আজই ডিসচার্জ দেবে

প্রায় গত দু’বছর ধরে এই মানসিক আবাসে। বিষাদ নিয়ে এসেছিলাম। প্রথম বছরটার কথা প্রায় মনেই নেই। অ্যাকিউট অবস্থায় ভর্তি। কে ভর্তি করেছিল, মা না বাবা? নাকি সেদিন দু’জনেই এসেছিল!
ধীরে ধীরে বোধে ফিরলাম।
এখানে পাশাপাশি খান কয়েক ঘর, পর্দা টাঙানো দরজায় পাল্লা নেই। বাথরুমেও তাই। লম্বা একটা করিডর।
সিমেন্টের জাফরি দিয়ে বৃষ্টি আর সকালের ঘুম-ভাঙা আলো। ঢোকা বেরোবার কোলাপসিবল সবসময় তালা মারা। কেয়ার গিভাররা সবাইকে নাম ধরেই ডাকে। ইলেকট্রিক শক দেওয়া হয় না। কে জানে এদের ওপরও হাত পা চালিয়েছি কিনা!
মাকে তো খুব মারধর করেছি
বাড়ির কত জিনিসও তো দুমদাম ভেঙেছি। তবু পাল্টা হাত গায়ে তোলেনি। না মা, না  বাবা। তাঁদের ধৈর্যের পরীক্ষা শেষ হতেই আমি এই সাইকিয়াট্রিক সেন্টারে। 

আজ আমি পরোয়ানা পেয়েছি বাড়ি ফিরে যাবার।
বাড়ি মানে, আমার ঘর, ড্রেসিং ইউনিট আর গান চালিয়ে নাচ! তেমন কোনও দায়িত্ব নেই। পয়সার চিন্তা তো নেইই।
বাবা এবং মা দু’জনেই ব্যাঙ্ককর্মী। আমি একমাত্র মেয়ে। আদরে ভালোবাসায় যত্নে ভরপুর ছিল জীবন। তবু  এমন হল!
ইশকুলে থাকতেই নাচগানের চর্চা। লম্বা ছিপছিপে সুন্দর বলে সকলেরই চোখে পড়তাম। যে কারণেই হোক বোধ বুদ্ধি নিয়ে চলার বয়স হলেও, নিজের ইচ্ছের ওপর লাগাম দিতে শিখিনি। ফলে কলেজে ঢুকেই শুরু হল বিপত্তি। ক্লাস কামাই করে উড়ে বেড়ানো, সাজগোজ, সবেতেই ভেসে গেলাম। ভাসিয়ে নিল কেউ কেউ।
ড্রাগ বা মদের নেশায় না জড়ালেও, জড়ালাম আমোদের নেশায়।
কলেজে থাকতেই যোগাযোগ হল এক শুটিং পার্টির সঙ্গে
মাথায় ঢুকল মডেল হওয়ার স্বপ্ন। মা-বাবা কিছুই আন্দাজ করতে পারল না। কলেজ কেটে ঘুরে বেড়াতে লাগলাম সম্পূর্ণ অচেনা এক জগতে। একে একে বন্ধুরাও বাদ পড়তে থাকল জীবন থেকে। পরীক্ষা দিলাম একেবারেই অপ্রস্তুত অবস্থায়। আটকে গেলাম। মানে ফেল। এবার টনক নড়ল মা-বাবার।
কিন্তু বেপরোয়া আমাকে তখন পথে ফেরানো তাঁদের হাতের বাইরে। শুরু হল ‘বোঝানো’ নামক শাস্তি। পরের বছরের পরীক্ষা পর্যন্ত আর অপেক্ষা করতে হল না। তার আগেই আমার মেজাজ সম্পূর্ণ বিগড়ে গেল। শুরু হল দাপানো হুজ্জুতি আর অবসাদে ঘুম। আতঙ্ক আর অসহায় অপমানে মা-বাবা তখন চোখে অন্ধকার দেখছে। তাই চেনা মনোচিকিৎসকের নির্দেশেই ভর্তি হলাম অ্যাকিউট ওয়ার্ডে

নির্বাসনে ওষুধ আর শুশ্রূষা। 

কিছুটা সুস্থ হতে ওয়ার্ড বদলে রিহ্যাবিলিটেশন বিভাগে একটা অন্য বাড়িতে এলাম। ‘রিহ্যাবে’ থাকলে মাঝে মাঝে বাড়ি যাবার ছুটি মেলে, তবে আমি আসিনি। কিন্তু সত্যি সত্যি ছুটি পেয়ে বাড়ি ফিরে, আজ খুব অপরিচিত লাগছে। আড়ষ্টও কোথাও ফুল সাজানো নেই। মায়ের ঘরে বড় মাপের একখানা ঠাকুরের সিংহাসন। কোন এক মহারাজের দেওয়াল জোড়া বাঁধানো ছবি। বাবার দিকের জানলাটায় টবের ফুলগাছগুলো সব উধাও।
আমার ঘরটায় বিষণ্ণ উৎকট গন্ধ। ঘর পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে মা আর ঢুকল না। বাবাও পর্দার ওপাশেই।
বাড়িতে পরার পোশাক নিয়ে স্নানে ঢুকলাম। প্রিয় সব সুগন্ধি, মা গুছিয়ে রেখেছে! ওহ্ ! কতকাল পরে ছিটকিনি সমেত দরজা দেওয়া স্নানঘর! ছিটকিনিটাই খেলনার মতো কতবার খোলা বন্ধ করলাম। বন্ধ দরজাটা এতই আয়েশ দিল, যে কল এবং শাওয়ার দু’টোই খুলে দিলাম একসঙ্গে। কতক্ষণ ধরে ভিজছি, অথচ কেউ তাড়া দিচ্ছে না! ছাড়া জামাকাপড়গুলো কাচার বালতিতে গুঁজে দিতেই মনে হল, কাচার অভ্যেস তো হয়েই গেছে। অন্তত ব্রা আর প্যান্টিটা কেচে মেলে দিই! মাথায় তোয়ালে জড়িয়ে হাউসকোট পরতে পরতে মনে পড়ল, কেয়ার গিভাররা সকলে বলত, কী সুন্দর ফিগার! আমারও মনে হত, যেন ক্যামেরা জ়োন-এ হেঁটে আসছি।
এক পা বাড়িয়ে খাটে শুয়ে পড়তেই ঘুম এসে গেল। অথচ এ সময় তো পর পর ক্লাস থাকত – হাতের কাজ, কম্প্যিউটার, খাবার পরিবেশন… মানে বিকেলের চায়ের সময় না হওয়া পর্যন্ত!  

সকালে ঘুম ভাঙতে বুঝলাম যে, কালকেও ঘুমের ওষুধের রেশ ছিল। তাই গতকাল স্নানের পর থেকে আর কিচ্ছুই মনে নেই। মানে রাতে আদৌ কিছু খেয়েছিলাম কিনা!
ব্রাশ করে টেবিলে আসতেই একসঙ্গে চা। বাবা কেমন লজ্জা পেয়ে আছে। মায়ের ব্যবহারে অপরাধীর সঙ্কোচ। কতদিন পর ফ্রুট জুস, হার্ড টোস্ট আর পেপার চিজ! এক চুমুকে গ্লাস খালি হয়ে যাওয়া দেখে আর এক গ্লাস ভর্তি করে দিল বাবা
এখনও কোনও কথা হল না। ভাবলাম, খাওয়া বাসনগুলো ধুয়ে রাখি। তারপর নিজেকে আটকালাম এই ভেবে যে, হোমের নিয়মকানুনে যেন বাঁধা না পড়ি। যে স্বাভাবিক নিয়মে এতদিন স্বচ্ছন্দ ছিলাম, তাতেই ফিরতে হবে।
চোখের ওপর থেকে মুছে দিতে লাগলাম স্টিলের গ্লাস, থালা, চামচ, বাটি এবং খাওয়ার পর নিজেরটা ধুয়েমুছে রাখা
মনে পড়ল, কয়েক মাস পর ওয়ার্ড বদল হতেই পুরনো বাসনের সেটটা বদলে, নতুন একটা সেট দিয়ে এসেছিল বাবা-মা। আর ওইটুকুতেই মনে হয়েছিল যে, ওরা আমাকে এত ভালবাসে! ওই নতুন বাসনের সেটটা কোলে নিয়ে সেদিন এমন বিহ্বল বসেছিলাম, যেন আমিই নতুন হয়ে গেলাম!

Sekhar Roy
অলঙ্করণ: শেখর রায়।

জলখাবার খেয়ে ঘরে এসে আবার বোধহয় একটু ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। উঠে কারও সাড়া পেলাম না।
ড্রেসিং ইউনিটের ওপর একটা নোট রেখে মা-বাবা দু’জনেই বেরিয়ে গেছে।
জমজমাট হোম থেকে ফিরে বেশ ফাঁকা লাগছে। মা-বাবার ঘরটা কেমন ম্যাড়মেড়ে ম্লান। ড্রেসিং ইউনিটে কসমেটিক্সের বদলে রাজ্যের ওষুধ রাখা। আমার বাঁধানো ফটোটা একই জায়গায়। বাবার  কলম, নোটপ্যাড, অ্যাশ্ট্রেও।
জানলাগুলো খুলে দিলাম। আমাকে একা রেখে দু’জনেরই বেরিয়ে যাওয়াতে বুঝলাম, এবার আর এক নতুন পরীক্ষার শুরু। কারণ এই বেডরুমটা আমি থাকাকালীন শেষদিকে লক করা থাকত। আমার ভাঙচুর ছাড়াও, টাকা ও দামি জিনিস খোওয়া যাবার ভয়ে। অন্য বন্ধুদের মতো, টিউশান করে বা ব্লগ লিখে রোজগারে আমার মন ছিল না।

আমি পড়েছিলাম পুরুষ সঙ্গের নেশায়। প্রেম ছাড়াও তো কেনা যায়। হাতে টাকা আর খালি ঘর পাওয়ার অপেক্ষা। আমার কাছে মন মানে ইচ্ছে, চাহিদা– বাড়াবাড়ি রকমের লাগাম ছাড়া। শরীরও তাই চায়। সহপাঠী বা পরিচিত ছেলেরা বড্ড গায়ে পড়া। সম্পর্কের ব্যাগেজ ছাড়া খেলতে শেখেনি।  ওসব প্যানপ্যানানি কোনওদিনই আমার পোষায়নি। কাগজের বিজ্ঞাপন ছাড়াও অসংখ্য অনলাইন সাইট। সাবধানও হতে হয় না। “বোল্ড রিলেশনের” শর্ত পূরণ হলেই হল। গোপনীয়তা দু’পক্ষেই সেটাই পেশাদারিত্ব একবারই মা সময়ের আগে অফিস থেকে এসে পড়ায়, দরজা খুলে দিতে হয়েছিল। তবে কিছু বোঝবার আগেই কলেজের সহপাঠীর ভান করে, দু’টো বই হাতে দিয়ে বিদায় করে দিয়েছিলাম ছেলেটাকে। আশপাশেও কোনও গুঞ্জন ওঠেনি, কারণ সব সময়েই তো নতুন ছেলে এসেছেকে কোন কাজে কার কাছে আসে, এত হদিশ কে রাখে! একজন টানা আসা যাওয়া  করলে লোকে নজর করে বুঝতে চায়। আর তাছাড়া পুরুষ ফিজিওথেরাপিস্ট বা মাসাজের লোকও তো এখন ঘরে  ঘরে।

সমস্যাটা হল, যখন বাবা মাসখানেক ছুটি নিয়ে বাড়িতে থাকতে শুরু করল। কী একটা প্রজেক্টের কাজ নাকি। সর্বক্ষণ বাবা বাড়িতে, মহা অসুবিধে। বাইরের ঠেকগুলোতে বেশি টাকা লাগে। টান পড়ল টাকায়অভ্যস্ত নেশায় বাধা পড়লে যা হয় পরিণতি, উন্মত্ত অবসাদ। এই কারণটা মা-বাবা কেন, ক্লিনিকের ডাক্তাররাও ধরতে পারেনি। সকলেই ভেবেছে, শুকনো নেশা বা প্রেমে আঘাত। ওসব আমার হয়নি। গর্ভপাত-জনিত মনোবেদনাও নয়। গর্ভ সঞ্চারই বা কেন হবে! আমি তো আর আবেগে ভাসিনি। ফলে আমার শান্ত স্বভাবটা বদলে ক্রমে বেখাপ্পা রকমের মারকুটে, খ্যাপাটে হয়ে উঠল। কয়েক মাসের মধ্যে পাকা চোর হয়ে দাঁড়ালাম।
কয়েক বছরের আইসোলেশনে কতকগুলো পরিস্থিতিতে জোর করে অভ্যস্ত করিয়ে ওই মেন্টাল হোম আমাকে কিছুটা নিঃস্পৃহ আর নিস্তেজ করেছে মাত্র। তবে অত বড় সাজানো ক্যাম্পাস, গাছ, ফুল, পরিচ্ছন্নতা এবং অপরিচিত মানুষদের সঙ্গে বছর দু’য়েকের বাধ্যত সহাবস্থান মনের ওপর একটা প্রভাব তো নিশ্চয়ই ফেলেছে। কিন্তু ওদের চিকিৎসা পদ্ধতি ঠিক কী ছিল তা জানি না। নিয়মিত এই যৌন সংসর্গের আকুতি, জানি না ওরা বুঝেছিল কিনা! আর ধরতে পারলেও সেটা কি মা-বাবাকে জানিয়েছে? কী জানি!    

আজ মা-বাবা ফিরল বিকেল পার করে। মুখে কিছু না বলে মা বুঝতে চেষ্টা করল, স্নান-খাওয়া করেছি কিনা। যদিও সাবধানে, তবু আমার চোখ এড়াল না, সন্তর্পণে আমার মোবাইলটা নেড়ে চেড়ে বাবার চেক করা। মাঝারি দামের একটা স্মার্টফোনও আমার ঘরে ওরা রেখে গেছিল। একেবারে ফাঁকা। না কারও নম্বর, না কোনও আপসস্ট্রে মেসেজ কিছু ঢুকছে।
আসলে মোবাইল ব্যবহার না করাটাও অভ্যেস করিয়ে দিয়েছে ওই মেন্টাল হোম
বাবাকে দেখে কিছু বোঝার উপায় নেই। চা করছে, নিউজ চ্যানেল অন করে। মা এসময় একটু সেলাই নিয়ে বসবে। বিমলা মাসিকে রান্না বলা আছে। তবু একটু স্যুপ খেতে চাইলাম। কতদিন পর নিজের পছন্দ মতো, চিকেন, কর্ন আর চিজ দিয়ে। ভাবছিলাম, আমাকে ছাড়া জীবন কাটানোই কি অভ্যেস হয়ে গেছে ওদের! দারুণ সঙ্কটের পর নিশ্চিন্ততার আরাম আর নিরাপদ দূরত্ব! এই প্রথম একটা চিনচিনে কষ্ট হচ্ছে। একেই কি শূন্যতা বলে!   

মনে পড়ল, মেন্টাল হোমে সপ্তাহে একদিন নাচগানের ক্লাস, নাচের দিদি আর তাঁর সহযোগী ছাত্রী সুহাসিনীর কথা। আর মনে পড়ল, ওই ক্লাসেই আছে শোভাঞ্জন সে ওখানকার স্থায়ী আবাসিক, অপূর্ব তার গান। একটা দল আসে সপ্তাহে একদিন, নাচগান দিয়ে আমাদের নিষ্ক্রিয় মনগুলিকে জাগিয়ে তুলতে। রবীন্দ্রনাথের গানে, প্রথমে পাঠ, তারপর সুর তোলা এবং সব শেষে নাচ। গানের দলটা ছেলে মেয়ে মিশিয়ে, তবে নাচের দলে শুধু মেয়েরাই।
“এ তার বাঁধা কাছের সুরে
ওই বাঁশি যে বাজে দূরে” –
গানের সঙ্গে নাচের ভঙ্গিতে শরীর সাড়া দিতেই বুকের মধ্যে সামান্য কাঁপন জেগে, চোখ দু’টো ভিজে এল

নাচের দিদির চোখে চোখ পড়তে বুঝলাম, তাঁর নজর এড়ায়নিদিদি শান্ত ভাবে হাসলেন। আঙুল চালিয়ে চুলের লকস বারবার নাড়াচাড়া করা, চঞ্চল চোখ, নিরূৎসাহ ভাব, কোথায় যেন মিলিয়ে যেতে লাগল। এক সপ্তাহ পর আবার ক্লাসে গিয়ে বুঝলাম, আগের দিনের শেখা সবটাই মনে আছে। নিয়মিত ক্লাসে যেতে লাগলাম।
দেখতে দেখতে ডেমো দেবার দিন এসে গেল। ট্রেনার সুহাসিনীর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নাচলাম সামনের সারিতে। দিদির মুগ্ধ দৃষ্টি সর্বাঙ্গে জড়িয়ে। শেষে সবাই যখন কফি খাচ্ছে, দিদিকে একা পেয়ে জানতে চাইলাম, ‘বাড়ি ফিরে কী করব?’
চুপ করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন, ‘যা যা ভাল লাগে। আর আবার যদি সবসময় ঘুম পায়, এখানে চলে আসবে, নাচবে
।’
ঠিক হল যে, মাস দুই বাদেই বার্ষিক অনুষ্ঠানে, শোভাঞ্জন গাইবে,
“হৃদয়ে ছিলে জেগে
দেখি আজ শরত মেঘে”
ওই গানের সঙ্গে দিদি আমাকে বললেন একা নাচতে
সময় দিয়ে নাচটা তুলিয়েও দিলেন। এম.এ পরীক্ষা এসে যাওয়ায় সুহাসিনী এখন ছুটিতে। ফলে আমিই মূল নাচিয়ে। কত বছর বাদে! উৎরে গেলাম হাততালি দিয়ে উচ্ছ্বাস জানাল গোটা অডিটোরিয়াম 

আজ রাতে ডাইনিং টেবিলে বাবা, আমি এবং মা। থালা হাতে লাইন নেই। আমার পছন্দের রুটি, শাহী পনির আর পুডিংমা-বাবাকে গুড নাইট করে নিজের ঘরে চলে এলামএকা এই ঘরে, আলো নিভিয়ে জামাকাপড় খুলে নগ্ন। চোখ সওয়া অন্ধকার। নাইটিটা হাতে নিয়েও পরলাম না। আয়নায় আমার ছায়া – ধূসর উলঙ্গ। এ আমার নিজের ঘর, নিজের আয়না, নিজের শরীর– নাচ-মাখাসারা শরীরে হাত বুলিয়ে উদ্দাম আদর করলাম নিজেকে। হস্ত মৈথুন- স্বাধীন অন্ধকারে, অপরাধ বিহীন।
আবার মনে পড়ল, অডিটোরিয়াম সংলগ্ন সেই সাজঘর। চারটে দেওয়ালেই মানুষ-সমান আয়না। সাদা আর আকাশির ম্যাচিং পোশাক আর গয়না পরিয়ে চোখ এঁকে দিচ্ছে মেকআপ ম্যান। চোখ খুলতেই দেখি, ঠিক পিছনেই দাঁড়িয়ে আয়নার মধ্যে দিয়ে শোভাঞ্জন বলছে, ‘মন দিয়ে নেচো কিন্তু, গানটা বড় সুন্দর।’
আমাদের এই বিনিময় কারও চোখে পড়েনি। কী আশ্চর্য, আমাকে ছাপিয়ে সে ছুঁতে চাইছে আমার নাচ? অথচ মহড়ায় কোনওদিন কোনও কথাই তো সে বলেনি!
এই মুহূর্তে হুহু করে কান্না এল। নাইটিটা গায়ে গলিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। বাইরে কিছু দেখার উপায় নেই। দু’চোখ জলে ঝাপসা। কাল, ডিসচার্জের দিন বলে আর ক্লাসে যাইনি। দিদিই ডেকে পাঠিয়েছিলেন। ‘আবার এসো’ তো বলা যায় না! বরং শুভেচ্ছা এই, যাতে আবার ফিরে আসতে না হয়।
দিদিকে প্রণাম করতেই, চোখ গেল শোভাঞ্জনের দিকে। কাছে গিয়ে হাত বাড়িয়ে দিতেই হাতটা ছুঁয়ে রইল এক গভীর দৃষ্টি বিনিময়ে। ওর গান আর আমার নাচ দু’টো শরীরকে যেন এভাবেই মিলিয়ে দিল। সমস্ত সক্ষমতাও নিদারুণ অক্ষমতা হয়ে দাঁড়াল, এই প্রথম। প্রেমও তো এই প্রথম!  

বারান্দার অন্ধকারে দাঁড়িয়ে এখন আর কাঁদছি না। জানি যে আর কখনও দেখা হবে না শোভাঞ্জনের সঙ্গেসুযোগও হবে না ওর গানের সঙ্গে নাচবার। শোভাঞ্জনের সেই স্থির চোখে আবেদন, ‘মন দিয়ে নেচো কিন্তু’ – জড়িয়ে ধরলাম এক গভীর আসক্তিতেনিশ্চিন্তে ঘুম আসছে, ওষুধ ছাড়াই।

Mandar Mukhopadhyay

আড্ডা আর একা থাকা,দুটোই খুব ভাল লাগে।
লিখতে লিখতে শেখা আর ভাবতে ভাবতেই খেই হারানো।ভালোবাসি পদ্য গান আর পিছুটান।
ও হ্যাঁ আর মনের মতো সাজ,অবশ্যই খোঁপায় একটা সতেজ ফুল।

2 Responses

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *