আমি আসলে অ্যাক্সিডেন্টাল অ্যাক্টর। পরিকল্পনা করে নয়। অভিনয়টা পেশা হয়ে গিয়েছে নেহাত ঘটনাচক্রে। মানিকদা নিলেন পরপর দু’টো ছবিতে। তারপর কাঞ্চনজঙ্ঘা’-য় অভিনয় করা হল না। ইতিহাস ভালোবাসি বলে মন দিয়েই পড়াশোনা শুরু করেছিলাম। কিন্তু শেষ অঙ্ক’, ‘নির্জন সৈকতে’-র মত ছবিগুলো পরপর চলে এল বলে কলেজ অনেকটা অনিয়মিত হয়ে গেল। ঠিক স্বাভাবিক ছাত্রীজীবনও ছিল না আমার। সহপাঠীদের মধ্যে যারা নাক-উঁচু, তারা অনেকে মনে করত সিনেমার অভিনেত্রী, ও ভালো মেয়ে নয়। কী দরকার কথা বলার? আবার অন্য অনেকে ছুটে এসে জানতে চাইত, উত্তমকুমারের সঙ্গে ওই সিনটার কথা বল। কী মনে হচ্ছিল তোর? উত্তমকুমার কী বললেন তোকে, এই সব।

এদিকে লোরেটোর প্রিন্সিপাল মাদার অ্যান্সেলর বারবার বলেন, ‘এত পুওর অ্যাটেন্ড্যান্স তোমার, কী করে হিস্ট্রি অনার্স পারবে? পাস কোর্স নাও।’ একদিন রাগ করে বললাম, আমি যথেষ্ট উৎসাহ নিয়েই কলেজে ভর্তি হয়েছিলাম। কিন্তু তোমরাই আমাকে নিরুৎসাহ করছ। শুধু অনার্স কেন, কলেজই ছেড়ে দিচ্ছি। তবে পড়াশোনাটা তো ছাড়ছি না। দেখো, তোমার অনার্স-পড়া মেয়েদের চেয়ে ইতিহাস আমি কম জানব না! প্রিন্সিপালকে এইভাবে কথা শুনিয়ে আসায় মা অবশ্য খুব চিন্তায় পড়েছিলেন। বোনেরা যদি পড়তে চায়, এরপর ওই কলেজ কি আর তাদের নেবে?  

Sharmila Tagore
ততদিনে বম্বেতে কাজের ব্যাপারে কথাবার্তা শুরু হয়ে গিয়েছে। ছবি – লেখকের সংগ্রহ

এদিকে তত দিনে বম্বেতে কাজের ব্যাপারে কথাবার্তাও শুরু হয়ে গেছে। সেটা ১৯৬২।
শাম্মি কপুর তখন নতুন নতুন মেয়েদের হিরোইন করে ছবি করছেন
, আর সেই সব ছবি ভালো ব্যবসাও করছে। শাম্মিজিকে নায়ক করে নতুন ছবি তৈরি করবেন শক্তি সামন্ত। নিজেরই প্রযোজনায়। ছবির নায়িকা থাকে কাশ্মীরের গ্রামে, সেখানেই নায়কের সঙ্গে তার প্রেম। সুতরাং বেশ কিছু নাচ-গান থাকবে কাশ্মীরের সুন্দর সুন্দর জায়গায়। চলছে সেই ছবির নায়িকার সন্ধান।
তখনকার দিনে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় কলাম লিখতেন বিখ্যাত লেখক শচিন ভৌমিক। তিনি ছিলেন আমার মায়ের বন্ধু। তিনি আমার কথা বলতেই সকলে বলল
, হ্যাঁ, ‘অপুর সংসার’-এ তো ওর কাজ দেখেছি। আর, ‘অপুর সংসারসকলেরই খুব ভালো লেগেছিল। পাবলিসিটির সুবিধের কথাটাও ওঁদের মাথায় ছিল। সত্যজিৎ রায়ের নায়িকা, সারনেম টেগোর, ইত্যাদি। তাছাড়া, বাঙালি প্রযোজক-পরিচালক বলে বাঙালি নায়িকার প্রতি একটা টানও বোধ হয় ছিল। সুতরাং আমাকেই বাছা হল কাশ্মীর কি কলি’-র (১৯৬৪) নায়িকা। ছায়াসূর্য’-র ঘেঁটু হয়ে গেল কাশ্মীর কি কলি’-র চম্পা।

কত টাকা পেয়েছিলাম জানেন, নায়িকা হিসেবে? পঁচিশ হাজার। এখন শুনলে অনেকে হাসে, কিন্তু তখন ওইরকমই ছিল হিন্দি ছবির নায়িকাদের পারিশ্রমিক। সেটা বাড়তে বাড়তে, যখন আমি বম্বের সবচেয়ে দামি হিরোইন, পৌঁছেছিল সাড়ে ন’ লাখ টাকায়। আর এখন? বিজ্ঞাপনের জন্যে একদিনের কাজ করতেই আজকাল অনেকে ওরকম টাকা নেয়।

কাশ্মীর কি কলি’-র আউটডোর করে নেওয়া হল আগে। মানে প্রথমেই সেরে নেওয়া হল শ্যুটিংয়ের কাশ্মীর-পর্ব। শুরুতে টানা বৃষ্টি চলেছিল বেশ কয়েক দিন। বৃষ্টি থামতেই পরপর শ্যুটিং হল ‘দিওয়ানা হুয়া বাদল’-এর মত গোটা চারেক গানের। শিকারাতে শ্যুটিং হল ‘ইয়ে চাঁদ সা রোশন চেহরা’ গানটার। তখন কি আর জানি, ও পি নায়ারের সুর দেওয়া এই সব গান আর তার পিকচারাইজেশন পঞ্চাশ বছরেরও বেশি জাঁকিয়ে বসে থাকবে লোকের মনে! আউটডোর শেষ করে আমরা বম্বে ফেরার পর ইনডোরে ‘ইশারোঁ ইশারোঁ’ গানটার শ্যুটিং। সেদিন সেটে হাজির শশী কপুর। আমি আবার তখন শশী কপুরের মস্ত ফ্যান। সত্যিই নার্ভাস হয়ে পড়েছিলাম ওঁর সামনে অভিনয় করতে গিয়ে। শক্তিজি গিয়ে শশীকে বললেন, প্লিজ বাইরে যাও, তুমি সেটে থাকলে আমার হিরোইন কাজ করতে পারছে না। এসব বলে বারই করে দেওয়া হল শশী কপুরকে।

শ্যুটিং শেষ হওয়ার পর সবাই মিলে যখন রাশ দেখা হল, আমি তো কেঁদেই আকুল। যেমন খারাপ দেখাচ্ছে আমাকে, কাজও করেছি তেমনই খারাপ। বললাম, এখানে কাজ করব না, থাকবও না আর। ফিরে যাব কলকাতায়। শশীই তখন অনেক বুঝিয়েছিল। বলেছিল, এসব ভেবই না। বেশ ভালো কাজ করেছ, লোকের খুব ভালো লাগবে! তার অনেক বছর পরেও যখন বম্বেতেই থেকে গিয়েছি, শশী তখন ঠাট্টা করে বলত, একজন হিরোইন আছে যে একটা করে ছবি শেষ করে আর বলে, আর কোনও ছবি করব না। বলে, চারটে ছবি ছেড়ে দেয়। তারপর পাঁচটা ছবি সাইন করে!

Sharmila Tagore
অনুপমাতে প্রথম একটু অন্য ধরনের চরিত্র হিন্দিতে। হৃষীদার সঙ্গে প্রথম কাজ। ছবি – লেখকের সংগ্রহ

বম্বেতে কাজ করতে গিয়ে, হ্যাঁ, কালচার শক তো বলাই যায়। বম্বের ধরনধারণ কলকাতার থেকে এত আলাদা! প্লে ব্যাকের সঙ্গে লিপ সিঙ্ক, নাচ, এসব তো করিনি আগে। রঙিন ছবিই করিনি, তার ওপর কাশ্মীর কি কলিতো ইস্টম্যানকালার। মেক আপ হত খুব চড়া। আমাকে কোচ রেখে হিন্দি শেখানো হল, নাচ শেখানোর ব্যবস্থা হল। বম্বেতে কাজ করতে হলে অভিনেতা-অভিনেত্রীদের তো কিছু অতিরিক্ত দক্ষতা লাগে। বাংলার তুলনায় হিন্দি ছবির টেম্পোও অনেকটা আলাদা, ক্যানভাসটা অনেক বড়। প্রযোজক, পরিচালক, সহ-অভিনেতা, কলাকুশলীরা সব এসেছেন দেশের এক এক জায়গা থেকে। ভাষাই শুধু নয়, তাঁদের পোশাক, সংস্কৃতি, ভাবনাচিন্তার ধরন, সব মিলিয়ে যে বৈচিত্র্যটা তৈরি করে সেটা বেশ তাক লাগিয়ে দেওয়ার মত। কেউ কাউকে মিস টেগোর বা মিস্টার সিকন্দ বলে ডাকছে না। মিস শর্মিলা বা মিস্টার প্রাণ বলে ডাকছে। আঞ্চলিকতা ছাপিয়ে সর্বভারতীয় পরিচয় তৈরির একটা প্রকট চেষ্টা। ছবির গল্পেও অবাস্তবতা। নায়ক শহরের ছেলে হয়েও গ্রামের মেয়ের প্রেমে পাগল। কিন্তু নায়ককে সবাই যার ছেলে বলে জানে, আসলে সে তার ছেলে নয়। নায়িকা যাকে বাবা বলে জানে, সে আসলে নায়িকার বাবা নয়! এইরকম অদ্ভুত সব জটিলতা থাকত তখনকার ছবিতে।

হিন্দি ছবির গল্পের ধরন এখন অনেক পাল্টে গেছে। অবাস্তব গল্প নিয়ে ছবি হয়তো আজও হচ্ছে, কিন্তু তার পাশাপাশি বিষয়ের, কাহিনীর নতুন দিগন্ত খুলে গেছে হিন্দি ছবিতে। গভীর সামাজিক প্রাসঙ্গিকতার পরিচয় দিচ্ছে মূল ধারার বেশ কিছু হিন্দি ছবি। জাত-পাত, নারী-পুরুষের বৈষম্য তুলে ধরছে, তার সঙ্গে সোজাসাপ্টা ভাষায় বলছে রাজনৈতিক দুর্নীতি, প্রশাসনিক দুর্নীতি, সংবাদজগতের দুর্নীতি, শিক্ষাক্ষেত্রের দুর্নীতি, বিচারব্যবস্থার দুর্নীতি, এমনকি ধর্মগুরুদের দুর্নীতির কথা। অনেক পরিণত হয়েছে দেশের বিনোদনের জগৎ। 

Sharmila Tagore
১৯৬৯-এ করলাম সত্যকাম। আবার হৃষীদা। ছবি – লেখকের সংগ্রহ

 আসলে, আমি যখন বম্বেতে প্রথম কাজ করতে গিয়েছি, প্রায় পঞ্চান্ন বছর আগের সেই সময়টার একটা নিজস্ব বৈশিষ্ট্য ছিল। বন্দিনী’-র (১৯৬৩) পর থেকে তো বিমল রায়ের যুগ শেষ। শরীর খারাপ হয়ে গেছে তাঁর, ক্যান্সার হয়েছে। এদিকে, চিনের সঙ্গে যুদ্ধের ফলে তখন আমাদের অর্থনীতি টালমাটাল। চাকরি নেই, প্রচুর বেকার। স্বাধীনতার পর নতুন ভারত নির্মাণের যে স্বপ্ন ছিল, সেটা মস্ত ধাক্কা খেয়েছে। এইরকম প্রতিকূল একটা বাস্তব পরিস্থিতিতে দর্শক টানতে হিন্দি ছবি বিনোদনের দিকে একটু বেশিই ঝুঁকল, এসকেপিস্ট হয়ে গেল। সিমলা, কাশ্মীরের মত চোখ-জুড়নো লোকেশনে তৈরি হতে লাগল ছবি। চমৎকার গান থাকত সাত-আটটা। সে রকম ছবি লোকের পছন্দও হচ্ছিল তখন। পথটা দেখিয়েছিলেন শশধর মুখোপাধ্যায়। তাঁর সাফল্য দেখে অনেকেই তখন সেই রাস্তা ধরেছিলেন।

Sharmila Tagore
বাসু ভট্টাচার্যের ছবি গৃহপ্রবেশ মন দিয়ে দেখার মতো ছবি। ছবি – লেখকের সংগ্রহ

হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায়, বাসু ভট্টাচার্যরা অবশ্য এই ধারার বাইরে হেঁটেছেন। ঠিক সমান্তরাল বলব না, খানিকটা মধ্যপন্থী। ছবিতে বিনোদন যেমন থাকত, তার সঙ্গে মধ্যবিত্ত বা নিম্নবিত্ত সমাজের একটা হৃদয়স্পর্শী কাহিনিও থাকত। ব্যবসায়িক ছবিতে সফল অভিনেতা-অভিনেত্রী থাকত, পাশাপাশি কোনও সামাজিক সমস্যা নিয়ে একটা গভীর ভাবনাও থাকত। দু’জনেরই কয়েকটা ছবিতে কাজ করেছি আমি। হৃষীদার অনুপমা’ (১৯৬৬), ‘সত্যকাম’ (১৯৬৯), ‘চুপকে চুপকে’ (১৯৭৫)। বাসু ভট্টাচার্যের আবিষ্কার’ (১৯৭৪), ‘গৃহপ্রবেশ’ (১৯৭৯)। মন দিয়ে দেখার মত ছবি সেগুলো, তবে সিরিয়াস আর্ট ফিল্ম নয়।

বম্বেতে সমান্তরাল ছবি, বা আর্ট ফিল্ম করে প্রথম সফল হলেন শ্যাম বেনেগাল। একের পর এক সুদৃশ্য ফ্রেম সাজিয়ে ঠাসবুনোট চিত্রনাট্যের মধ্যে দিয়ে সামন্ততান্ত্রিক সমাজ, পুরুষতান্ত্রিক একাধিপত্য বা কিছু জাতিকে নিচুমনে করার মতো উৎকট সামাজিক সমস্যার কথা বলতে পেরেছিলেন শ্যাম। দারুণ ছবি হয়েছিল অঙ্কুর’ (১৯৭৩)। চমৎকারভাবে সিনেমার ভাষা প্রয়োগ করে সামাজিক ভাবনার দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সব ছবি করেছেন শ্যাম বেনেগাল। এবং তাঁর পর আরও অনেকে। ফলে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ভারতীয় সিনেমার তিনটে ধারা একেবারে বাণিজ্যিক ছবি, পুরোপুরি শিল্পসমৃদ্ধ ছবি, আর এই দু’য়ের মাঝামাঝি একটা পথ ধরে তৈরি ছবি নিজের নিজের জায়গা খুঁজে পেয়েছে, আমাদের সিনেমা শিল্পকে সমৃদ্ধ করেছে। (চলবে)

মনে, রেখে দেব (পর্ব ৩)

আদতে ছিলেন সাংবাদিক, তারপর কর্পোরেট কর্তা। অবসরের পর শান্তিনিকেতনে বসে লেখাজোকায় মন দিয়েছেন। বেশ কিছু প্রবন্ধ আর গল্প লিখেছেন আজকাল, অনুষ্টুপ আর হরপ্পা-য়। প্রথম উপন্যাস 'গোলকিপার' প্রকাশিত হয়েছে বাংলালাইভে। আপাতত ডুবে রয়েছেন ভারতীয় সিনেমার ইতিহাসে। আজকালের রবিবাসর ক্রোড়পত্রে প্রকাশিত হচ্ছে তাঁর ধারাবাহিক রচনা - সিনেমাতলার বাঙালি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *