‘স্বাধীনতা তুমি
রবিঠাকুরের অজর কবিতা, অবিনাশী গান।
স্বাধীনতা তুমি
কাজী নজরুল ঝাঁকড়া চুলের বাবরি দোলানো
মহান পুরুষ, সৃষ্টিসুখের উল্লাসে কাঁপা-‘
এই প্রখর উচ্চারণ যে কবির স্বাক্ষর, সেই শামসুর রাহমানের আজ জন্মদিন। দুই বাংলার পদ্যপ্রেমীদের যে এক কাব্যস্রোতে উথাল পাথাল করে ভাসিয়ে দিয়েছিলেন, সেই প্রতিবাদী প্রেমিক শামসুর রাহমানের আজ জন্মদিন। তাঁকে অননুকরণীয় গদ্যে স্মরণ করলেন এ কালের বাউল-কবি জয় গোস্বামী।
বাংলা ভাষা যতদিন বাঁঁচবে, ততদিন পর্যন্ত বেঁচে থাকবে শামসুর রাহমানের কবিতা। এই কবি তাঁর ইহশরীর ছেড়ে গিয়েছেন আজ কয়েকবছর হল। কিন্তু তাঁর কবিতাশরীর চিরজীবীত রয়েছে পাঠকদের জন্য।
শামসুর রাহমানের কবিতার মূল ভরকেন্দ্রে তিনটি দিকনির্দেশক চিহ্ন আমরা পাই। প্রথম চিহ্ন হল তাঁর স্বদেশ। দ্বিতীয় হল তাঁর ভাষা। অর্থাৎ আমাদের এই বাংলা ভাষা। শামসুর রাহমানের একটি কবিতার বইয়ের নাম-ই হল ‘আমার দুখিনী বর্ণমালা।’ এই সূত্রে বোঝা যায় বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটির কেন্দ্রে কেবল রাজনৈতিক ক্ষমতার নানা যুদ্ধই ছিল না, বরং তার সঙ্গে মিলিত হয়েছিল কবিদের কবিতা-উচ্চারণ।

মুক্তিযুদ্ধের সমসময়ে শামসুর যখন তাঁর কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ করার অবকাশ পেলেন, পাঠক বিমুগ্ধ ও চমৎকৃত হল তাঁর কবিতার বইয়ের নামকরণ দেখে৷ সে বইয়ের নাম, ‘বন্দিশিবির থেকে।’ একেবারে সরাসরি কথা বলা হয়েছে এই কাব্যগ্রন্থ। প্রতিবাদ দৃপ্ত হয়ে উঠেছে। কোনওকিছুর ভয়ে নিজের মনকে কোনওদিন গোপন করেননি শামসুর রাহমান। তেজি, জোরালো, এক অগ্নিধর্ম সব সময়ই তাঁর আত্মমূল থেকে উচ্চারিত হয়েছে কবিতায়। শামসুর রাহমানের একটু কবিতার বইয়ের নাম ‘উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ।’ তিনি কোনওদিন কোনও রাজনৈতিক চোখরাঙানিকে পরোয়া করেননি। নিজের দেশ বারংবার রাজনৈতিক উত্থানপতনে অস্থির হয়ে উঠলেও তিনি তাঁর কবিতার বইয়ের নাম দিয়েছেন, ‘বাংলাদেশ স্বপ্ন দেখে।’ ‘আমার দুখিনী বর্ণমালা’ এবং ‘বাংলাদেশ স্বপ্ন দেখে’ – এই নাম দু’টি সামান্য উদাহরণমাত্র। দেশমাতৃকা এবং ভাষামাতৃকার প্রতি একাগ্র অবিচল স্তোত্র তিনি নিবেদন করে গিয়েছেন আজীবন। আবার কবিতা রচনা যে শামসুর রাহমানের আকৈশোর সঙ্গী সে কথা মনে করিয়ে দেয় তাঁর বই ‘কবিতার সঙ্গে গেরস্থালি।’

শামসুর রাহমানের একটি অবিস্মরণীয় কবিতার নাম ‘বার্ধক্যে জসিমউদ্দিন’। পল্লিকবি জসিমউদ্দিন যখন তাঁর নিজের আয়ুর শেষপ্রান্তে উপনীত, তখন সর্বজনমান্য ওই বৃদ্ধ কবির প্রতি উৎসর্গীকৃত শামসুর রাহমানের কবিতাটি কেবল প্রণতি ও শ্রদ্ধা জানানোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না — এক আশ্চর্য নরম স্নেহের স্বর এসে পিতামহ-প্রতীম কবি জসিমউদদীনের জীবনকে ছুঁয়ে দিতে চায়। এমনই একটি মর্মস্পর্শী কবিতা আছে শামসুর রাহমানের ‘রৌদ্রকরোটিতে’ কাব্যগ্রন্থেও। সে কবিতার নাম ‘আমার মা-কে’। নিজের মাকে নিয়ে এমন বুকমোচড়ানো কবিতা বাংলা কাব্যসাহিত্যে দুর্লভ।
আমার মাকে
কখনো আমার মাকে কোনো গান গাইতে শুনিনি।
সেই কবে শিশু রাতে ঘুম পাড়ানিয়া গান গেয়ে
আমাকে কখনো ঘুম পাড়াতেন কি না আজ মনেই পড়ে না।
যখন শরীরে তার বসন্তের সম্ভার আসেনি,
যখন ছিলেন তিনি ঝড়ে আম-কুড়িয়ে বেড়ানো
বয়সের কাছাকাছি হয়তো তখনো কোনো গান
লতিয়ে ওঠেনি মীড়ে মীড়ে দুপুরে সন্ধ্যায়,
পাছে গুরুজনদের কানে যায়। এবং স্বামীর
সংসারে এসেও মা আমার সারাক্ষণ
ছিলেন নিশ্চুপ বড়ো, বড়ো বেশি নেপথ্যচারিণী। যতদূর
জানা আছে, টপ্পা কি খেয়াল তাঁকে করেনি দখল
কোনোদিন। মাছ কোটা কিংবা হলুদ বাটার ফাঁকে
অথবা বিকেলবেলা নিকিয়ে উঠোন
ধুয়ে মুছে বাসন-কোসন
সেলাইয়ের কলে ঝুঁকে, আলনায় ঝুলিয়ে কাপড়,
ছেঁড়া শার্টে রিফু কর্মে মেতে
আমাকে খেলার মাঠে পাঠিয়ে আদরে
অবসরে চুল বাঁধবার ছলে কোনো গান গেয়েছেন কি না
এতকাল কাছাকাছি আছি তবু জানতে পারিনি।
যেন তিনি সব গান দুঃখ-জাগানিয়া কোনো কাঠের সিন্দুকে
রেখেছেন বন্ধ ক’রে আজীবন, এখন তাদের
গ্রন্থিল শরীর থেকে কালেভদ্রে সুর নয়, শুধু
ন্যাপথলিনের তীব্র ঘ্রাণ ভেসে আসে !

এবার আমি কথা বলব শামসুর রাহমানের কবিতার ভরকেন্দ্রের তৃতীয় চিহ্নটির প্রসঙ্গে, যে চিহ্ন তাঁর প্রথম বই থেকেই আমৃত্যু সঙ্গী হয়ে থেকে গিয়েছে। সেই কাব্যধর্মের নাম প্রেম। অতুলনীয় সব প্রেমের কবিতা শামসুর রাহমান ছড়িয়ে রেখে গিয়েছেন তাঁর গ্রন্থের পর গ্রন্থে। ‘প্রথম গান দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে’ — এই নামের কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ করে শামসুর রাহমান কবিতাজগতে প্রবেশ করেন। হ্যাঁ, এটিই তাঁর প্রথম কবিতার বই। সেই বই থেকেই প্রেমের কবিতার স্রোতধারা কখনও শামসুর রাহমানকে ছেড়ে যায়নি। অনবরত ঘটে চলা রাজনৈতিক সংঘাতের মধ্যেও প্রেমের কবিতা লিখতে কখনও ভোলেননি শামসুর রাহমান।

জানকীকে যখন হরণ করে নিয়ে আকাশপথে উড্ডীন রাবণ পলায়মান, তখন জানকী একটি একটি করে অলঙ্কার নিক্ষেপ করছিলেন অরণ্যের মাটিতে। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল, ঘাসজঙ্গলের মধ্যে রোদ্দুর পড়ে জ্বলজ্বল করে ওঠা সেই সব স্বর্ণাভরণ যখন সন্ধানরত রামচন্দ্রের চোখে পড়বে, তখন তাঁর স্বামী বুঝতে পারবেন অপহৃতা জানকীর গমনপথ ঠিক কোনদিকে ছিল।

শামসুর রাহমানের প্রত্যেকটি কবিতার বই যদি আমরা খুঁজতে খুঁজতে অগ্রসর হই, তাহলে আমাদের চোখে পড়বে তাঁর অবিস্মরণীয় প্রেমের কবিতাগুলি। সেইসব কবিতা জানকীর নিক্ষিপ্ত গহনার মতোই শামসুর রাহমানের কাব্যগ্রন্থগুলির ফাঁকে ফাঁকে আত্মগোপন করে রয়েছে। যতবার আমরা আবিষ্কার করব, ততবারই বিমুগ্ধ ও অভিভূত হব।
স্বদেশ, ভাষা আর প্রেম — এই তিনটি ধারায় প্রবাহিত হয়েছে শামসুর রাহমানের সারাজীবনের কাব্যচিন্তা। এই তিনটি প্রবাহই আজও আমাদের আঘাত করে, বিক্ষুব্ধ করে, প্রতিবাদের জন্য শক্ত করে মুষ্টিবদ্ধ হাত, আর প্রেমের প্রস্রবণে আমাদের হৃদয় দ্রবীভূত করে। বাংলা কাব্যজগতে শামসুর রাহমান এমন এক কবি যাঁর কবিতা অবিনশ্বর। আমার এই সামান্য রচনাটি পিতার উদ্দেশে সন্তানের ক্ষুদ্র শ্রদ্ধাঞ্জলি মাত্র।
জয় গোস্বামীর জন্ম ১৯৫৪ সালে, কলকাতায়। শৈশব কৈশোর কেটেছে রানাঘাটে। দেশ পত্রিকাতে চাকরি করেছেন বহু বছর। আনন্দ পুরস্কার পেয়েছেন দু'বার - ১৯৯০ সালে 'ঘুমিয়েছ ঝাউপাতা?' কাব্যগ্রন্থের জন্য। ১৯৯৮ সালে 'যারা বৃষ্টিতে ভিজেছিল' কাব্যোপন্যাসের জন্য। ১৯৯৭ সালে পেয়েছেন বাংলা আকাদেমি পুরস্কার। দেশ বিদেশ ঘুরে বেড়িয়েছেন কবিতার সাহচর্যে। ২০১৫ সালে উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাম্মানিক ডি.লিট পেয়েছেন।
অসাধারণ
কবিতার মতোই এই গদ্যটিও অসাধারণ
এই অবনত লেখনী যেন এক কাব্যরূপ নিলো।কবি আপনাদের কাছে হাঁটু মুড়ে বসে হাত পেতে চেটেপুটে খাই কাব্য অমৃত ধারা।শ্রদ্ধা জানালাম কবি শামসুর রহমান কে।
অসাধারণ লিখেছেন। বিনম্র ষ্রদ্ধা জানাই প্রিয় কবির প্রতি।
ভালোবাসা প্রিয় কবি জয় গোস্বামী
Thanks Joy. Touched me like a poetry.
কবির কলমে কবি। খুব সুন্দর