ভোরে উঠে রোজকার মত দরজা খুলেই লাফ দিয়ে ওঠেন ম্যাডলিন। একি! একটা ফুলের বোকে না? বাইরের ডোরম্যাটের ওপর বসান। বিশাল একটা সাদা ক্রিসান্থিমাম ঘিরে এক গুচ্ছ পিংক কারনেশন- সাদা স্নো-ডিউয়ের কুঁচি দিয়ে হালকা গোলাপি রিবন এর বাঁধনে আটকান সাদা বাক্সটি যেন রাজকীয় ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে ম্যাডলিনের দিকে। কৌতূহলী হয়ে এগিয়ে গিয়ে তুলে নেন বোকেটি।
“যার ফুল নিয়েছিলাম”– লেখা একটা ছোট্ট কার্ড আটকান বাক্সটিতে।
সেকি? কাকে তিনি ফুল দিয়েছিলেন? ম্যাডলিন ভুরু কোঁচকান। না, দেখছি লেখা রয়েছে- ‘যার ফুল নিয়েছিলাম’। মানে? যার ফুল নেওয়া হয়েছিল তার ইচ্ছের তোয়াক্কা না করেই… তাই কি? সে রকমই তো মানে দাঁড়াচ্ছে। তাহলে? কে সে? এ ফুল যদি তাঁকেই দেওয়া হয় তবে ম্যাডলিন তো মনে করতে পারছেন না এরকম কোন ঘটনা।
ফুলের বোকেটি নিয়ে এসে কফি টেবিলের উপর রেখে জানলায় এসে দাঁড়ান ম্যাডলিন। স্মৃতির ঝাঁপি খুলে হাতড়াতে থাকেন। কিছু সুদূর, কিছু অদূর অতীত, কিছু গতকাল, কিছু তার আগের এলোমেলো ছবি আসতে থাকে। মিল খুঁজে পান না। চোখ ভেসে থাকে সামনের বাগানে, রাস্তায়। এখনও ভাল করে আলো ফোটেনি। সকালের পথচারী রাস্তায়। আরে কে ও? সেই মেয়েটি না? সেই দীঘল কালো তেজালো চেহারা, বড় বড় চোখ, ঘন কালো চুলের গোছার পনিটেল। হ্যাঁ সেই তো। সেই বোট লেডি। চেহারা দেখলেই বোঝা যায়। এই তো তার গাছ তলায় পড়ে থাকা ফ্র্যাঞ্জিপ্যানি থেকে রোজ ঠিক দু’টো ফুল তুলে নিয়ে যেত। গাছটা ম্যাডলিনের ড্রাইভওয়ের ঠিক মাঝামাঝি জায়গায়। সেখান থেকেই মেয়েটি ফুল নিত। মেয়েটা আরও একটু ভেতরে এলেই হয়ত সিকিউরিটি অ্যালার্ম বাজা শুরু হত। তার মানে মেয়েটা প্রায় বাড়ির প্রাইভেসি লঙ্ঘন করত। তাই একটা বিতৃষ্ণা জাগে মেয়েটাকে দেখে।
অনসূয়া রোজ সকালে হাঁটতে বের হয়। আর ফেরে ঠিক দু’টো টাটকা ফুল নিয়ে। যে কোনও রঙের টাটকা দু’টো ফুল। ফুল দু’টো এনে রাধা মাধবের পায়ের কাছে রাখে। সবে দেশ থেকে সে এসেছে এই বিদেশ বিভূঁইয়ে। চারদিকে এত ফুল, কিন্তু গাছ থেকে একটাও তোলার উপায় নেই।
ম্যাডলিনের ঘুম ভাঙে প্রায় ভোর পাঁচটায়। নিত্য তিরিশ দিন, সারা বছর। উঠে তিনি দোতলার রাস্তার ধারের জানালার পাশে এসে বসেন। তার আগে বেডরুম লাগোয়া ছোট্ট কিচেনেটে ঢোকেন। বার করেন সুগন্ধী চা আর সুদৃশ্য কাপ। কাপের গায়ে জ্যাকারান্ডার সবুজ ঝিরঝিরে পাতা। পাতার মাঝখানে গাঢ় বেগুনি রঙের ফুল। ম্যাডলিনের পছন্দের রং এটা। সে নিজেই এই টি-সেটটি কিনেছিলেন তাঁর গত জন্মদিনে।
ম্যাডলিন কাপেতে চা ঢালেন। দু’কাপেই ঢালেন সব সময়। মার্কের জন্য এক কাপ। ভাবেন মার্ক ঠিক তার সঙ্গেই চা খাচ্ছেন। কতদিন তার সঙ্গে দেখা নেই। তবু অভ্যাসটি ধরে রেখেছেন। প্লেটে রকমারি বিস্কিট নিয়ে ট্রেতে সাজিয়ে জানলার ধারের টেবিলে রেখে চেয়ারে বসেন। জানলা দিয়ে সকালের টাটকা ঠান্ডা বাতাস জ্যাকারান্ডার ঝিরঝিরে পাতা দুলিয়ে গায়ে এসে লাগে। মনটা তাজা হয়ে ওঠে। চায়ে চুমুক দেন। চোখ থাকে রাস্তায়। এ রকম সময়ে কোনও এক দিনে তিনি দেখেছিলেন ওই বোট লেডিকে ড্রাইভওয়েতে ঢুকে একটা ফুল কুড়িয়ে নিয়ে চলে যেতে।
একই ঘটনা তিনি পর পর কয়েকদিন দেখেছিলেন। ভাবছিলেন কিছু একটা করতেই হবে এটা আটকাতে। এটা সহ্য করা যায় না কোনওমতেই।
অনসূয়া রোজ সকালে হাঁটতে বের হয়। আর ফেরে ঠিক দু’টো টাটকা ফুল নিয়ে। যে কোনও রঙের টাটকা দু’টো ফুল। ফুল দু’টো এনে রাধা মাধবের পায়ের কাছে রাখে। সবে দেশ থেকে সে এসেছে এই বিদেশ বিভূঁইয়ে। চারদিকে এত ফুল, কিন্তু গাছ থেকে একটাও তোলার উপায় নেই। কাউকে তেমন চেনে না যে ফুল চাইবে। চাইলে হয়ত দেবে। কিন্তু রোজ রোজ চাইলে নিশ্চয়ই সেটা বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে। কিন্তু ফুল যে তার রোজই চাই। দেশ থেকে গৃহদেবতা রাধামাধব তার সঙ্গে এসেছেন। তার পুজো তো করতেই হবে দু’টো ফুল দিয়ে। আর সেটা টাটকা ফুল হওয়া চাই। সুপার মার্কেটের বাসি ফুল নয়।
হাঁটতে হাঁটতে ফ্র্যাঞ্জিপ্যানি বাড়িটার কাছাকাছি আসতেই চমকে উঠল সে। বাড়িটার ঠিক বাইরে রাস্তার উপরে আর ধারে ধারে পড়ে আছে একরাশ কাঠগোলাপ ফুল। সব দলিত, নিষ্পেষিত, ছেঁড়া-ছেঁড়া। মনে হচ্ছে, কেউ যেন নিরুদ্ধ রাগে ফুলগুলোকে পা দিয়ে দলেছে। তারপর ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলেছে রাস্তার ওপর। অবাক বিস্ময়ে সে লক্ষ্য করে কাঠগোলাপ গাছটির তলা শুন্য, একটি ফুলও সেখানে পড়ে নেই।
তাই প্রাতঃভ্রমণে বেরিয়ে নিজেই ফুল কুড়িয়ে আনে, যখন যেখানে পায়। মাটিতে যেগুলো সদ্য পড়ে থাকে সেগুলোই নেয়। গাছ থেকে তো আর ছেঁড়া যায় না। তাই ফুল কুড়নো চলছিল বেশ কিছুদিন ধরে। বিশেষ করে কয়েকটা ব্লক পেড়িয়ে দু’রাস্তার কোণে যে বাড়িটা আছে, সেই খুব সুন্দর দোতলা বাড়িটা। একপাশে দীর্ঘ পাম গাছের সারি, সতেজ সবুজ পাতা আর ছোট ছোট মুক্তো রঙের ফলের বিশাল ঝারি ঝুলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তারা। লনটার ঘাস সুন্দর করে ছাঁটা। পামের সারির নিচেই সবুজ গাছ দিয়ে বানান ছোট ছোট মোড়ার মত এক সারি– ঠিক যেন বসার জায়গা। কী গাছ ওগুলো কে জানে? পাতাগুলো দেখে মনে হয় কামিনী গাছ। কিন্তু কোনওদিন ওই মোড়াগুলোতে ফুল ফুটতে দেখেনি সে। কে জানে? হয়ত ফুটবে কোনও এক দিন। কালো খসখসে টাইলস দিয়ে বানান একটা চওড়া গাড়ি ঢোকার রাস্তার ঠিক মাঝখানে একটা কাঠগোলাপ বা ফ্র্যাঞ্জিপ্যানি গাছ। কালচে সবুজ বলিষ্ঠ তার পাতাগুলো। আর কী সুন্দর যে তার মাঝখানের ফুলগুলো– ঘিয়ে রঙের পাপড়ি– একটু ভেতরের দিকে গাঢ় হলুদ রং। তার দু’-একটা পড়েছিল গাছতলায়, কালো টাইলস আলো করে। যেন মাধবের পদমূলেই কেউ অর্ঘ্য দিয়েছে। অনসূয়া নিজেকে সামলাতে পারেনি। এগিয়ে গিয়েছিল। তুলে নিয়েছিল দু’টো ফুল। নিয়েছিল তার পরের দিনও আবার। তারও পরের দিন, এবং পর পর আরও কিছুদিন।
সেদিন অনেক ভোরে বেরিয়েছে অনসূয়া। হাঁটছে। সূর্য ওঠার অনেক দেরি। এই অঞ্চলটি এখানকার একটি জাতীয় অরণ্যের কাছাকাছি। তাই দীর্ঘ বয়স্ক চিরহরিৎ মহীরুহের উপস্থিতি এখানে। তাদের মাথায় হালকা কুয়াশার আচ্ছাদন এই বসন্তেও।
হাঁটতে হাঁটতে ফ্র্যাঞ্জিপ্যানি বাড়িটার কাছাকাছি আসতেই চমকে উঠল সে। বাড়িটার ঠিক বাইরে রাস্তার উপরে আর ধারে ধারে পড়ে আছে একরাশ কাঠগোলাপ ফুল। সব দলিত, নিষ্পেষিত, ছেঁড়া-ছেঁড়া। মনে হচ্ছে, কেউ যেন নিরুদ্ধ রাগে ফুলগুলোকে পা দিয়ে দলেছে। তারপর ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলেছে রাস্তার ওপর। অবাক বিস্ময়ে সে লক্ষ্য করে কাঠগোলাপ গাছটির তলা শূন্য, একটি ফুলও সেখানে পড়ে নেই। মাথা তুলে দোতলার দিকে চোখ পড়তেই এক বয়স্কার চোখে চোখ পড়ে।
ব্যাপারটা বুঝতে অনসূয়ার আর অসুবিধে হয় না। মাথা হেঁট হয়ে আসে তার বিচিত্র অনুভুতিতে। লজ্জা, ক্ষোভ, ধিক্কার সব একসঙ্গে তার মনকে অবশ করে দেয়। কী করবে সে এখন?
ম্যাডলিনের চা খাওয়া শেষ হয়েছে। তবু তিনি বসে থাকেন। অন্যমনস্ক। কে দিয়ে গেল বোকেটা? এই যে এইমাত্র গেল যে বোট লেডিটি, সেই কি দিল? ও অনেকদিন আসেনি এদিকে। আবারও দেখছি আজকাল আসছে। ওকে তো ভালো জব্দই করা গেছে সেদিন। সেই কি লজ্জায় পড়ে ফুল দিয়ে… না না… সেই সেন্স অফ গ্র্যাটিটুড এর কাছে আশা করা যায় না? একেবারেই না। তবে কি ডিক? হ্যাঁ হ্যাঁ হতে পারে। ওই তো বলেছিল যে,
– তোমার ফুল ফেরত দিয়ে আসব ঠিক একদিন।
গতবারের ক্রিসমাস পার্টিতে যে জেন্টলম্যানের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। হ্যান্ডসাম, কেতাদুরস্ত, রয়্যাল ড্রেস আর নিখুঁত টাই-এর নট দিয়ে যে মধ্য বয়স্ক যুবকটি প্রায় সব পার্টি লেডিদের চোখ টেনে নিচ্ছিল। ম্যাডলিনের মনে হয়েছিল, ঠিক যেন এক রয়্যাল প্রিন্স। ইতিহাসের পাতা থেকে উঠে এসেছে।
পিঙ্ক কারনেশনটা টেবিলে রাখতে রাখতে ভাবেন ডিক। কিন্তু কেন এমন হল? একি পিঙ্ক কারনেশনটার জন্য? যে ফুল ওকে, ওর মনকে স্মৃতিমেদুর করে দেয়। ওর হাই-স্কুল সুইটহার্ট ইসাবেলা, তার অনুষঙ্গ এই ফুলে। হঠাৎ কী হয়েছিল ইসাবেলার কে জানে? ওর কি একবারও ভুলে ডিকের কথা…
নাচের মিউজিক শুরু হতেই আচমকা ম্যাডলিনকে অবাক করে দিয়ে সেই রাজপুত্র বাও করে এসে ম্যাডলিনকে নাচের অফার দিয়েছিল হাত বাড়িয়ে দিয়ে। নাম বলেছিল, ডিক। ম্যাডলিনের সাধ্য কী সেই বাড়ান হাত ফিরিয়ে দেন। নাচতে উঠেছিলেন ম্যাডলিন। মিউজিক শুরু হয়েছিল- ‘ওহ মাই আইলীন’। ম্যাডলিন নাচছিলেন একাত্ম হয়ে। বহুদিন পড়ে গালে তাঁর রং ধরেছিল– বার্গান্ডি। কিন্তু খুব বেশি ক্ষণ সেটা স্থায়ী হয়নি। তাল দ্রুত হতেই আচমকা ডিকের হিল তোলা ভারি জ্যাজ প্ল্যাটফর্ম জুতোর আঘাতে তিনি একেবারে বসে পড়েন। সঙ্গে সঙ্গে ডিক তাঁকে ধরে ফেলেছিল। নিচু হয়ে বসে পড়ে ওর পা দেখেছিল– কতটা আঘাত সেখানে। তারপরে হাত ধরে টেবিলে এনে বসিয়ে দিয়েছিল। ডিক ক্ষমা চেয়েছিল। অনেকবার। ম্যাডলিন তখনও হাঁপাচ্ছিলেন। কোটের লাগানো পিঙ্ক কারনেশনটা টেবিলের তলায় পায়ের কাছে পড়েছিল। ডিক তুলে নিয়ে সেটা পকেটে পুরেছিল। বলেছিল,
– এটা নিলাম আপাতত, ইভনিংটার স্মারক চিহ্ন। একদিন নক করব, ফেরত দেব।
বলে হেসে ফিরে গিয়েছিল। তখনও ম্যাডলিন তাঁর স্বাভাবিক ছন্দে ফিরে আসেননি। এক টেবিলে বসা বন্ধু জ্যাকি একটা লিকারের গ্লাস এগিয়ে দিয়ে মৃদু স্বরে বলে উঠেছিলেন,
– ইউ ব্লাশ ম্যাডি।
– অফ কোর্স নট।
হঠাৎ একটু যেন বেশি জোরেই বলে ওঠেছিলেন ম্যাডলিন। নিজের কানেই ঠেকেছিল।
বাড়ি ফিরে সেদিন ম্যাডলিনের ঘুম আসেনি সহসা। দক্ষিণ গোলার্ধের ডিসেম্বরের চাঁদ জ্বলজ্বল করছিল আকাশে। ডিকের কথা মনে হয়েছিল। কেন মনে হয়েছিল ধরতে পারছিলেন না।
– না কাজটা ভাল হয়নি নাচের জন্য ভদ্রমহিলাকে ডেকে নিয়ে।
পিঙ্ক কারনেশনটা টেবিলে রাখতে রাখতে ভাবে ডিক। কিন্তু কেন এমন হল? একি পিঙ্ক কারনেশনটার জন্য? যে ফুল ওকে, ওর মনকে স্মৃতিমেদুর করে দেয়। ওর হাই-স্কুল সুইটহার্ট ইসাবেলা, তার অনুষঙ্গ এই ফুলে। হঠাৎ কী হয়েছিল ইসাবেলার কে জানে? ওর কি একবারও ভুলে ডিকের কথা… হঠাৎ সম্বিত ফেরে ডিকের। কী সব ভাবছে ও তখন থেকে! পানীয় কি বেশি নিয়েছে সে? তার চেয়ে ঢের বেশি দরকার আজকের পিঙ্ক কারনেশনের অধিকারিনীর জন্য কিছু একটা করা। কিছু একটা। কারণ আঘাতটা বেশ ভালোই।
আবারও বোকেটার দিকে নজর পড়ে ম্যাডলিনের। পিঙ্ক কারনেশন রয়েছে বোকেতে। এ নিশ্চয়ই ডিকের পাঠান। নিশ্চয়ই। বলেছিল, একদিন নক করবে। ওই নক করেছে। ম্যাডলিন এবার স্থির নিশ্চিত। তিনি আনমনে এগিয়ে যান তাঁর রাইটিং টেবিলে। সকাল হয়ে গেছে ইতিমধ্যে। প্রথম সকালের নরম চাঁপা-রং রোদে চারিদিক ছেয়ে আছে। ফ্র্যাঞ্জিপ্যানি গাছটার তলায় টুপটাপ ঝরে পড়ছে ফুল। ম্যাডলিন লিখতে শুরু করেন, ডিয়ার ডিক…
দীর্ঘদিনের প্রবাসী শাশ্বতীর বর্তমান ঠিকানা সিডনি। পেশা ছিল অস্ট্রেলিয়ার নিউসাউথ ওয়েলসের এক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা। কর্মজীবন থেকে অবসর নেওয়ার পর সময় কাটে বিভিন্ন ভাল লাগার চর্চা করে। তার মধ্যে বই পড়া, লেখা, আর গান শোনা প্রধান। লিখতে ভালবাসেন ছোটবেলা থেকেই। লেখার মধ্যে দিয়ে মানুষের নানান রূপ খোঁজার, ধরার চেষ্টা করেন।