গ্রীষ্মের শেষ বিকেলের আলো একটু একটু করে হেলে পড়ছে পশ্চিমে। ঘন গাছগাছালির ফাঁক দিয়ে ক্ষীণ আলোর রেখা এসে পড়ছে এদিক ওদিক। আলোআঁধারি রহস্যময় পরিবেশ গোটা জঙ্গল জুড়ে। বিশাল একটা জারুল গাছের গায়ে মিশে দাঁড়িয়েছিল বিশ্বনাথ। পাথরের মত স্থির। হঠাৎ দেখলে মনে হবে গাছেরই অংশ যেন। হুঁড়ারের মত চোখজোড়া ধকধক করে জ্বলছে উত্তেজনায়। কান দু’টো খাড়া। নির্দিষ্ট কিছু একটা শোনার অপেক্ষায়। আধঘণ্টাটাক বাদে ক্ষীণ সুতোর মতো একটা আওয়াজ ভেসে এলো বহুদূর থেকে। “হুম হুঁ না, হুম হুঁ না…” ক্রমশ এগিয়ে আসছে শব্দটা।

— আসছে শালারা!

বিশ্বনাথের পাশ থেকে চাপা গলায় হিসহিস করে উঠলো মেঘা।

— কুলকুলি (ডাকাতদের রণহুংকার) তুলতে বলি সবাইকে?

— এখনই না। আর একটু কাছে আসতে দে শালাদের। দাঁতে দাঁত চেপে উত্তর দিল বিশ্বনাথ। তারপর ঘাড় ঘুরিয়ে চারপাশে নজর চালিয়ে নিল ভালো করে। প্রত্যেকটা গাছের ওপর শিকরে বাজের মত ওঁৎ পেতে বসে রয়েছে দলের ছেলেরা। ডালপালার আড়ালে এমন ভাবে লুকিয়ে রেখেছে নিজেদের, খুঁটিয়ে চোখ চালিয়েও ঠাহর করা অসম্ভব কারও পক্ষে। ভালো করে সবকিছু দেখে নিয়ে ফের মেঘার দিকে ঘুরে তাকাল বিশ্বনাথ।

— জমিদারবাবুর ফৌজে দু’টো বন্দুকওলা সেপাই রয়েছে। ও দু’টোকে আগে মাটি ধরাতে হবে। একটাকে বল্লম ফুঁড়বে কেষ্ট। অন্যটার পায়ের গাঁটে পাবড়া চালাবি তুই। যাতে একদানে ভুঁয়ে লটকে পড়ে। তারপর আমি নিজে কুলকুলি তুলব। বাকিরা সঙ্গে সঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়বে। ঠিক আছে?

— ঠিক আছে। ফিশফিশ করে উত্তর দিলো মেঘা।

“হুম হুঁ না হুম হুঁ না…” বেহারাদের বোলের তালে পালকির গায়ে গায়ে দৌড়চ্ছিল সেপাই ছেদিলাল। হঠাৎই শোঁ শব্দে একটা কী উড়ে এসে বিদ্যুৎগতিতে আঘাত হানল হাঁটুতে। “মর গিয়া রে বাপ!” কাটা কলাগাছের মত মাটিতে পড়ে গেল ছেদি। পালকির অন্য দিকে ছুটতে থাকা রামখেলাওন কী ঘটছে ঠিকঠাক বুঝে ওঠার আগেই ঘন গাছের আড়াল থেকে একটা বর্শা এসে বিঁধে গেল কাঁধে। তীব্র আর্তনাদে কাঁধ চেপে ধরে বসে পড়ল রামখেলাওন। হাতের বন্দুক খসে পড়ে গেল মাটিতে। পরমুহূর্তেই “হা রে রে রে রে” ভয়ঙ্কর বজ্রহুঙ্কারে কেঁপে উঠলো নীলের জঙ্গল। পালকির ভিতরে ভূপতি রায়ের মনে হল গোটা জঙ্গলটাই যেন ভেঙে পড়ছে মাথার ওপর। কুলকুলি শোনামাত্র গাছ থেকে লাফিয়ে মাটিতে নেমে পড়েছে দলের ছেলেরা। ভোজপুরি সেপাইরা তো আগেই ফৌত হয়ে গেছিল। বাকি চল্লিশজনের লেঠেল ফৌজ খড়কুটোর মত উড়ে গেল বিশ্বনাথের দলবলের সামনে। লড়াই শেষ মিনিট দশেকের মধ্যে। আহত হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো দশ-বারোজন। বাকিরা প্রাণভয়ে ছুটে পালাল যে যেদিকে পারে। পালকির মধ্যে ভয়ে ঠকঠক করে করে কাঁপছিলেন ভূপতি রায়। ঠিক তখনই পালকির দরজায় ঠুকঠুক আওয়াজ একটা। পরমুহূর্তেই কেউ হাট করে টেনে খুলে দিলো দরজাটাকে। দরজার সামনে ঝুঁকে পড়া একটা মুখ — “নেমে আসুন জমিদারবাবু।” আদেশ উচ্চারিত হল গম্ভীর গলায়।

কাঁপতে কাঁপতে পালকি থেকে নেমে এলেন ভূপতি। সামনে লাঠি, সড়কি আর বল্লমের ঘায়ে সাঙ্ঘাতিক রকম জখম হয়ে মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে দুই ভোজপুরি সেপাই আর কাছারির লেঠেলরা। আর্তনাদ করছে করুণ গলায়। রক্তে ভেসে যাচ্ছে ঘাসজমি। চারপাশ ঘিরে রেখেছে বিশাল ডাকাতদল। সংখ্যায় কম করে একশো জন তো হবেই। দরজার সামনে দাঁড়ানো একজন। মাঝারি উচ্চতা। ছিপছিপে বেতপেটা শরীরের গড়ন। ঝাঁকড়া বাবরি চুল লাল ফেট্টিতে বাঁধা। হাতে তেল খাওয়ানো পাকা গেঁটে বাঁশের লাঠি। ভূপতির চোখে চোখ রেখে হাড়হিম করা একটা হাসি হাসল লোকটা।

— নমস্কার জমিদারবাবু। আপনি আমাকে চেনেন না। তবে নামটা শুনেছেন বোধ করি। অধমের নাম বিশ্বনাথ বাগদি।

শোনামাত্র হাঁটুর কাঁপুনি কয়েকগুণ বেড়ে গেল ভূপতি রায়ের। সামনে দাঁড়ানো বিশে ডাকাত। নাম শুনেছেন বহুবার। সামনাসামনি সশরীরে মোলাকাত হয়নি কোনও দিন। গলা শুকিয়ে খটখটে কাঠ।

— খাজনার টাকাটা কোথায়?” একটুও সময় নষ্ট না করে প্রশ্ন করল বিশ্বনাথ।

— ক-কোনও টাকা তো নেই…! কাঁপা কাঁপা গলায় উত্তর দিলেন ভূপতি। নায়েব কেদার চক্কোত্তি পিছনের পালকি থেকে এগিয়ে এলেন শশব্যস্তে।

— বিশ্বাস করুণ বিশ্বনাথবাবু, টাকাপয়সা কিছুই নেই আমাদের কাছে। সামান্য চাল ডাল আর ফলফলারি সিধে দিতে নিয়ে যাচ্ছি ম্যাজিস্ট্রেট সায়েবের কাছে। বিশ্বাস করুন হুজুর।

তীব্র ব্যঙ্গের একটা হাসি চোখে নিয়ে নায়েবমশাইয়ের দিকে তাকাল বিশ্বনাথ।

— আড়ালে যাকে ছোটলোক, বাগদি বলে গাল পাড়েন, সামনে তাকে আজ্ঞে হুজুর না-ই বা করলেন নায়েবমশাই। বলেই ঘুরে তাকাল দলের লোকেদের দিকে। “প্রত্যেকটা পালকি তল্লাশি কর।”

আদেশ পাওয়ামাত্র ছুটে গিয়ে তল্লাশি শুরু করে দিল দলের লোকেরা। ভিতরে সার দিয়ে সাজানো তোরঙ্গ, পিতলের ঘড়া আর বাক্সপ্যাঁটরা একে একে বের করে এনে নামিয়ে রাখল মাটিতে। “উপুড় কর।” চাল ভর্তি একটা পেতলের ঘড়ার দিকে আঙুল দেখাল বিশ্বনাথ। চালের নিচে রাশি রাশি চাঁদির টাকা। উপুড় করতেই ঝনঝন শব্দে ঝরে পড়ল মাটিতে।

— ব্যবস্থাপত্তর তো বেশ ভালোই সাজিয়েছিলেন নায়েবমশাই। অনেক ঘোড়েল খালিফাও ঘোল খেয়ে যাবে ব্যাপারটা বুঝতে। এগিয়ে এসে কেদার চক্কোত্তির কাঁধে হাত রাখল বিশ্বনাথ। “কিন্তু মিথ্যে কথা বলার শাস্তি তো পেতেই হবে আপনাদের। ছোটবেলায় পাঠশালায় দেখেছি মিছে কথা কইলে কান ধরে ওঠবোস করাতেন পণ্ডিতমশাই। জমিদারবাবু আর আপনাকে যে সেটাই করতে হবে এখন। তবে বেশি নয়, গুনে গুনে মাত্র পঞ্চাশবার। আপনারা মানী মানুষ। তাই বেতপেটাটা নয় বাদই রাখলাম আপনাদের সম্মানের কথা ভেবে। নিন নিন শুরু করুন। দেরি করবেন না মোটে।”

আহত হয়ে মাটিতে পড়ে থাকা কাছারির লেঠেলদের বিস্ফারিত চোখ, ঝুলে পড়া চোয়াল। প্রবল বিস্ময়ে তাদের প্রবল প্রতাপান্বিত মনিব আর নায়েবমশাইকে কান ধরে ওঠবোস করতে দেখল চোখের সামনে। কাঁধে লাঠির ঘা খেয়ে পড়ে থাকা হারু তীব্র যন্ত্রণার মধ্যেও ভারী খুশি হল মনে মনে। বিশেষত নায়েবমশাইয়ের দুরবস্থা দেখে। শালা কেদার! বেদোর ব্যাটা। কথায় কথায় মা বাপ তুলে গাল আর জুতোপেটা? এবার দ্যাখ কেমন লাগে।

পঞ্চাশবার কান ধরে ওঠবোস করে টলতে টলতে উঠে দাঁড়ালেন ভূপতি রায় আর কেদার চক্কোত্তি। দমফাটা পরিশ্রমে হাপরের মত ওঠানামা করছে বুকের খাঁচাজোড়া। একটা টোকা দিলেই নির্ঘাত পড়ে যাবেন মাটিতে। “রাম দুই তিন।” সামনে দাঁড়িয়ে গুনছিল নলেডোবা। গোনা শেষ হতেই খ্যাঁকখ্যাঁক করে হেসে উঠল শেয়ালের মত।

— আহারে, বড় কষ্ট হচ্ছে বাবুদের। আসলে দুধ ঘিয়ে সাঁতার কাটা শরীর তো। ঘেমেনেয়ে একশা একেবারে। জিভের ডগায় চুকচুক একটা শব্দ করলো নলে।

— কিন্তু ঘেমো গায়ে জামাকাপড় পড়ে থাকলে সর্দি বসে যাবে যে। তখন আবার জ্বর-সান্নিপাতিক হয়ে সে এক চিত্তির…কোবরেজ, বদ্যি..হ্যাপার একশেষ। আমি বলি কি জামাকাপড়গুলো না হয় থাক একেনে। ভেতরে ন্যাঙোট আছে তো? ওতেই কাজ চলে যাবে। আর তো আধক্রোশ মাত্র পথ। নিন আর দেরি না করে শুরু করে দিন এবারে। বলতে বলতে হুমকে উঠলো নলে। ঠোঁটের কোণে ফিচেল হাসিটা মিলিয়ে গেছে একমুহূর্তে। তার বদলে ক্রূর একটা দৃষ্টি চোখে। হুকুম না শুনলে মরতে হবে এটা বুঝে ফেলতে একমুহূর্ত সময় লাগল না ভুপতি রায় আর কেদার চকোত্তি, দু’জনের মধ্যে কারওরই। কাজটা শেষ হওয়ামাত্র জঙ্গল কাঁপিয়ে হো হো শব্দে হেসে উঠল পুরো ডাকাতদল। বেশ কিছুক্ষন বাদে হাসি থামলে সামনে এগিয়ে এল বিশ্বনাথ।

— পালকি তিনটে আমরা নিয়ে গেলাম জমিদারবাবু। এটুকু পথ হেঁটেই গেলেন না হয়। এদিকে বন্দুক আর টোটাগুলোও নিচ্ছি নজরানা মনে করে। রাজা বিশ্বনাথের পায়ে প্রণামী দিলেন ধরে নেবেন। আর এই যাত্রাদলের সখিগুলো… মাটিতে পড়ে থাকা দুই ভোজপুরি সেপাই আর লেঠেলদের দিকে আঙুল দেখাল বিশ্বনাথ। “এক আধটা লাঠির ঘা পড়তে না পড়তেই কেঁদেককিয়ে একশা একেবারে। এদের দিয়ে ফৌজ বানিয়েছেন আপনি? দ্দুদ্দুর, কিস্যু হবে না এগুলোকে দিয়ে। বিশের সঙ্গে টক্কর দেবার জন্য বরং হারমাদ-দিনেমার ফিরিঙ্গিদের ফৌজ বানান একটা। নমস্কার। এবার আসি তাহলে? জয় মা কালী!” হুঙ্কার তুলে মুহূর্তের মধ্যে দলবল নিয়ে ভোজবাজির মত জঙ্গলে মিলিয়ে গেল বিশ্বনাথ।

পরের পর্ব – শোণিতমন্ত্র (পর্ব ৬)

আগের পর্ব – শোণিতমন্ত্র (পর্ব ৪)

জন্ম ও বেড়ে ওঠা উত্তর কলকাতার পুরোনো পাড়ায়। বহু অকাজের কাজী কিন্তু কলম ধরতে পারেন এটা নিজেরই জানা ছিল না বহুদিন। ফলে লেখালেখি শুরু করার আগেই ছাপ্পান্নটি বসন্ত পেরিয়ে গেছে। ১৪২১ সালে জীবনে প্রথম লেখা উপন্যাস 'দ্রোহজ' প্রকাশিত হয় শারদীয় 'দেশ' পত্রিকায় এবং পাঠকমহলে বিপুল সাড়া ফেলে। পরবর্তীতে আরও দুটি উপন্যাস 'জলভৈরব' (১৪২২) এবং 'বৃশ্চিককাল' (১৪২৩) প্রকাশিত হয়েছে যথাক্রমে পুজোসংখ্যা আনন্দবাজার এবং পত্রিকায়। এছাড়া বেশ কিছু প্রবন্ধ এবং দু চারটি ছোটগল্প লিখেছেন বিভিন্ন পত্রপত্রিকা আর লিটিল ম্যাগাজিনে। তার আংশিক একটি সংকলন বই আকারে প্রকাশিত হয়েছে 'ব্যবসা যখন নারীপাচার' শিরোনামে। ২০১৭ সালে পেয়েছেন পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি পুরস্কার।

One Response

  1. কি বিবরণ একেবারে পুরোনো দিনের বর্ণনা , ডিটেইলিং দুর্দান্ত , জমছে খেল , এর জন্যেই না সাত দিন অপেক্ষা ?????

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *