরা বইকে ধ্বংস করতে চেয়েছে। তারই একটা দিক হচ্ছে বইটিকে নিষিদ্ধ করা। চিন্তাটা যেন ছড়াতে না পারে। মানুষের সভ্যতায় বই নিষিদ্ধ করার ইতিহাস বহুদিনের। ধর্মান্ধ শক্তি একসময় কত যে বই আগুনে পুড়িয়েছে তার হিসেব নেই। মানুষের অন্ধ বিশ্বাসকে পুঁজি করে ধর্মগুরুরা এই কাজ করতেন নিজেদের গুরুবাদী অস্তিত্বের স্বার্থে। নতুন চিন্তা এবং যুক্তিকে তারা যে কারণে ভয় পেত, রাজা এবং রাষ্ট্র সেই কারণেই বারংবার মহৎ সৃষ্টিকে আক্রমণ করেছে। পুরনো দিনগুলোর দিকে তাকালে মনে পড়ে হোমারের অমর মহাকাব্য ‘ওডিসি’ আংশিক সম্পাদনার কথা ভেবেছিলেন প্লেটো। ভাবা যায়! আবার স্বাধীনতার স্বপ্নকে ভয় পেয়ে রোমের শাসক ক্যালিগুলা নিষিদ্ধ করতে চেয়েছিল ‘ওডিসি’ মহাকাব্যকে। পৃথিবীর বিখ্যাত দার্শনিক কনফুসিয়াসের সৃষ্টিকে সহ্য করেনি চীনের রাজশক্তি। এই দার্শনিকের অজস্র অনুগামীদের জীবন্ত কবর দেওয়া হয়েছিল সে দেশে। কোপারনিকাস, ম্যাকিয়াভেলি, শেক্সপিয়ার, গ্যালিলিও থেকে পাবলো নেরুদা, সলঝেনিৎসিনরা রাষ্ট্রের আক্রমণের শিকার হয়েছেন তাঁদের সৃষ্টির কারণে। আমাদের দেশে যেমন বঙ্কিমচন্দ্র, দীনবন্ধু, সখারাম গণেশ দেউস্কর, মুকুন্দদাস, গিরিশচন্দ্র ঘোষ, রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দ, শরৎচন্দ্র, নজরুলকে রাষ্ট্রের শাসকের রক্তচক্ষুর মুখোমুখি হতে হয়েছে বারবারই। কিন্তু বই নিষিদ্ধ করে কোনও চিন্তাকে গুমখুন করা যায় না। সময়ের দাবিতেই নতুন চিন্তার জন্ম হয়। বই পুড়িয়ে, লেখককে মেরে কোনও লাভ হয় না শাসকের। ইতিহাস ধিক্কার জানায় একদিন।
আজ মজাই লাগে এই ইতিহাস জেনে, অশ্লীলতার দায়ে লরেন্সের ‘লেডি চ্যাটার্লিজ লাভার’ বইটি নিষিদ্ধ করা নিয়ে কতদিন ধরে কী কাণ্ড চলেছিল! ১৯২৯ সাল থেকে ১৯৬১ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ বিচার চলে। ১৯২৯ সালে আমেরিকা আটকায় বইটিকে এবং ১৯৬১-তে ভারতে বিচার হয়। নিষিদ্ধ করে বইটিকে আটকানো যায়নি, বরং যৌনতা নিয়ে সেদিনের বোধ বদলে গেছে আজ। সাহিত্যের এমন কোনও পাঠক সম্ভবত নেই, নিষিদ্ধ করতে চাওয়া এই বইটিকে যিনি পড়েননি। এমনকী পরবর্তীকালে, বইটিকে নিয়ে এই যে ম্যারাথন বিচার চলেছিল, সেই বিষয়েই একটি বই প্রকাশিত হয় ‘দি ট্রায়াল অফ লেডি চ্যাটার্লি’।
ইংরেজদের সবচেয়ে বেশি রাগ ছিল সাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এবং বিশেষত কবি নজরুল ইসলামের ওপর। শরৎচন্দ্রের রাজনৈতিক উপন্যাস ‘পথের দাবী’ নিষিদ্ধ হয়েছিল এবং তা নিয়ে সেইসময় প্রবল আলোড়ন সৃষ্টি হয়। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু জোরালো প্রশ্ন তুলেছিলেন সরকারের কাছে। ইংরেজরা শরৎচন্দ্রের ‘পথের দাবী’কে মনে করেছিল ‘বিষাক্ত সৃষ্টি’। তবে সবচেয়ে বিপজ্জনক মনে করত তারা কবি নজরুল ইসলামকে।
ব্রিটেনে প্রথম নিষিদ্ধ বই উইলিয়াম টিন্ডেলের ‘টিন্ডা বাইবেল’। ১৯২৫-২৬-এর কথা। এরকম অনেক বইয়ের মতন এই আলোচনায় উল্লেখ করা যেতে পারে জেমস জয়েসের বিশ্ববন্দিত উপন্যাস ‘ইউলিসিস’-এর কথা। ব্রিটেনেই নিষিদ্ধ করা হয়েছিল আশ্চর্য এই বইটিকে। নিষিদ্ধ করার কারণ আজ খুবই বোকা-বোকা বলে মনে হয়। সবচেয়ে হাস্যকর লাগে যখন আমরা জানি ‘গালিভারস ট্রাভেলস’-এর মতো অ্যাডভেঞ্চার বই অশ্লীলতার দোষে আয়ারল্যান্ডে নিষিদ্ধ হয়েছিল। কিংবা আমেরিকার ইন্ডিয়ানা রাষ্ট্রে ‘রবিনহুড’ নিষিদ্ধ হয়েছিল কমিউনিজমের গন্ধ খুঁজে পাওয়ায়। এরকমই বলা যায় রাশিয়ায় নিষিদ্ধ হওয়া একটি বইয়ের নাম আর্থার কোনান ডয়েলের ‘দি অ্যাডভেঞ্চারস অফ শার্লক হোমস’!
স্বেচ্ছাচারী শাসকের আচরণ এমনই হয়। কখনও নিষ্ঠুর, কখনও হাস্যকর। কিন্তু সবকিছুর পেছনেই থাকে তাদের আধিপত্যবাদ এবং সন্দেহবাতিকতা। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে এক কাণ্ড হয়েছিল। বিপ্লবী হীরালাল সেনের ‘হুঙ্কার’ বইটি নিষিদ্ধ হয় ১৯১১ সালে। এই বইটি তিনি উৎসর্গ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথকে। ফলে ইংরেজ শাসকের চাপে রবীন্দ্রনাথকে খুলনা কোর্টে হাজিরা দিতে হয় সাক্ষী হিসেবে। এরপর রবীন্দ্রনাথ হীরালাল সেনকে শান্তিনিকেতনে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ করেন। কিন্তু পুলিশের উৎপাত সেখানে এত বেড়ে যায় কবি তাঁকে জমিদারি দেখাশোনার কাজে পাঠান বাধ্য হয়ে। তাঁর কোনও বই নিষিদ্ধ না করলেও রবীন্দ্রনাথকে শাসক ইংরেজরা সন্দেহের চোখে দেখতেন। তবে ইংরেজদের সবচেয়ে বেশি রাগ ছিল সাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এবং বিশেষত কবি নজরুল ইসলামের ওপর। শরৎচন্দ্রের রাজনৈতিক উপন্যাস ‘পথের দাবী’ নিষিদ্ধ হয়েছিল এবং তা নিয়ে সেইসময় প্রবল আলোড়ন সৃষ্টি হয়। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু জোরালো প্রশ্ন তুলেছিলেন সরকারের কাছে। ইংরেজরা শরৎচন্দ্রের ‘পথের দাবী’কে মনে করেছিল ‘বিষাক্ত সৃষ্টি’। তবে সবচেয়ে বিপজ্জনক মনে করত তারা কবি নজরুল ইসলামকে। নজরুলের একের পর এক সৃষ্টিকে ইংরেজ সরকার নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছেন। নজরুলের নিষিদ্ধ প্রথম বই কিন্তু কাব্যগ্রন্থ নয়, তাঁর রচিত কিছু নিবন্ধের সংকলন ‘যুগবাণী’। ১৯২২সালে নিষিদ্ধ হয় বইটি। এর পরপরই নিষিদ্ধ হয় কাব্যগ্রন্থ ‘বিষের বাঁশি’, ‘ভাঙার গান’, ‘প্রলয় শিখা’। ছয় মাসের কারাদণ্ড হয় বিদ্রোহী কবির। নিষিদ্ধ হয় তাঁর ব্যঙ্গ কবিতার সংকলন ‘চন্দ্রবিন্দু’ও। প্রায় একই সময়ে ১৯৩২ সালে চারণকবি মুকুন্দরাম দাসের দেশাত্মবোধক গানের সংকলন ‘কর্মক্ষেত্রের গান’ এবং ‘পথের গান’ নিষিদ্ধ ঘোষণা করে ইংরেজ সরকার। এই সময়ের শাসক ইংরেজদের খেয়াল করলেই বোঝা যায় কোন ভয় থেকে, কোন অসহিষ্ণুতা থেকে বিশ্বজুড়ে এতকাল ধরে শত শত শত বই নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এই সময়ে ভারতবাসীর অন্তর স্বাধীনতা-স্পৃহায় ভরে গিয়েছিল। আর সেই বিদ্রোহের আভাস শাসকের অন্তরে এনেছিল ভয়। ক্ষমতা চলে যাওয়ার ভয়েই ইংরেজ শাসক দেশপ্রেমমূলক অজস্র বাংলা বইকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। দুঃখের কথা, সেই সব বই ও তার লেখকদের বেশির ভাগকেই আমরা ভুলে গেছি। সখারাম গণেশ দেউস্কর-এর ‘দেশের কথা’ এবং ‘তিলকের মোকদ্দমা ও সংক্ষিপ্ত জীবনকথা’ বই দুটি নিষিদ্ধ হয় ১৯১০ সালে। ১৯২৫ সালে নিষিদ্ধ হয় বিপ্লবী মানবেন্দ্রনাথ রায়ের ‘সান ইয়াৎ সেন’— চীনের নেতার জীবনী। বিপ্লবী ডঃ ভূপেন্দ্রনাথ দত্তের ‘অপ্রকাশিত রাজনৈতিক ইতিহাস’ প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ড নিষিদ্ধ হয় ১৯৩৪ সালে। সোমনাথ লাহিড়ীর ‘সাম্যবাদ’ নিষিদ্ধ হয় ১৯৩০ সালে। এইগুলি হয়তো তাঁদের প্রতিষ্ঠার কারণে আমাদের জানা আছে।
ব্রিটেনে প্রথম নিষিদ্ধ বই উইলিয়াম টিন্ডেলের ‘টিন্ডা বাইবেল’। ১৯২৫-২৬-এর কথা। এরকম অনেক বইয়ের মতন এই আলোচনায় উল্লেখ করা যেতে পারে জেমস জয়েসের বিশ্ববন্দিত উপন্যাস ‘ইউলিসিস’-এর কথা। ব্রিটেনেই নিষিদ্ধ করা হয়েছিল আশ্চর্য এই বইটিকে। নিষিদ্ধ করার কারণ আজ খুবই বোকা-বোকা বলে মনে হয়। সবচেয়ে হাস্যকর লাগে যখন আমরা জানি ‘গালিভারস ট্রাভেলস’-এর মতো অ্যাডভেঞ্চার বই অশ্লীলতার দোষে আয়ারল্যান্ডে নিষিদ্ধ হয়েছিল।
কিন্তু আমরা ভুলে গেছি ইংরেজ আমলে প্রথম নিষিদ্ধ উপন্যাসের নাম ‘সোফিয়া বেগম’। মণীন্দ্রনাথ বসুর এই উপন্যাসটিতে আছে সিপাহী বিদ্রোহের সময়কাল। এই ঐতিহাসিক রাজনৈতিক উপন্যাসটি ১৯১০ সালে নিষিদ্ধ হয়। স্বাধীনতার দাবিতে মুখর এই অগ্নিকালে নিষিদ্ধ হয় মৌলবী আহমেদ আলীর ‘চরকা মাহাত্ম্য’, মতিলাল রায়ের ‘শতবর্ষের বাংলা’—যা বিখ্যাত বাঙালিদের জীবনী, পুলকেশ চন্দ্র দে সরকারের ‘বিপ্লব পথে ভারত’ ও ‘ফাঁসির আশীর্বাদ’, বিপ্লবী চারুবিকাশ দত্তের ‘বিদ্রোহী বীর প্রমোদরঞ্জন’— যা ফাঁসি হয়ে যাওয়ার পরে সহযোদ্ধা বিপ্লবী বন্ধুকে নিয়ে লেখা। অজস্র নিষিদ্ধ বইয়ের মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য স্বাধীনতা সংগ্রামী জ্ঞানাঞ্জন নিয়োগীর ‘বিপ্লবী বাংলা’, ‘দেশের ডাক’, ‘বিলাতী বস্ত্র বর্জন করিব কেন?’। স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ নেওয়া নারীদের কথা লিখে ইংরেজ সরকারের মুখে পড়েছিলেন সান্ত্বনা গুহ। তাঁর ‘বন্দী নারী’ ও ‘অগ্নিমন্ত্রে নারী’ গ্রন্থদুটি প্রকাশ মাত্র নিষিদ্ধ হয়।
বই পুড়িয়ে বা লেখককে শাস্তি দিয়ে বইয়ের মৃত্যু ঘটানো যায় না। আমাদের সময়ের দুটি ঘটনা মনে করিয়ে দিই। দুই লেখক সালমান রুশদি এবং তসলিমা নাসরিন। রুশদির ‘স্যাটানিক ভার্সেস’ প্রকাশিত হয় ১৯৮৮ সালে। একটি ধর্মের অবমাননা হয়েছে এই অভিযোগে পৃথিবী জুড়ে হইচই! কিছু জায়গায় নিষিদ্ধ হয় বইটি। ১৯৮৯ সালে তাঁর বিরুদ্ধে মৃত্যু পরোয়ানা জারি করে একটি গোষ্ঠী। জীবন বাঁচাতে দীর্ঘকাল লুকিয়ে থাকেন লেখক। বাংলাদেশি সাহিত্যিক, বর্তমানে নির্বাসিত জীবনযাপনকারী, তসলিমারও ‘লজ্জা’ উপন্যাস সহ বেশ কয়েকটি বই তাঁর স্বদেশে নিষিদ্ধ। এমনকী ভারতের পশ্চিমবঙ্গেও নিষিদ্ধ হয়েছে তাঁর আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘দ্বি-খণ্ডিত’। লেখকের বিরুদ্ধে অভিযোগ যা-ই থাকুক না কেন, বই নিষিদ্ধ করা কি সঠিক পথ? পক্ষে-বিপক্ষে মতামত থাকবেই, কিন্তু মনে রাখতে হবে নিষিদ্ধ বই অস্তিত্ব হারায় না। আজকের ধর্মীয়, সামাজিক, রাজনৈতিক কারণগুলি বরং আগামীতে বদলে যায়। পাঠকের সমর্থনে বই ফিরে-ফিরে আসে।
বইয়ের মধ্যে থাকা চিন্তাকে মেরে ফেলা যায় না, একথা প্রমাণিত সত্য। কিন্তু একইসঙ্গে আমাদের মনে রাখতে হবে সেই বই, সেই লেখক এবং বইয়ের মধ্যে রাখা চিন্তা ও ঘটনা তার অস্তিত্ব হারাতে পারে চর্চার অভাবে। নিষেধ যাকে মারতে পারে না, জ্ঞানস্পৃহার অভাব তাকে নিশ্চিহ্ন করতে পারে সহজেই। বই নিষিদ্ধ করুক শাসক, বই পড়বার মনকে যেন নিষিদ্ধ না করি আমরা কখনও।
কবি, ঔপন্যাসিক ও প্রাবন্ধিক বিভাস রায়চৌধুরী দীর্ঘদিন কবিতার প্রকাশনা ও চর্চার সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত। 'কবিতা আশ্রম' পত্রিকার মুখ্য পরিকল্পক। পেয়েছেন কৃত্তিবাস পুরস্কার ও বাংলা একাডেমি পুরস্কার। ওঁর প্রথম প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের নাম নষ্ট প্রজন্মের ভাসান (১৯৯৬)। এর পরে কবি পাঁচটি উপন্যাস সহ কুড়িটিরও বেশি কবিতা গদ্য ও প্রবন্ধের বই লিখেছেন।