মোহনিয়া আর টেরাস কনসার্ট, এই দুই সাংস্কৃতিক সংস্হার যৌথ প্রয়াসে গত ৮’ই ফেব্রুয়ারি, কলকাতার সল্টলেকে অনুষ্ঠিত হল শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের এক অনবদ্য বৈঠকি, রাগ বৈঠকি।
বৈঠকির আমেজে আয়োজিত এই আসরের প্রথমার্ধের অতিথি শিল্পী ছিলেন সঙ্গীতাচার্য্য শ্রী অমিয় রঞ্জন বন্দোপাধ্যায়। ৯৩ বছরের মহর্ষি প্রথমে পরিবেশন করলেন রাগ ইমন, বিলম্বিত আর দ্রুত খেয়ালে। ওনার বিখ্যাত সুললিত তানকারিতে যখন বৈঠকখানায় উপস্থিত সমস্ত শ্রোতা মুগ্ধ, ঠিক তখনই সবাইকে বিস্মিত করে উনি সন্ধ্যের দ্বিতীয় রাগ, যোগ ধরলেন আর সবাইকে করলেন অভিভূত, ধন্য! ওনার সাথে তবলা সঙ্গতে ছিলেন শ্রী রূপক ভট্টাচার্য্য, হারমোনিয়ামে শ্রী শুভ্রকান্তি চট্টোপাধ্যায় ও তানপুরায় শ্রী শুভজিৎ পাত্র। গানের পর বৈঠকি আমেজে দু চার কথাও বললেন শ্রোতাদের সাথে। বিষ্ণুপুর ঘরানার সাথে নিজস্বতা মিশিয়ে যে অপরূপ যুগপোযোগী গায়কির সৃষ্টি করেছেন মহর্ষি, আর এই বয়সেও যেভাবে উনি একাধারে সঙ্গীতশিক্ষা ও রাগ পরিবেশন করে চলেছেন; তা চাক্ষুষ করা নিঃসন্দেহে এক অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতা যে কোনো সঙ্গীতপ্রেমীর কাছে।
বৈঠকির এক বিশেষ অংশে, সঙ্গীতাচার্য্যর ৪ দশকেরও পুরোনো ছাত্রী, মোহনিয়ার শ্রীমতি রিনা মুখোপাধ্যায় তাঁর স্মৃতিচারণের মধ্য দিয়ে তাঁর তখনকার দেখা গুরুকে তুলে ধরেন স্রোতাদের চোখের সামনে। উল্লেখযোগ্য, তাঁর কন্যা, সুলগ্নাও গুরুজীর শিষ্যা। গুরু শিষ্য পরম্পরার এ এক অনবদ্য নিদর্শন।
বৈঠকির পরের অংশে ছিল বিশিষ্ট সঙ্গীতশিল্পী শ্রী সৌনক চট্টপাধ্যায়ের সঙ্গীত পরিবেশোনা। গান শুরুর আগে, এই বৈঠকির পরিকল্পনা অনুযায়ী তাঁর নবীন ছাত্রীর চোখে দেখা গুরু সৌনক কেমন সেই অভিজ্ঞতার কথা সবার সাথে ভাগ করে নেন নিলোর্মি। সব ধরণের গানেই সমান সপ্রতিভ, কিরানা ঘরানার সৌনক, রাগ বৈঠকিতে প্রথমে শোনালেন রাগ বাগেশ্রী। তারপর শ্রোতার অনুরোধে গাইলেন এক অপূর্ব ভজন। ভক্তিরসে পরিপূর্ণ বৈঠকখানায় তখন এক অদ্ভুত অনুভূতি। ওনার সাথে তবলা সঙ্গতে ছিলেন শ্রী সন্দীপ ঘোষ, হারমনিয়ামে শ্রী অর্পণ ভট্টাচার্য। বৈঠকি আসর শেষ মুহূর্ত অবধিও ছিল কানায় কানায় পূর্ণ।
প্রবীনের আশীর্বাদ দিয়ে যাত্রা শুরু করে, নবীনের হাত ধরে এগিয়ে যাওয়া রাগ বৈঠকির এই আসর এক পরিপূর্ণতার মাত্রা পেয়েছিল যা স্রোতাদের অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করাবে আগামী দিনের আরো রাগ বৈঠকি এবং অন্যান্য বৈঠকির জন্যে, এমনটাই আশা রাখলেন উপস্থিত এক স্রোতা বন্ধু।
প্রসঙ্গত, মোহনিয়া গত এক বছর ধরে নানা ধরনের আলোচনা ভিত্তিক বৈঠকির আয়োজন করে চলেছে সফলতার সাথে। এই অনুষ্ঠান তাদের এক বছরের পূর্তির আনন্দবার্তাও বয়ে আনে। মোহনিয়া যাঁদের হাতে তৈরি, শ্রীমতি রিনা মুখোপাধ্যায়, শ্রী নীলাঞ্জন ভট্টাচার্য ও শ্রীমতি সুলগ্না বন্দোপাধ্যায় মনে করেন আজকাল যেভাবে সমাজে একাকীত্ব, অবসাদ আর ভাঙ্গনের রোগ ধরেছে, গুরু শিষ্য পরম্পরা উঠে যেতে বসেছে, ঘরোয়া অধিবেশনের কোনো চল নেই, সেখানে দাঁড়িয়ে নানান বিষয়ে বৈঠকির আয়োজন নিয়মিত করা উচিত। এই ঘরোয়া আসরে মানুষ একে অপরকে চিনবেন, মোবাইল ফোনের দুনিয়া থেকে বেরিয়ে সামনাসামনি যোগাযোগ স্থাপন করবেন, যা আজকের দিনে ক্রমেই বিরল ঘটনা হয়ে পড়ছে। এমন বৈঠকির আসর আয়োজন করে মোহনিয়া তার আশেপাশের মানুষদের কাছে যাতে এক গঠনমূলক সাংস্কৃতিক আদানপ্রদানের সহজ ও আনন্দময় মঞ্চ হয়ে উঠতে পারে, সেই চেষ্টাই ওনারা করতে চান। মোহনিয়ার আরো এক বিশেষ উদ্দেশ্য হল যে শিল্পীরা প্রচারের আলোর বাইরে নিরন্তর সাধনা করে চলেছেন, তাঁদের নিয়ে বিশেষ বৈঠকি আয়োজন করা।
মোহনিয়ার বন্ধু আয়োজক, টেরাস ক্ন্সার্টও গত কয়েক বছর ধরে আয়োজন করছে এমন রাগ সঙ্গীতের অনুষ্ঠান, কখনো টেরাসে, কখনো হলে। এর কর্নধার, শ্রী অনির্বান বিশ্বাস মনের করেন যে সঙ্গীত মানুষকে যা দিয়েছে তার খুব ক্ষুদ্র ভাগ হলেও এভাবেই তিনি সঙ্গীত কে ফিরিয়ে দিতে চান তার ন্যায্য পাওনা।
মোহনিয়ার শুভাকাঙ্খী, বাংলা ব্যান্ড চন্দ্রবিন্দুর শ্রী উপল সেনগুপ্ত, রাগ বৈঠকির এই প্রচেষ্টাকে সাধুবাদ জানিয়ে বলেন, “এমন অনুষ্ঠান আরো হওয়া উচিত যাতে সাধারণ স্রোতা আর সঙ্গীতপ্রেমীদের মধ্যে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের আগ্রহ আরো বাড়ে।”