ডলির শরীরে ধুলো জমেছে। কতদিন কাচা-ধোওয়া হয় না! কেন হয় না? সে কি পম্পার দোষ? পম্পা দূর থেকে ডলিকে দেখছে। আড়চোখে। ক্যাবিনেটের পাশে মেঝেয় পড়ে আছে। কেন এত অনাদর! মিমি বলবে, বলেওছে হয়তো, ওফ মা! আমি তো ক্যাবিনেটের ওপরে রেখেছিলাম! কোনওভাবে পড়ে গেছে! না মিমি। তুমি এখন আর দেখ না, কী ভাবে, কখন পড়ে যায় ডলি!

ডলি। একটা ফারের ডলফিন। অনুপ কিনে এনেছিল। তখন মিমি কত হবে, চার কি পাঁচ!  অনুপের এই এক অভ্যেস ছিল। প্রায় রোজই একটা করে খেলনা কিনে আনে ফেরার পথে, মেয়ের জন্য। পম্পার আপত্তি কানেই তোলে না। আহা একটাই তো মেয়ে! আমাদের সময় ভাইবোনেরা হইহই করে কাটিয়ে দিতাম! এদের তো সে সুযোগ নেই। এখন সব ফ্যামিলিতেই হাম দো, হামারা এক! অনুপ তখনও ভাবেনি, পম্পা তো নয়ই, আসলে সবাই একা! মিমির তো ভাবার বয়সই হয়নি।

খেলনায় বোঝাই হয়ে গেল দু’কামরার ফ্ল্যাট। কোনওটা নিজে নিজে ডুগডুগি বাজায়, কোনওটা করতাল। হেলিকপ্টার ঘরের মধ্যেই পাক খায়! ট্রেন গাড়ি ফ্ল্যাটের মেঝেয় চক্কর কাটে! ধুমসো ধুমসো ফারের পুতুল মেকশিফট বালিশের কাজ করে!
এত কিছুর মধ্যে মিমির মনে ধরে গেল ডলফিনটা। আকাশি-সাদা রঙের শরীর। নরম। মিমির দু’হাতের বেড়ে দিব্যি চলে আসে।  মিমি একটা মিনিটের জন্য তাকে হাতছাড়া করে না! অনুপের তা নিয়ে বেশ গর্ব!
— পছন্দ হয়েছে মা তোর এটা!
— হ্যাঁ! এর একটা নাম দেবে বাবা!
— নাম? মিমির বন্ধু হামি!
— ধ্যুৎ! বিচ্ছিরি নাম এটা! একটা ভালো নাম দাও না!
— তোর মা’কে বল!

পম্পা নাম দিল ডলি। পছন্দ হল মিমির। সে আর ডলফিন নয়, খেলনা তো নয়ই, সে ডলি। মিমির ডলি। মিমির সঙ্গে সে খায়, শোয়। মিমি ওকে স্নান করায়, জামাকাপড় পরায়! স্নানের ব্যাপারে অবশ্য পম্পাকে নাক গলাতে হয়! বোঝাতে হয়, রোজ চান করা ওর স্বাস্থ্যের পক্ষে মোটেই ভালো নয়! দরকার পড়লে পম্পা-ই ওকে সাবান মাখিয়ে চান করিয়ে দেবে, যেমন মিমিকে করায়!
তখন অনুপ চেনা মানুষ ছিল, পম্পার অন্তত তাই মনে হয়। সত্যিই তাই! কবে থেকে অনুপ অচেনা হয়ে উঠেছিল, সত্যিই পম্পা জানে না! মিমি ডলিকে নিয়ে আহ্লাদ করছে, অনুপ মিমিকে নিয়ে। পম্পার মনে হয়েছিল, এই তো সুখী গৃহকোণের ছবি!

অনুপ কিন্তু বেশ স্পষ্ট করেই জানিয়েছিল, আর পাঁচটা সাধারণ কথা বলার মতো করেই, বিদিশার ব্যাপারটা সিরিয়াস কোনও টার্ন নিলে তোমায় জানিয়েই যা করার করব!

মিমি! মিমির কথা ভাবলে না তুমি! এ কথাটা কী কখনও পম্পা বলেছে অনুপকে! না নিজেই ভেবেছে, এ রকম কিছুই তো বলার কথা ওর! মিমি ক্লাস সেভেন মানে তো একটু বড়। আজকালকার মেয়েরা যেমন হয় আর কী! অনেকটাই বোঝে, বাকি না বোঝাটুকু দিব্যি মুছে ফেলে, বা গিলে নেয়! জীবন যেমন বোঝায় আর কী! বাবার সঙ্গে দূরত্বটাকে মিমি তো বেশ একটু একটু করে সহনীয় করে নিচ্ছিল। কবে থেকে ওর মধ্যে সে প্রস্তুতি শুরু হয়েছিল, পম্পা অন্তত ঠাহর করতে পারে না!

‘যা করার’ মানে! অনুপ কী বলতে চায়, পম্পা বোঝেনি। অথচ প্রশ্নটা ও-ই করেছিল, অন্যের  কাছে তোমার ব্যাপারে কিছু শুনতে আমার খারাপ লাগবে অনুপ! তখন অবশ্য সবই শোনা হয়ে গেছে ওর। শুধু শুনেই কি সবটুকু জেনেছে পম্পা! কিছুই কি বুঝতে পারেনি নিজে! না বোঝানোর কোনও চেষ্টাই তো করেনি অনুপ। অন্য সময় কতবারই অনুপ বলেছে, তোমার মাথায় গজাল মেরে না ঢোকালে কি কিছুই ঢোকে না! তখন হারতে ভালো লাগত পম্পার, অনুপের কাছে! আর যখন সহজ ভাবে অনুপ ধরা দিল ওর কাছে, ওর সবটুকু অসহায়তা নিয়ে, তখনই সেই পরাজয় অসহ্য হয়ে উঠল পম্পার কাছে!

মিমি! মিমির কথা ভাবলে না তুমি! এ কথাটা কি কখনও পম্পা বলেছে অনুপকে! না নিজেই ভেবেছে, এ রকম কিছুই তো বলার কথা ওর! মিমি ক্লাস সেভেন মানে তো একটু বড়। আজকালকার মেয়েরা যেমন হয় আর কী! অনেকটাই বোঝে, বাকি না বোঝাটুকু দিব্যি মুছে ফেলে, বা গিলে নেয়! জীবন যেমন বোঝায় আর কী! বাবার সঙ্গে দূরত্বটাকে মিমি তো বেশ একটু একটু করে সহনীয় করে নিচ্ছিল। কবে থেকে ওর মধ্যে সে প্রস্তুতি শুরু হয়েছিল, পম্পা অন্তত ঠাহর করতে পারে না!
মিমি ইস্কুল থেকে ফেরার পরে অনুপ আসত। বেশির ভাগ দিন বাসস্টপ থেকেই  মিমির সঙ্গে। পম্পা অফিস থেকে ফিরে টেবিলে রিস্ট ওয়াচ রেখে বলল, কতক্ষণ!

মিমির সঙ্গেই তো ঢুকলাম! কথাটা বলার সময় অনুপের গলায় বাড়তি উচ্ছ্বাস পম্পার চোখ এড়াত না!
অনেক দিন ঠেকিয়ে রাখার পর পম্পা সেদিন বলেই ফেলল, আমি ফেরার আগে তুমি এস না!
পম্পা অনুপের চোখের দিকে তাকায়নি! হয়ত ‘কেন’ প্রশ্নটা লেপ্টে ছিল সেখানে! কী বলবে? কেন-র উত্তর তো জানা নেই! বা, আছে হয়তো! ওর ভয় করে। তাই অনুপকে সে কথা বলতে ওর বাধো বাধো ঠেকল, এখনও!

ডলি এখন মিমির সর্বক্ষণের সঙ্গী। ওকে নিয়ে মিমির কাজও বেড়েছে বিস্তর! কেন না ডলি এখন পড়াশোনা করে। মিমি ওকে দু’বেলা পড়ায়! যত্ন করে পড়া বোঝানো, ধমক-ধামক দেওয়া, আদর করা সবই চলে। পম্পা মনে করিয়ে দিতে চায়, তুমি কিন্তু এখন সেই ছোট্টটি নেই মা! এখন পড়ার চাপ বাড়ছে, হোম ওয়ার্ক করতে হচ্ছে নিয়মিত। এখন একটু এ সব ছেলেমানুষি কমাও!
অবাক হয়ে যায় মিমি! মা বলে কী! ডলি বড় হচ্ছে না! এ কথা শুনে অনুপ বলেছিল, তা’হলে এবার একটা বড়সড় ডলি এনে দিই!
এবার অবাক নয়, আহত হয়েছিল মিমি! ক্লাস সেভেনেই অপছন্দের কথার উত্তরে চুপ করে থাকতে শিখেছে মিমি, পম্পা নজর করে।

অনুপ যেদিন বলল, সবকটা জয়েন্ট আ্যকাউন্ট তোমার নামে করে নাও, সেদিন অনুপের উদারতায় ঈর্ষা হয়েছিল পম্পার। কী দিতে চেয়েছিল অনুপ? নিরাপত্তা! স্বাচ্ছন্দ্য! প্রমাণ দিতে চেয়ছিল সন্তানের প্রতি ওর কর্তব্যের! সবাই বুঝিয়েছিল, ইমোশনাল হোস না পম্পি! মিমি অনুপেরও মেয়ে তো! পম্পা আসলে হেরে যাচ্ছিল! শুধু অনুপের কাছে না, বিদিশার কাছেও!

অনুপের আসা ক্রমশ কমছিল, বাড়ছিল ফোন। মিমি ফোন ধরে বলত,
— মা, বাবা! পম্পা বলত, তুমি কথা বল।
— তোমার ফোন। মিমির ছোট্ট উত্তর।
মিমির ফোনে অনুপ ফোন করলে মিমি দু’একটা কথা  বলার পর বলত,  মা’কে দেব? কথা বলবে?
— তোর ডলি কেমন আছে?
— ভালো।

ক্লাস এইটে ওঠার পর পম্পা মিমিকে নিয়ে পুরী গেল। অনুপকে বাদ দিয়ে এই প্রথম ওদের ট্রেনে ওঠা! পম্পার অফিসের একটা টিম ছিল। বাড়ি থেকে বেরিয়ে ট্যাক্সিতে ওঠার পর মিমি আবিষ্কার করল, ডলিকে নেওয়া হয়নি!
— মা বাড়ি চল!
— ছেলেমানুষি করিস না মিমি! এটা লোকাল ট্রেন না!
মিমি নাছোড়! ফিরতেই হয় পম্পাকে! ওর সন্দেহ হয়, মিমি যেতে চাইছে তো!

পম্পা, মিমি, মাঝখানে ডলি। আকাশী রঙের মশারির ওপর নাইট বাল্বের হাল্কা আলো ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে। সকাল হলেই অফিসের তাড়া লাগে, তবু চট করে চোখ লাগে না পম্পার। মিমিও কী জেগে আছে! আলতো করে মেয়ের গায়ে হাত রাখে পম্পা। এবারে আইসিএসসি ওর। পড়াশোনার কথা বলতে হয় না। শুধু পড়াশোনা নয়, সব কাজই এত নিখুঁত নিষ্ঠায় করে ফেলে, যে পম্পার অস্বস্তি হয়। এত বড় হয়ে গেল মেয়ে, যে পম্পার মনে হয় এও  ওকে আরও একা করে দেবার এক আয়োজন! মিমি বড় হল না শুধু ডলির বেলায়।

সমুদ্র মিমিকে উচ্ছ্বাসের সাগরে ভাসিয়ে দিল! পম্পাকেও দিল অনেক কিছু। অনুপ ফোন করেছে রোজ! একজন বয়স্ক মহিলা  প্রায় ডুবেই যাচ্ছিল। ডুবুরিরা ওকে কীভাবে বাঁচাল, তার বিস্তারিত বিবরণ অনুপকে দিল পম্পা! তারপর বলল, মিমি তো দারুণ এনজয় করছে! ওই জন্যেই তার ফোন বেজেই যাচ্ছে, কথা বলার সময় নেই ম্যাডামের! অনুপের প্রতিক্রিয়ায় তৃপ্তির সুর বেজেছিল পম্পার কানে! পুরী থেকে ফিরলে সবাই কালো হয়ে যায়। মিমি দাবি করল, ডলিও কালো হয়ে গেছে! পম্পা ডলিকে কেচে  দিল। ডলি ঝকঝকে হয়ে গেল! নাইনে গার্ডিয়ান্স মিটিঙে পম্পা যাবে, যেমন প্রত্যেক বার যায়। অনুপ জানাল, এবার ও যাবে পম্পার সঙ্গে! পম্পা একটু অবাকই হল! এতদিন তো পম্পা বললেও ও বলেছে, তুমি রেগুলার ওর পড়াশোনার টাচে থাকো, তুমিই যাও! পম্পাকে সেজন্য ছুটিই নিতে হয় এদিনটায়। আজ এই আদিখ্যেতার মানে কী!
— তোমার ছুটি আছে সেদিন?
— নেব।
— কী দরকার!
— এনি প্রব্লেম!

অনুপ গেল। পম্পাও। পাশাপাশি বসল। প্রিন্সিপাল বললেন, সন্তানের বেড়ে ওঠার জন্য মা-বাবার দু’জনেরই ভূমিকার কথা! ওরা পাশাপাশি বসে শুনল। বেরিয়ে এসে অনুপ বলল,
— ট্যাক্সি নেব?
— দরকার নেই।
— অন্য কোথাও যাবে?
— না, বাড়িই যাব।
— তা’হলে চল। অনুপ আবার ট্যাক্সির কথা বলে। ছুটি তো নেওয়াই হল!

পম্পা বলে, মিমি নেই এখন। বন্ধুর বাড়ি যাবে। অনুপ ততক্ষণে হাত তুলে ট্যাক্সি দাঁড় করিয়েছে। মিমি আরএকবার হারল?

মিমি ঘরে ফিরলে অনুপের হয়ে যেন পম্পাই কৈফিয়ত দিল, আজ অনেক তাড়াতাড়ি মিটিং শেষ হয়েছে। কী আর বলবে, সেই তো একই কথা! পম্পা বোধহয় মিটিং নিয়ে আরও কিছু জানাতে চাইছিল মিমিকে। মিমি বলল,
— আমি খেয়ে এসেছি মা! তোমরা খেয়ে নাও!
— একটা নতুন ডিশ এনেছি। একটু টেস্ট কর। অনুপ বলল।
— ওবেলা খাব। বলে মিমি ওর ঘরে ঢুকে যায়!
— আমি বরং উঠি। অনুপ বলে।
পম্পা ওর দিকে তাকিয়ে বলে, খেয়ে যাও। এতগুলো আনলে কেন তা’হলে!

পম্পা, মিমি, মাঝখানে ডলি। আকাশী রঙের মশারির ওপর নাইট বাল্বের হাল্কা আলো ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে। সকাল হলেই অফিসের তাড়া লাগে, তবু চট করে চোখ লাগে না পম্পার। মিমিও কি জেগে আছে! আলতো করে মেয়ের গায়ে হাত রাখে পম্পা। এবারে আইসিএসসি ওর। পড়াশোনার কথা  বলতে হয় না। শুধু পড়াশোনা নয়, সব কাজই এত নিখুঁত নিষ্ঠায় করে ফেলে, যে পম্পার অস্বস্তি হয়। এত বড়  হয়ে গেল মেয়ে, যে পম্পার মনে হয় এও ওকে আরও একা করে দেবার এক আয়োজন! মিমি বড় হল না শুধু ডলির বেলায়। এখনও ডলি ওর কাছে পুতুল নয়, সন্তান। এতে অবশ্য় পম্পার মজাই লাগে! খেতে বসার সময় ডলি সঙ্গে বসে, ডলিকে ঘুম পাড়িয়ে মিমি শোয়। আবার কখনও কখনও পম্পার মনে হয়, এই বয়সে এসে মিমির এতটা বাড়াবাড়ি খুব স্বাভাবিক কী! আগে অনুপ যে রকম ফোন করে মিমিকে অন্তত একবার ডলির কথা জিগ্যেস করতই, এখন অনুপও যেন ভুলে গেছে ডলির কথা! মিমিই বরং নিজে থেকে বাবাকে জানায় ডলির কথা!

পম্পা বলল,
— বাবার সঙ্গে দেখা হয়েছিল?
— হ্যাঁ।
— বলিসনি তো!
— বলার কী আছে! এক শহরে সবাই থাকি যখন, দেখা হতেই পারে!
মিমির উত্তরের ধরন পম্পার কানে বেসুরো ঠেকছে কিছুদিন থেকেই! পম্পা খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে আবার জিগ্যেস করে,
— ও ছিল, নারে!
— তুমি তো সব জেনেই জিগ্যেস করছ মা!
— তোকে কিছু বলল?
— না। মিমি এবার ওর ঘরে চলে গেল।

পম্পা নজরই করতে পারেনি প্রথমে, ঠিক কবে থেকে মিমি আর ডলি আলাদা হয়ে গেল! ডলি এখন যেন মিমির কাছে একটা আসবাব! চোখের সামনে পড়ে গেলে ওটাকে বুকসেলফ বা ক্যাবিনেটের ওপরে সরিয়ে রাখে মিমি। ডলির শরীরময় ধুলো। মিমি পরীক্ষার পড়ায় ব্যস্ত। পম্পা পারে না।

মিমিকে লুকোতে হয় কেন কে জানে! কিন্তু মিমিকে লুকিয়েই ও ডলিকে কাচতে বসে!

পেশায় স্কুলশিক্ষক। বিষয় বাংলা সাহিত্য। বর্তমানে হালিশহরের বাসিন্দা। সাহিত্যের প্রতি একনিষ্ঠ দীর্ঘদিন ধরেই। ইতিমধ্যেই দুটি ছোটগল্প সংকলন প্রকাশিত হয়েছে। একটির নাম তৃতীয় প্রহর। অপরটি পূর্বাপর।

2 Responses

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *